জাহান্নামে প্রবেশের কারণ সমূহ
আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাদের সার্বিক জীবন পরিচালনার যাবতীয় বিধি-বিধান অহি মারফত জানিয়ে দিয়েছেন। আর তা বাস্তবায়নের জন্য যুগে যগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা আল্লাহর বিধানকে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহ এমন কাউকে পাকড়াও করবেন না যাদের নিকট হক্ক পৌঁছেনি।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُوْلاً
‘আর রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি আযাবদাতা নই’ (সূরা ইসরা ১৭/১৫)। অতএব যারা আল্লাহ্ বিধানকে অমান্য করার মাধ্যমে তাঁর নাফরমানী করবে তারাই কেবল জাহান্নামে প্রবেশ করবে। নিম্নে জাহান্নামে প্রবেশের কতিপয় কারণ আলোচনা করা হল ।
(১) আল্লাহর সাথে কুফরী করা :
আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُونَ –
‘যারা কুফরী করে এবং আমার নিদর্শনসমূহকে অস্বীকার করে তারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে’ (সূরা বাকারাহ ২/৩৯)।
তিনি অন্যত্র বলেন,
وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُونَ –
‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ স্বীয় দ্বীন হতে ফিরে যায় এবং কাফিররূপে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের আমল বরবাদ হয়ে যায়। আর তারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে’ (সূরা বাকারাহ ২/২১৭)।
তিনি অন্যত্র বলেন,
وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّوْرِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُونَ
‘যারা কুফরী করে ত্বাগূত তাদের অভিভাবক, এরাই তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। আর তারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে’ (সূরা বাকারাহ ২/২৫৭)।
তিনি অন্যত্র বলেন,
إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوا لَنْ تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلاَ أَوْلَادُهُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ –
‘যারা কুফরী করে তাদের ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্তুতি আল্লাহ্র নিকট কখনো কোন কাজে আসবে না। আর তারাই অগ্নিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে’ (সূরা আলে-ইমরান ৩/১১৬)।
(২) আল্লাহর সাথে শিরক করা :
আল্লাহ তা’আলা বলেন, إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ –
‘নিশ্চয়ই যে আল্লাহ্র সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা জাহান্নাম। আর যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদা,৫/৭২)
রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন مَنْ مَاتَ يُشرك بالله شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ –
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্র সাথে কোন কিছুকে শরীক করে মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।
(৩) বিদ’আত কর্মে লিপ্ত হওয়া :
যারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর প্রেরিত আল্লাহ তা’আলার বিধানকে উপেক্ষা করে নিজেদের মস্তিস্ক প্রসূত কাজকে ভাল কাজের দোহায় দিয়ে ইবাদাত হিসাবে চালু করেছে।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيَأْتِيَنَّ عَلَى أُمَّتِي مَا أَتَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ حَذْوَ النَّعْلِ بِالنَّعْلِ حَتَّى إِنْ كَانَ مِنْهُمْ مَنْ أَتَى أُمَّهُ عَلَانِيَةً لَكَانَ فِي أُمَّتِي مَنْ يَصْنَعُ ذَلِكَ، وَإِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةٌ، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلَاثَ وَسَبْعِينَ مِلَّةً، كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلا مِلَّةً وَاحِدَةً، قَالُوْا وَمَنْ هِيَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي –
ইসরাঈলের যা হয়েছিল আমার উম্মাতেরও ঠিক তাই হবে, যেভাবে এক পায়ের জুতা অপর পায়ের জুতার ঠিক সমান হয়। এমনকি যদি তাদের মধ্যে এরূপ কেহ থেকে থাকে যে নিজ মায়ের সহিত প্রকাশ্যে কুকাজ করেছিল, তাহলে আমার উম্মতের মধ্যেও সে লোক হবে, যে এরূপ কাজ করবে। এছাড়া বনী ইসরাঈল (আক্বীদার দিক দিয়ে) বিভক্ত হয়েছিল ৭২ দলে, আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। এদের সকলেই জাহান্নামে যাবে একটি দল ব্যতীত। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল (ছাঃ) সেটি কোন দল? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে দল আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপর আছি তার উপর থাকবে।
(৪) মুনাফিকী বা কপটতা :
মুনাফিকী বা কপটতা অতি বড় পাপ। যার জন্য পরকালে অত্যন্ত কঠোর শাস্তি রয়েছে । মহান আল্লাহ বলেন,
وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُوْنَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لَا تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ سَنُعَذِّبُهُمْ مَرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّوْنَ إِلَى عَذَابٍ عَظِيْم
‘আর তোমাদের আশপাশের মরুবাসীদের মধ্যে কিছু লোক মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কিছু লোক অতিমাত্রায় মুনাফিকীতে লিপ্ত আছে। তুমি তাদেরকে জান না। আমি তাদেরকে জানি। অচিরেই আমি তাদেরকে দু’বার আযাব দেব এবং পরে তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে মহা আযাবের দিকে’ (সূরা তওবা ৯/১০১)।
তিনি অন্যত্র বলেন, إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ – ‘মুনাফিকগণ জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে থাকবে’ (সূরা নিসা ৪/১৪৫)।
(৫) সম্পদ আত্মসাৎ করা :
সম্পদ আত্মসাৎ করা মহাপাপ। বিশেষ করে রাজস্ব সম্পদ চুরি করা আরো বড় পাপ। কুরআন ও হাদীছে তার কঠিন শাস্তির কথা উল্লিখিত হয়েছে। কারণ রাজস্ব চুরি করা কিংবা তাতে খিয়ানত করা সাধারণ চুরি ও খিয়ানতের চেয়েও জঘন্য পাপ। বায়তুল মাল তথা সরকারী কোষাগারের সম্পদের সাথে সমগ্র দেশের নাগরিকের অধিকার সংযুক্ত থাকে। সুতরাং এখান থেকে চুরি করা শত-সহস্র লোকের সম্পদ চুরির শামিল। আর এখান থেকে চুরির পর তা থেকে তওবা করার জন্য দেশের সকল নাগরিককে তাদের হক ফেরত দেয়া কিংবা সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া আবশ্যক । অন্যথা তওবা গ্রহণযোগ্য হবে না। অথচ এ কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। পক্ষান্তরে অন্যান্য চুরির ক্ষেত্রে সম্পদের মালিকের কাছ থেকে ক্ষমা নেয়া সহজ । তাই বায়তুল মালের কোন কিছু আত্মসাৎ করা হলে জাহান্নামে তাকে শাস্তি পেতে হবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَمَا كان لِنَبِي أ يَغُلُّ وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَا كَسَبَتْ وَهُمْ لا يُظْلَمُوْنَ –
‘নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি খিয়ানত করবেন । আর যে লোক খিয়ানত করবে সে ক্বিয়ামতের দিন সেই খিয়ানত করা বস্তু নিয়ে উপস্থিত হবে।
অতঃপর প্রত্যেকেই পরিপূর্ণভাবে পাবে যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোন অন্যায় করা হবে না’ (সূরা আলে-ইমরান ৩/১৬১)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو قَالَ كَانَ عَلَى تَقلِ النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ كَرْكَرَةُ فَمَاتَ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هُوَ فِي النَّارِ فَذَهَبُوا يَنْظُرُونَ إِلَيْهِ فَوَجَدُوْا عَبَاءَةً قَدْ غَلْهَا.
আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর গনীমতের মালের দায়িত্বশীল ছিল, যাকে কারকারা বলা হত। সে মারা গেলে রাসূল (ছাঃ) বললেন, সে জাহান্নামী। ছাহাবীগণ তার নিকট গিয়ে দেখলেন, সে একটি চাদর আত্মসাৎ করেছিল।
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبَّاسٍ قَالَ حَدَّثَنِي عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ قَالَ لَمَّا كَانَ يَوْمُ خَيْبَرَ أَقْبَلَ نَفَرٌ مِنْ صَحَابَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوْا فُلاَنٌ شَهِيدٌ فُلاَنٌ شَهِيدٌ حَتَّى مَرُّوا عَلَى رَجُلٍ فَقَالُوْا فُلاَنٌ شَهِيدٌ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَلَّا إِنِّي رَأَيْتُهُ فِي النَّارِ فِي بُرْدَةٍ غَلْهَا –
দিন ছাহাবীগণের একটি দল বাড়ী ফিরে আসছিলেন। ঐ সময় ছাহাবীগণ বললেন, অমুক অমুক শহীদ, শেষ পর্যন্ত এমন এক ব্যক্তিকে ছাহাবীগণ শহীদ বললেন, যার ব্যাপারে রাসূল বললেন, কখনো নয়, আমি তাকে জাহান্নামে দেখছি,সে একটি চাদর আত্মসাৎ করেছে। (মুসলিম,হাদীস:১১৪)
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ أَهْدَى رَجُلٌ لِرَسُوْلِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غُلاَمًا يُقَالُ لَهُ مِدْعَمُ فَبَيْنَمَا مِدْعَمُ يَحُطُّ رَحْلاً لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ أَصَابَهُ سَهْمُ عَائِرُ فَقَتَلَهُ فَقَالَ النَّاسُ هَنِيئًا لَهُ الْجَنَّةُ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَلا أَخَذَهَا يَوْمَ خَيْبَرَ مِنَ الْمَغَائِمِ لَمْ تُصِبْهَا وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّ الشَّمْلَةَ الَّتِي أَخَذَهَا يَوْمَ خَيْبَرَ الْمَقَاسِمُ لَتَسْتَعِلُ عَلَيْهِ نَارًا ، فَلَمَّا سَمِعَ ذَلِكَ النَّاسُ جَاءَ رَجُلٌ بِشِرَاكَ أَوْ شِرَاكَيْنِ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ شِرَاكُ مِنْ نَارٍ أَوْ شِرَاكَانِ مِنْ نَارٍ –
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি মিদ‘আম নামে একটি গোলাম রাসূল (ছাঃ)-কে হাদিয়া দিয়েছিল । মিদ‘আম এক সময় রাসূল (ছাঃ)-এর উটের পিঠের হাওদা নামাচ্ছিল এমতাবস্থায় একটি অতর্কিত তীর এসে তার গায়ে লাগে এবং সে মারা যায়। ছাহাবীগণ বলেন, তার জন্য আমার প্রাণ! নিশ্চয়ই ঐ চাদরটি যেটি সে খায়বারের গনীমত বণ্টন করার পূর্বে আত্মসাৎ করেছিল, সে চাদরটি জাহান্নামের আগুন তার উপর উত্তেজিত করছে। এ কথা শুনে একজন লোক একটি জুতার ফিতা বা দু’টি জুতার ফিতা রাসূলের নিকট নিয়ে আসল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, একটি বা দু’টি জুতার ফিতা আত্মসাৎ করলেও জাহান্নামে যাবে’।বুখারী হা/৬২১৩, আবু দাউদ হা/২৭১৩; নাসাঈ হা/৩৮৪৩; মিশকাত হা/৩৯৯৭
(৬-৯) মিথ্যা বলা বা মিথ্যাচার করা, কুরআন তেলাওয়াত ত্যাগ করা, ব্যভিচার করা ও সূদ খাওয়া :
মিথাচার, কুরআন তেলাওয়াত পরিত্যাগ, যেনা-ব্যভিচার করা ও সুদ খাওয়া অতি বড় গুনাহ। যা থেকে পার্থিব জীবনে তওবা না করলে পরকালে শাস্তি পেতে হবে।
হাদীসে এসেছে, সামুরা ইবনু জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর অভ্যাস ছিল তিনি ফজরের ছালাত শেষে প্রায়ই আমাদের দিকে মুখ করে বসতেন এবং জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের কেউ আজ রাত্রে কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? বর্ণনাকারী বলেন, আমাদের কেউ স্বপ্ন দেখে থাকলে সে তাঁর নিকট বলত। আর তিনি আল্লাহর হুকুম মোতাবেক তার তা’বীর (ব্যাখ্যা) বর্ণনা করতেন। যথারীতি একদিন সকালে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ (আজ রাত্রে) কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? আমরা বললাম, না। তখন তিনি বললেন, কিন্তু আমি দেখেছি । আজ রাত্রে দুই ব্যক্তি আমার নিকট আসল এবং তারা উভয়ে আমার হাত ধরে একটি পবিত্র ভূমির দিকে (সম্ভবত শাম বা সিরিয়ার দিকে) নিয়ে গেল। দেখলাম, এক ব্যক্তি বসে আছে আর অপর এক ব্যক্তি লোহার সাঁড়াশি হাতে দাঁড়ানো। সে তা উক্ত বসা ব্যক্তির গালের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয় এবং তা দ্বারা চিরে গর্দানের পিছন পর্যন্ত নিয়ে যায়। অতঃপর তার দ্বিতীয় গালের সাথে অনুরূপ ব্যবহার করে। ইত্যবসরে প্রথম গালটি ভাল হয়ে যায়। আবার সে (প্রথমে যেভাবে চিরেছিল) পুনরায় তাই করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি? তারা উভয়ে বলল, সামনে চলুন। সম্মুখের দিকে চললাম। অবশেষে আমরা এমন এক ব্যক্তির কাছে এসে পৌঁছলাম, যে ঘাড়ের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে, আর অপর এক ব্যক্তি একখানা ভারী পাথর নিয়ে তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার আঘাতে শায়িত ব্যক্তির মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করছে। যখনই সে পাথরটি নিক্ষেপ করে মাথা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে) তা গড়িয়ে দূরে চলে যায়, তখনই সে লোকটি পুনরায় পাথরটি তুলে আনতে যায়। সে ফিরে আসার পূর্বে ঐ ব্যক্তির মাথাটি পূর্বের ন্যায় ঠিক হয়ে যায় এবং পুনরায় সে পাথর দ্বারা তাকে আঘাত করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি? তারা উভয়ে বলল, সামনে চলুন। আমরা সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলাম। অবশেষে একটি গর্তের নিকট এসে পৌঁছলাম, যা তন্দুরের মত ছিল। তার উপর অংশ ছিল সংকীর্ণ এবং ভিতরের অংশটি ছিল প্রশস্ত। তার তলদেশে আগুন প্রজ্বলিত ছিল। আগুনের লেলিহান শিখা যখন উপরের দিকে উঠছিল, তখন তার ভিতরে যারা রয়েছে তারাও উপরে উঠে আসছিল এবং উক্ত গর্ত হতে বাইরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিল। আর যখন অগ্নিশিখা কিছুটা শিথিল হচ্ছিল, তখন তারাও পুনরায় ভিতরের দিকে চলে যাচ্ছিল। তার মধ্যে রয়েছে কতিপয় উলঙ্গ নারী ও পুরুষ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি? তারা উভয়ে বলল, সামনে চলুন। সুতরাং সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলাম এবং একটি রক্তের নহরের (নদীর) নিকট এসে পৌঁছলাম। দেখলাম, তার মধ্যস্থলে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে এবং নহরের তীরে একজন লোক দণ্ডায়মান। আর তার সম্মুখে রয়েছে প্রস্তরখণ্ড। নহরের ভিতরের লোকটি যখন তা থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে কিনারার দিকে অগ্রসর হতে চায়, তখন তীরে দাঁড়ানো লোকটি ঐ লোকটির মুখ লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করে এবং সে লোকটিকে ঐ স্থানে ফিরিয়ে দেয় যেখানে সে ছিল। মোটকথা, লোকটি যখনই বাইরে আসার চেষ্টা করে, তখনই তার মুখের উপর পাথর মেরে যেখানে ছিল পুনরায় সেখানে ফিরিয়ে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি? সঙ্গীদ্বয় বলল, সামনে চলুন। আমরা সম্মুখে অগ্রসর হয়ে শ্যামল সুশোভিত একটি বাগানে পৌঁছলাম । বাগানে ছিল একটি বিরাট বৃক্ষ। আর উক্ত বৃক্ষটির গোড়ায় উপবিষ্ট ছিলেন একজন বৃদ্ধ লোক এবং বিপুল সংখ্যক বালক। এ বৃক্ষটির সন্নিকটে আরেক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যার সম্মুখে রয়েছে আগুন, যা সে প্রজ্বলিত করছে। এরপর আমার সঙ্গীদ্বয় আমাকে ঐ বৃক্ষের উপরে আরোহণ করালো এবং সেখানে তারা আমাকে বৃক্ষরাজির মাঝখানে এমন একখানা গৃহে প্রবেশ করালো যে, এরূপ সুন্দর ও মনোরম ঘর আমি আর কখনো দেখিনি। তার মধ্যে ছিল কতিপয় বৃদ্ধ, যুবক, নারী ও বালক। অনন্তর তারা উভয়ে আমাকে সে ঘর হতে বের করে বৃক্ষের আরও উপরে উঠালো এবং এমন একখানা গৃহে প্রবেশ করালো যা প্রথমটি হতে সমধিক সুন্দর ও উত্তম । তাতেও দেখলাম, কতিপয় বৃদ্ধ ও যুবক। অনন্তর আমি উক্ত সঙ্গীদ্বয়কে বললাম, আপনারা উভয়েই তো আমাকে আজ সারা রাতে অনেক কিছু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন । এখন বলুন, আমি যা কিছু দেখেছি তার তাৎপর্য কি? তারা উভয়ে বলল, হ্যাঁ (আমরা তা জানাবো)। ঐ যে এক ব্যক্তিকে দেখেছেন সাঁড়াশি দ্বারা যার গাল চিরা হচ্ছে, সে মিথ্যাবাদী। সে মিথ্যা বলত এবং তার নিকট হতে মিথ্যা রটানো হত । এমনকি তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত । অতএব তার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত ঐ আচরণ করা হবে, যা আপনি দেখেছেন । আর যে ব্যক্তির মস্তক পাথর মেরে চূর্ণ করতে দেখেছেন, সে ঐ ব্যক্তি, আল্লাহ তা’আলা যাকে কুরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে কুরআন হতে গাফেল হয়ে রাত্রে ঘুমাতো এবং দিনেও তার নির্দেশ মোতাবেক আমল করত না । সুতরাং তার সাথে কিয়ামত পর্যন্ত ঐ আচরণই করা হবে, যা আপনি দেখেছেন। আর (আগুনের) তন্দুরে যাদেরকে দেখেছেন, তারা হল যেনাকারী (নারী-পুরুষ)। আর ঐ ব্যক্তি যাকে (রক্তের) নহরে দেখেছেন, সে হল সুদখোর। আর ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তি যাকে একটি বৃক্ষের গোড়ায় উপবিষ্ট দেখেছেন, তিনি হলেন ইবরাহীম (আঃ) । আর তাঁর চতুষ্পার্শ্বে শিশুরা হল মানুষের সন্তানাদি । আর যে লোকটিকে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করতে দেখেছেন, সে হল জাহান্নামের দারোগা মালেক। আর প্রথম যে ঘরটিতে আপনি প্রবেশ করেছিলেন, তা (জান্নাতের মধ্যে) সর্বসাধারণ মুমিনদের গৃহ। আর যে ঘর পরে দেখেছেন, তা শহীদদের ঘর । আর আমি হলাম জিব্রাঈল এবং এই হলেন মীকাঈল। এবার আপনি মাথা উপরের দিকে তুলে দেখুন। তখন আমি মাথা তুলে দেখলাম, যেন আমার মাথার উপরে মেঘের মত কোন একটি জিনিস রয়েছে। অপর এক বর্ণনায় আছে, একের পর এক স্তরবিশিষ্ট সাদা মেঘের মত কোন জিনিস দেখলাম। তাঁরা বললেন, সেটা আপনারই বাসস্থান। আমি বললাম, আমাকে সুযোগ দিন আমি আমার ঘরে প্রবেশ করি। তারা বললেন, এখনও আপনার হায়াত বাকী আছে, যা আপনি এখনো পূর্ণ করেননি আপনার যখন নির্দিষ্ট হায়াত পূর্ণ হবে, তখন আপনি আপনার বাসস্থানে প্রবেশ করবেন। বুখারী,হাদীস : ১৩৮৬
