ইসলাম

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার পরিণতি

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা শুধু একটি মারাত্মক অপরাধই নয়, বরং এটি একটি সামাজিক, মানবিক ও আত্মিক ব্যাধি, যা একটি সুস্থ সমাজ, সুন্দর পরিবেশ, ও মানবতা-বোধকে হত্যা করে এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব-বোধকে ব্যাহত করে। যার ফলে ইসলাম আত্মীয়তার বন্ধনকে অটুট রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে এবং যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করে, তাদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারি এবং কঠিন আযাব ও শাস্তির কথা ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তা’আলা কোরআন মাজীদে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের নিন্দা করেন এবং তাদেরকে লা’নত ও অভিসম্পাত দেন।

আল্লাহ তা’আলা বলেন: فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِن تَوَلَّيْتُمْ أَن تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِعُوا أَرْحَامَكُمْ أَوْلَتَبِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَرَهُمْ ﴾ [محمد : ٢٢، ٢٣]

“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকেই করেন অভিশপ্ত, বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন”। (সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ২২-২৩)

আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন:وَالَّذِينَ يَنقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَقِهِ، وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَن يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُوْلَتِّيكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ ﴾ [الرعد: 05]

“যারা আল্লাহকে দেওয়া দৃঢ় অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের জন্য রয়েছে লা’নত ও অভিসম্পাত এবং তাদের জন্যই রয়েছে মন্দ আবাস”। (সূরা রাদ, আয়াত: ২৫)

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না:

হাদিসেও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীদের কঠিন শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়। তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না- আল্লাহর দরবারে তাদের আমল কবুল হবে না। যুবায়ের ইবন মুত’ইম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِع»

“আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না”।(বুখারী, হাদীস: ৫৯৮৪ মুসলিম, হাদীস: ২৫৫৬; তিরমিযী, হাদীস: ১৯০৯; আবু দাউদ, হাদীস: ১৬৯৬; আবদুর রায্যাক, হাদীস: ২০২৩৮; বায়হাক্বী, হাদীস: ১২৯৯৭)

আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ثَلَاثَةٌ لَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ الْخَمْرِ وَقَاطِعُ الرَّحِمِ وَمُصَدِّقُ بِالسِّحْرِ»

“তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না: অভ্যস্ত মদ্যপায়ী, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ও জাদুতে বিশ্বাসী”। (আহমদ, হাদীস: ১৯৫৮৭; হাকিম, হাদীস: ৭২৩৪; ইবনু হিব্বান, হাদীস : ৫৩৪৬।)

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর নেক আমল আল্লাহ তা’আলা গ্রহণ করেন না:

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর আমল আল্লাহ তা’আলা কবুল করেন না। সপ্তাহে একদিন আল্লাহর নিকট আদম সন্তানের আমল পেশ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর আমল প্রত্যাখ্যান করেন।

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

إِنَّ أَعْمَالَ بَنِي آدَمَ تُعْرَضُ كُلَّ خَمِيْسٍ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ ، فَلَا يُقْبَلُ عَمَلُ قَاطِع رَحِمٍ

“আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত জুম’আর রাত্রিতে [আল্লাহ তা’আলার নিকট] উপস্থাপন করা হয়। তখন আত্মীয়তার বন্ধন বিচ্ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না”। আহমদ: হাদীস: ১০২৭৭

আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর শাস্তি দুনিয়াতেই হবে:

আত্মীয়তা বন্ধন ছিন্নকারীর শাস্তি শুধু আখিরাতেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের শাস্তি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই দেওয়া হবে। আল্লাহ তা’আলা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর শাস্তি দুনিয়াতেই দিয়ে থাকেন। উপরন্তু আখিরাতের শাস্তি-তো তার জন্য প্রস্তুত আছেই।

আবু বাকরাহ্ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: «مَا مِنْ ذَنْبٍ أَجْدَرُ أَنْ يُعَجَلَ اللهُ لِصَاحِبِهِ الْعُقُوْبَةَ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ

“দু’টি গুনাহ ছাড়া এমন কোনও গুনাহ নেই যে গুনাহগারের শাস্তি আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াতেই দিবেন এবং তা দেয়াই উচিৎ; উপরন্তু তার জন্য আখিরাতের শাস্তি তো আছেই। গুনাহ দু’টি হচ্ছে, অত্যাচার বা সীমালঙ্ঘন ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী”।(আবু দাউদ, হাদীস: ৪৯০২; তিরমিযী, হাদীস: ২৫১১; ইবনু মাজাহ্, হাদীস : ৪২৮৬; ইবনু হিব্বান, হাদীস: ৪৫৫, ৪৫৬; বায্যার, হাদীস: ৩৬৯৩; আহমদ, হাদীস: ২০৩৯০, ২০৩৯৬, ২০৪১৪।)

আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা আল্লাহ তাআলার সাথে

সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা:

কেউ আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলে আল্লাহ তা’আলাও তার সাথে নিজ সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَامَتِ الرَّحِمُ فَقَالَتْ: يَا رَبِّ، هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيعَةِ. قَالَ: أَلَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ وَأَصِلُ مَنْ وَصَلَكِ؟ قَالَتْ: بَلَى يَا رَبِّ. قَالَ: فَهُوَ لَكِ “. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” اقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ: فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تُولَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتَقْطَعُوا أَرْحَامَكُمْ، أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ» الآية

“আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিকুল সৃজন শেষে আত্মীয়তার বন্ধন [দাঁড়িয়ে] বলল: এটিই হচ্ছে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনাকারীর স্থান। আল্লাহ তা’আলা বললেন: হ্যাঁ, ঠিকই। তুমি কি এ কথায় সন্তুষ্ট নও যে, আমি ওর সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করবো যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং আমি ওর সাথেই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করবো যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করবে। তখন সে বলল: আমি এ কথায় অবশ্যই রাজি আছি হে আমার প্রভু! তখন আল্লাহ তা’আলা বললেন: তা হলে তোমার জন্য তাই হোক। তারপর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা চাইলে فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِن تَوَلَّيْتُمْ أَن تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِعُوا أَرْحَامَكُمْ © أُوْلَتبكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَرَهُمْ ﴾ [محمد : ٢٢، ٢٣] –

“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আল্লাহ তা’আলা এদেরকেই করেন অভিশপ্ত, বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন”।”(মুহাম্মাদ, আয়াত: ২২-২৩) এ আয়াত- তিলাওয়াত করতে পার”।(বুখারী, হাদীস: ৪৮৩০, ৫৯৮৭ মুসলিম, হাদীস: ২৫৫৪)

অন্য হাদীসে এসেছে, عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ عَوْفٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ اللهُ تَعَالَى: «أَنَا الرَّحْمَنُ خَلَقْتُ الرَّحِم وَاشْتَقَقْتُ لَهَا مِنِ اسْمِي، فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ، وَمَنْ قَطَعَهَا بَتَتُهُ

“আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন, আমি রহমান আমি রাহেম (‘আত্মীয়তার বন্ধন’)কে সৃষ্টি করেছি এবং ‘রাহেম’ (তথা আত্মীয়তা বন্ধনের) নামটিকে আমি আমার নিজের নাম থেকে নির্গত করেছি, সুতরাং যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে আমিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব”।(বুখারি, হাদিস: ৫৯৮৯; আহমদ, হাদিস: ১৬৮৬; তিরমিযি, হাদিস: ১৯০৭)

সংকলক:

মুফতি রাশেদুল ইসলাম

ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স

উস্তাদ: জামিয়াতুল মানহাল আল কওমিয়া,উত্তরা,ঢাকা

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *