ইসলাম

আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার ফযীলতঃ

আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার ফযিলত সত্যিই অনেক, যা দুনিয়া ও আখিরাত তথা উভয় জাহানের কল্যাণকেই শামিল করে এবং যা কুরআন-হাদীস: ও বিজ্ঞজনদের কথায় পরিব্যাপ্ত। নিম্নে এ সংক্রান্ত কিছু ফযীলত উল্লেখ করা হল:

আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষা করার ফযীলত

১. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা একজন একান্ত আল্লাহ তা’আলার অনুগত বুদ্ধিমানের পরিচায়ক :

আল্লাহ তা’আলা সত্যিকার বুদ্ধিমানদের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন : وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَن يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ “আর যারা আল্লাহ তা’আলা যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আদেশ করেছেন তা অক্ষুণ্ণ রাখে, ভয় করে তাদের প্রভুকে এবং ভয় করে কঠোর হিসাবকে। সূরা রাআদ, আয়াত : ২১

২. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা ঈমানের একটি বাহ্যিক পরিচয় বহন করে:

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ “যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলা ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে সে যেন নিজ আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে”।

৩. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে রিযিক ও বয়সে বরকত আসে।

উপরন্তু তাদের ভালোবাসাও পাওয়া যায় : আনাস ও আবু হুরাইরা [রাদিয়াল্লাহু আন্হুমা] থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: (مَنْ أَحَبَّ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ وَيُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ» “যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, তার রিযিক বেড়ে যাক, তার স্মৃতি বাকী থাকুক সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে”।

এখানে রিযিক বাড়া ও স্মৃতি বাকী থাকা বলতে তা সরাসরি বেড়ে যাওয়া অথবা তাতে বরকত হওয়াকে বুঝানো হয়৷ রিযিক ও বয়সে বরকত হওয়া মানে আল্লাহ তা’আলা আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারীকে এমন শারীরিক শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, কর্ম ক্ষমতা ও কর্ম দক্ষতা দান করবেন যাতে করে সে তার সীমিত বয়স এবং রিযিক নিয়ে এমন সকল মহান কর্মকাণ্ড তার জীবনে বাস্তবায়ন করবে যা সাধারণত অন্য কারোর পক্ষে দীর্ঘ বয়স এবং বেশি রিযিক নিয়েও বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হবে না।

বয়স ও রিযিক মুক্বাদ্দার তথা চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত। এরপরও তা সরাসরি বেড়ে যাওয়া মানে বরাদ্দ মূলত দু’ ধরনের। প্রথম বরাদ্দ চিরস্থায়ী তথা সর্ব চূড়ান্ত যা একমাত্র লাওহে মাহফুজেই লিপিবদ্ধ থাকে। যা কখনো পরিবর্তন করা হয় না। আর দ্বিতীয় বরাদ্দ হচ্ছে অস্থায়ী যা একমাত্র ফেরেশতাদের বালামেই লিপিবদ্ধ থাকে। যাতে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটতে পারে, আল্লাহ এর মধ্য থেকে যা ইচ্ছে মুছে ফেলতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তা মূল লেখা লাওহে মাহফূজে যা আছে তার বাইরে কিছু ঘটায় না।

সুতরাং কখনো কখনো কোনও কোনো কারণে কারোর রিযিক ও বয়সে পরিবর্তন আসতে পারে যা আল্লাহ তা’আলা পূর্ব থেকেই জানেন এবং তা লাওহে মাহফুজে চূড়ান্তভাবে লিপিবদ্ধও করে রেখেছেন। যদিও তা দায়িত্বশীল ফেরেশতা জানেন না। যদি আল্লাহ তা’আলা কারোর জন্য তার কামাইয়ের মাধ্যমে তার জন্য কোনও রিযিক বরাদ্দ করে থাকেন তা হলে তিনি তাকে কামাইয়ের উৎসাহ ও সুযোগ দিবেন। আর যদি আল্লাহ তা’আলা কারোর জন্য তার আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার মাধ্যমে তার জন্য কোনও রিযিক বরাদ্দ করে থাকেন তা হলে তিনি তাকে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার উৎসাহ ও সুযোগ দিবেন। তেমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা যদি কারোর জন্য তার কোনও পরিশ্রম ছাড়াই তথা ওয়ারিশি সূত্রে