(১০) মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেওয়া ও নিজে তা না করা :
যারা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দেয় কিন্তু নিজেরা সে অনুযায়ী আমল করে না তাদেরকেও কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَرْتُ لَيْلَةَ أُسْرِيَبِي عَلَى قَوْمٍ تُقْرَضُ شِفَاهُهُمْ بِمَقَارِيْضَ مِنْ نَارٍ قَالَ قُلْتُ مَنْ هَؤُلاَءِ قَالُوا حُطَبَاءُ مِنْ أَهْلِ الدُّنْيَا كَانُوا يَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبِرِّ وَيَنْسَوْنَ أَنْفُسَهُمْ وَهُمْ يَتْلُونَ الْكِتَابَ أَفَلَا يَعْقِلُوْنَ –
আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘মিরাজের রাত্রে আমি এক দল লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের ঠোট আগুনের কাচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল। তিনি বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম,এরা কারা?তারা (ফেরেশতাগণ) বললেন,এরা দুনিয়ার বক্তারা, যারা মানুষকে সৎকাজের আদেশ দিত কিন্তু নিজেরা তা ভুলে থাকত। তারা কিতাব (কুরআন) তেলাওয়াত করত কিন্তু অনুধাবন করত না’। আহমাদ,হাদীস: ১২২৩২
অন্য বর্ণনায় এসেছে, أَتَيْتُ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِي عَلَى قَوْمٍ تُقْرَضُ شِفَاهُهُمْ بِمَقَارِيْضَ مِنْ نَارٍ، كُلَّمَا قُرِضَتْ وَفَتْ، فَقُلْتُ: يَا جِبْرِيلُ مَنْ هَؤُلاَءِ قَالَ: حُطَبَاءُ مِنْ أُمَّتِكَ الَّذِيْنَ يَقُولُونَ مَا لاَ يَفْعَلُوْنَ، وَيَقْرَعُوْنَ كِتَابَ اللهِ وَلَا يَعْمَلُوْنَ
‘মিরাজের রাত্রে আমি একদল লোকের নিকটে আসলাম, যাদের ঠোট আগুনের কাচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল। যখনই কাটা হচ্ছিল, তা পুনরায় ঠিক হয়ে যাচ্ছিল।আমি জিজ্ঞেস করলাম,হে জিবরীল,এরা কারা?তিনি বললেন,এরা আপনার উম্মতের বক্তারা, তারা যা বলত, তা করতো না। তারা আল্লাহ্কি তাব (কুরআন) পাঠ করতো এবং আমল করতো না’।
(১১) ইচ্ছাকৃত ছালাত ত্যাগ করা :
হাদীছে এসেছে,
عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْعَهْدُ الَّذِي بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمُ الصَّلاةُ، فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ –
হযরত বুরায়দা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তাদের (মুনাফিকদের) মধ্যে যে অঙ্গীকার রয়েছে তা হল, ছালাত । সুতরাং যে ছালাত ত্যাগ করল সে কাফির হয়ে গেল ।
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصلاة –
জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,বান্দার ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হল ছালাত ত্যাগ করা । মুসলিম হা/৮২; মিশকাত হা/৫৬৯, ‘ছালাতের ফযীলত ও মাহাত্মা’ অধ্যায়,
অতএব ইচ্চাকৃত ছালাত পরিত্যাগ করলে অবশ্যই তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে।
(১২) সম্পদের যাকাত আদায় না করা :
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَالَّذِينَ يَكْنرُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابِ أَلِيمٍ، يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا حِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَرْتُمْ لِأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْثِرُونَ –
‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে না তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে। আর বলা হবে, এটাই তা, যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভূত করতে । সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা আস্বাদন কর’ (তওবা ৯/৩৪-৩৫)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ آتَاهُ اللهُ مَالاً، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثْلَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ، لَهُ زَبِيْبَتَانِ، يُطَوَّقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ يَعْنِى شِدْقَيْهِ ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ، أَنَا كنركْ
‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে টেকো (বিষের তীব্রতার কারণে) মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু’পার্শ্বে কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল । অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তেলাওয়াত করেন, وَلاَ يَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَهُمْ بَلْ هُوَ شَرٌّ لَهُمْ سَيُطَوَّقُوْنَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلَّهِ مِيْرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللَّه بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ
‘আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর হবে। অচিরেই কিয়ামত দিবসে, যা নিয়ে কার্পণ্য করেছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হবে’ (আলে-ইমরান ৩/১৮০)। বুখারী হা/১৪০৩, ‘যাকাত’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ২/৭৯; মিশকাত হা/১৭৭৪ ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, প্রত্যেক স্বর্ণ ও রৌপ্যের মালিক যে উহার হক (যাকাত) আদায় করে না, ‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের বহু পাত তৈরী করা হবে এবং সে সমুদয়কে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে এবং তার পাঁজর, কপাল ও পিঠে দাগ দেওয়া হবে। যখনই তা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তখন পুনরায় তাকে গরম করা হবে (তার সাথে এরূপ করা হবে) সে দিনের পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। (তার এ শাস্তি চলতে থাকবে) যতদিন না বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি হয়। অতঃপর সে তার পথ ধরবে, হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে।
জিজ্ঞেস করা হ’ল হে রাসূল (ছাঃ)! উট সম্পর্কে কি হবে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যে উটের মালিক তার হক আদায় করবে না আর তার হকসমূহের বললেন, যে উটের মালিক তার হক আদায় করবে না আর তার হকসমূহের মধ্যে পানি পানের তারিখে তার দুধ দোহন করা (এবং অন্যদের দান করাও) এক হক। “কিয়ামতের দিন নিশ্চয়ই তাকে এক ধুধু ময়দানে উপুড় করে ফেলা হবে, আর তার সে সকল উট যার একটি বাচ্চাও সে সেই দিন হারাবে না; বরং সকলকে পূর্ণভাবে পাবে, তাকে তার ক্ষুর দ্বারা মাড়াতে থাকবে এবং মুখ দ্বারা কামড়াতে থাকবে। এভাবে যখনই তাদের শেষ দল অতিক্রম করবে পুনরায় প্রথম দল এসে পৌঁছবে। এরূপ করা হবে সেই দিন, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। (তার এ শাস্তি চলতে থাকবে) যতদিন না বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি হয়। অতঃপর সে তার পথ ধরবে, হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে ।
অতঃপর জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহ্র রাসূল! গরু ছাগল সম্পর্কে কি হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক গরু ও ছাগলের মালিক যে তার হক আদায় করবে না, ‘ক্বিয়ামতের দিন নিশ্চয়ই তাকে এক ধুধু মাঠে উপুড় করে ফেলা হবে, আর তার সে সকল গরু-ছাগল তাকে শিং মারতে থাকবে এবং ক্ষুরের দ্বারা মাড়াতে থাকবে, অথচ সে দিন তার কোন একটি গরু ছাগলই শিং বাঁকা, শিং হীন বা শিং ভাঙ্গা হবে না এবং একটি মাত্র গরু-ছাগলকেও সে হারাবে না । যখনই তার প্রথম দল অতিক্রম কারবে, তখনই শেষ দল উপস্থিত হবে। এরূপ করা হবে সেই দিন, যার পরিমাণ হবে পঞ্চাশ হাযার বছরের সমান। (তার এ শাস্তি চলতে থাকবে) যতদিন না বান্দাদের বিচার নিষ্পত্তি হয়। অতঃপর সে তার পথ ধরবে, হয় জান্নাতের দিকে, না হয় জাহান্নামের দিকে ।
অতঃপর জিজ্ঞেস করা হ’ল হে আল্লাহ্র রাসূল! ঘোড়া সম্পর্কে কি হবে? তিনি বললেন, ঘোড়া তিন প্রকার। ঘোড়া কারো জন্য পাপের কারণ, কারো জন্য আবরণ স্বরূপ, আবার কারো জন্য ছওয়াবের বিষয়। (ক) যে ঘোড়া তার মালিকের পক্ষে পাপের কারণ, তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে লোক দেখানো, গর্ব এবং মুসলমানদের প্রতি শত্রুতার উদ্দেশ্যে। এ ঘোড়া হ’ল তার পাপের কারণ। (খ) যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য আবরণস্বরূপ, তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে আল্লাহর রাস্তায়, অতঃপর ভুলে যায়নি তার সম্পর্কে ও তার পিঠ সম্পর্কে আল্লাহ্র হক। এই ঘোড়া তার ইয্যত-সম্মানের জন্য আবরণস্বরূপ। (গ) আর যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য ছওয়াবের কারণ, তা হ’ল সে ব্যক্তির ঘোড়া, যে তাকে পালন করেছে কোন চারণভূমিতে বা ঘাসের বাগানে শুধু আল্লাহর রাস্তায় মুসলমানদের (দেশ রক্ষার) জন্য। তখন তার সে ঘোড়া চারণভূমি অথবা বাগানের যা কিছু খাবে, তার পরিমাণ তার জন্য নেকী লিখা হবে এবং লিখা হবে গোবর ও পেশাব পরিমাণ নেকী। আর যদি তা আপন রশি ছিড়ে একটি বা দু’টি মাঠও বিচরণ করে, তাহ’লে নিশ্চয়ই উহার পদচিহ্ন ও গোবরসমূহ পরিমাণ নেকী লিখা হবে। এছাড়া মালিক যদি উক্ত ঘোড়াকে কোন নদীর কিনারে নিয়ে যায়, আর তা নদী হ’তে পানি পান করে, অথচ মালিকের ইচ্ছা ছিল না পানি পান করাতে, তথাপি তার পানি পান পরিমাণ নেকী তার জন্য লিখা হবে ।
অতঃপর জিজ্ঞেস করা হ’ল, হে আল্লাহ্র রাসূল! গাধা সম্পর্কে কি হবে? তিনি বললেন, গাধার বিষয়ে আমার প্রতি কিছু নাযিল হয়নি। এই স্বতন্ত্র ও ব্যাপকার্থক আয়াতটি ব্যতীত, ‘যে ব্যক্তি এক অণু পরিমাণ ভাল কাজ করবে,সে তার নেক ফল পাবে, আর যে এক অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সে তার মন্দ ফল ভোগ করবে (অর্থাৎ গাধার যাকাত দিলে তারও ছওয়াব পাওয়া যাবে)’ (যিলযাল ৭-৮)। মুসলিম হা/৯৮৭; মিশকাত হা/১৭৭৩, ‘যাকাত’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ৪/১২৩ পৃঃ।
(১৩) রামাযানে বিনা কারণে ছিয়াম ভঙ্গ করা :
মহান আল্লাহ মুসলিম উম্মাহর উপরে রামাযানের ছিয়াম পালন করা ফরয করেছেন। কিন্তু অনেকে ছিয়াম পালন করে না । বিনা কারণে ছিয়াম পরিত্যাগ করে । এদের জন্য জাহান্নামে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
بَيْنَا أَنَا نَائِمٌ إِذْ أَتَانِي رَجُلَانِ فَأَخَذَا بِضَبْعَى فَأَتَيَا بِي جَبَلاً فَقَالَا لِيَ : اصْعَدْ فَقُلْتُ : إِنِّي لا أُطِيقُهُ فَقَالا : إِنَّا سَنُسَهْلُهُ لَكَ فَصَعِدْتُ حَتَّى إِذَا كُنْتُ فِي سَوَاءِ الْجَبَل إِذَا أَنَا بَأَصْوَاتِ شَدِيدَة فَقُلْتُ : مَا هَذه الأَصْوَاتُ، قَالُوا : هَذَا عُوَاءُ أَهْلِ النَّارِ، ثُمَّ انْطُلِقَ بِى فَإِذَا بِقَوْمٍ مُعَلَّقِيْنَ بِعَرَاقِيبِهِمْ مُشَقَّقَةٌ أَشْدَاقُهُمْ تَسِيْلُ أَشْدَاقُهُمْ دَمًا ، قَالَ قُلْتُ : مَنْ هَؤُلاَءِ قَالَ : هُمُ الَّذِينَ يُفْطِرُوْنَ قَبْلَ تَحِلَّةِ صَوْمِهِمْ –
‘একদা আমি ঘুমন্ত ছিলাম। ইতিমধ্যে দু’ব্যক্তি আমার নিকটে আসল। তারা আমার দু’বাহু ধরে একটি পাহাড়ের নিকটে নিয়ে এসে বলল, পাহাড়ে আরোহন কর। তখন আমি বললাম, আমি উঠতে পারব না। তারা বলল, আমরা তোমাকে সহযোগিতা করছি। রাসূল (ছাঃ) বলেন, তখন আমি আরোহন করলাম। এমনকি আমি প্রায় পাহাড়ের সমতল স্থানে পৌঁছে গেলাম। পথিমধ্যে আমি একটি বিকট আওয়াজ শুনতে পেলাম। তখন আমি বললাম, এটা কিসের শব্দ? তারা বলল, এটা জাহান্নামবাসীদের আর্তনাদ।
অতঃপর আমাকে সামনে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে হাঁটুর সাথে ঝুলন্ত, চোয়াল বিদীর্ণ করা কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদের চোয়াল থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। রাসূল (ছাঃ) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বলল, এরা হচ্ছে ঐ সকল লোক যারা ছিয়াম থেকে হালাল হওয়ার পূর্বে তথা ইফতারের সময় হওয়ার পূর্বে ইফতার করত’।৮৯ অর্থাৎ যারা ছিয়াম পালন করত না ৷
(১৪) টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা :
পুরুষ মানুষ স্বীয় পরিধেয় পোশাক পায়ের টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে পরলে তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে ।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَا أَسْفَلَ مِنَ الْكَعْبَيْنِ مِنَ الإِزارِ فَفِي النَّارِ –
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরবে, সে জাহান্নামী।
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ بَيْنَمَا رَجُلٌ يَحُرُّ إِزَارَهُ مِنْ الْخُيَلاَءِ حُسِفَ بِهِ فَهُوَ يَتَجَلْجَلُ فِي الْأَرْضِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ –
ইবনু ওমর (রা:) হতে বর্ণিত,নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, এক লোক অহংকারবশত লুঙ্গি ঝুলিয়ে চলছিল। ইত্যবসরে তাকে ধসিয়ে দেয়া হল । সে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মাটির গভীরে নেমে যেতেই থাকবে’
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ حُيَلاَءَ لَمْ يَنْظُرِ اللَّهُ إِلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ –
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি অহংকারবশত (টাখনুর নিচে) কাপড় ঝুলিয়ে পরিধান করবে, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে দৃষ্টি দিবেন না। বুখারী হা/৩৬৬৫; মুসলিম হা/২০৮৫; মিশকাত হা/৪৩১২, ‘পোষাক’ অধ্যায়।
(১৫) প্রাণীদের বন্দী রেখে কষ্ট দেওয়া ও তাদের প্রতি ইহসান না করা :
কোন প্রাণীকে বন্দী রেখে কষ্ট দেওয়া এবং তাদের প্রতি দয়া না করার কারণে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رضى الله عنهما أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ عُذِّبَتِ امْرَأَةٌ فِي هِرَّةٍ حَبَسَتْهَا، حَتَّى مَاتَتْ جُوْعًا، فَدَخَلَتْ فِيْهَا النَّارَ، قَالَ فَقَالَ وَاللَّهُ أَعْلَمُ لاَ أَنْتِ أَطْعَمْتِهَا وَلاَ سَقَيْتِهَا حِيْنَ حَبَسْتِيْهَا، وَلَا أَنْتِ أَرْسَلْتِيْهَا فَأَكَلَتْ مِنْ خَشَاشِ الْأَرْضِ
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রা:) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মহিলাকে একটি বিড়ালের কারণে আযাব দেওয়া হয়। সে বিড়ালটি বেঁধে রেখেছিল, অবশেষে বিড়ালটি খুধায় মারা যায়। এ কারণে মহিলাটি জাহান্নামে জানেন, বাঁধা থাকাকালীন তুমি তাকে না খেতে দিয়েছিলে, না পান কারতে দিয়েছিলে এবং না তুমি তাকে ছেড়ে দিয়েছিলে, তাহলে সে যমিনের পোকা- মাকড় খেয়ে বেঁচে থাকত । ”বুখারী হা/২৩৬৫; মুসলিম হা/২২৪২; মিশকাত হা/১৯০৩।
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমার সম্মুখে জাহান্নাম পেশ করা হয়েছিল। সেখানে বনী ইসরাঈলের এক মহিলাকে দেখতে পেলাম। তাকে একটি বিড়ালের কারণে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। সে বিড়ালটি বেঁধে রেখেছিল, তাকে খাদ্য দেয়নি এবং ছেড়েও দেয়নি, যাতে সে যমীনের পোকামাকড় খেতে পারে’। মুসলিম হা/৯০৪; মিশকাত হা/৫৩৪১।
(১৬) ঋণ করে পরিশোধ না করা :
ঋণ করার পর তা পরিশোধ না করে মৃত্যুবরণ করলে এবং তার উত্তরাধিকারীরাও তা পরিশোধ না করলে শাস্তি পেতে হবে ।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ سَعْدِ بْنِ الْأَطْوَلِ قَالَ مَاتَ أَخِي وَتَرَكَ ثَلَاثَمِائَةِ دِينَارٍ وَتَرَكَ وَلَداً صِغَاراً فَأَرَدْتُ أَنْ أُنْفِقَ عَلَيْهِمْ فَقَالَ لِي رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنْ أَخَاكَ مَحْبُوْسٌ بِدَيْنِهِ فَاذْهَبْ فَاقْضِ عَنْهُ ، قَالَ فَذَهَبْتُ فَقَضَيْتُ عَنْهُ ثُمَّ حِيْتُ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَدْ قَضَيْتُ عَنْهُ وَلَمْ يَبْقَ إِلا امْرَأَةٌ تَدَّعِي دِينَارَيْنِ وَلَيْسَتْ لَهَا بَيْنَةٌ قَالَأَعْطِهَا فَإِنَّهَا صَادِقَةٌ
সা’দ ইবনুল আওয়াল হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার ভাই তিনশত দীনার রেখে মারা গেল। সে একটি ছোট ছেলে রেখে গেল । আমি তাদের জন্য ঐ অর্থ ব্যয় করার ইচ্ছা করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, তোমার ভাই তার ঋণের কারণে বন্দী আছে। সুতরাং যাও তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করে এস। বর্ণনাকারী বলেন, আমি গিয়ে তার ঋণ পরিশোধ করে ফিরে আসলাম । অতঃপর এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করেছি। একজন মহিলা ব্যতীত (কোন দাবীদার) বাকী নেই। সে দুই দীনার দাবী করছে, কিন্তু তার কোন প্রমাণ নেই । রাসূল (ছাঃ) বললেন, তাকে তা দিয়ে দাও। কেননা সে সত্যবাদী’। আহমাদ হা/১৬৭৭৬; ইবনু মাজাহ; ছহীহুল জামে’ হা/১৫৫০, সনদ ছহীহ।
উপরে বর্ণিত পাপকর্ম ও অপরাধের কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করতে হবে এবং কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। তাই এসব কর্মকাণ্ড থেকে আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে । আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক্ব দান করুন। আমীন!
তথ্যসূত্র:
জাহান্নামের ভয়াভহ আযাব
শরীফুল ইসলাম বিন জয়নাল আবেদীন