ঈমান ভঙ্গের কারণসমূহ
১.ঈমান ভঙ্গ হওয়ার প্রথম কারণ ইসলাম ত্যাগ করা বা মুরতাদ হওয়া
ইসলাম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করা কিংবা কোনো ধর্মই না মানা। যেমন : খ্রিষ্টান বা ‘ঈসায়ী মুসলিম’ হওয়া, অদৃশ্য বস্তুকে না মানার কথা বলে আল্লাহকে বিশ্বাস না করা এবং প্রকৃতিবাদী বা নাস্তিক হওয়া ইত্যাদি।
ব্যাখ্যা
পরিভাষায় এটাকে ‘ইরতিদাদ’ বা ‘মুরতাদ’ হওয়া বলে। আর মুরতাদ দুই প্রকারের হয়ে থাকে : ১. যে নিজের ইরতিদাদ বা ইসলাম ত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে। ২. যে ইরতিদাদমূলক (তথা নিশ্চিত ঈমান নষ্ট ও ভঙ্গ হয় এমন) কোনো কুফর করার পরেও নিজেকে মুসলমান দাবি করে অথবা মুসলমানের বেশভূষা ধারণ করে। দ্বিতীয় প্রকারের মুরতাদকে মুনাফিক ও যিন্দীকও বলা হয়।
দ্বিতীয় প্রকারের ব্যাপারে মুফতী শফী রাহ. (মৃ. ১৩৯৬ হি.) বলেন, ‘এ প্রকারেও সর্বসম্মতভাবে মুরতাদ হয়ে যাবে, যদিও সে এই একটি বিধান ছাড়া ইসলামের অন্য সমস্ত বিধান দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে।
ইরতিদাদের এ দ্বিতীয় প্রকারে অধিকাংশ মুসলমান ভুল বুঝে থাকে।
২.ঈমান ভঙ্গ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ শিরক করা।
আর শিরক সাধারণত দুই বিষয়ের মধ্যে হয়ে থাকে :
১. শিরক ফিল ইবাদাহ বা উলুহিয়্যাহ : তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের উপযুক্ত মনে করে তার ইবাদত করা কিংবা আল্লাহর সাথে অন্য কারও ইবাদত করা। যেমন : আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে (কোনো ওলী বা মাজারকে) ইবাদতের সিজদা করা বা কারও জন্য নামাজ পড়া, গায়রুল্লাহর নামে মান্নত করা, সাদকা দেওয়া, কুরবানী করা ইত্যাদি।
২. শিরক ফির রুবুবিয়্যাহ : তথা এমন কোনো বিশ্বাস পোষণ করা বা কাজ করা, যা তাওহীদ-পরিপন্থী। যেমন : আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরীক করা, আল্লাহ ছাড়া কাউকে রিযিকদাতা, সন্তানদাতা ইত্যাদি মনে করা।
আল্লামা সা’দুদ্দীন তাফতাযানী রাহ. (মৃ. ৭৯২ হি.) লেখেন, “শিরক হলো প্রভুত্বের মধ্যে কাউকে শরীক করা, অর্থাৎ অগ্নিপূজকদের মতো অন্য কিছুকে প্রভু মনে করা। অথবা মূর্তিপূজকদের মতো অন্য কাউকে ইবাদতের উপযুক্ত মনে করা।
আল্লাহ তাআলার ইরশাদ,‘যারা বলে, মারয়ামের পুত্র মাসীহই আল্লাহ, নিশ্চয়ই তারা কাফের হয়ে গেছে। অথচ মাসীহ বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল! আল্লাহর ইবাদত করো, যিনি আমারও প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে (কাউকে) শরীক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন। তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর জালেমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।”(সূরা মায়েদা, আয়াত :৭২)
৩.ঈমান ভঙ্গের তৃতীয় কারণ কোনো পীর-ওলী বা মাজারকে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী বা লাভ-ক্ষতির মালিক মনে করে সাহায্য চাওয়া, সন্তান চাওয়া, ধন-সম্পদ চাওয়া, সমস্যার সমাধান চাওয়া।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,‘আল্লাহ ব্যতীত এমন কাউকে ডাকবে না, যা তোমার কোনো উপকারও করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না। তারপরও যদি তুমি এরূপ করো, তবে তুমি জালেমদের মধ্যে গণ্য হবে। (সূরা ইউনুস, আয়াত :১০)
ইবাদত যেমন একমাত্র তাঁরই করা হবে, সাহায্যের জন্যও তাঁকেই ডাকতে হবে। কেননা, সর্বপ্রকার লাভ-ক্ষতি ও মঙ্গল-অমঙ্গল এককভাবে তাঁরই মুঠিতে রয়েছে।মুশরিকদের ন্যায় এমন সব জিনিসকে সাহায্যের জন্য ডাকা—যারা কোনো লাভ লোকসানের মালিক নয়—অত্যন্ত গর্হিত বিষয়, বরং চরম অন্যায় (অর্থাৎ শিরক)- এর একটি শাখা।
৪.ঈমান ভঙ্গের চতুর্থ কারণ ইসলামে অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়গুলোর কোনো একটিতে সন্দেহ বা সংশয় পোষণ করা বা অজ্ঞেয়বাদী হওয়া। কেননা, সংশয়-সন্দেহ ও ঈমান একসাথে হতে পারেনা; বরং এটা মুনাফিকের কাজ।
আল্লামা ইবনে হাজার হাইতামী রাহ (মৃ. ৯৭৪ হি.) বলেন, ‘জেনে রাখো, জরুরিয়াতে দ্বীন তথা দ্বীনের সর্বজনবিদিত বিধানের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া তা অস্বীকারের মতো।
৫.ঈমান ভঙ্গের পঞ্চম কারণ কুফর করা। যেমন :
১. অকাট্যভাবে প্রমাণিত ইসলামের বিষয়গুলোর কোনো একটিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, অবিশ্বাস করা, অস্বীকার করা।
২. অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয় ও বিধানাবলির কোনো একটিকে অবজ্ঞা করা, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা এবং ইসলামের শিআর তথা প্রতীকসমূহের অবমাননা করা।
ইসলামের মৌলিক শিআর হলো কুরআন মাজীদ, বিভিন্ন ইবাদত, যথা : আজান, নামাজ, রোযা, হজ-যাকাত, দুআ-দরূদ; বিভিন্ন ফযীলতপূর্ণ স্থান, যথা : কাবা শরীফ, মসজিদে নববী, মসজিদে আকসা ও পৃথিবীর সকল মসজিদ ইত্যাদি— এগুলোর অবমাননা, যেমন : কুরআন মাজীদকে আবর্জনায় ছুড়ে ফেলা, মসজিদকে গোয়ালঘর বলা।
এভাবে অকাট্যভাবে প্রমাণিত ইসলামের কোনো বিধান, নবীজীর কোনো সুন্নাত, এমনকি অকাট্যভাবে প্রমাণিত কোনো মুস্তাহাব আমল ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার করা অথবা অবজ্ঞা-প্রকাশক কোনো আচরণ করা। যেমন : কুকুরের মাথায় টুপি পরানো, ধর্মপালনকারীর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির জন্য দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে দিয়ে নাটক-সিনেমা বা কৌতুক বানানো, হাতে তাসবীহওয়ালা ব্যক্তিকে ক্রিমিনাল সাজানো, আজানের ধ্বনিকে বেশ্যার আওয়াজ বলা, পর্দাকে হেয় করে বোরকাকে ট্যাবু ইত্যাদি বলা।
৬.ঈমান ভঙ্গের ষষ্ঠ কারণ আল্লাহ ও রাসূলের অবমাননা বা কটূক্তি করা।
যেমন : নবীজীকে যুদ্ধবাজ বা নারীলোভী বলা, অবমাননার উদ্দেশ্যে তাঁর ছবি আঁকা বা নামের অবমাননা করা ইত্যাদি।
ইমাম ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. (মৃ. ২৩৮ হি.) বলেন, ‘কেউ যদি আল্লাহ তাআলা বা তাঁর রাসূলকে গালিগালাজ করে, অথবা আল্লাহর নাযিলকৃত কোনো বিষয় প্রত্যাখ্যান করে, কিংবা কোনো নবীকে হত্যা করে, তাহলে সে মুসলমানদের নিকট সর্বসম্মতভাবে কাফের। যদিও সে আল্লাহর নাযিলকৃত প্রতিটি বিষয়ের স্বীকারোক্তি প্রদান করে।’
৭.ঈমান ভঙ্গের সপ্তম কারণ ইসলামের অকাট্য কোনো বিধানের ওপর আপত্তি তোলা বা যুগের সাথে অনুপযোগী মনে করা কিংবা সংস্কারযোগ্য বলে মনে করা।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,‘রাসূল তার ওপর তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও।… এবং তারা বলে, আমরা (আল্লাহ ও রাসূলের বিধানসমূহ মনোযোগ সহকারে) শুনেছি এবং তা (খুশিমনে) কবুল বা পালন করছি। (সূরা বাকারা, আয়াত :২৮৫)
অন্যত্র এসেছে, ‘আমরা আল্লাহ এবং যে সত্য (ইসলামের বিধানাবলি) আমাদের প্রতি আগত হয়েছে, তাতে কেন ঈমান আনব না? অথচ আমরা প্রত্যাশা করি, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করবেন। (সূরা মায়েদা, আয়াত :৮৪)
ইসলামের বিধানাবলির প্রতি ঈমান আনার অনিবার্য অর্থ হচ্ছে, মুসলিম হওয়া তথা নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা। আল্লাহর প্রতি ঈমান আর আল্লাহর বিধানে আপত্তি একত্র হতে পারে না। রাসূলের প্রতি ঈমান আর তাঁর আদর্শের ওপর আপত্তি, কুরআনের প্রতি ঈমান আর তার কোনো আয়াত বা বিধানের ওপর আপত্তি কখনো একত্রিত হয় না।
৮.ঈমান ভঙ্গের অষ্টম কারণ সুনিশ্চিত প্রমাণিত ইসলামের কোনো বিধান বা রাসূলের সুন্নাহকে শরীয়তের বিধান হিসেবে অপছন্দ করা।
ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা কাফের তাদের জন্য আছে ধ্বংস। এবং আল্লাহ তাদের কর্ম ব্যর্থ করে দিয়েছেন। তা এই জন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তারা তা অপছন্দ করেছিল। সুতরাং আল্লাহ তাদের কর্ম নিষ্ফল করে দিয়েছেন।(সূরা মুহাম্মদ, আয়াত :৮-৯)
উল্লেখ্য, দ্বীনের কোনো বিষয়কে শরীয়তের বিধান হিসেবে অপছন্দ করে না; বরং অপছন্দ করে স্বভাবগত কারণে বা ঝামেলা-বিরক্তি, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি কারণে, যেমন : ঠান্ডা পানির কারণে শীতের রাতে ওযু করতে অপছন্দ করা, ভালোবাসা কমে যাবে বলে স্বামীর একাধিক বিবাহ অপছন্দ করা, তাহলে এটা কুফর নয়।
সুতরাং কারও স্ত্রী বহুবিবাহের শরয়ী বিধানকে অপছন্দ ও ঘৃণা করলে কাফের হয়ে যাবে। তবে স্ত্রী শরয়ী বিধানকে অপছন্দ করে না; বরং তার স্বামীর অন্য মহিলাকে বিয়ে করাটা অপছন্দ করে, তাহলে ঈমান ভঙ্গ হবে না।
৯.ঈমান ভঙ্গের নবম কারণ অকাট্যভাবে প্রমাণিত কিছু বিধান মানা, আর কিছু না মানা।
অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়গুলোর কিছু মানা আর কিছু না মানা কুফর। এগুলোর কিছু মেনে আর কিছু না মেনে কুফর ও ঈমানের মাঝামাঝি কোনো পথ অবলম্বন করার সুযোগ নেই।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কতকের (রাসূলগণের থেকে) ওপর ঈমান রাখি ও কতককে অস্বীকার করি। আর (এভাবে) তারা (কুফর ও ঈমানের মাঝখানে) মাঝামাঝি কোনো পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই কাফের। আর আমি কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি।'(সূরা নিসা, আয়াত :১৫০-১৫১)
আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের সেই মাঝামাঝি পন্থা হলো, আল্লাহকে বিশ্বাস করা, কিন্তু রাসূলকে অবিশ্বাস করা। অথবা রাসূলদের কাউকে মান্য করা আর কাউকে অমান্য করা।
১০.ঈমান ভঙ্গের দশম কারণ অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিধানাবলির সুনির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত অর্থ-ব্যাখ্যা ও রূপ-পদ্ধতির বিপরীত ভিন্ন ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা করা।
এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা ওপরে ঈমানের আলোচনায় হয়েছে। তবে এখানে একটা তথ্য যোগ করছি—
শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. (মৃ. ১১৭৬ হি.) বলেন, ‘ইসলামের বিরোধী ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যে-গোপনে কোনোভাবেই ইসলাম মেনে না নেয় এবং স্বীকার না করে, তাহলে সে কাফের। তবে যদি অন্তরে কুফর রেখে মুখে ইসলাম স্বীকার করে, তাহলে সে মুনাফিক।
আর যদি প্রকাশ্যে-গোপনে ইসলাম স্বীকার করে, কিন্তু দ্বীনের যে সকল বিষয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত, সেগুলোর মধ্য থেকে কোনো বিধানের এমন ব্যাখ্যা করে, যা সাহাবা, তাবেয়ীন ও উম্মাহর সর্বসম্মত ব্যাখ্যার বিপরীত, তাহলে সে যিন্দীক। যেমন কেউ স্বীকার করল, জান্নাত-জাহান্নাম সত্য; কিন্তু জান্নাত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সেই: প্রফুল্লতা, যা প্রশংসিত গুণাবলি থেকে সৃষ্ট হয় এবং জাহান্নাম দ্বারা উদ্দেশ্য সেই অনুশোচনা, যা নিন্দিত গুণাবলি থেকে অস্তিত্ব লাভ করে, বাস্তবে জান্নাত-জাহান্নাম বলতে কিছু নেই। তাহলে এমন ব্যক্তি যিন্দীক।’
১১.ঈমান ভঙ্গের এগারোতম কারণ অকাট্যভাবে প্রমাণিত কোনো হারামকে হারাম মনে না করা তথা বৈধ মনে করা অথবা হালালকে হারাম মনে করা।
যেমন : সুদ-ঘুষ, জুলুম-দুর্নীতি, মদ-মাদকদ্রব্য, গান- বাদ্য, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, লিভ-টুগেদার, সমকামিতা, ট্রান্সজেন্ডারবাদ (রূপায়নকামিতা) ও প্রাণী/মানবভাস্কর্য ইত্যাদিকে হারাম জানা সত্ত্বেও হালাল-বৈধ মনে করা অথবা পুরুষের জন্য একাধিক বিবাহ বা বিধবা মহিলার বিবাহকে হালাল- বৈধ জানার পরও হারাম মনে করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন,“কিতাবীদের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং পরকালেও নয়, এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তাকে হারাম মনে করে না আর সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন বলে স্বীকার করে না, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা হেয় হয়ে নিজ হাতে জিযিয়া আদায় করে।
আরও ইরশাদ হয়েছে, “তোমাদের মুখ থেকে সাধারণত যেসব মিথ্যা বের হয়ে আসে তেমনই করে বোলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম। কেননা, এর অর্থ হবে তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ।
১২.ঈমান ভঙ্গের বারোতম কারণ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম-মতবাদকে সত্য-সঠিক মনে করা বা পরকালে মুক্তি পাবে বিশ্বাস করা। অথবা ইসলামের চেয়ে অন্য কোনো জীবনব্যবস্থা ও সংবিধানকে উত্তম বা সমতুল্য মনে করা কিংবা মুসলমানদের জন্য কল্যাণকর মনে করা এবং ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা বিশ্বাস না করা।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম-দ্বীন অবলম্বন করবে, তা কস্মিনকালেও গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
এ আয়াত বলছে, ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো ধর্ম-মতবাদকে সত্য-সঠিক মনে করা যাবে না কিংবা পরকালে মুক্তি পাবে বিশ্বাস করা যাবে না। কাজেই যে এরূপ বিশ্বাস করল, সে এ আয়াত অস্বীকার করল। আর যে কোনো আয়াত অস্বীকার করবে, সে নিশ্চিত কাফের হয়ে যাবে।
১৩.ঈমান ভঙ্গের তেরোতম কারণ সুনিশ্চিত কাফেরকে কাফের মনে না করা বা কুফরের ওপর সন্তুষ্ট হওয়া।
ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী (যেমন : হিন্দু ও ইহুদী-খ্রিষ্টান) বা মুসলিম নামধারী সুনিশ্চিত কাফেরকে (যেমন : কাদিয়ানী ও হিজবুত তাওহীদ ইত্যাদি দলের কুফরী বিশ্বাস জানার পরও) কাফের মনে না করলে নিজের ঈমান চলে যাবে,কাফের হয়ে যাবে। কেননা, ‘ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম’ এই বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি ইসলামের বিপরীত কুফর-শিরকমিশ্রিত সব ধর্ম, মতবাদ ও আদর্শকে অস্বীকার করে মুমিন হতে হয়।
১৪.ঈমান ভঙ্গের চৌদ্দতম কারণ ইবাদতের ক্ষেত্রে বা আকীদার ক্ষেত্রে বিধর্মীদের অনুকরণ ও সাদৃশ্য গ্রহণ করা। কথা বা কাজে তাদের ধর্মীয় প্রতীক ও সংস্কৃতির প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ করা।
কাফেরদের অনুকরণ ও সাদৃশ্য গ্রহণের প্রকার ও বিধান
১. ইবাদতের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য গ্রহণ করা কুফর। অর্থাৎ যে উপাসনা বা ইবাদতগুলো কাফেররা করে থাকে, এতে সাদৃশ্য গ্রহণ করলে কাফের হয়ে যাবে। যেমন : মূর্তিকে সিজদা করা ইত্যাদি।
২. অনুরূপ আকীদার ক্ষেত্রে সাদৃশ্য গ্রহণ করা কুফর। অর্থাৎ যে সকল প্রতীক, সংস্কৃতি বা বিশেষ চিহ্ন কাফের, মুশরিক, হিন্দু, ইহুদী, খ্রিষ্টান বা অন্য কোনো অমুসলিমের আকীদার প্রমাণ বহন করে, এ ক্ষেত্রে তাদের অনুকরণ ও সাদৃশ্য গ্রহণ করা কুফর। এমন সাদৃশ্য গ্রহণ করলে কাফের সাব্যস্ত হবে। যেমন : খ্রিষ্টানদের ন্যায় গলায় ও বুকে ক্রুশ ঝোলানো বা ঘর-অফিসে ক্রুশ রাখা এবং হিন্দুদের মতো পৈতা লাগানো। কেননা, কাফেরদের ইবাদত বা কুফরী প্রতীক, সংস্কৃতি বা ধর্মীয় বিশেষ চিহ্ন গ্রহণ করা আন্তরিক সমর্থনের নিদর্শন।
৩. কাফেরদের ধর্মীয় প্রথার অনুকরণ হারাম। অর্থাৎ কিছু বিষয় আছে ধৰ্মীয় প্রথা, সরাসরি তাদের ইবাদত বা আকীদার প্রতীক না। এগুলোর মধ্যে সাদৃশ্য গ্রহণ করাও হারাম। যেমন : হিন্দু মেয়েদের মতো মাথায় সিঁদুর দেওয়া, কপালে টিপ দেওয়া বা হাতে শাঁখা পরা। এগুলো তাদের ধর্মীয় প্রথা। তাই এ ধরনের অনুকরণ হারাম।
কোনো মুসলিম নারী এটা গ্রহণ করতে পারে না। এভাবে বৌদ্ধরা গেরুয়া বসন পরে, এটা তাদের ধর্মীয় সাজ। সান্তাক্লজ খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় সাজ। কোনো মুসলমান এ সাজ নিতে পারে না। এটা হারাম। ধর্মীয় প্রথার ক্ষেত্রে অমুসলমানের সাদৃশ্য গ্রহণ করা হারাম।
৪. জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও অভ্যাস এবং সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনুকরণ মাকরূহে তাহরীমী। অর্থাৎ কিছু বিষয় আছে, যা মূলত ধর্মীয় না; বরং তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য, জাতিগত প্রথা। জাতি হিসেবে করে, ধর্মীয় হিসেবে না। ওই সমস্ত বিষয়ে তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা মাকরূহে তাহরীমী তথা হারামের কাছাকাছি।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের নিজস্ব পোশাক, যা তারা ব্যবহার করে থাকে। আর এসবের ব্যবহারকারীকে সেই সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মনে করা হয়। যেমন : হিন্দুরা ধুতি পরে। এটা তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। জাতি হিসেবে তারা এটা পরে। কোনো মুসলমান এই ধুতি পরতে পারে না। এসব নাজায়েয ও নিষিদ্ধ। এগুলো ব্যবহার করাকে বিজাতীয় অনুকরণ হিসেবে শামিল করা হয়।
১৫.ঈমান ভঙ্গের পনেরোতম কারণ কুরআনকে বিকৃত বা অরক্ষিত মনে করা। পুরো কুরআন হোক বা আংশিক হোক।
ইরশাদ হয়েছে, ‘বস্তুত এ উপদেশবাণী (কুরআন) আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। যদিও কুরআন মাজীদের আগে বহু আসমানী কিতাব নাযিল করা হয়েছিল, কিন্তু তা ছিল বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য এবং নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। তাই আল্লাহ তাআলা সেগুলো কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করার গ্যারান্টি দেননি। সেগুলো হেফাজত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের ওপরই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, যেমন সূরা মায়েদায় ( ৫ :৪৪ ) বলা হয়েছে।
কিন্তু কুরআন মাজীদ সর্বশেষ আসমানী কিতাব। কিয়ামতকাল পর্যন্ত এর কার্যকারিতা বলবৎ থাকবে। তাই এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলা এর সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত এর ভেতর কোনো রদবদলের সম্ভাবনা নেই।
১৬.ঈমান ভঙ্গের ষোলোতম কারণ শুধু কুরআন মানা, হাদীস-সুন্নাহ তথা নবীজীর বক্তব্য, কর্ম ও সমর্থন না মানা।
আর এ না মানাটা কয়েকভাবে হতে পারে :
১. হাদীস-সুন্নাহকে শরীয়তের আলাদা উৎস না মানা বা দ্বিতীয় প্রধান দলীল মনে না করা। তা এ কারণে যে, কুরআন মানলেই হাদীস মানা হয়ে যায় মনে করা!
২. হাদীসকে দলীল হিসেবে মানা। তবে সব হাদীসকে নয়; বরং হাদীসকে শরীয়তের আলাদা দলীল হিসেবে না মানার কারণে যেই হাদীস কুরআনের সাথে মিল থাকবে তা নানা; আর যে হাদীসে অতিরিক্ত বিধান থাকবে, তা না মানা। অর্থাৎ সব বিষয়ে কুরআনের রেফারেন্স চাওয়া।
৩. হাদীসকে ঐতিহাসিক রেকর্ড হিসেবে মানা, কিন্তু বিধান শুধু কুরআন থেকে নেওয়া, বিধান হবে শুধু আল্লাহর মনে করা।
৪. রাসূলের আনুগত্যকে তাঁর জীবদ্দশায় প্রযোজ্য মনে করা।
৫. হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা। তবে কোন হাদীস প্রমাণিত আর কোনটা অপ্রমাণিত এ ক্ষেত্রে মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদগণের সর্বসম্মত উসূল অনুসরণ না করে বরং কমনসেন্স, বিজ্ঞান, প্রচলিত বা ধারণাপ্রসূত ভদ্রতা ও সামাজিকতার সাথে সাংঘর্ষিক কি না তা দেখা। ফলে হাদীসের সংকলনগুলো সামগ্রিকভাবে অগ্রহণযোগ্য মনে করা।
৬. মুতাওয়াতির ছাড়া না মানা। কারণ, খবরে ওয়াহিদগুলো যন বা ধারণামাত্র।শেষটা ব্যতীত সবগুলো কুফর।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,'(হে নবী!) আপনার রবের কসম! তারা মুমিন হবে না, যতক্ষণ না নিজেদের ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে আপনাকে বিচারক বানাবে, অতঃপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো দ্বিধা থাকবে না এবং তা সচিতে মেনে নেবে।
১৭.ঈমান ভঙ্গের সতেরোতম কারণ সশস্ত্র জিহাদের বিধান অস্বীকার করা কিংবা রাসূলের যুগে জিহাদ থাকলেও এখন আর জিহাদের বিধান নেই মনে করা অথবা কুরআন-হাদীসে বর্ণিত জিহাদকে জঙ্গীবাদ, বর্বরতা, মারামারি, উগ্রতা ও সন্ত্রাস ইত্যাদি বলা
বলাবাহুল্য, জিহাদের উদ্দেশ্য কাউকে হত্যা করা বা ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা নয়; বরং সন্ত্রাস দমন করা এবং দুনিয়াতে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আইন-কানুন মেনে নিতে বাধ্য করা।
এ জন্যই তো কোনো কাফের ইসলামী রাষ্ট্রে থাকতে চাইলে সামান্য জিযিয়া দিয়ে থাকতে পারে। আর জিহাদের উদ্দেশ্য যদি কাউকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হতো, তাহলে কাফেরদের নারী, বৃদ্ধ ও অক্ষম ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও জিহাদের বিধান থাকত। অথচ এদের বিরুদ্ধে জিহাদের বিধান নেই।
১৮.ঈমান ভঙ্গের আঠারোতম কারণ ইসলামী দণ্ডবিধি অস্বীকার করা, বর্বরতা বলা বা ঘৃণা করা।
ইসলামী দণ্ডবিধির মৌলিক প্রকার ও পরিচিতি । ইসলামী দণ্ডবিধির মৌলিকভাবে তিনটি ধারা রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের কোর্টে যাবতীয় বিচার ও দণ্ড এই তিনটি ধারার অধীনে করা হয় : ১. কিসাস। ২. হদ। ৩. তা’যীর।
১৯.ঈমান ভঙ্গের উনিশতম কারণ আল্লাহ তাআলাকে দেহ ও শরীরবিশিষ্ট বা মাখলুকের মতো দেহ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওআকার-আকৃতিবিশিষ্ট মনে করা।
‘কেউ যদি জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো কিছু অস্বীকার করে, তাহলে কাফের হয়ে যাবে। যেমন : আল্লাহ তাআলাকে দেহসমূহের মতো দেহবিশিষ্ট বলা।
‘‘ফাতাওয়া শামী’তে আরও ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে,:‘এভাবে কেউ যদি আল্লাহ তাআলাকে (দেহসমূহের মতো না বলে, বরং শুধু)দেহবিশিষ্ট বলে, তাও কাফের হয়ে যাবে।
‘মুহাক্কিক ইবনুল হুমাম রাহ. ‘খুলাসা’ গ্রন্থ থেকে নকল করে বলেন,.‘সাদৃশ্যবাদী যদি বলে, আল্লাহ তাআলার হাত ও পা আছে বান্দার মতো, তাহলে সে অভিশপ্ত কাফের। আর যদি বলে, আল্লাহ তাআলা দেহবিশিষ্ট, তবে অন্যদেহসমূহের মতো নয়, তাহলে সে বিদআতী ।
সারকথা : ‘দুইভাবে বললে কাফের হয়ে যাবে : ১. আল্লাহ তাআলাকে দেহসমূহেরমতো দেহবিশিষ্ট বলা, ২. তাঁকে শুধু দেহবিশিষ্ট বলা।আর যদি বলে, আল্লাহ তাআলা দেহবিশিষ্ট, তবে অন্য দেহসমূহের মতো নয়,তাহলে সে বিদআতী।’
২০.ঈমান ভঙ্গের বিশতম কারণ আল্লাহ তাআলাকে কোনো স্থানে বা আসমানে কিংবা আরশে অবস্থানকারী মনে করা।
ফকীহ ইবনে নুজাইম মিসরী রাহ. (মৃ. ৯৭০ হি.) বলেন, আল্লাহর জন্য স্থান সাব্যস্ত করার দ্বারা কাফের হয়ে যাবে। অবশ্য কেউ যদি বলে,“আল্লাহ আসমানে” কথা দ্বারা সে কুরআন-হাদীসের বাহ্যিক বর্ণনাকে উদ্বৃত করতে চায়, তাহলে সে কাফের হবে না।
তবে যদি সে (আল্লাহ তাআলা) স্থানে আছেন বলে উদ্দেশ্য নেয়, তাহলে সে কাফেরহয়ে যাবে। এমনকি তার যদি কোনোরূপ নিয়তই না থাকে, তাহলেও অধিকাংশেরদৃষ্টিতে সে কাফের হয়ে যাবে। এটাই সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত এবং এর ওপরই ফতোয়া।
২১.ঈমান ভঙ্গের একুশতম কারণ আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কাউকে বা নবীকে ‘আলেমুল গায়ব’ বা সরাসরি গায়ব জানেন’ বিশ্বাস করা অথবা ‘হাযির-নাযির’ মনে করা।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘বলুন, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া কেউ গায়ব জানে না।’
উল্লেখ্য, আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা করেন, ওহীর মাধ্যমে বিভিন্ন গায়বী বিষয় সম্পর্কে অবহিত করেন।
আর গায়বী খবরাখবর সর্বাপেক্ষা বেশি জানানো হয়েছিল আমাদের মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও গায়বের যাবতীয় বিষয় সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন না। সরাসরি গায়বী জ্ঞান কেবল আল্লাহ তাআলারই আছে। সুতরাং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে ‘গায়ব জানেন’ বা ‘আলেমুল গায়ব’ বলা যায় না।
২২.ঈমান ভঙ্গের বাইশতম কারণ খতমে নবুওয়াত তথা আমাদের নবীকে শেষ নবী না মানা।
কেননা, তাঁর পর কোনো প্রকারের কোনো ধরনের কোনো রকমের নতুন নবীর আগমন হবে না বা জন্মগ্রহণ করবেন না। ইরশাদ হয়েছে, ‘মুহাম্মাদ তোমাদের কোনো সাবালক পুরুষের পিতা নন, তবে তিনি আল্লাহর রাসূল এবং সর্বশেষ নবী।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘অন্যান্য নবী থেকে আমাকে ছয়টি বিষয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা হয়েছে। (তন্মধ্যে পাঁচ ও ছয় নম্বর হলো,) আমি সকল মাখলুকের প্রতি প্রেরিত হয়েছি এবং আমার দ্বারা নবীদের আগমন সমাপ্ত করা হয়েছে।’
অন্য হাদীসে ইরশাদ করেছেন, ‘রিসালত ও নবুওয়াতের ধারাবাহিকতা সমাপ্ত হয়ে গেছে। আমার পরে কোনো রাসূল নেই এবং কোনো নবীও নেই।
২৩.ঈমান ভঙ্গের তেইশতম কারণ ঈসা আলাইহিস সালামের জীবিত থাকা ও অবতরণ অস্বীকার করা।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর গুরুত্বপূর্ণ একটি আকীদা হলো, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার বড় আলামত হিসেবে কানা দাজ্জাল বের হলে তাকে কতল করার জন্য হযরত ঈসা আ. আসমান থেকে অবতরণ করবেন। কুরআন মাজীদের অনেক আয়াত ও ১১৬টি হাদীস দ্বারা ঈসা আলাইহিস সালামের জীবিত থাকা ও কিয়ামতের পূর্বে আসমান থেকে অবতরণ করাটা প্রমাণিত এবং এ বিষয়ে সকলের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু মির্যা কাদিয়ানী বলেছে, ‘ঈসা মৃত্যুবরণ করেছেন; তিনি আর আসবেন না এবং আমিই হলাম ঈসা।’ সে আরও বলেছে, ‘ঈসা মরেনি বলা বড় ধরনের শিরক।”
সুতরাং মির্যা কাদিয়ানী ও তার অনুসারীসহ যে কেউ ইসলামের এ অকাট্য আকীদা জানার পরও অস্বীকার করবে, সে কাফের হয়ে যাবে।
২৪.ঈমান ভঙ্গের চব্বিশতম কারণ সেকুলার হওয়া বা সেকুলারিজমে বিশ্বাসী হওয়া।
সেকুলারিজম মতবাদে একজন ব্যক্তিকে সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র, বিচার, শিক্ষা, অর্থ ও সংস্কৃতি প্রভৃতিতে ধর্মের ঊর্ধ্বে মনে করা হয় বা এগুলোতে ধর্মের বিধান নেই মনে করা হয়, যা নিঃসন্দেহে কুফর।
সুতরাং কোনো মুসলিম সেকুলার তথা সেকুলারিজমে বিশ্বাসী হতে পারে না এবং কোনো সেকুলার মুসলিম থাকতে পারে না।
সেকুলারিজম কী ও কেন ? সেকুলারিজমের তিনটি বাংলা অনুবাদ হতে পারে। যথা : ১. ইহজাগতিকতাবাদ। ২. ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। ৩. ধর্মহীনতা বা ধর্মহীন মতবাদ।
২৫.ঈমান ভঙ্গের পঁচিশতম কারণ লিবারেলিজমে বিশ্বাসী হওয়া বা লিবারেল তথা উদার হওয়া।
লিবারেলিজম শব্দের অর্থ হলো উদারনীতিবাদ। The voice of freedom of life. একটি স্বাধীন জীবনের কণ্ঠস্বর। যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার চিন্তা-চেতনাকে বিকাশ করতে পারে এবং বাধাহীন চলার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। ব্যক্তির অবাধ স্বাধীনতা প্রদান করাই হলো লিবারেলিজম উদারনীতিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য।
লিবারেলদের সাথে নামাজ-রোযার মতো ইবাদত নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই; বরং এগুলো পালন করেও কেউ লিবারেল হতে পারে। লিবারেলিজমের সাথে ইসলামের মৌলিক একটা দ্বন্দ্ব হলো, নৈতিকতা ও অধিকারের মানদণ্ড নিয়ে। লিবারেলিজমে এগুলোর মানদণ্ড হলো, মানুষের চাহিদা ও প্রবৃত্তি। লিবারেলরা মনে করে, কোনো ব্যক্তি অন্য কারও বেঁধে দেওয়া মানদণ্ড মানতে বাধ্য নয়। এখন সেই মানদণ্ড যে কেউ দিক না কেন কিংবা আল্লাহরই দেওয়া হোক না কেন। এটাকে বলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। ব্যক্তি নিজেই নিজের প্রভু। তার চাহিদা ও প্রবৃত্তিই তার প্রভু।
অথচ ইসলামে ব্যক্তির অবস্থান হলো, আবদিয়্যাত-দাসত্বের ও ইতাআত -আনুগত্যের; ব্যক্তিস্বাধীনতার না, প্রবৃত্তি অনুসরণের না।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ঈমান – আকিদা ১
লেখকঃ মাওলানা সাঈদ আহমদ উস্তাদঃ দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম