ইলম অর্জনের ফজিলত
ইলমে দ্বীন হাছেল করার গুরুত্বঃ
ইল্ম বলা হয় কুরআন-হাদীছের কথা এবং মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কিত জ্ঞানকে। এই ইলম বা জ্ঞান না হলে আমল আসে না। সহীহভাবে মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা না করলে সহীহ-শুদ্ধভাবে আমল করা যায় না। আর আমল সহীহ-শুদ্ধভাবে না হলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এজন্যই আবশ্যক পরিমাণ ইল্ম হাছেল করা অর্থাৎ, প্রয়োজন পরিমাণ মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরযে আইন। আর ফরয তরক করা কবীরা গোনাহ । প্রয়োজন পরিমাণ ইল্ম বলতে বোঝায় নামায, রোযা ইত্যাদি ফরয বিষয়ের মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা করা এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেক ব্যক্তির যেসব লেন-দেন ও কাজ কারবার করতে হয়, সেসব বিষয়ের মাসআলা মাসায়েল, হুকুম-আহকাম ও নিয়ম-কানূন সম্পর্কে অবহিত হওয়া। আমরা যদি নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, উযূ, গোসল ইত্যাদি বিষয়ের মাসআলা মাসায়েল শিক্ষা না করি, তাহলে আমাদের ফরয তরক করার গোনাহ হতে থাকবে।
হাদীছে ইরশাদ হয়েছে, অর্থাৎ, হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সমস্ত মুসলমান নর-নারীর উপর ইলম শিক্ষা করা ফরয। (ইব্নে মাজাহ) দ্বীনের উপর চলতে যতটুকু জ্ঞান দরকার তা শিক্ষা করা প্রত্যেকের উপর ফরয। যেমন ঈমান-আকীদা, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা সকলেরই উপর ফরয। সেই সঙ্গে যে ব্যক্তি ব্যবসায়ী তার উপর ব্যবসার মাসআলা-মাসায়েল জানা ফরয। যে চাকরিজীবী তার উপর চাকরি সংক্রান্ত মাসআলা-মাসায়েল জানা ফরয।
যিনি গৃহিণী তার উপর ছেলে-মেয়ে লালন-পালন, স্বামীর খেদমত ইত্যাদি বিষয়ের মাসআলা- মাসায়েল জানা ফরয। এমনিভাবে যে যেই লাইনে বা যে যেই পেশা নিয়ে চলছে, সেই লাইনে চলতে গেলে তার জীবনে যা যা করতে হবে সেসব বিষয়ের মাসআলা- মাসায়েল জানা তার উপর ফরয।
এই ফরয পরিত্যাগ করার পাপে আমরা অনেকেই জর্জরিত আছি । আমরা অনেকেই যা যা জানার প্রয়োজন তা জানি না, অথচ সেটা জানা ফরয। আমরা নামায পড়ি, রোযা রাখি, হজ্জ করি, যাকাত দেই এবং অন্যান্য যত দ্বীনী কাজ করি এসব আমল করার জযবা তো আমাদের মধ্যে আসে, কিন্তু ইলম অর্জন করার জযবা আসে না। ইবাদত করার গুরুত্ব আমাদের মনে জাগে, কিন্তু সেই ইবাদত সম্পর্কে ইলম অর্জন করা এবং তার মাসআলা মাসায়েল জানার গুরুত্ব মনে জাগে না। এজন্যই আমরা অনেকে ইবাদতকারী হতে চাই, কিন্তু ইলম হাছেল করতে বা আলেম হতে চাই না। নিজেদের সন্তানকে ইবাদতকারী বানাতে চাই, কিন্তু তাদেরকে আলেম বানাতে চাই না।
ইলমে দ্বীন হাছেল করার ফযীলত
কুরআন-হাদীছের কথা এবং মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা করার অনেক ফযীলত রয়েছে। ইলম শিক্ষা করার ছওয়াব অনেক বেশী । নফল ইবাদতের চেয়ে ইল্ম শিক্ষা করার ফযীলত বেশী। হাদীছ দ্বারা এটা প্রমাণিত। এক হাদীছে এসেছে-
হযরত সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.) বলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার নিকট ইবাদতের ফযীলতের চেয়ে ইলমের ফযীলত বেশী প্রিয়। আর তোমাদের দ্বীনী বিষয়ের মধ্যে পরহেযগারী একটি উত্তম বিষয়। (মুস্তাদরকে হাকিম) ইলমের ফযীলত বেশী হওয়ার কারণে প্রমাণিত হয় যে, যাকে ইলম দান করা হয় সে বেশী ফযীলতের অধিকারী, আল্লাহ তাকে বেশী ফযীলত তথা বেশী কল্যাণ দান করেছেন। অন্য এক হাদীছে এ কথাই ইরশাদ হয়েছে।
অর্থাৎ, হযরত মুআবিয়া (রা.) বলেন যে, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি- আল্লাহ পাক যার কল্যাণ চান তাকে ধর্মীয় জ্ঞান দান করেন। (বোখারী) ইলমে দ্বীন হাছেল করার ফযীলত বয়ান করে অপর এক হাদীছে বলা হয়েছে,
হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীছের শেষাংশে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখনই কোনো একটি দল আল্লাহর ঘরসমূহের কোনো এক ঘরে (মসজিদে বা মাদ্রাসায়) একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব পাঠ করতে থাকে এবং পরস্পরে তার আলোচনা করতে থাকে, তখনই (আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে) তাদের উপর ‘ছাকীনা’ তথা স্বস্তি ও শান্তি অবতীর্ণ হতে আরম্ভ করে এবং আল্লাহর রহমত তাদেরকে ঢেকে নেয়, ফেরেশতাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে নেয় আর আল্লাহ তাআলা তাঁর নিকট যারা রয়েছে তাদের নিকট (অর্থাৎ, ফেরেশতাদের নিকট) তাদের উল্লেখ করেন। (মুসলিম)
করলেন। (তন্মধ্যে একটি মজলিস ছিল দুআর, আর একটি ছিল ইলমের।) তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, উভয় মজলিসই ভাল কাজে আছে; তবে একটি মজলিস অপরটি থেকে উত্তম । এই যে দলটি (যারা দুআয় মশগুল আছে) তারা আল্লাহকে ডাকছে, আল্লাহর প্রতি আগ্রহ ব্যক্ত করছে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের আশা পূর্ণও করতে পারেন আবার ইচ্ছা হলে না-ও করতে পারেন। কিন্তু এই যে (অপর) দলটি যারা ফেকাহ বা (বর্ণনাকারীর সন্দেহ) ইলম শিক্ষা করছে এবং অজ্ঞ লোককে শিক্ষা দিচ্ছে এরা উত্তম । আর আমিও মুআল্লিম বা শিক্ষাদাতা হিসাবে প্রেরিত হয়েছি। অনন্তর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে বসে পড়লেন। (সুনানে দারিমী) ইলমের ফযীলত বয়ান করে অন্য এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে- অর্থাৎ, হযরত আবূ যর গিফারী (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, হে আবূ যর! তুমি যদি সকাল বেলা গিয়ে কুরআনের একটি আয়াত শিক্ষা কর তাহলে তা তোমার জন্য একশত রাকআত নফল পড়া থেকেও উত্তম। আর যদি সকাল বেলায় গিয়ে ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা কর, –চাই তার উপর আমল করা হোক বা না হোক— তাহলে তা তোমার জন্য এক হাজার রাকআত নফল নামায থেকেও উত্তম। (ইবনে মাজা)
তালিবে ইলমের মর্যাদা ও ফযীলত
“তালিবে ইলম” কথাটার অর্থ হল ইল্ম তথা কুরআন হাদীছের জ্ঞান সন্ধানকারী । হাদীছে তালিবে ইলমের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে একটি ফযীলত হল-
তালিবে ইলমের জন্য ফেরেশতারা পর বিছিয়ে দেয় হাদীছে বর্ণিত হয়েছে— অর্থাৎ, হযরত সাফওয়ান ইবনে আছ্ছাল (রা.) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তালিবে ইলমের ইলম সন্ধানের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে ফেরেশতা তাদের জন্য নিজেদের পর বিছিয়ে দেয় । (মুসনাদে আহমদ ও তিরমিযী)
ব্যাখ্যা: তালিবে ইলমদের জন্য ফেরেশতাদের পর বিছিয়ে দেওয়া দ্বারা এরূপ উদ্দেশ্য হতে পারে যে, ফেরেশতাগণ তাদের ইলম শিক্ষা করার মজলিসে হাজির হয়, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং তাদের জন্য দুআ করে। অথবা প্রকৃতই ফেরেশতাগণ তাদের সম্মানার্থে পর বিছিয়ে দেয় । আল্লামা নববী (রহ.) তার “বুছতান” কিতাবে সনদ সহকারে বর্ণনা করেছেন যে, আবূ যাকারিয়া আছ-ছাজী বলেছেন, “আমরা জনৈক মুহাদ্দিছের দরবারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বসরার এক গলি দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা দ্রুত চলছিলাম । আমাদের সঙ্গে ছিল এক পাপী ব্যক্তি। সে তালিবে ইলমদের জন্য ফেরেশতাদের পর বিছিয়ে দেওয়ার বিষয়টির প্রতি উপহাস করে বলল, তোমরা সকলে পা উঁচু করে চল, আবার ফেরেশতাদের ডানা যেন ভেঙ্গে না যায়! ব্যস এ কথা বলা মাত্রই তার পা দুটো শুকিয়ে গেল এবং সে মাটিতে পড়ে গেল । মুহাম্মাদ ইবনে তাহের আল-মাকদিছী সনদ সহকারে ইমাম আবূ দাউদ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, একবার এক লম্পট ধরনের লোক’ তালিবে ইলমদের জন্য ফেরেশতাদের পর বিছানোর হাদীছ শুনে তার জুতার তলায় লোহার পিন লাগাল এবং বলল, আমি এই পিন দিয়ে ফেরেশতাদের ডানা মাড়াতে চাই। এ কথা বলার পর লোকটার পায়ে পচন ধরল। আর এক বর্ণনায় আছে লোকটা হাত পা পক্ষাঘাত গ্রস্ত হয়ে গেল।
তালিবে ইলমের সময় জেহাদে কাটানোর মধ্যে গণ্য হয় তালিবে ইলমের ফযীলত সম্পর্কে আর এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে হযরত আনাস (রা.) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ইল্ম সন্ধানে বের হয়েছে, সে আল্লাহর রাস্তায় রয়েছে যে পর্যন্ত না সে প্রত্যাবর্তন করবে। (তিরমিযী) তালিবে ইলমের জন্য জান্নাতের পথ আছান হয় হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীছের একাংশে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইল্ম সন্ধানের উদ্দেশ্যে বের হয় আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। (মুসলিম ও আবূ দাউদ) এ হাদীছ থেকে বুঝা যায় ইল্ম জান্নাতের পথ দেখায়।
আলেমের মর্যাদা ও ফযীলত
কুরআন হাদীছে উলামায়ে কেরামের অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে থেকে নিয়ে বিশেষ কয়েকটি ফযীলত বর্ণনা করা হল।
আল্লাহর কাছে আলেমের মর্যাদা অনেক উঁচু। কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে (কুরআন- হাদীছের জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাদের মর্যাদা অনেক উঁচু করে দেন। (সূরা মুজাদালা: ১১)
কত উঁচু করে দেন আল্লাহ পাক সেটা বলেননি। হতে পারে তাঁদের মর্যাদা এত উঁচু করে দেন যা আমাদের কল্পনায়ও আসবে না, তাই সীমানা নির্ধারণ না করেই বলা হয়েছে অনেক উঁচু করে দেন ।
আলেমগণ নবীদের ওয়ারিছ
উলামায়ে কেরামের মর্যাদা ও ফযীলত বয়ান করে এক হাদীছে রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অর্থাৎ, হযরত আবুদ্দারদা (রা.) বলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী । আর নবীগণ দেরহাম-দীনারের উত্তরাধিকার রেখে যান না, তাঁরা ইলমের উত্তরাধিকার রেখে যান। অতএব যে ইলম (-এর হিস্সা) গ্রহণ করল সে (নবীর উত্তরাধিকার গ্রহণ করল বিধায়) একটা গুরুত্বপূর্ণ হিস্সা গ্রহণ করল । (আবূ দাউদ)
আলেম ঈর্ষণীয়
আলেমের মর্যাদা এত বেশী যে হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে আলেম ঈর্ষা করার যোগ্য। বর্ণিত হয়েছে—
অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দুই ধরনের ব্যক্তির প্রতি হিংসা করা যায়। এক ব্যক্তি হল যাকে আল্লাহ তাআলা ধন-সম্পদ দান করেছেন, আর সে ব্যক্তি ঐ ধন-সম্পদ অকাতরে দ্বীনের কাজে ব্যয় করে । আর এক ব্যক্তি হল যাকে আল্লাহ তাআলা ধর্মীয় জ্ঞান দান করেছেন, আর সে ঐ ধর্মীয় জ্ঞান অনুযায়ী সবকিছুর ফয়সালা করে এবং অন্যদেরকে সেই ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়। (বোখারী ও মুসলিম) ব্যাখ্যাঃ এ হাদীছে ‘হিংসা’ বলে ‘গেবতা’কে বোঝানো হয়েছে। হিংসা নিষেধ, গেবতা নিষেধ নয়। হিংসা বলা হয় কারও ভাল কিছু দেখে তা ধ্বংস হওয়া কামনা করা। আর গেবতা বলা হয় কারও নেক আমল দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ হওয়ার কামনা করা। এরূপ কামনা করা নিষেধ নয়, বরং তা উত্তম । আবেদের চেয়ে আলেমের ইবাদতে ছওয়াব বেশী। উলামায়ে কেরামের মর্যাদা ও ফযীলত বয়ান করে আর এক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে—
হযরত আবূ উমামা বাহিলী (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আবেদ তথা ইবাদতকারীর উপর আলেমের ফযীলত যথা আমার (মত একজন নবীর ফযীলত তোমাদের একজন সাধারণ লোকের উপর। তারপর তিনি বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীবাসী এমনকি পৃথিবীর গর্তের পিপড়া এবং মাছ পর্যন্ত মানুষের (দ্বীনী ইলমের শিক্ষকের জন্য কল্যাণের দুআ করে। (তিরমিযী) ব্যাখ্যাঃ এ হাদীছে বোঝানো হয়েছে— যে আলেম শুধু ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতে মুআক্কাদা আদায় করার উপর ক্ষান্ত করে, তার মর্যাদা ঐ নফল ইবাদতকারীর চেয়ে যে আলেম নয় এত বেশী, যেমন আমার মর্যাদা তোমাদের একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশী।
এর কারণ হল ইল্ম থাকার কারণে উলামায়ে কেরামের মধ্যে আল্লাহর ভয় আসে। এই ভয় তাদেরকে গোনাহ থেকে বিরত রাখে এবং আমলের উপর উদ্বুদ্ধ করে ও আমলের উপর অটল রাখে। তদুপরি তারা জেনে আমল করেন ফলে তাদের আমল সহীহ-শুদ্ধ হয় । আলেমদের জন্য ফেরেশতাসহ সকল মাখলূক দুআ করে। পূর্বে উল্লেখিত হযরত আবূ উমামা বাহিলী (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে এ বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়াও হযরত আবুদ্দারদা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত অপর এক হাদীছের শেষাংষে এসেছে হযরত আবুদ্দারদা (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আসমান ও জমিনের অধিবাসীরা এবং পানির গর্ভের মাছ (পর্যন্ত) আলেমের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে । মৃত্যুর পরও আলেমের ছওয়াব জারী থাকে (আবূ দাউদ)
আলেমগণ একদিকে বেশী ছওয়াবের অধিকারী হয়ে থাকেন, আবার মৃত্যুর পরও তাঁদের ছওয়াব জারী থাকে। এভাবে তাঁদের ছওয়াবের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। হাদীছে এসেছে- হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন মানুষ মারা যায় তখন তার আমল (ও তার ছওয়াব) বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমল ব্যতিক্রম (যার ছওয়াব বন্ধ হয় না):- সদকায়ে জারিয়া, ইল্ম-যা দ্বারা মানুষের উপকার সাধিত হয়— এবং সু সন্তান- যে তার জন্য দুআ করে । (মুসলিম ও তিরমিযী)
ইলমের সঙ্গে আমল থাকা চাই
তবে ইলম শুধু শিখলে হবে না, ইলম অনুযায়ী আমলও থাকতে হবে। নতুবা ঐ ইলমেরও কোনো দাম থাকবে না। ইলম শেখার এত ফযীলত তো এজন্যই যে, সেই অনুযায়ী ইবাদত করা হবে, সেই অনুযায়ী আমল করা হবে। ইল্ম অনুযায়ী আমল না করলে সেই ইলমের কোনো ফযীলত থাকে না । যার আমল নেই সে আলেমই আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য নয়। রেওয়ায়েতে এসেছে- হযরত ওমর (রা.) কা’ব (রা.)কে জিজ্ঞাসা করলেন, আলেম কারা? তিনি জওয়াব দিলেন- যারা ইল্ম অনুযায়ী আমল করে। অতঃপর জিজ্ঞাসা করলেন, কোন্ জিনিস আলেমদের অন্তর থেকে ইলম বের করে দেয়? জওয়াব দিলেন— লোভ । (সুনানে দারিমী যাদের ইল্ম আছে আমল নেই, তাদের উদাহরণ দিয়ে কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, তারা হল ঐ গাধার মত, যে গাধা পিঠে বহু কিতাবের বোঝা বহন করে চলে । (সূরা জুমুআ: ৫)
অতএব ইল্ম শিখে আমল করা চাই । আমল করাই মূল উদ্দেশ্য ।
মুআল্লিমের ফযীলতঃ
মুআল্লিম তথা কুরআন-হাদীছের ইলম যারা শিক্ষা দেন তাঁদের অনেক ফযীলত। পূর্বে ‘আলেমের মর্যাদা ও ফযীলত’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে যেসব ফযীলতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, তা মুআল্লিমের জন্যও প্রযোজ্য যদি তিনি আলেম হয়ে থাকেন। এ ছাড়া মুআল্লিম তথা শিক্ষক হওয়ার ভিত্তিতেও তার জন্য অনেক ফযীলত রয়েছে। এক হাদীছে মুআল্লিমকে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আখ্যায়িত করা হয়েছে,
বর্ণিত হয়েছে- হযরত ওছমান (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ (আর এক বর্ণনায় আছে- ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ), যে কুরআন শরীফ (স্বয়ং) শিক্ষা করে এবং (অপরকে) শিক্ষা দেয়। (বোখারী ও আবূ দাউদ)
ফায়দা: উল্লেখিত ফযীলত ও মর্যাদা, শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়া উভয় কাজের প্রত্যেকটি দ্বারাই হাছেল হবে। শিক্ষা করা এবং শিক্ষা দেওয়া উভয় কাজ এক সঙ্গে হওয়া জরূরী নয়। অন্য এক হাদীছে মুআল্লিমকে ঈর্ষণীয় ব্যক্তি আখ্যায়িত করা হয়েছে । অর্থাৎ, মুআল্লিম এত মর্যাদার যে, তার মর্যাদা দেখে রীতিমত ঈর্ষা হতে পারে ।
বর্ণিত হয়েছে- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, দুই ধরনের ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা করা যায়:- এক ব্যক্তি হল যাকে আল্লাহ তাআলা ধন-সম্পদ দান করেছেন, আর সে ব্যক্তি ঐ ধন-সম্পদ অকাতরে দ্বীনের কাজে ব্যয় করে, আর এক ব্যক্তি হল যাকে আল্লাহ তাআলা ধর্মীয় জ্ঞান দান করেছেন, সে ঐ ধর্মীয় জ্ঞান অনুযায়ী সবকিছুর ফয়সালা করে এবং অন্যদেরকে সেই ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়। (বোখারী ও মুসলিম)
ব্যাখ্যা: এ হাদীছে “হাছাদ” শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে । হাছাদ শব্দের মূল অর্থ হিংসা। তবে এখানে হাছাদ বলে হিংসা নয় বরং ‘গেবতা’কে বোঝানো হয়েছে । হাছাদ বা হিংসা নিষিদ্ধ, গেবতা নিষিদ্ধ নয় । হাছাদ বা হিংসা বলা হয় কারও ভাল কিছু দেখে তা ধ্বংস হওয়ার কামনা করা । আর গেবতা বলা হয় কারও নেক আমল দেখে নিজের জন্যও অনুরূপ হওয়ার কামনা করা । এরূপ কামনা করা নিষেধ নয়, বরং তা উত্তম। আর এক হাদীছে মুআল্লিমের জন্য আসমান জমিনের সকলে দুআ করে বলা হয়েছে। হাদীছটি পূর্বেও বর্ণনা করা হয়েছে ।
বর্ণিত হয়েছে- হযরত আবূ উমামা বাহিলী (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আবেদ তথা ইবাদতকারীর উপর আলেমের ফযীলত যথা আমার (মত একজন নবীর ফযীলত তোমাদের একজন সাধারণ লোকের উপর। তারপর তিনি বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা এবং আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীবাসী এমনকি পৃথিবীর গর্তের পিপড়া এবং মাছ পর্যন্ত মানুষের (দ্বীনী ইলমের শিক্ষকের জন্য কল্যাণের দুআ করে থাকে । (তিরমিযী) ইলমে দ্বীন শিক্ষা করার ব্যাপারে উদাসীনতা কুরআন-হাদীছের ইলমের এত মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও আমরা এই ইল্ম শিক্ষা করার ব্যাপারে উদাসীন। মাসআলা-মাসায়েল শেখার এত গুরুত্ব এবং ফযীলত থাকা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে আমরা উদাসীন। সারা জীবন নামায পড়েই যাচ্ছি, কিন্তু নামাযের মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে ভালভাবে অবগত নই। সারা জীবন উযূ, গোসল করে যাচ্ছি, অথচ পবিত্র হওয়ার সঙ্গে জড়িত এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মাসায়েল ও তরীকা ভালভাবে জানা নেই।
রোযা, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি ফরয বিষয়গুলি সম্বন্ধেও ভালভাবে ইলম নেই। শুধু উযূ, গোসল, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত নয় প্রত্যেকটা বিষয়ের মাসায়েল জেনে জেনে আমল করতে হবে। নতুবা এক সময় বুঝে আসবে যে, ইল্ম না থাকার কারণে এবং গলদ তরীকায় আমল করার কারণে সারা যিন্দেগীর মেহনত মোজাহাদা বেকার সাব্যস্ত হয়েছে । আল্লাহ পাক আমাদেরকে হেফাজত করুন। যাহোক দ্বীনী ইল্ম অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ বিষয়, তাই দ্বীনী ইলমের প্রতি অন্তরে আযমত এবং সম্মানবোধ রাখতে হবে। এই ইলম শিক্ষা করে কী হবে- এরূপ হীনমন্নতা পরিহার করতে হবে। আলেমকে সম্মান করার গুরুত্ব ও ফযীলত আলেম ব্যক্তি সম্মানিত ব্যক্তি হওয়ার কারণে বড়দের অন্তর্ভূক্ত। কোনো আলেম ব্যক্তি আলেম নন- এরূপ ব্যক্তির চেয়ে বয়সে ছোট হলেও তিনি বড়। ইলমের কারণে তিনি বড়। অতএব বড় হিসাবে তিনি আদব-সম্মান পাওয়ার হকদার। ইসলামে বড়দের প্রতি আদব-সম্মানের গুরুত্ব এত বেশী যে, কারও মধ্যে এ গুণ উপস্থিত না থাকলে সে যেন ভাল মুসলমান বলেই আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য থাকে না। হাদীছে এসেছে- হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যারা ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা এবং বড়দের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (তিরমিযী)
আর এক হাদীছে স্পষ্টত আলেমদের সম্মান না করলে সে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শভুক্ত নয় বলা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে- অর্থাৎ, হযরত উবাদাহ ইবনুস সামিত (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যারা বড়দের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না, ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা রাখে না এবং আমাদের আলেমদের হক জেনে সে অনুযায়ী কাজ করে না, তারা আমাদের দলভুক্ত নয় (অর্থাৎ, আমাদের আদর্শভুক্ত নয়।)। [মুসনাদে আহমদ ও মুস্তাদরকে হাকিম) আলেমগণ সমাজের বড় ব্যক্তি। আর বড়দের মান্য করার মধ্যে বরকত নিহীত রয়েছে। এক হাদীছে এসেছে- অর্থাৎ, হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমাদের আকাবির তথা বড়দের সঙ্গে বরকত রয়ে গেছে। (মুস্তাদরকে হাকিম ও সহীহ ইবনে হিব্বান)
ইলমে দ্বীন ও উলামায়ে দ্বীনের অবমাননা করা প্রসঙ্গঃ
আমরা নিজেদের সন্তানদের আলেম বানাতে চাই না, তাদেরকে কুরআন-হাদীছের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই না। কারণ আমাদের মনে আলেমদের প্রতি মর্যাদাবোধ নেই। আমাদের কাছে আলেমদের মূল্যায়ন নেই। ইলমের ফযীলত সম্বন্ধে আমাদের বিশ্বাস নেই। এই ইল্ম যে ফযীলতপূর্ণ ইল্ম, এই লাইনের শিক্ষা যে মর্যাদার শিক্ষা, এই বুঝ আমাদের ভিতরে নেই। নতুবা আলেদেরকে আমরা ছোট মনে করতে পারতাম না। আমাদের সন্তানদেরকে দ্বীনী লাইনের শিক্ষায় শিক্ষিত করাকে হেয় মনে করতাম না ।
আলেমদেরকে হেয় জানা ধর্মীয় জীবনের জন্য অনেক ক্ষতিকর। বিধর্মীরা সব সময় সমাজে আলেমদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে তুলতে চেষ্টা করে। কারণ আলেমদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে তুলতে পারলে সমাজের মানুষকে তাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলা সহজ হবে এবং আলেমদের থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা সহজ হবে । আর আলেমদের থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে তাদেরকে ধর্মের বিরুদ্ধে যে কোনো মন্ত্ৰ গেলানো সহজ হবে, যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে তাদেরকে ধর্ম বিরোধী করে গড়ে তোলা সহজ হবে। এজন্য বিধর্মীরা সব সময় চেষ্টা চালায় কীভাবে আলেমদেরকে সমাজে হেয় করে তোলা যায় । এই চেষ্টারই একটা অংশ হিসাবে এক শ্রেণীর লোক পরিকল্পিতভাবে সব সময় আলেমদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে থাকে। তাদের ব্যাপারে মুসলমানদের সাবধান থাকা চাই । আলেম সমাজের ব্যাপারে কোনো অপপ্রচারে মুসলমানদের কর্ণপাত করা উচিত নয় । কেউ কেউ বলেন, আলেমদের এই দোষ সেই দোষ, কীভাবে তাদের প্রতি ভক্তি রাখব? কিন্তু মনে রাখতে হবে আলেমগণ ফেরেশতা বা নবী নন । তাঁরাও সাধারণ রক্ত মাংসের মানুষ । অতএব তাঁদেরও ভুল-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক । তাঁরা যদি বাস্তবেই কোনো ভুল বা অন্যায় করেন, তাহলে সেটার অনুসরণ না করা চাই। তবে সেই সব ভুল-ত্রুটির কারণে তাঁদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়া যাবে না। তাঁদের প্রতি সম্পূর্ণ ভক্তি হারিয়ে ফেলা উচিত হবে না। তাঁদের সমালোচনায় লিপ্ত হওয়া ঠিক হবে না। বাস্তবে তাঁদের কোনো ভুল-বিচ্যুতি থাকলে তাঁদের সমপর্যায়ের বা তাঁদের চেয়ে বড় আলেম মুরব্বীগণ সেটা সংশোধন করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। তাঁদের জন্য দুআ করা চাই আল্লাহ পাক যেন তাঁদেরকে সেই ভুল-ত্রুটি থেকে ফিরিয়ে আনেন, সাধারণ মানুষদের উচিত হবে তাঁদের সমালোচনায় লিপ্ত না হওয়া। বরং এক রেওয়ায়েতে আছে— অর্থাৎ, তোমরা আলেমদের ভুল-বিচ্যুতি থেকে বেঁচে থাক, তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (আবূ দাউদ)
যাহোক কুরআন-হাদীছের শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের অমর্যাদা করা চাই না। তাঁদের অবমূল্যায়ন করা চাই না। তাঁদেরকে ছোট মনে করা চাই না। তাঁদেরকে হেয় মনে করা চাই না। তাঁদের প্রতি এই হীন দৃষ্টি থাকার কারণেই আমরা নিজেরা আলেম হতে পছন্দ করি না। নিজেদের সন্তানদেরকে আলেম বানাতে চাই না। আমরা সন্তানকে ইঞ্জিনিয়ার বানাব, ডাক্তার বানাব, বিজ্ঞানী বানাব সেটাকে নিজেদের জন্য গর্বের বিষয় মনে করি, মর্যাদার বিষয় মনে করি, কিন্তু আমাদের সন্তানদেরকে আলেম বানাব, দ্বীনী লাইনের শিক্ষায় শিক্ষিত করব, সেটাকে গুরুরূপূর্ণ মনে করি না, সেটাকে সম্মানের বিষয় মনে করি না। আমরা সন্তানকে ডাক্তার বানাব, ইঞ্জিনিয়ার বানাব, বিজ্ঞানী বানাব, তা নিষেধ নয় । দুনিয়াবী লাইনের এসব শিক্ষা গ্রহণ করা হারাম বা নাজায়েয তো নয়। যদি নিয়ত সহীহ্ থাকে তাহলে এসব শিক্ষা গ্রহণ করাও ঠিক আছে। যদি নিয়ত সহীহ্ থাকে যে, এসব শিক্ষা গ্রহণ করে এর দ্বারা মানুষের সেবা করব, এর ওছীলায় আল্লাহ পাক আমাদের হালাল রিযিকের ব্যবস্থাও করে দিবেন- এরকম নিয়ত থাকলে এসব বিদ্যা গ্রহণ করাও জায়েয। কিন্তু যদি গলত নিয়ত থাকে যে, এই সব ডিগ্রি অর্জন করলে সরকারী চাকরি পাব, সুদ-ঘুষের মাধ্যমে অনেক টাকা-পয়সা অর্জন করতে পারব, তার দ্বারা গাড়ী-বাড়ী অনেক কিছু করতে পারব, অনেক আরাম-আয়েশে চলতে পারব, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে মানুষকে ফাঁকি দিয়ে অনেক টাকা-পয়সার লাইন করতে পারব। এরকম গলদ নিয়ত থাকলে এসব বিদ্যা শিক্ষা করা গোনাহের কারণ হয়ে দাঁড়াবে । কারণ এই সব জ্ঞানকে গোনাহের কাজে লাগানো হবে । তাই তা গোনাহের কারণ হবে। এমনিতে কুরআন-হাদীছের ইল্ম ছাড়া অন্য কোনো জ্ঞানের নিজস্ব কোনো ফযীলত নেই, তবে ভাল নিয়ত থাকলে অর্থাৎ, তার মাধ্যমে অন্য কোনো ভাল কাজের নিয়ত থাকলে, অন্য কোনো ভাল কাজের ওছীলা বানালে সেটাও ছওয়াবের কাজ হতে পারে। কাজেই দুনিয়াবী লাইনের এসব বিদ্যা শিক্ষা করতে হলে নিয়ত সহীহ করে নিতে হবে। আর কুরআন-হাদীছের ইল্ম এমনিতেই অনেক ফযীলতের ইল্ম । অন্য কোনো নেক কাজের মাধ্যম বানানোর নিয়ত ছাড়াও সেটা ফযীলতের ইলম । তাছাড়া কুরআন-হাদীছের জ্ঞান শিক্ষা করাকে ফরয করা হয়েছে।
পালাক্রমে ইলম শিক্ষা করাঃ
ইলম শিক্ষা করার অনেক গুরুত্ব ও ফযীলত থাকা সত্ত্বেও অনেকে কর্ম ব্যস্ততার কারণে ইলম শিক্ষা করার জন্য সময় সুযোগ বের করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন না। এরূপ লোকদের জন্য ইলম শিক্ষা করার একটা ব্যবস্থা তা-ই হতে পারে যা হযরত ওমর (রা.) ও তাঁর এক সঙ্গী অবলম্বন করেছিলেন। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
হযরত ওমর (রা.) বলেন যে, আমি এবং মদীনার আওয়ালী এলাকার অধিবাসী আমার এক আনসারী প্রতিবেশী – আমরা দু’জন পালাক্রমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট গমন করতাম। যেদিন আমি গমন করতাম আমি সেদিনকার ওহী ইত্যাদি যা কিছু সম্বন্ধে অবগত হতাম তা আমার প্রতিবেশীকে জানাতাম । আর যেদিন সে গমন করত সেও অনুরূপ করত। (বোখারী)
ফায়দা: এ হাদীছের অনুসরণ করে আমাদেরও উচিত উলামায়ে কেরামের সোহবতে গিয়ে ইলম শিক্ষা করা। কর্মব্যস্ততার কারণে নিজে প্রতিদিন যেতে না পারলেও পরিকল্পিতভাবে সাথী-সংগীদের মধ্যে কাউকে পাঠানো এবং দিনের শেষে একটা সময়ে তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া।
ইলম শিক্ষা করার যত ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে, সে সব ফযীলত তখন পাওয়া যাবে যখন ইলম শিক্ষা করার নিয়ত সহীহ হবে । নিয়ত গলদহলে ফযীলত পাওয়া যাবে না বরং তাতে শাস্তির হুমকী রয়েছে। ইলম শিক্ষা করতে হবে আল্লাহ্ উদ্দেশ্যে অর্থাৎ, ইলম অনুযায়ী আমল করে মহান আল্লাহকে রাজী-খুশী করার নিয়তে। এছাড়া অন্যান্য নিয়তে ইলম শিক্ষা করা হবে গলদ নিয়ত। যেমন- সম্পদ অর্জন করার নিয়তে ইলম শিক্ষা করা, মানুষের কাছে জ্ঞানী হিসাবে সম্মান লাভ করার নিয়তে ইলম শিক্ষা করা, জ্ঞানীদের সঙ্গে তর্কে বিজয়ী হওয়ার নিয়তে ইলম শিক্ষা করা, মূর্খদের সামনে জ্ঞান ফলানোর নিয়তে ইলম শিক্ষা করা ইত্যাদি। এগুলে হল গলদ নিয়ত। এক হাদীছে এরূপ কয়েকটা গলদ নিয়তের কথা তুলে ধরে ইলম শিক্ষার পশ্চাতে এসব গলদ নিয়ত না রাখার কথা বলা হয়েছে এবং এরূপ গলদ নিয়ত থাকলে জাহান্নামের হুমকি প্রদান করা হয়েছে। বর্ণিত হয়েছে— অর্থাৎ, হযরত জাবের (রা.) বলেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা ইলম শিক্ষা কর না এ উদ্দেশ্যে যে, তা দ্বারা আলেমদের সঙ্গে অহংকার প্রদর্শন করবে, আর না এ উদ্দেশ্যে যে, তা দ্বারা মূর্খদের সঙ্গে তর্ক করবে, আর না এ উদ্দেশ্যে যে, তা দ্বারা মজলিসে বিশেষ স্থান দখল করবে। কেউ এরূপ নিয়তে ইলম শিক্ষা করলে (তার জন্য রয়েছে) আগুন আগুন! (ইবনে মাজা ও সহীহ ইবনে হিব্বান)