চামড়া ছাড়া অন্য মোজার উপর মাসাহ করার বিধান কী?
প্রশ্নঃ
বিষয়ঃ মোজার উপর মাসেহ করা
জনাব,
আমি একজন প্রবাসী।আমি যেখানে থাকি সেখানে অনেক আরব/ আরবি ভাষাভাষী লোক থাকে। তাদেরকে প্রায়ই দেখা যায় অজুর শেষে পা না ধুয়ে মোজার উপর মাসেহ করতে। আমি খেয়াল করে দেখেছি তাদের পায়ের মোজা কাপড়ের। চামড়ার মুজা সাধারনত কেউই পরে না। আমার প্রশ্ন হল,এ অবস্থায় তাদের ইমামতিতে নামাজ আদায় কি ঠিক আছে? হানাফি মাজহাব ছাড়া অন্য মাজহাবে অজুতে মাসেহ করার জন্যে পায়ের মোজার ধরণ কি রকম হতে হবে যদি জানাতেন ভাল হত।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
মোজা তিন ধরণের হতে পারে। যথা-
১,চামড়ার মোজা। এ ধরণের মোজার উপর সর্বসম্মতভাবে মাসাহ করা জায়েজ। এতে কোন ফক্বীহ ও মাযহাব তথা মুজতাহিদগণের মাঝে মতভেদ নেই।
قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ مَا قُلْت بِالْمَسْحِ حَتَّى جَاءَنِي فِيهِ مِثْلُ ضَوْءِ النَّهَارِ وَعَنْهُ أَخَافُ الْكُفْرَ عَلَى مَنْ لَمْ يَرَ الْمَسْحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ؛ لِأَنَّ الْآثَارَ الَّتِي جَاءَتْ فِيهِ فِي حَيِّزِ التَّوَاتُرِ وَقَالَ أَبُو يُوسُفَ خَبَرُ الْمَسْحِ يَجُوزُ نَسْخُ الْكِتَابِ بِهِ لِشُهْرَتِهِ وَقَالَ أَحْمَدُ لَيْسَ فِي قَلْبِي شَيْءٌ مِنْ الْمَسْحِ فِيهِ أَرْبَعُونَ حَدِيثًا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – مَا رَفَعُوا وَمَا وَقَفُوا
ইমাম আবূ হানীফা রহঃ বলেছেন, আমি ততক্ষণ পর্যন্ত মোজার উপর মাসাহের প্রবক্তা হইনি, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিষয়টি আমার কাছে দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার হয়েছে। তার থেকে আরো বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি মোজার উপর মাসাহ করাকে অস্বিকার করে, তার ব্যাপারে কুফরীর ভয় করি। কেননা, এ বিষয়ক বর্ণনা মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
ইমাম আবূ ইউসুফ রহঃ বলেছেন, মাসাহের বর্ণনার প্রসিদ্ধতা কুরআনিক [পা ধৌত করার] বিধানকে রহিত করার সক্ষমতা রাখে। ইমাম আহমাদ রহঃ বলেছেন, মোজার উপর মাসাহ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই, কারণ এ বিষয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে চল্লিশটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।যার কিছু মারফূ ও কিছু মাওকুফ [আলবাহরুর রায়েক-১/২৮৮, জাকারিয়া বুক ডিপো]
قَالَ الْحَافِظُ فِي الْفَتْحِ: وَقَدْ صَرَّحَ جَمْعٌ مِنْ الْحُفَّاظِ بِأَنَّ الْمَسْحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ مُتَوَاتِرٌ وَجَمَعَ بَعْضُهُمْ رُوَاتَهُ فَجَاوَزُوا الثَّمَانِينَ مِنْهُمْ الْعَشَرَةُ
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ বলেছেন, হুফফাজদের এক বড় জামাত পরিস্কার বলেছেন যে, মোজার উপর মাসাহ করার বিষয়টি মুতাওয়াতির। কতিপয় হযরতগণ এ সংক্রান্ত বর্ণনাকারীর নাম একত্র করেছেন, তো দেখা গেল এর সংখ্যা আশি ছাড়িয়েছে। যার মাঝে আশারায়ে মুবাশশরাগণও রয়েছেন। [নাইলুল আওতার-১/২৫৫]
২,এমন পাতলা মোজা, যা চামড়ারও নয়, আবার চামড়ার মোজার কোন গুনাগুনও তাতে পাওয়া যায় না। যেমন আজকালকার সূতার মোজা, নাইলনের মোজা বা তোলার মোজা ইত্যাদি।
এসব মোজার ক্ষেত্রে সকল ফুক্বাহাগণের ইজমা তথা ঐক্যমত্ব হল, এসব মোজার উপর মাসাহ করা এমন কোন দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয় যে, যার উপর ভিত্তি করে পা ধোয়ার কুরআনিক বিধানকে ছেড়ে দেয়া যায়। তাই এসব মোজার উপর মাসাহ করলে তা শুদ্ধ হবে না।
فَإِنْ كَانَا رَقِيقَيْنِ يَشِفَّانِ الْمَاءَ، لَا يَجُوزُ الْمَسْحُ عَلَيْهِمَا بِالْإِجْمَاعِ،
যদি মোজা এতটা পাতলা হয় যে, তা ভেদ করে পানি প্রবেশ করে, তাহলে তার উপর সবার ঐক্যমত্বে মাসাহ করা জায়েজ নেই। [বাদায়েউস সানায়ে-১/৮৩, জাকারিয়া বুক ডিপো]
৩,এমন মোজা যা চামড়ার নয়। কিন্তু মোটা হবার দরূণ চামড়ার মোজার গুণ পাওয়া যায়। এমন মোজার উপর মাসাহ করার অনুমোদন বিষয়ে ফুক্বাহায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ আছে। কারো মতে শুদ্ধ হবে, আর কারো মতে শুদ্ধ হবে না।
لَا يَجُوزُ الْمَسْحُ عَلَى الْجَوْرَبِ الرَّقِيقِ مِنْ غَزْلٍ أَوْ شَعْرٍ بِلَا خِلَافٍ وَلَوْ كَانَ ثَخِينًا يَمْشِي مَعَهُ فَرْسَخًا فَصَاعِدًا كَجَوْرَبِ أَهْلِ مَرْوَ فَعَلَى الْخِلَافِ
সূতা বা চুলের পাতলা মোজার উপর মাসাহ করার অনুমোদন নেই সর্বসম্মত মতানুসারে। তবে যদি তা এতটা মোটা হয় যে, জুতা ছাড়া শুধু মোজা পরিধান করেই এক কোষ [আড়াই থেকে পৌনে তিন কিলোমিটার] পরিমাণ চলা যায় তবে এমন মোজার উপর মাসাহ বিষয়ে মতভেদ আছে।[আলবাহরুর রায়েক-১/৩১৮, জাকারিয়া বুক ডিপো]
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা একথা পরিস্কার হয়ে যাবার কথা যে, বর্তমানের প্রচলিত পাতলা মোজার উপর মাসাহ বিষয়ক কোন মতভেদই কোন মাযহাবে নেই।সকল মাযহাবের ইমামদের মতেই তা নাজায়েজ।
সুতরাং অন্য মাযহাবের ধোয়া তুলে এমন পাতলা মোজার উপর মাসাহ করা কোনভাবেই বৈধ হবে না। আর এমন পাতলা মোজার উপর মাসাহকারীর অজু শুদ্ধ হয় না। তাই তার পিছনে নামায পড়লে নামায আদায় হবে না। আলাদা নামায আদায় করতে হবে।
মাসআলাটির মূল হাকীকত
আসলে “পবিত্রতা অর্জন করতে হলে উভয় পা ধৌত করতে হবে” এমন নির্দেশই পবিত্র কুরআনে দেয়া হয়েছে। সূরা মায়েদার ৬ নাম্বার আয়াতে পরিস্কার নির্দেশ এসেছে যে, পবিত্রতা অর্জন করতে হলে উভয় পায়ের টাকনুসহ ধৌত করতে হবে।
কুরআনে যখন আদেশসূচক কোন বিধান আসে, তখন সেটিকে জঈফ বা খবরে ওয়াহিদ পর্যায়ের কোন হাদীস দিয়ে শর্তযুক্ত করার কোন সুযোগ নেই।
হ্যাঁ, যদি মুতাওয়াতির পর্যায়ের কোন হাদীস পাওয়া যায়, তাহলে উক্ত হাদীস দিয়ে কুরআনের বিধানকে কোন অংশের সাথে শর্তযুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। মুতাওয়াতির থেকে নিচের পর্যায়ের কোন হাদীস দিয়ে তা করার কোন সুযোগ নেই।
আলোচ্য মাসআলায় খেয়াল করুন!
কুরআনের পরিস্কার বিধান হল, পবিত্রতা অর্জিত হতে হলে পায়ের টাকনুসহ ধৌত করতে হবে। [সূরা মায়েদা, আয়াত নং-৬]।
অপরদিকে মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীস দ্বারা বর্ণিত যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চামড়ার মোজা পরিধান করা থাকলে পা না ধুয়ে তার উপর মাসাহ করতেন।তাছাড়া আশির উর্দ্ধে সাহাবাগণ থেকেও একই বিষয় বর্ণিত।
সুতরাং ফুক্বাহায়ে কেরাম উক্ত মুতাওয়াতির হাদীসের উপর নির্ভর করে বলেছেন যে, কুরআনের পা ধোয়ার বিধানটি উক্ত মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীসের উপর নির্ভর করে শর্তযুক্ত বিধান হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অন্য শব্দে বললে, কুরআনের বিধানকে শর্তযুক্ত বিধান বলা হচ্ছে। আর তাহল, পা ধৌত করতে হবে, যদি চামড়ার মোজা পরিধান করা না হয়, আর যদি চামড়ার মোজা পরিধান করা থাকে, তাহলে মাসাহ করলেই হবে, ধৌত করার প্রয়োজন নেই।
তাহলে কী বুঝা গেল? কুরআনের পা ধৌত করার বিধানকে চামড়ার মোজার পরিধানের না করে থাকার সাথে শর্তযুক্ত করা হল।
আর কুরআনের বিধানকে শর্তযুক্ত করার অধিকার কেবল মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীসের আছে। এর চেয়ে নিম্নমানের হাদীসের সে অধিকার নেই।
قَالَ أَبُو يُوسُفَ: خَبَرُ مَسْحِ الْخُفَّيْنِ يَجُوزُ نَسْخُ الْقُرْآنِ بِمِثْلِهِ.
وَرُوِيَ أَنَّهُ قَالَ: إنَّمَا يَجُوزُ نَسْخُ الْقُرْآنِ بِالسُّنَّةِ إذَا وَرَدَتْ كَوُرُودِ الْمَسْحِ عَلَى الْخُفَّيْنِ، وَكَذَا الصَّحَابَةُ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ – أَجْمَعُوا عَلَى جَوَازِ الْمَسْحِ قَوْلًا، وَفِعْلًا، حَتَّى رُوِيَ عَنْ الْحَسَنِ الْبَصْرِيِّ أَنَّهُ قَالَ: أَدْرَكْتُ سَبْعِينَ بَدْرِيًّا مِنْ الصَّحَابَةِ كُلُّهُمْ كَانُوا يَرَوْنَ الْمَسْحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ،
অনুবাদঃ হযরত আবূ ইউসুফ রহঃ বলেছেন, চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করা সংক্রান্ত হাদীস এমন পর্যায়ের যে, এমন টাইপের হাদীস দ্বারা কুরআনের বিধান রহিত করা যায়।
তার থেকে আরো বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, এমন সুন্নাহ দ্বারা কুরআনের হুকুম রহিত করা যায়, যা এমনভাবে বর্ণিত হয় যেমন চামড়ার মোজার উপর মাসাহের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
এমনিভাবে চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করার বিষয়টি সাহাবাগণের বক্তব্য ও আমলের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।
হযরত হাসান বসরী রহঃ থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেছেন, আমার সত্তরজন বদরী সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে, যাদের প্রতিজনকেই চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করতে দেখেছি। [বাদায়েউস সানায়ে-১/৭৭, জাকারিয়া বুক ডিপো, আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাসকৃত-২/৪২৫]
তাহলে আমরা পরিস্কার হলাম যে, চামড়ার মোজার উপর মাসাহের হাদীসগুলো মুতাওয়াতির পর্যায়ের।তাই এ পর্যায়ের হাদীস দিয়ে কুরআনের ধৌত করার বিধানকে শর্তযুক্ত করার সুযোগ তৈরী হয়েছে।
কিন্তু চামড়া ছাড়া অন্য মোজার উপর মাসাহের বিষয়টি মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং খুবই দুর্বল পর্যায়ের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাই এমন দুর্বল হাদীসের উপর ভিত্তি করে কুরআনের ধৌত করার বিধানকে বাদ দেয়ার কোনই সুযোগ নেই।
চামড়া ছাড়া অন্য মোজার উপর মাসাহের হাদীসের অবস্থা!
হাদীসের ভান্ডারে চামড়া ছাড়া অন্য মোজা [যাউরাব] এর উপর মাসাহ করা সম্পর্কিত হাদীস পাওয়া যায় তিনটি। যথা-
১- হযরত বেলাল রাঃ থেকে। ২- হযরত আবু মূসা আশআরী রাঃ থেকে। ৩- হযরত মুগীরা বিন শু’বা রাঃ থেকে।
হযরত বেলাল রাঃ এর হাদীস মু’জামে সগীর তাবরানীতে বর্ণিত হয়েছে। আর হযরত আবূ মুসা রাঃ এর হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ এবং ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু হাফেজ যায়লায়ী রহঃ উক্ত উভয় হাদীসের ব্যাপারে প্রমাণ করেছেন যে, উভয় হাদীসই সনদের বিচারে জঈফ। [নসবুর রায়াহ-১/১৮৩-১৮৪]
আর হযরত আবূ মুসা রাঃ এর হাদীসের ব্যাপারেতো ইমাম আবু দাউদ রহঃও লিখেছেন যে, ليس بالمتصل ولا بالقوى তথা এ হাদীসটি মুত্তাসিলও নয় আবার শক্তিশালীও নয়। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৫৯, বযলুল মাযহুদ-১/৯৬]
যেহেতু হযরত বেলাল রাঃ ও হযরত আবূ মুসা আশআরী রাঃ এর হাদীসের সনদের এই অবস্থা। সুতরাং এ দু’টি হাদীস নিয়ে আলোচনা করার কোন প্রয়োজনই নেই।
বাকি রইল হযরত মুগীরা বিন শু’বা রাঃ এর হাদীস। যদিও ইমাম তিরমিজী মুগীরা রাঃ এর বর্ণিত হাদীসটি বর্ণনা করে মন্তব্য করেছেন যে, এটি হাসান এবং সহীহ। কিন্তু অন্যান্য বড় বড় মুহাদ্দিসগণ উক্ত হাদীসের উপর কঠোর সমালোচনা করেছেন।
যেমন ইমাম আবূ দাউদ রহঃ উক্ত হাদীস বর্ণনা করে মন্তব্য করেছেনঃ
قَالَ أَبُو دَاوُدَ: كَانَ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ مَهْدِيٍّ: لَا يُحَدِّثُ بِهَذَا الْحَدِيثِ لِأَنَّ الْمَعْرُوفَ عَنِ الْمُغِيرَةِ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَسَحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ،
হযরত আব্দুর রহমান বিন মাহদী রহঃ এ হাদীস বর্ণনা করতেন না। কারণ, হযরত মুগীরা বিন শু’বা রাঃ থেকে মারূফ বর্ণনা হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুফফাইন তথা চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করতেন। [জাউরাব তথা চামড়া ছাড়া অন্য মোজার উপর মাসাহ করার কথা বর্ণিত হয়নি] {সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৫৯, বযলুল মাযহুদ-১/৯৬}
وَقَالَ النَّسَائِيّ فِي سُنَنِهِ الْكُبْرَى: لَا نَعْلَمُ أَحَدًا تَابَعَ أَبَا قَيْسٍ عَلَى هَذِهِ الرِّوَايَةِ، وَالصَّحِيحُ عَنْ الْمُغِيرَةِ أَنَّهُ عليه السلام مَسَحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ،
ইমাম নাসায়ী রহঃ সুনানে কুবরা গ্রন্থে লিখেছেনঃ উক্ত বর্ণনা আবু কায়েস ছাড়া আর কেউ করেনি। আমাদের জানা মতে আর কোন বর্ণনাকারী এ বর্ণনায় তাকে সমর্থন করেনি।
বিশুদ্ধ কথা হল, হযরত মুগীরা রাঃ থেকে বর্ণিত হল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুফফাইন তথা চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করেছেন। [নছবুর রায়াহ-১/১৮৩]
এছাড়া ইমাম মুসলিম রহঃ, ইমাম বায়হাকী রহঃ, ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহঃ, ইমাম আহমাদ রহঃ, ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন রহঃ, ইমাম আলী বিন মাদিনী রহঃ প্রমূখ মুহাদ্দিসীনে কেরাম এ বর্ণনাটিকে আবু কায়েছ এবং হুযাইল বিন শুরাহবীল এ দু’জনের কারণে জঈফ সাব্যস্ত করেছেন।
ইমাম নববী রহঃ লিখেছেনঃ
قَالَ النَّوَوِيُّ: كُلُّ وَاحِدٍ مِنْ هَؤُلَاءِ لَوْ انْفَرَدَ قُدِّمَ عَلَى التِّرْمِذِيِّ، مَعَ أَنَّ الْجَرْحَ مُقَدَّمٌ عَلَى التَّعْدِيلِ، قَالَ: وَاتَّفَقَ الْحُفَّاظُ عَلَى تَضْعِيفِهِ، وَلَا يُقْبَلُ قَوْلُ التِّرْمِذِيِّ: إنَّهُ حَسَنٌ صَحِيحٌ،
যে হযরতগণ উক্ত হাদীসটিকে জঈফ সাব্যস্ত করেছেন, যদি তারা প্রতিজন আলাদাও হতেন, তবু তিনি ইমাম তিরমিজীর উপর অগ্রগণ্য হতেন। এছাড়া মূলনীতি হল, জরাহ তাদীলের উপর অগ্রগণ্য হয়। আর হাফেজে হাদীসগণ তার জঈফ হবার উপর একমত। সুতরাং ইমাম তিরমিজীর মন্তব্য “হাদীসটি হাসান সহীহ” বলাটা গ্রহণযোগ্য বক্তব্য নয়। [নছবুর রায়াহ-১/১৮৪]
এই হল, চামড়া ছাড়া অন্য মোজার উপর মাসাহ করার হাদীসের হালাত। মোট হাদীস সংখ্যা তিনটি। যার মাঝের দু’টি হাদীস সর্বসম্মতভাবেই জঈফ।
আর বাকি একটি ইমাম তিরমিজীর কাছে হাসান সহীহ হলেও বাকি সকল গ্রহণযোগ্য মুহাদ্দিসগণের নিকট তা জঈফ।
এখন প্রশ্ন হল, এক ইমাম তিরমিজীর সহীহ বলা হাদীসের উপর নির্ভর করে কুরআনের ধৌত করার হুকুমকে শর্তযুক্ত করার অধিকার আছে কী? অধিকার থাকতে পারে? অসম্ভব।
এ কারণেই ইমাম আবু বকর জাসসাস রহঃ লিখেছেনঃ
وَالْأَصْلُ فِيهِ أَنَّهُ قَدْ ثَبَتَ أَنَّ مُرَادَ الْآيَةِ الْغَسْلُ عَلَى مَا قَدَّمْنَا فَلَوْ لَمْ تَرِدْ الْآثَارُ الْمُتَوَاتِرَةُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْحِ عَلَى الْخُفَّيْنِ لَمَا أَجَزْنَا الْمَسْحَ ……………وَلَمَّا لَمْ تَرِدْ الْآثَارُ في جواز المسح على الجور بين فِي وَزْنِ وُرُودِهَا فِي الْمَسْحِ عَلَى الْخُفَّيْنِ بَقَّيْنَا حُكْمَ الْغَسْلِ عَلَى مُرَادِ الْآيَةِ
অনুবাদঃ মাসআলাটির হাকীকত হল,আয়াতের দ্বারা আসল উদ্দেশ্য হল পা ধৌত করা। যেমনটি আগে আলোচিত হয়েছে। যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মুতাওয়াতির সূত্রে চামড়ার মোজার উপর মাসাহের বিষয়টি বর্ণিত না হতো, তাহলে আমরা মোজার উপর মাসাহকে জায়েজ সাব্যস্ত করতাম না।…….. যেহেতু খুফফাইন তথা চামড়ার মোজার উপর মাসাহের মত শক্তিশালী বর্ণনা যাউরাব তথা চামড়া ছাড়া অন্য মোজার উপর মাসাহের অনুমতি বিষয়ে বর্ণিত হয়নি,তাই আমরা এক্ষেত্রে কুরআনের আসল বিধান তথা ধৌত করার হুকুমটি বহাল রাখবো।[আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাসকৃত-২/৪২৮,ভিন্ন এডিশন-৩/৩৫৬]
বাকি থেকে যায় একটি কথা। সেটি হল, কতিপয় সাহাবাগণ থেকে চামড়া ছাড়া অন্য মোজার উপর মাসাহের বিষয়টি বর্ণিত আছে। এক্ষেত্রে জবাব কী হবে?
এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হল, চামড়া ছাড়া অন্য মোজা যদি এমন গুণ বিশিষ্ট হয় যে, তাতে চামড়ার মোজার গুণাবলী পাওয়া যায়, যেমন পানি প্রবেশ করে না। তা পরিধান করে জুতা ছাড়াই দুই আড়াই কিলোমিটার চলা যায়। বাঁধা ছাড়াই পায়ের সাথে আটকে থাকে, ইত্যাদি গুণাবলী পাওয়া গেলে তা চামড়ার মোজার হুকুমে চলে যাবে। অর্থাৎ এর উপর মাসাহ করা শুদ্ধ হবে।যেমনটি কিছু কিছু সাহাবাগণ করেছেন।
কিন্তু সতর্কতা হল, এমনটি না করা। যেহেতু কুরআনে পরিস্কার ধৌত করার হুকুম এসেছে। কুরআনের বিধানকে দুর্বল হাদীসের উপর ভিত্তি করে ছেড়ে দেয়া যায় না।
কিন্তু যদি মোজা চিকন ও পাতলা হয়, যেমন বর্তমানের সূতার মোজা ইত্যাদি। তাহলে এসবের উপর মাসাহ করলে ফুক্বাহায়ে কেরামগণের সর্বসম্মত মতানুসারে মাসাহ শুদ্ধ হবে না। সুতরাং অজু হবে না।
তাই এসব মোজার উপর মাসাহকারী ব্যক্তি নাপাকই থাকবে। এভাবে নামায পড়লে নামায হবে না। এমন ব্যক্তির পিছনে ইক্তিদা করলে নামায আদায় হবে না।
عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، وَالْحَسَنِ أَنَّهُمَا قَالَا: «يُمْسَحُ عَلَى الْجَوْرَبَيْنِ إِذَا كَانَا صَفِيقَيْنِ
হযরত কাতাদা রহঃ হযরত সাঈদ বিন মুসাইয়্যিব ও হযরত হাসান বসরী রহঃ থেকে বর্ণনা করেন যে, তারা উভয়ে বলেছেন, চামড়া ছাড়া অন্য মোজার উপরও মাসাহ করা যায় যদি তা মোটা হয়। [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-১/১৮৮, হাদীস নং-১৯৭৬]
لَا شَكَّ أَنَّ الْمَسْحَ عَلَى الْخُفِّ عَلَى خِلَافِ الْقِيَاسِ فَلَا يَصْلُحُ إلْحَاقُ غَيْرِهِ بِهِ إلَّا إذَا كَانَ بِطَرِيقِ الدَّلَالَةِ وَهُوَ أَنْ يَكُونَ فِي مَعْنَاهُ، وَمَعْنَاهُ السَّاتِرُ لِمَحِلِّ الْفَرْضِ الَّذِي هُوَ بِصَدَدِ مُتَابَعَةِ الْمَشْيِ فِيهِ فِي السَّفَرِ وَغَيْرِهِ
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করার বিষয়টি খেলাফে কিয়াস শরীয়তসিদ্ধ হয়েছে। সুতরাং এটির উপর অন্য কিছুকে কিয়াস করা যাবে না। তবে দালালাতুন নছ হিসেবে যদি খুফফাইনের গুণে গুণান্বিত কোন মোজা পাওয়া যায়, তাহলে ভিন্ন কথা। খুফফাইনের গুণের অন্তর্ভূক্ত বলতে উদ্দেশ্য হল, এমন মোজা যা পা’কে ঢেকে নেয়। যা পরিধান করে সফর অন্যান্য সময় লাগাতার চলাচল করা যায়। [ফাতহুল কাদীর-১/১০৯, ভিন্ন এডিশন-১/১৫৭]
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।
উস্তাজুল ইফতা– জামিয়া কাসিমুল উলুম সালেহপুর, আমীনবাজার ঢাকা।
ইমেইল– ahlehaqmedia2014@gmail.com