ফেরেশতা সম্বন্ধে ঈমান
দ্বিতীয় মৌলিক যে বিষয়ে ঈমান রাখতে হয় তা হল ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান। ফেরেশতা শব্দের আরবী হল মালায়িকা। এ শব্দটি বহুবচন। এর একবচন হল মালাকুন, এর আভিধানিক অর্থ হল বার্তাবাহক।
পরিভাষায় ফেরেশতা বলা হয় : এমন নূরানী মাকলূক, যারা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে থাকেন এবং আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করেন না। বরং সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ পালনে রত থাকেন।
ফেরেশতা সম্বন্ধে এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে,
১. ফেরেশতাগণ আল্লাহ্ তা’আলার এক সম্মানিত সৃষ্টি। তারা নূরের সৃষ্টি।
২. তারা পুরুষও নন নারীও নন। তারা কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি রিপু থেকে মুক্ত। ফেরেশতাদেরকে নারী বা পুরুষ আখ্যায়িত করা যায় না। কেননা এ ব্যাপারে কুরআন হাদীছে কোন ভাষ্য কিংবা কোন যুক্তি বর্তমান নেই ।
৩. তারা বিভিন্ন আকার ধারণ করতে পারেন। হযরত জিব্রাইল (আঃ) বিভিন্ন আকৃতিতে নবী কারীম (সাঃ)-এর দরবারে হাযির হতেন। অধিকাংশ সময় তিনি হযরত দেহ্ইয়ায়ে কালবী (রাঃ)-এর আকৃতিতে আসতেন। হাদীছে জিব্রীল নামক প্রসিদ্ধ হাদীছে তার এক বেদুঈনের বেশে আসার কথা উল্লেখিত আছে ।
৪. তাদের কোন সন্তান-সন্ততি নেই।
৫. তারা সংখ্যায় অনেক। হাদীছে বর্ণিত আছে সাত আসমানের সর্বত্র এত ফেরেশ্তা ইবাদতে রত আছেন যে, সামান্য অর্ধহাত জায়গাও খালী নেই। তাদের প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহ্ ব্যতীত কারও জানা নেই। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে : অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত তোমার প্রতিপালকের সৈন্যবাহিনী (ফেরেশতা) সম্বন্ধে কেউ অবগত নয় । (সূরাঃ ৭৪-মুদ্দাছিরঃ ৩১)
৬. আল্লাহ্ তাদেরকে বিপুল শক্তির অধিকারী বানিয়েছেন।
৭. আল্লাহ্ তাদেরকে সৃষ্টি করে বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন- কতিপয় আযাবের কাজে, কতিপয় রহমতের কাজে নিযুক্ত আছেন, কতিপয় আমলনামা লেখার কাজে নিযুক্ত, তাদেরকে “কিরামান কাতিবীন” বলা হয়। কেউ আল্লাহ্র আরশ বহনের দায়িত্বে নিয়োজিত। এমনিভাবে সৃষ্টির বিভিন্ন কাজে ফেরেশতাদেরকে আল্লাহ্ পাক নিয়োজিত করে রেখেছেন।
৮. ফেরেশ্তাগণ মাসূম বা নিস্পাপ। সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক কার্য সম্পাদন করে থাকেন, তার ব্যতিক্রম করেন না। আল্লাহর আদেশের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম তারা করেন না। তারা আল্লাহ পাকের নাফরমানী করেন না। বরং প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেন। এ ব্যাপারে কুরআনে বলা হয়েছে : অর্থাৎ, তারা আগে বেড়ে কথা বলে না। তারা তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে । (সূরা : ২১-আম্বিয়া ঃ ২৭)
ইবলীস আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল – এ থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে, ফেরেশতা থেকে নাফরমানী হতে পারে। কেননা মুহাক্কিকদের মতে ইবলীস ফেরেশতা নয়, বরং সে ছিল জিনদের অন্তর্ভুক্ত। যেমন এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ অর্থাৎ, সে ছিল জিনদের অন্তর্ভুক্ত। অতপর সে তার প্রতিপালকের নির্দেশের অবাধ্য হয়ে যায়।
তদুপরি ইবলীসের আওলাদ আছে বলে কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এটাও তার ফেরেশতা না হওয়ার দলীল। কেননা ফেরেশতাদের কোন আওলাদ হয় না। উপরোক্ত আয়াতেই আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন : افتتخذونه وذريته اولياء من دوني وهم لكم عدو – অর্থাৎ, তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। (সূরা : ১৮-কাহফ ঃ ৫০)
এছাড়া ইবলীস কর্তৃক নাফরমানী ঘটে যাওয়াও তার ফেরেশতা না হওয়ার দলীল। কেননা ফেরেশতাগণ আল্লাহর নাফরমানী করেন না। যেমন পূর্বে এক আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
হারুত ও মা’রূত সহীহ মত অনুসারে দুজন ফেরেশতা ছিলেন। তাদের থেকে কোন কুফর বা গোনাহে কাবীরা সংঘটিত হয়নি। তাদের শাস্তি গোনাহের কারণে নয়, বরং সেটা তিরস্কার স্বরূপ হয়েছে। যেমন নবীদের বিচ্যুতির ফলে তিরস্কার হয়ে থাকে। তদুপরি উক্ত ফেরেশতাদ্বয়ের সাথে জোহরা নাম্নী নারীর প্ররোচনা সংক্রান্ত রেওয়ায়াতটি বায়যাবী প্রমুখ সহীহ নয় বলে মন্তব্য করেছেন।
ফেরেশতাদের মধ্যে চারজন সর্ব প্রধান
(এক) জিব্রাঈল ফেরেশতা : তিনি ওহী ও আল্লাহর আদেশ বহন করে নবীদের নিকট আসতেন। এছাড়া আল্লাহ্ যখন যে নির্দেশ প্রদান করেন তা কর্তব্যরত ফেরেশতার নিকট পৌঁছান।
(দুই) মীকাঈল ফেরেশতা : তিনি মেঘ প্রস্তুত করা, বৃষ্টি বর্ষাণো এবং আল্লাহর নির্দেশে মাখলূকের জীবিকা সরবরাহের দায়িত্বে নিযুক্ত।
(তিন) ইসরাফীল ফেরেশতা ঃ তিনি রূহ সংরক্ষণ ও সিঙ্গায় ফুৎকার দিয়ে দুনিয়াকে ভাঙ্গা ও গড়ার দায়িত্বে নিযুক্ত।
(চার) আযরাঈল ফেরেশতা : জীবের প্রাণ হরণের কাজে নিযুক্ত তিনি ৷ হাদীছে তাকে ‘মালাকূল মউত’ বলা হয়েছে, আছারে সাহাবার মধ্যে আযরাঈল নামটি পাওয়া যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে রূহ কব্য করার সময় আযরাঈল (আঃ) কে কারও কাছে আসতে হয় না, বরং সারা প্রথিবী একটি গ্লোবের মত তার সামনে অবস্থিত, যার আয়ূষ্কাল শেষ হয়ে যায় নিজ স্থানে থেকেই তিনি তার রূহ কব্য করে নেন। তবে মৃত ব্যক্তি নেককার হলে রহমতের ফেরেশ্তা আর বদকার হলে আযাবের ফেরেশতা মৃতের নিকট এসে থাকেন এবং মৃত ব্যক্তির রূহ নিয়ে যান।
দুনিয়ার প্রতিটি ধর্ম মতেই বিশেষ করে গ্রীক দর্শনেও এ জাতীয় সত্তা সমূহের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। সাবিয়ী ধর্ম মতে এ শ্রেণীর মাখলূককে তারকাপূঞ্জ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। তারা ফেরেশতাদের উদ্দেশ্যে কুরবানী দিত। তাদের প্রতিকৃতি তৈরী করত এবং তাদেরকে এক দৃশ্যমান প্রভূ বা “খোদার প্রকাশ” মনে করত। ইউনানী মিশরী (ইসকান্দারী) দর্শনে তাদের নাম রাখা হয়েছে “উকূলে আশারা বা দশ বুদ্ধি আকল। পার্শিয়ানরা ফেরেশতাদেরকে “ইমশাস পান্দ” নামে অভিহিত করত এবং তাদের ধারণা মতে ফেরেশতাদের সংখ্যা অসংখ্য ও অগণিত। পার্শিয়ানরা ফেরেশতাদেরকে পূজা-অর্চনার যোগ্য বলে মনে করত। তাদের ধর্ম মতে সর্বাধিক মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতা হলেন ছয়জন। তাদের প্রত্যেকের অধীনে রয়েছে তেত্রিশজন করে ফেরেশ্তা। পার্শিয়ানদের ধর্ম মতে ভাল-মন্দের প্রভূ একজন নয় বরং দুইজন এবং তাদের প্রত্যেকের অধীনে রয়েছে অসংখ্য ফেরেশ্তা। এই উভয় শ্রেণীর প্রভূ নিজ নিজ সৈন্য সামন্তসহ সর্বদাই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে থাকে। এমনিভাবে তারা নর ও মাদী ফেরেশ্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে এবং তারা বলে, মাদী ফেরেশ্তা নর ফেরেশ্তার স্ত্রী। ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরা ফেরেশতাদেরকে করভীম বলে এবং বিশিষ্ট ফেরেশতাদেরকে জিব্রাঈল, মীকাঈল ইত্যাদি নামে অভিহিত করে। তারা মর্যাদা ও সম্মানের মস্তক অবনত করে তাদেরকে এমন ভাবে আহবান করে যেমনটি আল্লাহ্ শানে করা হয়ে থাকে। খৃষ্টান সম্প্রদায়ও ফেরেশ্তাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করে এবং বিশেষ বিশেষ ফেরেশ্তাকে জিব্রাঈল রূহুলকুস ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করে থাকে। হিন্দু ধর্মে ফেরেশ্তাদের সম্পর্কে নানান ধরনের উদ্ভট কল্পনা করা হয়ে থাকে।
জাহিলী যুগের পূর্বে আরবরা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে অভিহিত করত। তাদের পূজা-আর্চনা করত এবং এমন আকীদাও পোষণ করত যে, তারা আল্লাহর দরবারে তাদের জন্য সুপারিশকারীর ভূমিকা পালন করবে।
ইসলাম ফেরেশতাদের সম্বন্ধে এ সকল মতাদর্শকে ভ্রান্ত ধারণা এবং অসার বলে ঘোষণা করেছে। এ সকল ভ্রান্ত ধারণরা মূলোচ্ছেদ কল্পে কুরআনে কারীমের বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। প্রমাণ করা হয়েছে যে, প্রভূত্ব ও খোদায়ীত্বের কোন গুণ ফেরেশতাদের মধ্যে নেই। তারা আল্লাহর বান্দা। তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা। আল্লাহর নির্দেশ ব্যতিরেকে পৃথিবীতে কোন রূপ হস্তক্ষেপ করার অধিকার তাদের নেই। সুতরাং তাদের উদ্দেশ্যে ইবাদত-বন্দেগী করা এবং পূজা-অর্চনা করা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও না-জায়েয।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