কোনও রিযিক বরাদ্দ করে থাকেন তা হলে তিনি তার কোনও নিকট আত্মীয়কে যার থেকে সে মিরাস পাবে তাকে যথা সময়ে মৃত্যু দিয়ে তার উক্ত রিযিকের ব্যবস্থা করবেন। এগুলো কখনো চূড়ান্ত লেখা (লাওহে মাহফূযের লেখার) বিরোধী কিছু নয়। বরং কোনও বরাদ্দকে শুধুমাত্র কোনও কারণ সংশ্লিষ্ট করা যা চূড়ান্তভাবে লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ রয়েছে। যদিও তা দায়িত্বশীল ফেরেশতাকে পূর্ব থেকে না জানানোর দরুন তিনি তা চূড়ান্তভাবে তাঁর বালামে লিখে রাখতে পারেননি। বরং তাঁকে ব্যাপারটি চূড়ান্তভাবে লেখার জন্য উক্ত কারণটি বাস্তবে সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। যেমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা পরিতৃপ্তি ও তৃষ্ণা নিবারণকে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ, সন্তানকে স্ত্রী সহবাস এবং ফসলকে বীজের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।

৪. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে আল্লাহ তা’আলার সাথে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়:

আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক ভালো করা দ্বারা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো হয়। কারণ, আল্লাহ তা’আলা যারা তার স্বীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্কে ভালো রাখে তাদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখেন। পক্ষান্তরে যারা তাদের নিজেদের আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক খারাপ রাখে আল্লাহ তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ রাখেন। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إِنَّ اللهَ تَعَالَى خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَالَتِ الرَّحِمُ: هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيْعَةِ ، قَالَ: نَعَمْ ، أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ ، وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ؟ قَالَتْ: بَلَى يَا رَبِّ قَالَ: فَهُوَ لَكِ»

“আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিকুল সৃজন শেষে আত্মীয়তার বন্ধন [দাঁড়িয়ে] বলল: এটিই হচ্ছে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনাকারীর স্থান। আল্লাহ তা’আলা বললেন: হ্যাঁ, ঠিকই। তুমি কি এ কথায় সন্তুষ্ট নও যে, আমি ওর সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করি, যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে এবং আমি ওর সাথেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করি যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে। তখন সে বলল: আমি এ কথায় অবশ্যই রাজি আছি- হে আমার প্রভু! তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন: তা হলে তোমার জন্য তাই হোক”।

৫. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে জান্নাত অতি নিকটবর্তী এবং জাহান্নাম অতি দূরবর্তী হয়ে যায়:

আবু আইয়ূব আনছারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: جَاءَ رَجُلٌ إلى النبي صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: دُلَّنِي عَلَى عَمَلٍ أَعْمَلُهُ يُدْنِيْنِي مِنَ الْجَنَّةِ وَيُبَاعِدُنِي مِنَ النَّارِ، قَالَ: تَعْبُدُ اللهَ، لَا تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، وَتُقِيمُ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِي الزَّكَاةَ، وَتَصِلُ ذَا رَحِمِكَ، فَلَمَّا أَدْبَرَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: إِنْ تَمَسَّكَ بِمَا أُمِرَ بِهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ»

“জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেন: [হে নবী!] আপনি আমাকে এমন একটি আমল বাতলে দিন, যা আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: একমাত্র আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করবে; তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে ও নিজ আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে। লোকটি রওয়ানা করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন: সে যদি আদিষ্ট বিষয়গুলো আঁকড়ে ধরে রাখে তা হলে সে জান্নাতে যাবে”।

৬. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলে গুনাহ মাফ হয়। যদিও তা বড়ই হোক না কেন:

‘আব্দুল্লাহ ইবন উমর [রাদিয়াল্লাহু আন্হুমা] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: أَتَى رَجُلُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! إِنِّي أَصَبْتُ ذَنْبًا عَظِيمًا ، فَهَلْ لِي مِنْ تَوْبَةٍ؟ قَالَ: هَلْ لَكَ مِنْ أُمَ؟ قَالَ: لَا ، قَالَ: هَلْ لَكَ مِنْ خَالَةٍ؟ قَالَ: نَعَمْ ، قَالَ: فَبِرَّهَا

“এক ব্যক্তি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল: হে আল্লাহ’র রাসূল! আমি একটি বড় গুনাহ করে ফেলেছি। সুতরাং আমার জন্য কি তাওবা আছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করেন: তোমার কি মা আছে? সে বলল: নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আবারো জিজ্ঞাসা করলেন: তোমার কি খালা আছে? সে বলল: জি হ্যাঁ ৷ তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: সুতরাং তার সাথেই ভালো ব্যবহার কর।

৭. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা ইসলামের একটি বাহ্যিক সৌন্দর্য ধারণ করে:

ইসলাম মানুষের পারস্পরিক সুসম্পর্ক রক্ষা করে। ইসলাম অন্য মানুষের প্রতি দয়া ও কল্যাণ শিখায়। তাই ইসলাম মানুষের পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে আদেশ করে এবং তা যে কোনও কারণে ছিন্ন করতে নিষেধ করে। আর এভাবেই একদা একটি মুসলিম সমাজ পারস্পরিক সুসম্পর্কের ভিত্তিতে দৃঢ়, দয়াশীল ও পর কল্যাণকামী হয়। যা অন্য কোনও আধুনিক সমাজে দেখা যায় না।

৮. বিশ্বের প্রতিটি ধর্মই আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করতে আদেশ করে এবং তা ছিন্ন করতে নিষেধ করে।

এ থেকেই বুঝা যায় আল্লাহ তা’আলার নিকট আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করার ব্যাপারটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ।

৯. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা দুনিয়ার সুনাম ও জনমানুষের প্রশংসা পাওয়ার একটি বিশেষ মাধ্যম।

তা শুধু মুসলিম সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তা যে কোনও কাফির সমাজেও বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার।

১০. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিশেষ গুণাবলীর পরিচায়ক।

কারণ, তা বদান্যতা, উদারতা, কৃতজ্ঞতা, বংশীয় মর্যাদা, মানসিক স্বচ্ছতা, নিষ্ঠা ও মানুষের প্রতি সদ্ব্যবহারের পরিচয় বহন করে।

১১. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা আত্মীয়দের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভালোবাসা আরও বাড়িয়ে দেয়।

মনে হবে তারা একই সূত্রে গাঁথা। এতে করে তাদের পারস্পরিক জীবন আরও অত্যধিক সুখী ও আনন্দময় হবে।

১২. আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মান আরও বাড়িয়ে দেয়।

কারণ, কেউ নিজ আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে এবং তাদেরকে যথাযোগ্য সম্মান করলে তারাও তাকে সম্মান করবে, যে কোনও কাজে তারা তার একান্ত সহযোগী হবে এবং তারা তাকে তাদের নেতৃত্বের আসনে বসাবে।

১৩. আত্মীয়দের মধ্যকার পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন সুন্দরভাবে রক্ষা করা হলে জনসমাজে তাদের মর্যাদা বাড়ে।

অন্যদেরকে তখন তাদের সাথে বহু হিসাব করে চলতে হয়। কেউ কখনো তাদের উপর সামান্যটুকুও যুলুম করতে সাহস পায় না।

সংকলক:

মুফতি রাশেদুল ইসলাম

ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স

মুহাদ্দিস: মিরপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও জামিয়া মুহাম্মাদীয়া আরাবিয়া মাদরাসা কমপ্লেক্স

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *