ইসলাম

ইমাম চতুষ্টয়ের একজনের তাকলীদ কেন?

এখন প্রশ্ন হয়, চার ইমামের মধ্যে শুধু যে কোন একজনের তাকলীদ কেন করা হয়? উক্ত চার ইমামের অনুসরণের কথা কি কুরআন-সুন্নাহর কোথাও উল্লেখ আছে? তদুত্তরে প্রথমে বলা যায় যে, শুধু উক্ত চার ইমামের চার মাযহাব একটা বাস্তবতার ব্যাপার। যার কারণ হচ্ছে, উক্ত চার ইমামের চার মাযহাব ব্যতীত অন্যান্য মুজতাহিদ ইমামদের গবেষণালব্ধ মাযহাবগুলো নিঃশেষ হয়ে যাওয়া; এবং এটা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা অনিচ্ছারই প্রতিফলন। এখানে কারো কিছু করার নেই।

দ্বিতীয়তঃ আরেকটি কারণ উল্লেখ করা যায়। সেটা হচ্ছে, একটা মাযহাবকে মাযহাব হিসেবে তখন গণ্য করা যায়, যখন উক্ত মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তার প্রণীত মাযহাবে পুরো ইসলাম তথা শরীয়তের ছোট বড় সব ধরনের সমস্যার সমাধান প্রদান করে যান। শুধু দু’চারটি বা দু’চারশ বা দু’চার হাজার সমস্যার সমাধান দিলেই সেটাকে পুর্ণাঙ্গ মাযহাব হিসেবে গণ্য করা যায় না। পক্ষান্তরে অনুসরণকৃত চার মাযহাবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ইসলামের সবগুলো দিক বা সর্ব বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট সমাধান বা মতামত ব্যক্ত হয়েছে। চার মাযহাব ব্যতীত অন্যান্য মাযহাবগুলোর ব্যাপারটা এমন নয়।

মোটকথা, যখন দেখা গেল বাস্তবতার আলোকে অন্যান্য মাযহবগুলো নিঃশেষ হয়ে গেছে। তখন উক্ত চার মাযহাব অনুসরণ ব্যতীত অন্য কোন গত্যন্তর ছিল না এবং বর্তমানেও নেই। যেমন-তথা

১. ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন (রহ.) স্বীয় প্রসিদ্ধ মুকাদ্দামায়ে ইবনে খালদুন ইতিহাস গ্রন্থের ভূমিকায় যাহিরী মাযহাব পন্থীদের আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, আজকাল আর আহলে যাহিরের অস্তিত্ব নেই। কারণ, তাদের ইমামগণও শেষ, মাযহাবও শেষ। তাছাড়া বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ তাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে। উক্ত ইতিহাস গ্রন্থে তিনি আরো বলেন, বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শুধু উক্ত চার মাযহাবের বেলায়। সুতরাং এখন আর অন্য কোন মাযহাব অনুসরণ বৈধ নয়। তাছাড়া এখন কোন ব্যক্তির জন্য মুজতাহিদ হওয়ার দাবী করাও বৈধ নয়। কেউ তা করলে তাকে প্রত্যাখ্যান করা হবে এবং তার তাকলীদ বা অনুসরণ না জায়িয হবে।

২. হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহ.) বলেন, যেহেতু আর সব মাযহাব খতম হয়ে গেছে, তাই উক্ত চার মাযহাবের যে কোন এক মাযহাব অনুসরণ করা মানেই বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর দলভুক্ত থাকা। এর কোন একটা অনুসরণ না কক্ত মানেই বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ থেকে কেটে পড়া বা মুসলিম জামা’আত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-“আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতকে, আরেক রেওয়ায়াত অনুযায়ী উম্মতে মুহাম্মাদীকে ভ্রষ্টতার উপর সমবেত করবেন না। আল্লার সহযোগিতা রয়েছে জামা’আতের উপর। যে ব্যক্তি বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ থেকে কেটে পড়বে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।”তিরমিযী ৪০৫, হাদীস নং ২১৬৭, মুসতাদরাকে হাকিম ১/১১৬, হাদীস নং ৩৯৭, মিশকাত ৩০, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম সহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবে সতের জন সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে।

৩. শায়খ কামাল উদ্দীন ইবনুল হুমাম (রহ.) ‘ফাতহুল কদীর’ নামক গ্রন্থে বলেন, মুসলিম উম্মাহর নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্বদের ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, উক্ত চার মাযহাবের বাইরে আর কারও মতামত অনুযায়ী আমল করা চলবে না।

৪. আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) ‘ফাত্হুল মুবীন শরহে আরবাঈন’ নামক গ্রন্থে বলেন, আমাদের অনুসরণীয় ইমামগণ বলেছেন, এ যুগে ইমাম শাফিঈ (রহ.), ইমাম মালিক (রহ.), ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) ও ইমাম আযম আবূ হানীফা (রহ.) ব্যতীত অন্য কারো তাকলীদ বা অনুসরণ করা জায়িয নেই।

৫. আল্লাআ তাহতাভী (রহ.) ‘দুররে মুখতার’-এর পদটীকায় বলেন, যে ব্যক্তি উক্ত চার মাযহাব থেকে বের হয়ে যাবে, সে বিদ’আতপন্থী এবং জাহান্নামপন্থী। অতএব উপরোক্ত প্রামাণ্য ও সর্বজনমান্য ব্যক্তিত্বদের বক্তব্যসমূহের আলোকে বলা যায় যে, সাম্প্রতিক কালে কোন ব্যক্তির প্রমাণ চাওয়া যে, তাকলীদ শুধু চার মাযহাবেই সীমাদ্ধ থাকবে কেন? একেবারে অবান্তর।

৬, মোল্লা জীওয়ান (রহ.) “তাফসীরে আহমাদী” নামক গ্রন্থে লিখেছেন ন্যায় সঙ্গত কথা হচ্ছে, মাযহাবমূহের শুধু চারের মধ্যে সীমিত থাকা আল্লাহ তা’আলার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা এবং মেহেরবানী ব্যতীত আর কিছুই নয়। এতে বেশী যুক্তিতর্কে লিপ্ত হয়ে বা দলীল প্রমাণ তালাশ করে লাভ নেই।

একটি প্রশ্ন ও তার জবাব

এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম। তবে বলুন তো কোন আয়াতে বা কোন হাদীসে উক্ত চার ইমামের কথা বা তাদের মাযহাবের কথার উল্লেখ আছে? এটা তো একটা আজগুবী প্রশ্ন। কেননা, শরীয়তের বিধানাবলী কারো নামে বা নাম উল্লেখপূর্বক বর্ণিত হয়নি। নতুবা সম্মানিত পাঠক! আপনি বলুন তো কোন সুনির্দিষ্ট আয়াতে বা সুনির্দিষ্ট হাদীসে আপনার নাম উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছে যে, আপনার জন্য খানা-পিনা জায়িয? বা আপনার জন্য কাপড় পরা জায়িয? কোন সুনির্দিষ্ট আয়াতখানায় আপনার নাম উল্লেখপূর্বক বলা হয়েছে যে, আপনার জন্য ঘুমানো জায়িয এবং উঠা বসা সব জায়িয? যদি শরীয়তের বিধান প্রমাণ করার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে নাম উল্লেখও জরুরী সাব্যস্ত করা হয়। তবে এখন আর দুনিয়াতে কোন মানুষের উপর ফরয, ওয়াজিব, মাকরূহ ও হারাম বলতে কোন কিছুই থাকবে না। কোন আয়াতখানা এমন আপনি দেখাতে পারবেন, যেখানে আপনার নাম উল্লেখপূর্বক আপনার উপর নামায ফরয করা হয়েছে?

কারো নাম ঠিকানা কুরআন হাদীসের কোথায় পাওয়া যাবে? তবে হ্যাঁ, সাধারণভাবে ব্যাপক নির্দেশ বা বিধান যেমনিভাবে সবার জন্য হয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে মুজতাহিদ ইমামদের তাকলীদ বা অনুসরণের কথাও পবিত্র কুরআনে কারীমে বিদ্যমান রয়েছে। যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। فَاسْتَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ. “যা তাদের অজানা তা যারা জানেন তাদের থেকে জেনে নাও।

আর মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের প্রথম সারীর জ্ঞানী ও গুণী যে অনুসরণীয় ইমামগণ তাতে ওয়াকিফহাল মহলে কারো দ্বিমত নেই।

তথসূত্র:

তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ

মুফতি হিফজুর রহমান

প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *