দুনিয়ার লোভ আখেরাতকে নষ্ট করে দেয়
ভূমিকা
মানুষের জীবন মূলত দুই ভাগে বিভক্ত: দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ দুনিয়ার লোভ ও মোহে এতটাই মগ্ন হয়ে যায় যে, তারা আখেরাতের চিন্তা বিস্মৃত হয়। অথচ কুরআন ও হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, দুনিয়ার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয় এবং আখেরাতের সফলতা বাধাগ্রস্ত করে।
দুনিয়ার লোভ কী?
দুনিয়ার লোভ বলতে দুনিয়ার সম্পদ, খ্যাতি, ক্ষমতা ও ভোগবিলাসের প্রতি সীমাহীন আসক্তিকে বোঝানো হয়। যখন মানুষ দুনিয়াকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে সম্পদ ও প্রতিপত্তি অর্জনের চেষ্টা করে, তখন সেটাই “দুনিয়ার লোভ” হিসেবে চিহ্নিত হয়।
কুরআনের দৃষ্টিতে দুনিয়ার লোভের পরিণাম
১. দুনিয়া ধোঁকার বস্তু
আল্লাহ তাআলা বলেন: يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُم بِاللَّهِ الْغَرُورُ
“হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য, সুতরাং দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে এবং প্রতারক শয়তান যেন আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদেরকে ধোঁকায় না ফেলে।” (সূরা ফাতির: ৫)
আল্লাহ আমাদের সতর্ক করেছেন যে, দুনিয়ার জীবন কেবল এক সাময়িক পরীক্ষা। যারা একে স্থায়ী মনে করে এবং দুনিয়ার লোভে মগ্ন হয়, তারা ধোঁকায় পড়ে এবং আখেরাতকে ভুলে যায়।
২. দুনিয়ার মোহ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়
আল্লাহ বলেন: وَمَا ٱلۡحَيَوٰةُ ٱلدُّنۡيَآ إِلَّا مَتَٰعُ ٱلۡغُرُورِ
“এবং দুনিয়ার জীবন ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়।”(সূরা আলে ইমরান: ১৮৫)
দুনিয়ার সুখ-শান্তি, সম্পদ, ক্ষমতা সবই সাময়িক। কিন্তু মানুষ এগুলোকেই স্থায়ী মনে করে এবং এভাবেই তারা আখেরাতকে নষ্ট করে ফেলে।
৩. যারা দুনিয়ার পেছনে ছুটবে, তাদের আখেরাতে অংশ নেই
আল্লাহ বলেন:مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيۡهِمۡ أَعۡمَٰلَهُمۡ فِيهَا وَهُمۡ فِيهَا لَا يُبۡخَسُونَ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا ٱلنَّارُ
“যারা দুনিয়ার জীবন ও এর চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের কর্মফল দুনিয়াতেই দিয়ে দেই এবং এতে তাদের প্রতি কোনো কমতি করা হয় না। কিন্তু আখেরাতে তাদের জন্য থাকবে শুধু আগুন।” (সূরা হূদ: ১৫-১৬)
যারা শুধু দুনিয়ার জন্য কাজ করে এবং আখেরাতের চিন্তা বাদ দেয়, তারা আখেরাতে কোনো প্রতিদান পাবে না; বরং তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি অপেক্ষা করছে।
হাদিসের দৃষ্টিতে দুনিয়ার লোভের কুফল
১. দুনিয়ার লোভ সকল বিপদের মূল
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: حُبُّ الدُّنْيَا رَأْسُ كُلِّ خَطِيئَةٍ
“দুনিয়ার ভালোবাসা সকল পাপের মূল।” (বাইহাকি, শু’আবুল ঈমান: ১০৩০)
যখন মানুষ দুনিয়ার প্রতি অন্ধ হয়ে যায়, তখন তারা হারাম ও অন্যায় কাজ করতেও দ্বিধা করে না। এটি মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।
২. দুনিয়ার লোভ মানুষকে ধ্বংস করে
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: مَا ذِئْبَانِ جَائِعَانِ أُرْسِلَا فِي غَنَمٍ بِأَفْسَدَ لَهَا مِنْ حِرْصِ الْمَرْءِ عَلَى الْمَالِ وَالشَّرَفِ لِدِينِهِ
“যেমন দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে ভেড়ার পালের জন্য ধ্বংসাত্মক, তেমনি দুনিয়ার সম্পদ ও সম্মানের প্রতি লোভ মানুষের দ্বিনের জন্য আরও বেশি ধ্বংসাত্মক।” (তিরমিজি: ২৩৭6)
সম্পদের লোভ ও ক্ষমতার মোহ একজন মানুষের ঈমান ও দ্বিনকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
দুনিয়ার লোভ থেকে বাঁচার উপায়
১. আখেরাতের কথা সর্বদা স্মরণ রাখা
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَادِمِ اللَّذَّاتِ
“তোমরা বেশি বেশি মৃত্যুর স্মরণ করো।” (তিরমিজি: ২৩০৭)
মৃত্যু স্মরণ করলে দুনিয়ার প্রতি লোভ কমে যায় এবং মানুষ আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে আগ্রহী হয়।
২. দান-সদকা করা
আল্লাহ বলেন: وَمِمَّا رَزَقْنَٰهُمْ يُنفِقُونَ
“আর আমি তাদের যা রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে।”(সূরা বাকারা: ৩)
দান-সদকা করলে দুনিয়ার প্রতি লোভ কমে যায় এবং আখেরাতের জন্য সওয়াব জমা হয়।
উপসংহার
দুনিয়ার লোভ মানুষকে আখেরাত থেকে গাফিল করে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। তাই একজন মুমিনের উচিত দুনিয়াকে তার লক্ষ্য বানানো নয়, বরং দুনিয়াকে আখেরাতের সফলতার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা।
আল্লাহ আমাদের দুনিয়ার লোভ থেকে মুক্ত থাকার এবং আখেরাতের সফলতার জন্য কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমীন!