জাহান্নামের গরম ও ঠাণ্ডার তীব্রতা
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ ফরমান- وَقَالُوْا لَا تَنْفِرُوا فِي الْحَرَ قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُوْنَ
তারা পরস্পরে বলে থাকে, তোমরা এত প্রখর রোদে বের হয়ো না। (হে নবী!) আপনি বলে দিন, জাহান্নামের আগুন তার চেয়েও আরও অনেক বেশি গরম । কতই না ভাল হত যদি তারা বিষয়টি অনুধাবন করত । —সূরা তওবা-৭১
দোযখের একাংশ অপর অংশকে পুড়ে ফেলেছে
হাদীস ঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বলেন, নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান: اِشْتَكَتِ النَّارُ إِلى رَبِّهَا فَقَالَتْ يَارَبْ أَكَلَ بَعْضِيْ بَعْضًا فَنَفْسِي فَأُذِنَ لَهَا نَفْسَيْنِ نَفَسُ الشَّتَاءِ وَ نَفْسٌ فِي الصَّيْفِ فَاَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنْ الحَرَ مِنْ سُمُوْمِهَا وَاَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الْبَرْدِ مِنْ زَمْهَرِيرِهَا –
আগুন তার প্রতিপালকের নিকট এ অভিযোগ করেছে যে, হে প্রতিপালক! আমার একাংশ অন্য অংশকে খেয়ে ফেলেছে। এখন আমাকে শ্বাস ছাড়ার অনুমতি দিন। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাকে দু’টি শ্বাস ছাড়ার অনুমতি দিলেন। একটি হবে গরম শ্বাস ও অপরটি হবে ঠাণ্ডা শ্বাস। তোমরা যে দুনিয়াতে গরমের তীব্রতা ও প্রচণ্ডতা দেখতে পাও, তা জাহান্নামেরই গরমের একাংশ। অনুরূপভাবে তোমরা দুনিয়াতে যেই শীতের তীব্রতা ও প্রচণ্ডতা দেখতে পাও, তা জাহান্নামের শীতেরই একাংশ। —বুখারী, মুসলিম
হাদীস ঃ হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রাযিঃ) বলেন, নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান— نَارُكُمْ هَذِهِ جُزْءً مِنْ سَبْعِينَ جُزْءًا مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ لِكُلِّ جُزْءٍ مِنْهَا مِثْلُ حَرّهَا
তোমাদের এ আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগের এক ভাগ। সেখানকার প্রত্যেক ভাগের প্রখরতা দুনিয়ার আগুনের প্রখরতার সমান ।—তিরমিযী
হাদীস ঃ হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত—
إِنَّ نَارَكُمْ هَذِهِ ضُرِبَ بِهَا الْبَحْرُ فَفَتَرَتْ وَ لَوْلَا ذُلِكَ مَا انْتَفَعْتُمْ بِهَا وَ هِيَ جُزْءُ مِنْ سَبْعِينَ جُزْءٍ مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ –
তোমাদের এ আগুনকে সমুদ্রের পানি দ্বারা ধোয়া হয়েছে। তবেই তো এত ঠাণ্ডা। নয়তো তোমরা তা দ্বারা মোটেও উপকৃত হতে পারতে না। দুনিয়ার আগুন জাহান্নামের আগুনের সত্তর ভাগ তাপের এক ভাগ বহন করে। —বায্যার
হাদীস ঃ হযরত আনাস (রাযিঃ) বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান—
لَوْ أَنَّ خَرَبًا مِنْ جَهَنَّمَ جُعِلَ فِي وَسَطِ الْأَرْضِ لَاذْى رِيْحُهُ وَ شِدَّهُ حَرِهِ مَا بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَ الْمَغْرِبِ وَ لَوْ أَنَّ شِرَارَةً مِنْ شِرَارِ جَهَنَّمَ بِالْمَشْرِقِ لَوُجِدَ حَرُّهَا مِنْ بِالْمَغْرِبِ –
যদি জাহান্নামের আগুনের একটি বালতি এনে পৃথিবীতে রেখে দেয়া হয়, তাহলে পৃথিবীর প্রাচ্য-পাশ্চাত্য পুরোটাই তার দুর্গন্ধ ও উত্তপ্ততায় অতিষ্ঠ হয়ে যাবে। যদি পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে জাহান্নামের একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এনে রেখে দেয়া হয়, তাহলে তার তাপে পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তের লোকেরাও অতিষ্ঠ থাকবে ।
**হাদীস :**হযরত উমর (রাযিঃ) বলেন, হযরত জিব্রাঈল (আঃ) হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন:
وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَوْ أَنَّ قَدْرَ يُقْبِ إِبِرَةٍ فُتِحَ مِنْ جَهَنَّمَ لَمَاتَ مَنْ فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا مِنْ حَرِه –
সত্তার কসম! যিনি আপনাকে হক ধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যদি দুনিয়ার সাথে জাহান্নামের একটি শুঁইয়ের ছিদ্র পরিমাণ ছিদ্র পথ করে দেয়া হয়, তাহলেও তার প্রখরতায় অতিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীবাসী সকলে মৃত্যুবরণ করবে । —তিরমিযী
হাদীস ঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বর্ণনা করেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান
لَوْ كَانَ فِي هَذَا الْمَسْجِدِ مِائَةُ أَلْفٍ أَوْ يَزِيدُوْنَ فِيْهِمْ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَتَنَفَّسَ فَأَصَابَهُمْ نَفَسُهُ لَأَحْرَقَ مَنْ فِي الْمَسْجِدِ أَوْ يَزِيدُونَ –
যদি এ মসজিদে নববীতে এক লক্ষ বা ততোধিক মানুষের সমাবেশ ঘটে আর তাদের মাঝে একজন জাহান্নামী থাকে আর সে একটি মাত্র শ্বাস ছাড়ে, তাহলে তার এ শ্বাস তাদের সকলকে বা ততোধিক মানুষকে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবে।
হযরত কা’ব (রাযিঃ) হযরত উমর (রাযিঃ)-কে বললেন, যদি জাহান্নাম থেকে গরুর নাকের ছিদ্র পরিমাণ পৃথিবীর পূর্বদিকে একটি ছিদ্র করে দেয়া হয়, তাহলেও পৃথিবীর পশ্চিমের লোকদের মস্তিষ্ক বিগলিত হয়ে যাবে ।
হযরত আবদুল মালেক ইবনে উমায়ের (রাযিঃ) বলেন, যদি জাহান্নামীদেরকে দুনিয়ার আগুনে এনে ফেলে দেয়া হয়, তাহলে তাদের ঘুম এসে যাবে।
ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) বলেন, ইবনুল মুয়াযযা বলেন, আমার নিকট একথা পৌঁছেছে যে, যদি কোন লোককে জাহান্নামের আগুন থেকে এনে দুনিয়ার আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে তার ঘুম চলে আসবে এবং দুই হাজার বছর পর্যন্ত সে ঘুমিয়ে থাকবে।
হাদীস ঃ হযরত আবদুল মালেক ইবনে আবু বশীর (রাযিঃ) বর্ণনা করেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান— مَا مِنْ يَوْمٍ إِلَّا وَ النَّارُ تَقُوْلُ اشْتَدَّ حَرِى وَ بَعْدُ قَعْرِى وَ عَظُمَ جَمْرِي عَجَلْ الْهِيَ إِلَيَّ بِأَهْلِي –
কোন দিন এমন যায় না, জাহান্নাম একথা বলে না যে, আমার গরমী প্রখর হয়ে গেছে, আমার গভীরতা বেড়ে গেছে, আমার অঙ্গারগুলো বড় হয়ে গেছে। হে আল্লাহ্! এখন আমার ভেতরকার অধিবাসী যারা হবে তাদেরকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিন ।
হযরত আতা সুলামী
হযরত বশীর ইবনে মানসুর (রহঃ) বলেন, আমি হযরত আতা সুলামী (রহঃ)-কে বললাম, যদি কোন ব্যক্তির জন্য আগুন জ্বালানো হয় আর তাকে বলা হয় যে, যে ব্যক্তি এ আগুনে ঝাপ দিবে, সে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত পেয়ে যাবে। হযরত আতা সুলামী (রহঃ) বলেন, যদি একথা আমাকে বলা হয়,তাহলে তো আমি তাতে ঝাপ দেয়ার পূর্বেই এত খুশি হব যে, খুশিতে আমার প্রাণ বায়ু উড়ে যাবে। —ইবনে উয়াইনা
জাহান্নামের প্রচণ্ড শীত
হাদীস : হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান-
إِنَّ زَمْهَرِيرَ جَهَنَّمَ بَيْتُ يَتَمَيَّزُ فِيْهِ الْكَافِرُ مِنْ بَرْدِهِ জাহান্নামের যামহারীর নামক জায়গায় এত প্রচণ্ড শীত হবে যে, তার শৈত্য প্রবাহে কাফেরদের দেহ ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
হযরত মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, জাহান্নামের একটি স্তর রয়েছে ‘যামহারীর’। জাহান্নামীদেরকে যখন জাহান্নামে সিদ্ধ করা হবে, তখন তারা গরম থেকে পালায়ন করে যামহারীরের দিকে ছুটে যাবে। যখন তারা তাতে ঝাপ দিবে, তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তাদের হাড়গুলো কড়কড় করে ভাঙ্গতে থাকবে। এমনকি সেই হাড় ভাঙ্গা আওয়াজও শোনা যাবে। —ইবনে আবিদ্দুয়া
হযরত মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, যামহারীরের আযাব এত বেশি যন্ত্রণাদায়ক হবে যে, জাহান্নামীরা তার ঠাণ্ডা বরদাশত করতে পারবে না।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন, জাহান্নামবাসীরা দোযখের গরমীতে শাস্তি ভোগ করার পর যখন ফরিয়াদ করবে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য, তখন তাদের ফরিয়াদ গ্রহণ করা হবে এমন ঠাণ্ডা বাতাস দ্বারা, যা জাহান্নামীদের হাড়গুলোকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিবে। ফলে তারা পুনরায় জাহান্নামের আগুন প্রত্যাশা করতে থাকবে ।
হযরত আবদুল মালেক ইবনে উমায়ের (রহঃ) বলেন, আমার নিকট একখা পৌঁছেছে যে, জাহান্নামী জাহান্নামের দারোগার নিকট এ ফরিয়াদ করবে যে, আমাদেরকে একটু জাহান্নামের কিনারায় পৌঁছিয়ে দিন। ফলে তাদেরকে সে কিনারায় নিয়ে যাবে। তখন তাদেরকে যামহারীরের ঠাণ্ডা চরমভাবে আঘাত হানবে। তা বরদাশত করতে না পেরে তারা আবারও জাহান্নামে ফিরে যাবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) বলেন যে, হযরত কা’ব (রাযিঃ) বলেন, জাহান্নামে শীতও রয়েছে, যার নাম হল যামহারীর। দোযখবাসীরা যখন তাতে প্রবেশ করবে, তখন তাদের গোশত পেশী খসে খসে পড়বে। ফলে তারা আবার জাহান্নামে যাওয়ার ফরিয়াদ করবে। —আবু নুয়াঈম
হযরত ইবনে মাসঊদ (রাযিঃ) বলেন, জাহান্নামের যামহারীরও আযাবের একটি ধরন হবে । হযরত ইকরামা (রাযিঃ) বলেন, তা হবে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও শীত।
যামহারীরের কল্পনায় এক বুযুর্গ
হযরত যুবায়েদ আলইয়ামী (রহঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি এক রাতে তাহাজ্জুদ নামাযের উদ্দেশ্যে জাগ্রত হলেন, তিনি যে পাত্র দিয়ে ওযূ করতেন, তার দিকে তিনি হাত বাড়ালেন । তিনি তাতে হাত দিতেই অনুভব করলেন, পানি এত বেশি ঠাণ্ডা যে, পানি জমে বরফ হয়ে যাওয়ার উপক্রম ছিল। তৎক্ষণাৎ তিনি জাহান্নামের যামহারীর তবকার কথা স্মরণ করলেন। তিনি পাত্রে হাত ঢুকিয়েই রাখলেন। সকাল পর্যন্ত হাত বের করলেন না। তার এক বাদী তার কাছে আসল । তখনও তার ঐ একই অবস্থা ছিল। বাঁদী জিজ্ঞাসা করল, মনিব হে! আপনার এ কি অবস্থা? অন্যান্য দিনের মত আজ আপনি তাহাজ্জুদের নামায পড়লেন না? তিনি উত্তরে বললেন, আফসোস! অদ্য রাতে আমি লোটাতে হাত ঢুকাতেই খুব ঠাণ্ডা অনুভব হল । তৎক্ষণাৎ আমি জাহান্নামের যামহারীর তবকার কথা স্মরণ করলাম। কসম আল্লাহ্! ঐ স্মরণের পর থেকে এ পানির কোন ঠাণ্ডাই অনুভব হচ্ছে না। এমন কি তুমি আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছ।
সাবধান! যতদিন পর্যন্ত আমি জীবিত থাকব, ততদিন পর্যন্ত এ বিষয় আর কাউকে অবগত করাবে না । ঠিক তাই হল । এ বিষয় সম্পর্কে আর কেউ অবগত হয়নি। এমনকি তিনি ইহধাম ত্যাগ করলেন । (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
তথ্যসূত্র:
বই :জাহান্নামের বর্ণনা মূল :আল্লামা মুফতী মোহাম্মদ এমদাদুল্লাহ আনওয়ার অনুবাদ :মাওলানা নাজমুল হুদা মিরপুরী