দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে রাখে
ভূমিকা
মানুষের ফিতরাতেই ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা ও পরিকল্পনা করা রয়েছে। কিন্তু যখন এই আশা-আকাঙ্ক্ষা মাত্রা ছাড়িয়ে যায় এবং দুনিয়াবি জীবনই প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা মানুষের ঈমানের দুর্বলতার কারণ হয়। অধিকাংশ মানুষ দুনিয়ার লোভ-লালসা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এতটাই ব্যস্ত থাকে যে, তারা মৃত্যুর কথা ভুলে যায় এবং পরকালকে অবহেলা করে। ইসলাম এই ধরনের মানসিকতার ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে, কারণ দীর্ঘ আশা ও দুনিয়ার মোহ মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে দেয়, গুনাহের দিকে নিয়ে যায় এবং মৃত্যুর প্রস্তুতিকে বিলম্বিত করে।
এই প্রবন্ধে দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষার নেতিবাচক প্রভাব, কুরআন ও হাদিসের আলোকে এর ক্ষতিকর দিকসমূহ এবং কীভাবে এই প্রবণতা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সে সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হবে।
দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতি ও ক্ষতিকর দিক
দীর্ঘ আশা (طُولُ الأَمَلِ) বলতে বোঝানো হয় এমন এক মানসিকতা, যেখানে মানুষ মনে করে যে তার হাতে অনেক সময় আছে, তাই দুনিয়ার পেছনে ছুটতে হবে এবং পরে ইবাদত-আমল করা যাবে।
১. পরকাল থেকে উদাসীন করে ফেলে
মানুষ যখন দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও সম্পদ অর্জনের চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়, তখন সে মৃত্যুর কথা ভুলে যায়। ফলে সে নেক আমল করতে দেরি করে এবং গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়।
আল্লাহ বলেন—”তাদেরকে (দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে) ছেড়ে দাও, তারা খাবে ও ভোগ করবে এবং দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে গাফিল করে রাখবে। অতঃপর তারা জানতে পারবে।” (সূরা হিজর: ৩)
এই আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, যারা দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত, তারা পরকালের চিন্তা থেকে দূরে সরে যায়।
২. তাওবা ও নেক আমলকে বিলম্বিত করে
দীর্ঘ আশার কারণে মানুষ ভাবে, “আমি এখনও তরুণ, পরে তাওবা করব,” কিংবা “এই কাজটি শেষ করে নেব, তারপর ইবাদত শুরু করব।” অথচ মৃত্যুর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
নবী ﷺ বলেন—”আমি তোমাদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি যে জিনিস নিয়ে ভয় করি, তা হলো প্রবৃত্তির অনুসরণ ও দীর্ঘ আশা। কেননা প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে সত্য থেকে বিমুখ করে এবং দীর্ঘ আশা পরকালের কথা ভুলিয়ে দেয়।” (সুনান ইবনে মাজাহ: ৪১৯৮)
৩. দুনিয়ার মোহ ও গুনাহের প্রতি আসক্ত করে
যখন মানুষের অন্তর দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে যায়, তখন সে সম্পদ, ক্ষমতা ও খ্যাতি অর্জনের জন্য হারাম পথ বেছে নেয়। এতে হারাম উপার্জন, সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, অন্যের হক নষ্ট করা ইত্যাদি পাপ কাজে লিপ্ত হয়।
নবী ﷺ বলেছেন— “আদম সন্তানের বয়স যত বাড়ে, তার সঙ্গে দু’টি জিনিসও বৃদ্ধি পায়— সম্পদের ভালোবাসা ও দীর্ঘ জীবন লাভের আশা।” (সহিহ বুখারি: ৬৪৩৬)
৪. মৃত্যুর কথা ভুলিয়ে দেয়
দীর্ঘ আশা মানুষকে এমন এক মানসিকতা দেয়, যেখানে সে ভাবে, “আমার হাতে অনেক সময় আছে।” ফলে সে ইবাদত ও নেক আমলে অলসতা করে। অথচ মৃত্যু যেকোনো সময় চলে আসতে পারে।
রাসুল ﷺ বলেছেন—”তোমরা বেশি বেশি মৃত্যুর স্মরণ করো, যা সকল আনন্দ-উল্লাস ধ্বংস করে দেয়।” (সুনান তিরমিজি: ২৩০৭)
দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিকার
১. মৃত্যুর কথা অধিক পরিমাণে স্মরণ করা
যে ব্যক্তি মৃত্যুর কথা বেশি স্মরণ করে, তার অন্তর নরম হয়, দুনিয়ার মোহ কমে যায় এবং পরকালের প্রস্তুতি নেওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
রাসুল ﷺ বলেছেন—”সবচেয়ে বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে সর্বদা মৃত্যুকে স্মরণ করে এবং তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।” (সুনান ইবনে মাজাহ: ৪২৫৯)
২. দুনিয়াকে সাময়িক মনে করা
মুমিনের উচিত দুনিয়ার প্রতি আসক্ত না হয়ে এটিকে সাময়িক সফরের মতো দেখা।
নবী ﷺ বলেন—”তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে থাকো, যেন তুমি একজন অপরিচিত ব্যক্তি বা পথচারী।”(সহিহ বুখারি: ৬৪১৬)
৩. দ্রুত তাওবা ও নেক আমল শুরু করা
দীর্ঘ আশার সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো, এটি মানুষকে তাওবা থেকে বিরত রাখে। তাই বিলম্ব না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাওবা করা উচিত।
আল্লাহ বলেন—”তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাও এবং জান্নাতের দিকে ছুটে চলো, যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর সমান। এটি মুত্তাকিদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।” (সূরা আলে ইমরান: ১৩৩)
৪. নফল ইবাদত ও দান-সদকা বৃদ্ধি করা
দীর্ঘ আশা কমানোর অন্যতম উপায় হলো বেশি বেশি ইবাদত করা এবং আল্লাহর পথে দান-সদকা করা।
আল্লাহ বলেন—”যে কেউ আখিরাতের পুরস্কার কামনা করবে, আমি তার পুরস্কার বৃদ্ধি করে দেব। আর যে কেউ দুনিয়ার পুরস্কার কামনা করবে, আমি তাকে তাতে কিছু দিই, কিন্তু আখিরাতে তার কোনো অংশ থাকবে না।” (সূরা শূরা: ২০)
৫. আখিরাতের চিন্তা সর্বদা অন্তরে জাগ্রত রাখা
মানুষের উচিত আখিরাতকে তার মূল লক্ষ্য বানানো এবং দুনিয়ার জীবনকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা।
আল্লাহ বলেন— “আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন, তা দিয়ে আখিরাতের কল্যাণ কামনা কর এবং দুনিয়া থেকেও তোমার অংশ ভুলে যেও না।” (সূরা কাসাস: ৭৭)
উপসংহার
দীর্ঘ আশা-আকাঙ্ক্ষা মানুষের ঈমান দুর্বল করে, তাকে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত করে এবং পরকাল সম্পর্কে উদাসীন করে ফেলে। এই মানসিকতা মানুষের মৃত্যুর প্রস্তুতিকে বিলম্বিত করে, প্রবৃত্তির অনুসরণে বাধ্য করে এবং নেক আমলে অলসতা সৃষ্টি করে। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত মৃত্যুর কথা স্মরণ করা, দুনিয়াকে সাময়িক মনে করা, নেক আমল ও তাওবা দ্রুত করা এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে দীর্ঘ আশার প্রভাব থেকে রক্ষা করুন এবং পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমিন।