ইসলাম

জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও আশ্রয় প্রার্থনা

কুরআন ও হাদীসের বহু স্থানে উল্লিখিত হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে ক্রন্দন করার দ্বারা জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। জাহান্নামের ভয়ে কাঁদাও আল্লাহ্ ভয়ে কাঁদার অন্তর্ভুক্ত। কারণ, এ কাঁদাও আল্লাহ্র শাস্তি ও আযাবের ভয়ে হয়ে থাকে। এই ক্রন্দন আল্লাহ্ তা’আলা, তাঁর নৈকট্য, তাঁর মায়া-দয়া এবং জান্নাত থেকে দূরে চলে যাওয়ার ভয়ে হয়ে থাকে। নিম্নে এতদসংক্রান্ত কতিপয় হাদীস উল্লেখ করা হল ।

হাদীস ঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান— لَا يَلِجُ النَّارَ رَجُلُ بَكَى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ حَتَّى يَعُوْدَ اللَّبَنُ فِي الضَّرْعِ – ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে ক্রন্দন করল, তার জাহান্নামে প্রবেশ করা ঐরূপ কঠিন ব্যাপার, যেমন স্তন থেকে দুধ বের হয়ে যাওয়ার পর আবার তাতে প্রবেশ করানো কঠিন। —নাসায়ী, তিরমিযী

হাদীস : হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, তিনি এরশাদ ফরমান—

عَيْنَانِ لَا تَمَسُّهُمَا النَّارُ عَيْنُ بَكَتْ فِي جَوْفِ اللَّيْلِ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ وَ عَيْنٍ بَاتَتْ تَحْرُسُ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ –

জাহান্নামের আগুন ঐ দুই চক্ষুকে স্পর্শ করবে না, যে চক্ষুদ্বয় রাতে আল্লাহর ভয়ে কান্নাকাটি করেছে এবং যে চক্ষুদ্বয় আল্লাহর রাহে পাহারা দিতে গিয়ে রাত্রি জাগরণ করেছে। —তিরমিযী

হাদীস : হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান— عَيْنٍ حُرِّمَتِ النَّارُ عَلَى عَيْنٍ سَهَرَتْ بِكِتَابِ اللَّهِ وَ حُرِّمَتِ النَّارُ عَلَى دَمَعَتْ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ وَ حُرِّمَتِ النَّارُ عَلَى عَيْنِ غَضَتْ عَنْ مَحَارِمِ اللَّهِ أَوْ فَقَتَتْ فِي سَبيل الله

ঐ চোখের উপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যায়, যে চক্ষুদ্বয় রাত জেগে কুরআন তেলাওয়াত করে। ঐ চোখের উপর জাহান্নাম হারাম যে চক্ষুদ্বয় আল্লাহ্ ভয়ে অশ্রু প্রবাহিত করে। ঐ চোখের উপর জাহান্নাম হারাম, যে চক্ষুদ্বয় নিষিদ্ধ বস্তু দেখা থেকে বিরত থাকে অথবা যে চক্ষু আল্লাহ্র রাহে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।—জাওয়াজানী

হাদীস : হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান— مَا مِنْ عَبْدٍ مُؤْمِنٍ يَخْرُجُ مِنْ عَيْنَيْهِ دُمُوعُ وَ لَوْ كَانَ مِثْلَ رَأْسِ الدُّبَابِ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ ثُمَّ تُصِيبُ شَيْئًا مِنْ حَرّ وَجْهِهِ إِلَّا حَرَّمَهُ اللهُ عَلَى النَّارِ

যে কোন মু’মিন বান্দার চোখ থেকে আল্লাহ্র ভয়ে এক ফোটা অশ্রু বের হয়, চাই তা মাছির মাথার সমানই হোক না কেন এবং তা গাল বেয়ে প্রবাহিত হয়, আল্লাহ্ তা’আলা তাকে জাহান্নামের উপর হারাম করে দেন।

হাদীস ঃ হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রাযিঃ) বলেন, এক লোক আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি জাহান্নাম থেকে কিভাবে মুক্তি পাব? উত্তরে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান—

بِدُمُوعِ عَيْنَيْكَ فَإِنَّ عَيْنًا بَكَتْ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ لَاتَمَسُّهَا النَّارُ أَبَدًا –

তোমার চক্ষুদ্বয়ের অশ্রু দ্বারা । কারণ, তোমার যে চোখ আল্লাহ্ তা’আলার ভয়ে কাঁদে, তাকে জাহান্নামের আগুন কখনও স্পর্শ করতে পারে না ।

অশ্রুর মূল্য

হাদীস ঃ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান-

مَا أَغَرَّ وَ رَقَّتْ عَيْنَا عَبْدٍ بِمَابِهَا مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ إِلَّا حَرَّمَ اللَّهُ جَسَدَهَا عَلَى النَّارِ فَإِنْ فَاضَتْ عَلَى خَدَم لَمْ يَرْهَقُ وَجْهَهُ فَتَرُ وَ لَا ذِلَّهُ وَ لَوْ أَنَّ عَبْدًا بَكَى فِي أُمَّتِهِ مِنَ الْأُمَمِ لَاَنْجَى اللَّهُ عَزَّوَجَلَّ بِبُكَاءِ ذَلِكَ الْعَبْدِ تِلْكَ الْأُمَّةِ مِنَ النَّارِ وَ مَا مِنْ عَمَلٍ إِلَّا وَ لَهُ وَزْنُ أَوْ ثَوَابُ إِلَّا الدُّمْعَةَ فَإِنَّهَا تَطْفِئُ بُحُوْرًا مِنَ النَّارِ –

যে কোন বান্দার চক্ষুদ্বয় আল্লাহ্র ভয়ে অশ্রুতে টইটম্বুর হয়ে যায়, আল্লাহ তা’আলা তার দেহকে জাহান্নামের উপর হারাম করে দেন। আর যদি তা তার গাল বেয়ে যায়, তাহলে তার মুখমণ্ডলে কোন কষ্ট দেয়া হবে না এবং তাকে কোন রূপ লাঞ্ছিতও করা হবে না। আর যদি কোন জামাতের সদস্য আল্লাহর ভয়ে কেঁদে দেয়, তাহলে তার ওসিলায় আল্লাহ্ তা’আলা পুরো জামাতকে ক্ষমা করে দেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেন। প্রত্যেক আমলেরই ওযন ও সওয়াব রয়েছে। কিন্তু চোখের তপ্তাশ্রুর কোন সীমা-সীমান্ত নেই । এটা তো জাহান্নামের অগ্নি-দরিয়াকেও নিভিয়ে দিতে পারে।

হযরত যাযান (রহঃ) বলেন, আমাদের নিকট একথা পৌঁছেছে যে, যে ব্যক্তি জাহান্নামের ভয়ে কাঁদল, আল্লাহ্ তা’আলা তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেন। আর যে ব্যক্তি জান্নাতের আগ্রহে কাঁদল, আল্লাহ্ তা’আলা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেন।

হযরত আবদুল ওয়াহেদ ইবনে যায়েদ (রহঃ) বলতেন, ভাইয়েরা! তোমরা আল্লাহর আগ্রহে কেন ক্রন্দন কর না। তোমাদের কি একথা জানা নেই যে,যে ব্যক্তি আপন মাওলায়ে পাকের সাক্ষাতের আগ্রহে ক্রন্দন করে, তাকে আল্লাহ তা’আলা আপন দীদার থেকে মাহরুম করেন না। ভাইয়েরা! তোমরা জাহান্নামের ভয়ে কেন কাঁদ না? তোমাদের কি একথা জানা নেই যে, যে ব্যক্তি জাহান্নামের ভয়ে ক্রন্দন করে, আল্লাহ্ তা’আলা তাকে জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রদান করেন।

হযরত ফরকদ সাঞ্জী (রহঃ) বলেন, আমি এক কিতাবে অধ্যয়ন করেছি যে ব্যক্তি জান্নাতের আগ্রহে কেঁদে দেয়, তার জন্য স্বয়ং জান্নাত শাফাআত করতে থাকে এবং বলতে থাকে, হে প্রভু! সে যেমন আমার জন্য কেঁদেছে, ঠিক তেমনি তুমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দাও। অনুরূপ জাহান্নামও তার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করতে থাকে ও বলতে থাকে, হে প্রভু! তুমি তাকে ঐরূপ আমার থেকে আশ্রয় দাও, যেমন সে আমার থেকে আশ্রয় চেয়েছে এবং আমার ভয়ে কেঁদে দিয়েছে ও অশ্রু প্রবাহিত করেছে।

আল্লাহভীতির শক্তি

হাদীস ঃ হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি একদা রাত্রে স্বপ্নযোগে ‘আমি এক লোককে জাহান্নামের কিনারায় দেখতে পেলাম, যার নিকট ‘খোদাভীতি’ আগমন করল এবং তাকে সে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে নিয়ে গেল। অনুরূপ আরও কিছু লোককে দেখতে পেলাম, যারা জাহান্নামে পতিত হওয়ার উপক্রম ছিল। হঠাৎ তাদের কাছে দুনিয়াতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনের কারণে চোখের যে পানি প্রবাহিত হয়েছিল তা উপস্থিত হল এবং তাদেরকে মুক্ত করে নিয়ে গেল।

হাদীস ঃ হযরত আনাস (রাযিঃ) বলেন, একদা রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরায়ে তাহরীমের উক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন— قُوْا أَنْفُسَكُمْ وَ أَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ

নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে ঐ আগুন থেকে বাঁচাও, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর । –সূরা তাহরীম-৬

তখন রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর সম্মুখে জনৈক কাল হাবশী লোক বসা ছিল। সে উক্ত আয়াত শুনে খুব কাঁদতে থাকল। ইতোমধ্যে হযরত জিব্রাঈল নাযিল হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার সম্মুখে ঐ ক্রন্দনকারী ব্যক্তিটি কে? এর উত্তরে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একজন হাবশী লোক। অতঃপর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার খুব প্রশংসা করলেন। এরপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ ফরমান

وَ عِزَّتى وَ جَلَالِي وَ اِرْتِفَاعِى فَوْقَ عَرْشِئ لا تبكي عَيْنُ عَبْدِ فِي الدُّنْيا مِنْ خَشْيَتِى إِلَّا كَثُرَتْ ضِحْكُهُ فِي الْجَنَّةِ –

আমার ইয়্যতের কসম, জালালের কসম, আমার উঁচু শানের কসম, আমার কোন বান্দা যদি আমার ভয়ে ক্রন্দন করে ও তার চোখ বেয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়, তাহলে অবশ্যই জান্নাতে তার হাসি বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ, জান্নাতে সে খুব সুখী হবে। —আত্তাখবীফ

জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা

আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ ফরমান—

الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللهَ قيمًا وَقُعُودًا وَّ عَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُوْنَ فِي خَلْقِ السَّمَوتِ وَ الْأَرْضِ ج رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا: سُبْحَنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ * رَبَّنَا إِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ طَ وَ مَا لِلظَّلِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ . رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِى لِلْإِيْمَانِ أَنْ أَمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَأَمَنَّان رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ . رَبَّنَا وَ اتِنَا مَا وَعَدْتَنَا عَلَى رُسُلِكَ وَ لَا تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيمَةِ . إِنَّكَ لَا تُخلِفُ الْمِيْعَادَ فَاسْتَجَابَ لَهُمْ رَبُّهُمْ

তারা ঐ সকল লোক যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ তা’আলাকে স্মরণ করে। দাড়িয়ে, বসে এবং শয়নে এবং তারা ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টির গভীরে চিন্তা-ফিকির করে এবং বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি এসব অনর্থক সৃষ্টি করেন নি। আপনার সত্তা খুবই পবিত্র। আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে পরিত্রাণ দিন। হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আপনি যাকে জাহান্নামে প্রবেশ করান, তাকে আপনি চরম লাঞ্ছিত করেন। আর অত্যাচারীদের বাস্তবিকই কোন সাহায্যকারী নেই। হে প্রভু! আমরা শুনতে পেয়েছি কোন এক ঘোষক এ ঘোষণা দিচ্ছে যে, তোমরা আপন প্রতিপালকের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর।

অতঃপর আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতএব, প্রভু হে! আপনি আমাদের গোনাহসমূহ ক্ষমা করুন, আমাদের অন্যায়সমূহকে ন্যায় দ্বারা পরিবর্তন করুন এবং আমাদের মৃত্যু দান করুন নেককার লোকদের সাথে। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আপনার রাসূলের সাথে আমাদের ব্যাপারে যেসব ওয়াদা করেছেন, তা আমাদেরকে প্রদান করুন। কেয়ামত দিবসে আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি আপন প্রতিশ্রুতির কখনও ব্যতিক্রম করেন না। —আলে ইমরান : ১৯১-১৯৫

হাদীস ঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একখানা হাদীস এরশাদ ফরমান, যার মধ্যে তিনি ঐ সকল ফেরেশতাদের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা যিকিরের মজলিসের তালাশ করতে থাকেন এবং বান্দার অবস্থা দেখে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট রিপোর্ট পেশ করতে থাকেন। হাদীসটিতে একথারও উল্লেখ রয়েছে যে—

إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَسْأَلُهُمْ وَ هُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ فَيَقُوْلُوْنَ مِمَّ يَتَعَوَّذُوْنَ فَيَقُولُونَ مِنَ النَّارِ فَيَقُولُ وَ هَلْ رَاَوْهَا قَالُوا لَا وَاللَّهِ مَارَءَوْهَا فَيَقُولُ كَيْفَ لَوْ رَأَوْهَا؟ كَانُوا أَشَدَّ مِنْهَا فِرَارًا أَوْ أَشَدَّ مِنْهَا مَخَافَةً قَالَ فَيَقُولُ إِنِّي اُشْهِدُكُمْ إِنِّي قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ –

‘আল্লাহ্ তা’আলা বান্দার অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকা সত্ত্বেও ফেরেশতাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার বান্দারা কোন জিনিস থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, তারা কি জাহান্নাম দেখেছে? ফেরেশতারা বলেন, না তারা জাহান্নাম দেখেনি। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, যদি তারা জাহান্নাম দেখত তাহলে কি হত? ফেরেশতারা বলেন, হে আল্লাহ্! যদি তারা জাহান্নাম দেখতে পেত, তাহলে তারা জাহান্নামকে আরও বেশি ভয় পেত। জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আরও বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করতে থাকত। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, ‘হে ফেরেশতাকুল! জেনে রাখ, আমি তোমাদেরকে সাক্ষি বানাচ্ছি যে, আমি তাদের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দিলাম।

হাদীস ঃ হযরত আনাস (রাযিঃ) বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান—

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَسْأَلُ اللهَ الْجَنَّةَ ثَلَاثًا إِلَّا قَالَتِ الْجَنَّةُ اللَّهُمَّ اَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ وَ مَنْ اسْتَجَارَ مِنَ النَّارِ ثَلَاثًا قَالَتِ النَّارُ اللَّهُمَّ أَجِرْهُ مِنَ النَّارِ –

কোন মুসলমান যদি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট তিনবার জান্নাত প্রত্যাশা করে, তাহলে জান্নাতও তার জন্য এ দো’আ করতে থাকে যে, হে আল্লাহ্! আপনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন। আর যে ব্যক্তি তিন বার জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে, জাহান্নাম তার জন্য এ দো’আ করতে থাকে, হে আল্লাহ্! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করুন। —তিরমিযী ও নাসায়ী

হাদীস ঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হুযূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এরশাদ ফরমান-

مَا اسْتَجَارَ عَبْدُ مِنَ النَّارِ سَبْعَ مَرَّاتٍ إِلَّا قَالَتِ النَّارُ يَا رَبِّ إِنَّ عَبْدَكَ فُلَانًا اِسْتَجَارَ مِنِيْ فَأَجِرْهُ وَ لَا سَالَ عَبْدُ الْجَنَّةَ إِلَّا قَالَتِ الْجَنَّةُ يَا رَبِّ إِنَّ عَبْدَكَ فُلَانًا سَأَلَنِي فَأَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ

যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে সাতবার আশ্রয় প্রার্থনা করবে, জাহান্নাম আল্লাহ্তা ‘আলার নিকট আবেদন পেশ করতে থাকে যে, হে প্রতিপালক! আপনার অমুক বান্দা আমার থেকে মুক্তি প্রার্থনা করেছে। আপনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করুন। অনুরূপ যে ব্যক্তি সাতবার জান্নাত প্রত্যাশা করবে, তার জন্য স্বয়ং জান্নাত এ সুপারিশ করতে থাকে যে, হে আল্লাহ্! আপনার অমুক বান্দা আমাকে প্রত্যাশা করছে। আপনি তাকে আমার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিন ।

ফায়দা : উল্লিখিত দুটি হাদীস দ্বারা জানা গেল, যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে, তার জন্য স্বয়ং জাহান্নামও এ দোয়া করতে থাকে, হে আল্লাহ্! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করুন ।

হাদীস ঃ হযরত আনাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, হুযুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ ফরমান—

أنْظُرُوا فِي دِيْوَانِ عَبْدِى فَمَنْ رَأَيْتُمُوهُ سَأَلَنِى الْجَنَّةَ أَعْطَيْتُهُ وَ مَنْ اسْتَعَاذَنِي مِنَ النَّارِ أَعِذْهُ –

আমার বান্দার আমল নামার দিকে তাকাও। তোমরা তাদের মধ্য থেকে যার আমল নামায় জান্নাতের প্রত্যাশা প্রাপ্ত হবে, আমি তাকে জান্নাত প্রদান করব। আর যার আমল নামায় জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা প্রাপ্ত হবে,আমি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করব।

হাদীস ঃ হযরত আবু সায়ীদ এবং হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান—

إِذَا كَانَ يَوْمُ حَارٌ فَإِذَا قَالَ الرَّجُلُ لَا إِلهَ إِلَّا اللهُ مَا أَشَدَّ حَرُّ هذَا الْيَوْمِ اللّهُمَّ أَجِرْنِي مِنْ حَرِّ جَهَنَّمَ قَالَ اللهُ تَعَالَى لِجَهَنَّمَ إِنَّ عَبْدًا مِنْ عَبِيْدِي اِسْتَجَارَنِي مِنْ حَرِكُمْ وَ اَنَا اَشْهَدُكَ اَنّي قَدْ أَجِرْهُ ، وَإِذَا كَانَ يَوْمُ شَدِيدُ الْبَرْدِ فَقَالَ الْعَبْدُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مَا أَشَدَّ بَرْدِ هَذَا الْيَوْمِ اللَّهُمَّ أَجِرْنِي مِنْ زَمْهَرِيرِ جَهَنَّمَ قَالَ اللهُ تَعَالَى لِجَهَنَّمَ إِنَّ عَبْدًا مِنْ عَبِيدِي إِسْتَجَارَنِي مِنْ زَمْهَرِيرِكَ وَ أَنَا أَشْهَدُكَ أنّى قَد َأجِرْهُ قَالُوا وَ مَا زَمْهَرِيرُ جَهَنَّمَ؟ قَالَ بَيْتُ يُلْقَى فِيْهِ الْكَافِرُ فَيَتَمَيَّزُ مِنْ شِدَّةِ بَرْدِهِ –

গরমের দিনে যদি কোন ব্যক্তি প্রখর গরমের সময় এ দোয়া করে— لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ مَا أَشَدَّ حَرُّ هَذَا الْيَوْمِ اللَّهُمَّ أَجِرْنِى مِنْ حَرِّ جَهَنَّمَ

আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। আজ কত প্রখর গরম পড়েছে। হে আল্লাহ্! আমাকে জাহান্নামের উত্তপ্ত গরম থেকে রক্ষা করুন। তখন আল্লাহ্তা ‘আলা জাহান্নামকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, হে জাহান্নাম! আমার এক বান্দা তোর তপ্ত আগুন ও প্রখরতা থেকে মুক্তি চাচ্ছে। আমি তোকে সাক্ষি বানাচ্ছি যে, আমি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দিলাম। আর যখন প্রচণ্ড শীতের দিন হয়, তখন যেই বান্দা এ দোয়া করে— لاَ إِلَهَ إِلَّا اللهُ مَا أَشَدَّ بَرْدُ هَذَا الْيَوْمِ اللَّهُمَّ أَجِرْنِي مِنْ زَمْهَرِيرِ جَهَنَّمَ

আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। কত প্রচণ্ড শীত আজ। হে আল্লাহ্! আমাকে আপনি জাহান্নামের যামহারীর থেকে মুক্তি দান করুন। তখন আল্লাহ্তা ‘আলা জাহান্নামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে জাহান্নাম! আমার এক বান্দা আমার নিকট তোর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছে। আমি তোকে সাক্ষি বানাচ্ছি যে, আমি তাকে তোর যামহারীর থেকে মুক্তি দিয়ে দিলাম। সাহাবাগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! জাহান্নামের যামহারীর কি? তিনি উত্তরে বললেন, যামহারীর জাহান্নামের ঐ ঘর যেখানে কাফেরদের ফেলা হবে। তীব্র ও প্রচণ্ড শীতের কারণে তাদের দেহ ফেটে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে।

ফায়দা : হযরত মুজাহিদ (রহঃ) থেকে বর্ণিত, কেয়ামতের দিবসে এক লোককে জাহান্নামে প্রবেশের হুকুম করা হবে। তখন জাহান্নাম খুব সংকীর্ণ হয়ে যাবে। আল্লাহ্ তা’আলা তখন জাহান্নামের দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করবেন, কী ব্যাপার? তখন জাহান্নাম উত্তরে বলবে, হে আল্লাহ্! এ ব্যক্তি তো দুনিয়াতে আমার থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে রেখেছিল। আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন, ঠিক আছে তাকে ছেড়ে দাও ৷

আবু মুসলিম খওলানী (রহঃ) বলেন, আমি যে কোন দোআই করি না কেন, আমি তাতে জাহান্নামের কথা অবশ্যই উল্লেখ করি এবং তা থেকে আশ্রয়ও প্রার্থনা করে থাকি।

হযরত সুফিয়ান (রহঃ) আবদুল আ’লা থেকে বর্ণনা করেন যে, জান্নাত ও জাহান্নামকে মানবজাতির কথা শোনার ক্ষমতা দেয়া হবে। যখন কোন বান্দা এ দোয়া করে , اعوذ بالله من النار (আমি আল্লাহ্ তা’আলার নিকট জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি) তখন জাহান্নাম বলতে থাকে, হে আল্লাহ্, এ বান্দাকে আপনি আশ্রয় প্রদান করুন। আর যখন কোন বান্দা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট জান্নাত প্রার্থনা করে, তখন জান্নাত বলতে থাকে, হে আল্লাহ্! তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন।

হযরত আতা খোরাসানী (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি সাতবার জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করবে, জাহান্নাম তাকে বলতে থাকে, আমার মধ্যে আসার তোমার কোন প্রয়োজন নেই। জান্নাত হল সাত আসমানে আর জাহান্নাম সাত জমিনে। —ইবনে আবিদ্দুনয়া

হাদীস : হযরত বারা ইবনে আযেব (রাযিঃ) বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাফেরদের রূহ কবজ করার বিষয়ে এরশাদ ফরমান—

حَتَّى يَنْتَهُوا بِهَا إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَسْتَفْتِحُوْنَ فَلَا يُفْتَحُ لَهُ ثُمَّ قَرَأَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ لا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّى يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمَ الخِيَاطِ –

কাফেরদের রূহ বের হয়ে যাওয়ার পর ফেরেশতা সর্বাগ্রে তার রূহকে প্রথম আসমানে নিয়ে যায়। তারা আসামনের দরজা খোলার জন্য তাগাদা করতে থাকে। কিন্তু তাদের জন্য আসমানের দরজা খোলা হয় না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নোক্ত আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, যার অর্থ এই—’তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না আর তারা জান্নাতেও প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত একটি উট শুঁইয়ের ছিদ্রপথ দিয়ে প্রবেশ না করে।’ –সূরা আ’রাফ-৪০

অতঃপর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান, আল্লাহ্ তা’আলা আদেশ করেন, এ কাফেরের রূহকে যমীনের তলদেশে সিজ্জীনে নিয়ে যাও এবং তথায় তাকে সাজা দাও। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান, অতঃপর তার রূহকে সেখান থেকেই সিজ্জীনের দিকে নিক্ষেপ করে দেয়া হয়।

হাদীস ঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কীভাবে রূহ কবজ করা হবে? হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান—

فَتَخْرُجُ كَأَنْتَنَ رِيْحٍ جِيْفَةٍ فَيَنْطَلِقُوْنَ بِهِ إِلَى بَابِ الْأَرْضِ فَيَقُولُونَ : مَا انْتَنَ هَذِهِ الرِّيْحُ كُلَّمَا أَتَوْا عَلَى أَرْضِ قَالُوا ذلِكَ حَتَّى يَأْتُوا بِه إِلى أَزْوَاجِ الْكُفَّارِ –

কাফেরের রূহ তার দেহ থেকে বের হয় পঁচা মুর্দা প্রাণীর চেয়েও বেশি দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায়। তাকে যখন দুনিয়ার আসমানের দরজায় নিয়ে যায়, তখন তথাকার ফেরেশতারা বলতে থাকে, এর বাতাস কতই না দুর্গন্ধযুক্ত। অতঃপর ফেরেশতারা যতই যমীনের নীচে রূহটিকে নিয়ে যেতে থাকে, ততই ফেরেশতারা তাকে ধিক্কার দিতে থাকে। এভাবে তাকে সিজ্জীনে কাফেরদের রূহের মাঝে নিক্ষেপ করা হয়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) ফরমান, কাফেরদের রূহ যমীনের সপ্তস্তরে অবস্থিত থাকে। সারকথা হল, উল্লিখিত সকল হাদীস ও রেওয়ায়ত দ্বারা বুঝা গেল যে, জাহান্নাম যমীনের সপ্ত স্তরে বা আরও নীচে।

কেয়ামতের দিবসে সমুদ্র

হাদীস : হযরত ইয়া’লা ইবনে উমাইয়া (রাযিঃ) নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরশাদ বর্ণনা করেন, তিনি এরশাদ ফরমান, সমুদ্রই হল জাহান্নাম—

বর্ণনাকারী ইয়া’লা ইবনে উমাইয়া স্বীয় শাগরেদদের নিকট বললেন, আপনারা কি আল্লাহ্ তা’আলার উক্ত বাণী পাঠ করেন নি— نارا احاط بهم سرادقها (নিশ্চয়ই আমি জালেমদের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছি এমন আগুন, যার বেষ্টনী জাহান্নামীদেরকে বেষ্টন করে রাখবে । —সূরা কাহফ-২৯)

হযরত ইয়া’লা (রাযিঃ) বলেন, ঐ সত্তার কসম যার কুদরতী হাতে আমার জীবন, আমি কখনও সমূদ্রে প্রবেশ করব না, যাতে আমি যখন আল্লাহ তা’আলার সম্মুখে হাজির হব, তখন আমার দেহে জান্নামের এক টুকরাও স্পর্শ না করে । আলোচ্য হাদীসটি যদি প্রমাণিকভাবে সঠিক ও সহীহ প্রমাণিত হয়, তাহলে এর অর্থ দাড়াবে এমন যে, কেয়ামতের দিবসে সকল সমুদ্র প্রবাহিত হয়ে একটি সমূদ্রে পরিণত হয়ে যাবে। তখন সমূদ্রের পানিগুলোকে আগুনে পরিবর্তন করে দেয়া হবে। অতঃপর তার তাপ ও উত্তাপকে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। বুযুর্গানে দ্বীনের অনেকেই নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় এ ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন। আয়াতটি হল —واذا البحار سجرت এবং যখন সমুদ্রকে উত্তাল করা হবে। —সূরা তাকবীর-৬

তাদের অধিকাংশই বলে থাকেন, দুনিয়ার সকল সমুদ্রকে একত্রিত করে এক সমুদ্রে পরিণত করে দেয়া হবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, এই সমুদ্রকেই এত উত্তাল করা হবে যে, তা আগুনে পরিণত হয়ে যাবে।

হযরত মুজাহিদ (রহঃ) স্বীয় শায়েখ থেকে বর্ণনা করেন, আর তিনি বর্ণনা করেন হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে, তিনি واذا البحار سجرت এর তাফসীরে বলেন, চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্ররাজিকে কেয়ামতের দিবসে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে কিরণশূন্য করে দেয়া হবে। এরপর পূর্ব দিক থেকে প্রবল বেগে বাতাস প্রবাহিত করবেন। ফলে সমুদ্র ক্রমশ উত্তাল হতে থাকবে। এমনকি এক পর্যায়ে তার পানিগুলো আগুনে পরিণত হয়ে যাবে। —ইবনে আবিদ্দুনয়া, ইবনে আবী হাতেম

আল্লামা ইবনে জারীর (রহঃ) স্বীয় সনদে হযরত সায়ীদ ইবনে মুসাইয়িব (রহঃ)-এর মাধ্যমে হযরত আলী (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি এক ইহুদীকে জিজ্ঞাসা করলেন, সাত জাহান্নাম কোথায়? এর উত্তরে সে বলল, সমুদ্রে। হযরত আলী (রাযিঃ) বললেন, তার একথাকে আমি সত্য পেয়েছি। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ ফরমান, উত্তাল সমুদ্রের কসম (সূরা তূর-৬) والبحر المسجور যখন সমুদ্রকে উত্তাল করা হবে— (واذا البحار سجرت) –সূরা তাকবীর-৬) এ জাতীয় একটি রেওয়ায়েত হযরত আদম ইবনে আবী আয়াসও আপন তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। —ইবনে জারীর তাবারী

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, জাহান্নাম সাত সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত ।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সমুদ্রের পানি থেকে ওযু না করা চাই। কারণ, তা জাহান্নামের অংশ বিশেষ। হযরত সায়ীদ ইবনে আবুল হাসানও বলেন যে, সমুদ্র জাহান্নামের একটি অংশ বিশেষ।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) বলেন, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান-

لَا يَرْكَبُ الْبَحْرَ إِلَّا حَاجٌ أَوْ مُعْتَمِرُ أَوْ غَازِ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ فَإِنَّ تَحْتَ الْبَحْرِ نَارُ وَ تَحْتَ النَّارِ بَحْرًا –

তোমাদের কেউ যেন সমুদ্রে ভ্রমণ না করে, হ্যাঁ তবে হজ্জ, ওমরা ও জিহাদের লক্ষ্যে ভ্রমণকারীরা ব্যতীত। কারণ, সমুদ্রের নীচে জাহান্নাম আর জাহান্নামের নীচে সমুদ্র রয়েছে।

হযরত মুআবিয়া ইবনে সায়ীদ (রাযিঃ) বলেন, রোম সমুদ্র যা দুনিয়ার সকল সমুদ্রের মধ্যবিন্দু, ছোট ছোট সমুদ্রকে তার মধ্যেই ঢালা হবে। তার তলদেশে অসংখ্য কূপ রয়েছে, যেগুলো শুধু আগুন দ্বারা পরিপূর্ণ। কেয়ামতের দিবসে ঐ আগুনগুলোকেই আরো বড় আকারে জ্বালানো হবে।—ইবনে আবী হাতেম

হযরত আব্বাস ইবনে ইয়াযীদ বহরানী (রহঃ) বলেন, আমি ওলীদ ইবনে হিশামকে বলতে শুনেছি, তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কথাটি কার নিকট শুনেছেন” তিনি উত্তরে বলেন, আমি এমন লোক থেকে শুনতে পেয়েছি, যে পূর্বে আহলে কিতাব ছিল এবং পরে ইসলাম গ্রহণ করেছে। তিনি বলেছেন, যে মাছটি হযরত ইউনুস (আঃ)-কে গিলে ফেলেছিল, সে গ্রাস করার পর তাকে নিয়ে সাত সমুদ্রের তলদেশে চক্কর খেয়েছে। চক্কর খেতে খেতে সে সমুদ্রের গভীরের এমন স্থানে পৌঁছে যায়, যে স্থানটি জাহান্নামের গভীরতার সংযুক্ত। তখন হযরত ইউনুস (আঃ) মাছের পেটের ভেতর থেকেই তাসবীহ পাঠ করছিলেন, যা কারূনও শুনতে পেয়েছিল, যে তখন জাহান্নামে পতিত ছিল। এ ছাড়াও তিনি আরও কিছু বর্ণনা করেছেন। —ইবনে আবিদ্দুয়া

ফায়দা : হয়ত হযরত ইউনুস (আঃ) কারূণের জাহান্নামে পৌঁছার পরেই প্রেরিত হয়েছিলেন । তাই ঐতিহাসিকভাবেও উক্ত ঘটনাটি সঠিক প্রমাণিত হবে। অতএব, একথাও জানা গেল যে, সমুদ্রের গভীরতাই হল জাহান্নামের গভীরতা।

হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন—

إِنَّ جَهَنَّمَ مُحِيْطُ بِالدُّنْيَا وَ إِنَّ الْجَنَّةَ مِنْ وَرَابِهِ فَلِذْلِكَ كَانَ الصِّرَاطُ عَلَى جَهَنَّمَ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ –

জাহান্নাম দুনিয়াকে বেষ্টন করে রেখেছে। আর জান্নাত হবে তারও পরে। আর এ কারণেই জান্নাতে যেতে হলে জাহান্নামের উপর দিয়ে পুলসিরাত পার হওয়া আবশ্যক ।

কোন কোন রেওয়ায়েত মাধ্যমে একথাও বুঝা যায় যে, জাহান্নাম ও আসমানে । প্রখ্যাত মুফাসসির হযরত মুজাহিদ (রহঃ) وفي السماء رزقكم وما توعدون এর ব্যাখ্যায় বলেন, وما توعدون দ্বারা জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়ই উদ্দেশ্য। বিখ্যাত তাফসীরকারক হযরত যাহ্হাক (রহঃ) থেকেও এমন কথা বর্ণিত হয়েছে।

হাদীস ঃ হযরত হুযায়ফা (রাযিঃ) বলেন, নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান — أُوتِيتُ بِالْبُرَاقِ فَلَمْ نَزَايِلَ طَرْفَهُ انَا وَ جِبْرِيلُ حَتَّى أَتَيْنَا بَيْتَ الْمُقَدَّسِ وَ فُتِحَتْ لَنَا أَبْوَابَ السَّمَاءِ وَ رَأَيْتُ الْجَنَّةَ وَ النَّارَ –

‘আমার নিকট বোরাক আনা হল। আমি ও জিব্রাঈল (আঃ) বোরাকের সঙ্গে থাকলাম। তিনি আমাকে নিয়ে বাইতুল মাকদাস পৌছালেন। অতঃপর আমাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হল। তথায় আমি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখতে পেলাম। —মুসনাদে আহমদ

হযরত হুযায়ফা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান

رَأَيْتُ لَيْلَةَ أُسْرِىَ بى الْجَنَّةُ وَ النَّارُ فِي السَّمَاءِ فَقَرَأْتُ هَذِهِ الْآيَةَ وَفي السَّمَاءِ رِزْقُكُمْ وَ مَا تُوْعَدُوْنَ فَكَأَنِّي لَمْ أَرَاهَا قَطُّ

যে রজনীতে আমাকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হল, আমি তাতে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখতে পাই । অতঃপর আমি এ আয়াত তেলাওয়াত করলাম—وَفي السَّمَاءِ رِزْقُكُمْ وَ مَا تُوْعَدُوْنَ ‘আসমানে রয়েছে তোমাদের রিযিক এবং ঐ বস্তু যা তোমাদের সাথে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। —সূরা যারিয়াত-২২

আমার মনে হল, কেমন যেন ইতিপূর্বে আমি এ আয়াত কখনো পাঠও করি নাই ৷

হযরত হুযায়ফা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ্র কসম! হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাকে ঊর্ধ্ব গমনে গেলেন। তাঁর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হল । সেখানে তিনি জান্নাত, জাহান্নাম এবং আখেরাতকে একই সাথে প্রত্যক্ষ করেছেন।

জ্ঞাতব্য, এসকল রেওয়ায়েত দ্বারা যদিও একথা বুঝা যায় যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাত ও জাহান্নামকে আসমানে দেখেছেন, এদ্বারা একথা প্রমাণিত হয় না যে, জাহান্নাম আসমানেই অবস্থিত। এর অর্থ এমনও হতে পারে যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমান থেকে জাহান্নাম দেখেছেন, যা যমীনে অবস্থিত। যেমন মুর্দা ব্যক্তি কবরে শয়ন করে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখতে পায়। একথার অর্থ এই নয় যে, জান্নাত যমীনে অবস্থিত। অনুরূপ বর্ণিত আছে যে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য গ্রহণের নামাযের মধ্যে জান্নাত, জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করেছেন। এ থেকেও এ কথা বুঝা যায় না যে, জান্নাত জমিনে অবস্থিত । অনুরূপ মে’রাজের ঘটনা হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল মাকদাস যাওয়ার পথে জান্নাত ও জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করেছেন । এটা দ্বারাও একথা বুঝায় না যে, জান্নাত জমিনে অবস্থিত । অতএব, উপরিউক্ত হযরত হুযায়ফা (রাযিঃ) এর রেওয়ায়েত যদিও সঠিক, তবে তার অর্থ হল, তিনি আসমান থেকে জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করেছেন । আর ঐ জাহান্নাম তখনও জমিনে অবস্থিত ছিল। অনুরূপ হযরত আবু সায়ীদ (রাযিঃ) এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসমানে জান্নাত এবং জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করেছেন তার অর্থও এটা যে, তিনি আসমান থেকে জমিনে অবস্থিত জাহান্নাম দেখতে পেয়েছেন।

তথ্যসূত্র:

বই :জাহান্নামের বর্ণনা মূল :আল্লামা মুফতী মোহাম্মদ এমদাদুল্লাহ আনওয়ার অনুবাদ :মাওলানা নাজমুল হুদা মিরপুরী

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *