জাহান্নামের ভয়ে ভীত লোকদের অবস্থা
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন :
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوتِ وَ الْاَرْضِ وَاخْتِلْفِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولى الْأَلْبَابِ . الَّذِيْنَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيمًا وَ قَعُوْدًا وَّ عَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ ، رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحْنَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ * رَبَّنَا إِنَّكَ مَن تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ طَ وَمَا لِلظَّلِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ
“নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে এবং রাত্রি-দিনের আবর্তন বিবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান লোকদের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও যমীন সৃষ্টির বিষয়ে। (তারা বলে) হে পরওয়ারদেগার! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি কর নি। সকল পবিত্রতা তোমারই। আমাদেরকে তুমি দোযখের শাস্তি থেকে বাঁচাও। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই তুমি যাকে দোযখে নিক্ষেপ করলে, তাকে তুমি অপমানিত করলে । আর যালেমদের জন্য তো কোন সাহায্যকারী নেই ।’ —সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯২
অন্যত্র এরশাদ ফরমান— قُلْ اَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ ، لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّتَ تَجْرِى مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهرُ خُلِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْونٌ مِّنَ اللهِ ، وَ اللهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ . الَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا أَمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘বলুন, আমি কি তোমাদেরকে এসবের চাইতেও উত্তম বিষয়ের সন্ধান বলব? যারা পরহেযগার, আল্লাহ্ তা’আলার নিকট তাদের জন্য রয়েছে বেহেশত, যার তলদেশে প্রস্রবণ প্রবাহিত। তারা সেখানে থাকবে অনন্তকাল ৷ আর রয়েছে পরিচ্ছন্ন স্ত্রীগণ এবং আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ্তা ‘আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখেন। যারা বলেন, হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা ঈমান এনেছি, তাই আমাদের গোনাহসমূহকে ক্ষমা করে দাও আর আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা কর।’ —সূরা আলে ইমরান : ১৫-১৬
অন্যত্র এরশাদ ফরমান—
وَ عِبَادُ الرَّحْمٰنِ الَّذِيْنَ يَمْشُونَ عَلَى الْاَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجُهِلُوْنَ قَالُوا سَلَمًا . وَالَّذِيْنَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَّ قِيَامًا ، وَ الَّذِيْنَ يَقُولُونَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا . إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَّ مُقَامًا –
‘রহমান এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং যখন তাদের সাথে মূর্খরা কথা বলতে থাকে, তখন তারা বলে, সালাম এবং যারা রাত্রি যাপন করে পালনকর্তার সামনে সেজদাবনত হয়ে এবং দণ্ডায়মান হয়ে; এবং যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপর থেকে জাহান্নামের শাস্তি সরিয়ে দাও। নিশ্চয় এর শাস্তি নিশ্চিত সর্বনাশকারী। বসবাস ও অবস্থানস্থল হিসেবে তা কত নিকৃষ্ট জায়গা।’ –সূরা ফুরকান : ৬৩-৬৬
অন্যত্র এরশাদ ফরমান— وَ يَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُوْنَ عَذَابَهُ
‘তারা আল্লাহ্ তা’আলার দয়ার প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে চলে।’ –সূরা ইসরা-৫৭
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে— وَالَّذِيْنَ هُمْ مِنْ عَذَابٍ رَبِّهِمْ مُشْفِقُونَ . إِنَّ عَذَابَ رَبِّهِمْ غَيْرُ مَأْمُون
‘এবং যারা স্বীয় প্রতিপালকের আযাব থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। নিশ্চয় তাদের প্রভুর আযাব কষ্টকর-অনিরাপদ।’ –সূরা মা’আরিজ ঃ ২৭-২৮
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে— ذلِكَ لِمَنْ خَافَ مَقَامِي وَ خَافَ وَعِيْدُ
‘এসব নেয়ামত ঐ লোকের জন্য, যে আমার সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং আমার ধমককে ভয় করে থাকে।’ –সূরা ইবরাহীম-১৪
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে—
وَ أَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ قَالُوا إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِي أَهْلِنَا مُشْفِقِينَ فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَ وَقْنَا عَذَابَ السَّمُوْمِ
‘তারা একে অপরের দিকে মুখ করে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তারা বলবে, আমরা ইতিপূর্বে নিজেদের বাসগৃহে ভীত-কম্পিত ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন।’ –সূরা তূর : ২৫, ২৬, ২৭
হযরত ইবরাহীম তাইমী (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি মোটেও চিন্তাযুক্ত হয় না তার উচিৎ হল, সে যেন এ আশঙ্কা বোধ করে যে, সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় কিনা । কারণ, একমাত্র জান্নাতীরাই একথা বলবে — الحمد لله الذي اذهب عنا الحزن – প্রশংসা সব আল্লাহ্ তা’আলার জন্য যিনি আমাদের থেকে দুঃখ ও দুশ্চিন্তাকে দূর করে দিয়েছেন।’ –সূরা ফাতির-৩৪
আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে না তার উচিত হল, সে যেন এ আশঙ্কা বোধ করে যে, সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় কিনা। কারণ, একমাত্র জান্নাতীরাই বলবে—انا كنا قبل في اهلنا مشفقين – নিঃসন্দেহে আমরা ইতিপূর্বে দুনিয়াতে আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করতাম।
নবীয়ে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নাম থেকে অধিক পরিমাণে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। আর এবিষয়ে তিনি সাহাবাদেরকে আদেশ করতেন যে, তারা যেন নামাযের পরে জাহান্নাম থেকে আল্লাহ্র কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে । বহু হাদীসে এর বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে ।
হাদীস ঃ হযরত আনাস (রাযিঃ) বলেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অধিকাংশ দো’আ হত ঃ رَبَّنَا أُتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّ فِي الْآخِرَةِ حَسَنَةٌ وَ قِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদিগকে ইহলেকেও কল্যাণ দান করেন এবং পরলোকেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করেন।’ –সূরা বাকারা-২৯
হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ দো’আ শুনতে পেয়েছেন ঃ اللهُمَّ إِنِّي اَعُوْذُبِكَ مِنْ حَرِ جَهَنَّمَ ‘হে আল্লাহ্! আমি জাহান্নামের উত্তপ্ততা থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি।’—নাসায়ী শরীফ
হাদীস ঃ হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রাযিঃ) হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ এরশাদ বর্ণনা করেন : إِنَّمَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مَنْ يَرْجُوْهَا وَيُجَنّبُ النَّارَ مَنْ تَخَافُهَا وَإِنَّمَا يَرْحَمُ الله
‘অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে ঐ ব্যক্তি, যে জান্নাতের আশা রাখে । আর জাহান্নাম থেকে বাঁচবে ঐ ব্যক্তি, যে জাহান্নামকে ভয় করবে। আল্লাহ্ তা’আলা ঐ ব্যক্তির উপর দয়া করেন, যে দুনিয়াতে অন্যান্যদের উপর দয়া করে থাকে।’ —আবূ নুআঈম
ফায়দা ঃ উক্ত হাদীস দ্বারা জানা গেল যে, জান্নাতের আশা এবং জাহান্নামের ভয় উভয়টি একজন মুসলমানের মধ্যে থাকা আবশ্যক । যাতে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে । হযরত উমর (রাযিঃ) বলেন, যদি আসমান থেকে কেউ এ ঘোষণা করে, হে লোক সকল! তোমরা সকলেই জান্নাতী, তবে তোমাদের মধ্য থেকে এক জন জাহান্নামী । তাহলে আমার ভয় হবে যে, ঐ একজন আমিই হয়ে যাই কিনা । —আবু নুআঈম
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রূমী (রহঃ) বলেন, আমার নিকট হযরত উসমান (রাযিঃ) সম্পর্কে একথা পৌঁছেছে যে, তিনি বলেন, আমি যদি জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যখানে থাকি আর আমার একথা জানা না থাকে যে, আমার উপর কোথায় যাওয়ার আদেশ হয়, তাহলে আমি এটা প্রত্যাশা করব যে, আমার ঠিকানা অবগত হওয়ার পূর্বেই যেন আমি ছাই হয়ে যাই।
রাসূল (সাঃ)কেও ভয় দেখানো হয়েছে
আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ ফরমান : ذلِكَ مِمَّا أَوْحَى إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الحِكْمَةِ ، وَلَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلْهَا أَخَرَ فَتُلْقَى فِي جَهَنَّمَ مَلُوْمًا مَّدْحُوْرًا *
উল্লিখিত বিধি-বিধানসমূহ ঐসকল হেকমতের কথার অন্তর্ভুক্ত, যা আপনার প্রভু আপনার উপর ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন। আর আল্লাহ্ তা’আলার সাথে অন্য কাউকে উপাস্য সাব্যস্ত করবেন না। নতুবা অধঃমুখি করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। —সূরা ইসরা-৩৯
ফায়দা : এ আয়াতে সম্বোধিত ও উদ্দিষ্ট ব্যক্তি হলেন হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম । যখন তাঁকেই লক্ষ্য করে একথা বলা হল যে, আপনিও যদি কাউকে আল্লাহ্র সাথে সমকক্ষ সাব্যস্ত করেন, তাহলে আপনাকেও জাহান্নামে পতিত করা হবে সুতরাং ঐ সকল লোকের কী অবস্থা হবে, যারা জীবন-ভর আল্লাহ্ তা’আলার নাফরমানী করে যাচ্ছে! আল্লাহ্ তা’আলা তাদের সকলকে তাঁর আশ্রয় দান করুন।
ফেরেশতাদেরকেও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন
وَ مَنْ يَقُلْ مِنْهُمْ إِنّى إِلهُ مِنْ دُونِهِ فَذَلِكَ نَجْزِيْهِ جَهَنَّمَ كَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ
তাদের মধ্য থেকে যারা একথা বলে যে, আল্লাহ্ ছাড়া আমিও একজন মা’বূদ, আমি তাকে জাহান্নামের শাস্তি প্রদান করব । আর আমি অত্যাচারীদেরকে এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি । –সূরা আম্বিয়া-২৯
ফায়দা ঃ উক্ত আয়াতে ফেরেশতাদের সম্পর্কে যারা মুহূর্তের তরে আল্লাহ্তা ‘আলার আদেশ লঙ্ঘন করে না, বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ না করুন, তারাও যদি আল্লাহ্র নাফরমানি করে বসে, তাহলে তাদেরকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতএব, আমাদের মত গোনাহগারদের জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য সব সময় চিন্তিত থাকা চাই ।
নবীদের জাহান্নামের ভয়
হাদীস ঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাযিঃ) বর্ণনা করেন, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান : ‘কেয়ামতের দিবসে যখন লোকেরা হযরত আদম (আঃ)-এর খেদমতে সুপারিশের জন্য গমন করবে, তখন হযরত আদম (আঃ) বলবেন, অদ্য আমার পালনকর্তা এত বেশি ক্রোধান্বিত হয়ে আছেন, ইতিপূর্বে কখনো এত বেশি ক্রোধান্বিত ছিলেন না। তিনি আমাকে একটি কাজের আদেশ করেছিলেন, আমি তা লঙ্ঘন করেছি। আমার ভয় হচ্ছে যে, তিনি আজ আমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে দেন কি না। সুতরাং তোমরা অন্য কারো নিকট চলে যাও। অতঃপর তিনি নিজের নফসের মুক্তির জন্য, নাফসী নাফসী বলতে থাকবেন। অতঃপর তারা হযরত নূহ, হযরত ইবরাহীম, হযরত মূসা এবং হযরত ঈসা (আঃ)-এর নিকট গমন করবে। তাঁরাও অনুরূপ উত্তর প্রদান করবেন। —ইবনে আবিদ্দুনয়া
হাদীস : হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান ঃ নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং সালেহগণ সকলেই জাহান্নাম থেকে ভীত কম্পিত থাকতেন এবং অন্যান্য লোকদেরকে ভীতি প্রদর্শন করতেন। — বুখারী
জাহান্নামের ভয়ে জনৈক বুযুর্গ
জনৈক আরেফের উক্তি হল, আমার লজ্জা হয় যে, আমি এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা’আলার এবাদত করব যে, আমি জান্নাত প্রাপ্ত হব আর আমি ঐ নিমক হারাম মজদুরের ন্যায় হয়ে যাব, যে পারিশ্রমিক পেলে কাজ করে আর না পেলে কাজ না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। আমার এ বিষয়েও লজ্জা হয় যে, আমি জাহান্নামের ভয়ে আল্লাহ্ তা’আলার এবাদত করব এবং এমন মন্দ শ্রমিকের ন্যায় হব, যাকে ধমকানো হলে কাজ করে নয়তো নয়। —আবু নুআইম
ফায়দা : এ উক্তিটির অর্থ হল, যদি শুধু জান্নাতের নেয়ামত প্রাপ্তির আশায় কিংবা শুধু জাহান্নামের আযাবের ভয়ে আল্লাহ্ তা’আলার এবাদত করা হয়, তবে এটা হবে মন্দ কাজ; বরং এবাদত করার সময় জান্নাতের আশা এবং জাহান্নামের ভয়ভীতি উভয়টাই থাকা চাই। এর পাশাপাশি আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টিও যেন উদ্দেশ্য হয় । জনৈক বুযুর্গ বলেন, যে ব্যক্তি ভয় ও মহব্বত অন্তরে ধারণ না করে শুধুই আশায় আল্লাহ্ তা’আলার এবাদত করল, সে মুরজিয়া আর যে ব্যক্তি শুধুই ভয়ে এবাদত করল, সে হল হারুরী। উল্লেখ্য যে, উভয় সম্প্রদায়ই দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দির প্রসিদ্ধ দু’টি পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্ত সম্প্রদায়। যাদের এক সম্প্রদায় নিরেট জান্নাতের আশায় এবাদত করত এবং অন্য সম্প্রদায় নিরেট জাহান্নামের ভয়ে এবাদত করত । আর যে ব্যক্তি শুধুই মহব্বত নিয়ে এবাদত করে, তার অন্তরে আশা ও ভয় কিছুই নেই, সে হল যিন্দীক । আর যিন্দিক বলা হয় চরম পর্যায়ের কাফেরকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ভয় ও আশার মধ্যখানে থেকে মহব্বত ও ভালবাসার সাথে আল্লাহ্ তা’আলার এবাদত করে, সেই হল প্রকৃত মু’মিন ও একত্ববাদে বিশ্বাসী ।
এটা একারণে যে, মু’মিনের উপর আল্লাহ্র এবাদত ওয়াজিব হয় আশা- প্রত্যাশা, ভয়-ভীতি এবং মহব্বত-ভালবাসা এই তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে। যে ব্যক্তি এ তিনটির কোন একটিকে ত্যাগ করল, সে ঈমানের একটি ওয়াজিবকে তরক করল। তবে আল্লাহ্ তা’আলার মহব্বত-ভালবাসা, আশা ও ভয়ের উপর প্রাধান্য পাওয়া আবশ্যক।
হযরত ফুযায়েল ইবনে আয়ায (রহঃ) বলেন, মহব্বত ভয়-ভীতি থেকেও অনেক উত্তম । হযরত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ায (রহঃ) বলেন, ভয়-ভীতি এতটুকুই যথেষ্ট, মু’মিনকে গোনাহের কাজ থেকে বাধা প্রদান করে। আর মহব্বত ও ভালবাসার কোন সীমা-রেখা নেই । যত ইচ্ছা ততই আল্লাহ্ তা’আলার মহব্বত নিজ অন্তরে সৃষ্টি করতে পারে ।
হযরত মুতরিফ, ইমাম হাসান বসরী ও ইমাম আহমদ প্রমুখ বুযুর্গগণ আশা ও ভয় উভয়টিকে সমান মর্যাদা প্রদান করতেন; কোনটিকে অন্যটির উপর প্রাধান্য দিতেন না। হযরত ফুযায়েল ইবনে আয়ায (রহঃ) ভয়কে আশার উপর প্রাধান্য দিতেন।
হযরত উহাইব ইবনে ওয়ারদ (রহঃ)-এর সতর্কবাণী
হযরত উহাইব ইবনুল ওয়ারদ (রহঃ) বলেন, তোমরা শ্রমিকদের মত হয়োনা যে, বলার পরে বা পারিশ্রমিকের প্রতিশ্রুতি দিলে কাজ করবে। ইবনুল ওয়ারদ এ উক্তিটিতে ঐ সকল লোকদের নিন্দা প্রকাশ করেছেন,যারা কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে নিরেট পারিশ্রমিকের প্রতি লক্ষ্য করে—অন্য কোন দিকে তারা খেয়াল করে না।
উপরিউক্ত বক্তব্যদ্বয়ে দু’টি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথম হল, আল্লাহ্তা ‘আলার সত্তাটাই হল এমন যোগ্য যে, সব সময় তাঁর আনুগত্য স্বীকার করা হবে, কখনো তাঁর অবাধ্য হওয়া যাবে না, তাঁর সাথে ভালবাসা রাখতে হবে। তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে হবে এবং তাঁকে পাওয়ার জন্য ওসীলা তালাশ করতে হবে। আর এটা পরের বিষয় যে, তিনি কাউকে সওয়াবও দিতে পারেন আবার কাউকে আযাবও দিতে পারেন।
আল্লাহ্ তা’আলা এদিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি স্বীয় বান্দার উপর যেসব নেয়ামতরাজি প্রদান করেছেন, বান্দার উপর আবশ্যক হয়ে যায় যে, তারা যেন আপন প্রতিপালকের সমূহ নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করে। এ দিকেই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐ হাদীসও ইঙ্গিত করে যে, যখন এবাদত করতে করতে তাঁর কদম মোবারক ফুলে যেত, তখন লোকেরা জিজ্ঞাসা করত, আপনি কেন এত কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছেন, অথচ আল্লাহ্ তা’আলা তো আপনার সামনের পিছনের সকল গোনাহ-খাতাসমূহকে ক্ষমা করে দিয়েছেন? তখন তিনি উত্তরে বলতেন, আমি কি শোকরগুজার বান্দা হব না?
এখানে দ্বিতীয় লক্ষণীয় বিষয় হল, সর্বাপেক্ষা অধিক আশা ও ভয় সেটাই, যা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে সম্পৃক্ত। ঐ ভয় নয় যা আল্লাহ্ তা’আলার মাখলূকের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। সর্বোচ্চ ভয় হল আল্লাহ্ তা’আলা থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ভয়, আল্লাহর নারাযীর ভয় । আর তাঁর দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়। যেমন নিম্নোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা নিজ শত্রুদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার আলোচনার পূর্বে তাঁর দীদার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন— كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَّبِّهِمْ يَوْمَيذٍ لَمَحْجُوبُوْنَ . ثُمَّ إِنَّهُمْ لَصَالُوا الجَحِيمِ
কখনো নয়, তারা সেদিন তাদের পালনকর্তা থেকে অন্তরালে থাকবে অতঃপর তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। —সূরা মুতাফ্ফিফীন ঃ ১৫-১৬
হযরত যুনূন মিসরী (রহঃ) বলেন, জাহান্নামের আগুনের ভয় আল্লাহ তা’আলা থেকে দূরত্বের তুলনায় তেমন, যেমন কুল-কিনারাহীন সমুদ্রের মোকাবিলায় দু-এক বিন্দু পানি মাত্র। সর্বোত্তম আশা হল সেটাই, যা আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য রেজা ও দর্শন লাভ সংক্রান্ত হয়ে থাকে । তবে কতেক লোক এ বিষয়ে বিভ্রান্তিতে পতিত তারা মনে করে যে, কুরব, (আল্লাহ্র নৈকট্য) রেজা (তাঁর সন্তুষ্টি) দীদার ও মুশাহাদা (তাঁর দর্শন লাভ) জান্নাতী নেয়ামতের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং হিজাব (আল্লাহ্ থেকে দূরত্ব ও মধ্যখানে পর্দা পড়ে থাকা) জাহান্নামের আযাবের অন্তর্ভুক্ত নয়। এগুলো স্পষ্ট ভুল ধারণা; বরং কুরব, রেজা ও মুশাহাদা অবশ্যই জান্নাতী নেয়ামতের তালিকাভুক্ত। অনুরূপ হিজাব ও দূরত্ব জাহান্নামের আযাবের ফিরিস্তিভুক্ত।
কতেক বুযুর্গের জান্নাত জাহান্নাম থেকে বেপরোয়া ভাব ও তার কারণ
আল্লাহ্ তা’আলা জাহান্নামে নানা ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন এবং জান্নাতে অসংখ্য প্রকারের নেয়ামতরাজি সুসজ্জিত করে রেখেছেন । এতদসত্ত্বেও কতেক বুযুর্গানে-দীন জান্নাতের নেয়ামত লাভের আশা করেন না এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকেন না ।
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে, উপরিউক্ত ধারণাটি স্পষ্ট ভুল ধারণা । কারণ, জান্নাতের আশা পোষণ এবং জাহান্নাম থেকে ভয় করা কুরআনী নির্দেশের অন্যতম দু’টি নির্দেশ। এর খেলাপ করে কেউ বুযুর্গ হতে পারেন না । উপরন্তু এটা তো মানুষের স্বভাবেরও বিপরীত। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের মাঝে এ স্বভাব সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, পছন্দনীয় বস্তুর আশা করবে এবং ঘৃণ্য বস্তুকে ভয় করবে। এখন কথা হল, তাদের মাঝে দৃশ্যতঃ এমন অবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায় কেন? বুঝে নিতে হবে তাদের মধ্যে যে অবস্থাটি বিরাজ করছে, তাহল ইস্তিগরাকী ও বিজদানী একটি অবস্থা। যে অবস্থায় মানুষ এক ধরনের উন্মাদনায় ও মোহে হারিয়ে যায়। তখন তাদের মাঝে ইচ্ছা ও এখতিয়ারের কোন দখল থাকে না। এ অবস্থাটি কেটে গেলে আবারো তাদের মাঝে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। তখন তাদের মাঝে জান্নাতের আশা ও জাহান্নামের ভয় প্রত্যক্ষ করা যায়।
বিষয়টিকে আরো সহজে এভাবে বুঝতে হবে। তাহল ইতিপূর্বে ‘জান্নাতের বর্ণনা’ নামক গ্রন্থে দেখতে পেয়েছেন যে, জান্নাতে ‘ইয়াওমুল মাযীদ’ নামক একটি দিবস হবে। সেদিন আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাতীদেরকে তাঁর দর্শন লাভ করানোর জন্য একটি বিশেষ ময়দানে একত্রিত করবেন । সেদিন জান্নাতীরা যখন আল্লাহ্ তা’আলার দর্শন লাভ করবে, তখন তারা জান্নাতের অন্যান্য সকল নেয়ামতকে ভুলে যাবে, যা ইতিপূর্বে তারা দেখেছিল। আল্লাহ্ তা’আলার তাজাল্লীর দিকে তারা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে, মুহূর্তের তরেও জান্নাতীরা অন্য কোন নেয়ামতের দিকে ফিরেও তাকাবে না। এ অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত বিরাজ করতে থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহ্ তা’আলার দিকে তাকিয়ে থাকবে। এর মধ্যে যদি কোন জান্নাতী জান্নাতের কোন নেয়ামতের আশা করে ও সে দিকে মনোনিবেশ করে অথবা জাহান্নামের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সেদিকে মনোযোগী হয়ে পড়ে, তাহলে তৎক্ষণাত সে আল্লাহর দীদার থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে। তাই ঐ মুহূর্তে কোন জান্নাতীই জান্নাতের কোন নেয়ামতের আশা করবে না এবং জাহান্নামের কোন আযাবের ভয় করবে না। হ্যাঁ, যখন তারা এ দীদারে আল্লাহ্ থেকে ফারেগ হয়ে আবারও নিজ নিজ ভবনে ফিরে আসবে, তখন জান্নাতের নেয়ামতসমূহ ভোগ করতে থাকবে অতিশয় আনন্দে-উল্লাসে এবং চরম স্বাচ্ছন্দ্যে; বরং ঐ সকল নেয়ামতকে ইয়াওমে মাযীদের উসীলায় আরও বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হবে।
উল্লেখ্য যে, এ অবস্থা হবে আখেরাতে, যা আল্লাহ্ তা’আলার আরেফীন ও সাদেকীন বান্দার ক্ষেত্রে প্রকাশ পাবে। অনুরূপ মাঝে মধ্যে তাদের জীবনে পৃথিবীতেও এমন অবস্থা প্রকাশ পেয়ে যায়। তাদের অন্তর জগতে আল্লাহ্তা ‘আলার তাজাল্লির আলোকরশ্মি বিরাজ করতে থাকে। ফলে তারা সকাল- সন্ধ্যা আল্লাহ্ তা’আলাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তাজাল্লীয়াতে খোদাওয়ান্দী তাদের অন্তরে এত বেশি প্রবল হয়ে যায় যে, জান্নাতের আশা এবং জাহান্নামের ভয় সেই প্রাবল্যের প্রবাহে হারিয়ে যায়। অর্থাৎ, আল্লাহ্ তা’আলার দর্শন লাভই জান্নাতের সর্বাপেক্ষা বড় নেয়ামত, তাই তারা জান্নাতের এ বড় নেয়ামতের আশায় ডুবে থাকেন । অনুরূপ তাঁর অসন্তুষ্টি হল জাহান্নামের সর্বাপেক্ষা বড় শাস্তি, তাই আল্লাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহ্র সত্তার মাঝেই ডুবে থাকেন ৷ কতটুকু ভয়-ভীতি প্রয়োজন ?
এতটুকু ভয়-ভীতি অর্জন করা ওয়াজিব, যদ্বারা ফরযসমূহ আদায় করা
এবং হারাম বস্তু থেকে বিরত থাকার যোগ্যতা পয়দা হয়ে যায়। এর চেয়ে বেশি এতটুকু ভয় যা অন্তরকে নফল এবাদতের দিকে উদ্বুদ্ধ করে এবং অনর্থক ও বাজে কাজ-কর্ম ও কথা-বার্তা থেকে ফিরিয়ে রাখে তা অর্জন করা প্রশংসনীয়। এর চেয়ে বেশি ভয় অন্তরে বিরাজ করা প্রকারান্তরে রোগ-ব্যাধি, মৃত্যু অথবা স্থায়ী দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যা আল্লাহ্ তা’আলার প্রত্যাশিত এবাদত ও আমল ইত্যাদি পালনেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে; যা মোটেও ঠিক নয়; বরং তা ইসলামের কাম্য বিষয়ের বহির্ভূত একটি কাজ।
হযরত আতা সুলামী (রহঃ)-এর ভয়
একারণেই অনেক বুযুর্গানে দ্বীন হযরত আতা সুলামীর উপর তাঁর চরম ভয়ের কারণে আশঙ্কা বোধ করতেন। ভয়-ভীতি তাঁকে কুরআন পর্যন্ত ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর একারণেই তিনি বিছানায় পড়ে গিয়েছিলেন। এ জন্যই এমন ভয়-ভীতি শরীঅতের কাম্য বিষয় নয়। হ্যাঁ, তবে ভয়-ভীতি জনগণকে সতর্ক করার একটি পন্থা বা উপায় মাত্র। এ কারণে দোযখও আল্লাহ্ তা’আলার অন্যান্য নেয়ামতসমূহের একটি নেয়ামত, যদ্দ্বারা বান্দা আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করে। তাই আল্লাহ্ তা’আলা সূরায়ে রহমানে জাহান্নামকেও অন্যান্য নেয়ামতের সাথে ফিরিস্তিভুক্ত করেছেন।
জাহান্নাম মু’মিনদের জন্য আল্লাহর রহমত স্বরূপ
হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহঃ) বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা জাহান্নামের আগুনকে মু’মিন বান্দার জন্য রহমত স্বরূপ বানিয়েছেন, যাতে তাদ্বারা স্বীয় বান্দাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করেন, ফলে তারা গোনাহ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে । –আবু নুআইম
সেহেতু জাহান্নাম দ্বারাও মূল উদ্দেশ্য হল বান্দাগণকে আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্য তাঁর সন্তুষ্টির দিকে ধাবিত করা। তাঁর নিষিদ্ধ ও অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত রাখা ।
হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা
হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা জনৈক ব্যক্তিকে এ আয়াত পড়তে শুনলেন— إِنَّ لَدَيْنَا أَنْكَالًا وَجَحِيمًا * وَطَعَامًا ذَا غُصَّةٍ وَ عَذَابًا أَلِيمًا
নিশ্চয়ই আমার কাছে রয়েছে শিকল ও অগ্নিকুণ্ড গলগ্রহ হয়ে যায় এমন খাদ্য এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি । —সূরা মুয্যাম্মিল : ১২-১৩
তৎক্ষণাত হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এক চিৎকার বের হয়ে গেল । অন্যত্র বর্ণিত আছে যে, উক্ত আয়াত শ্রবণ করে তিনি ক্রন্দন করতে লাগলেন এবং বেহুশ হয়ে পড়লেন।’
ফেরেশতাদের ক্রন্দন
হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি যুবকের নিকট তাশরীফ আনলেন, যে অর্ধরাত পর্যন্ত চিৎকার করে জাহান্নামের ভয়ে ভীত ছিল। সকালে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, হে যুবক! তুমি তো আজ ফেরেশতাদের বিশাল এক জামাআতকে কাঁদিয়ে ফেললে। —কিতাবুন্নওয়াহীন, ইমাম জাওয়াজানী
হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ)-এর অবস্থা
সুলায়মান (রাযিঃ) বলেন, আমাকে এমন এক লোক বর্ণনা করেন, যিনি স্বচক্ষে হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ)-কে নামায পড়তে দেখেছিলেন। তিনি নামাযে একবার ঝুকতেন, আবার হেলে পড়তেন, আবার কখনো ব্যথিত লোকদের মত ব্যথার প্রকাশ ঘটাতেন। কোন নবাগত লোক তাঁকে দেখে বলত, লোকটিকে হয়ত পাগলে পেয়েছে। তাঁর মাঝে এ অবস্থা বিরাজ করেছে নিম্নোক্ত আয়াতের প্রভাবে—وَإِذَا الْقُوْا مِنْهَا مَكَانًا ضَيِّقًا مُقَرَّنِينَ ) যখন তাদেরকে শৃংখলিত অবস্থায় জাহান্নামের সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে। —সূরা ফুরকান : ১৩
হযরত ইয়াযীদ ইবনে মারছাদ
হযরত আবদুর রহমান ইবনে ইয়াযীদ বলেন, আমি ইয়াযীদ ইবনে মারছাদের নিকট আরয করলাম, আপনার কী হল, আমি আপনার চোখকে কখনো শুকনো দেখিনি। তিনি বললেন, তুমি আমাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? আমি বললাম, হয়ত এ থেকে আল্লাহ তা’আলা আমাকে কোন উপকার দান করবেন। তিনি বললেন, ভাই! আল্লাহ্ তা’আলা আমাকে ভয় দেখিয়েছেন যে, যদি আমি তাঁর অবাধ্যতা করি, তাহলে তিনি আমাকে জাহান্নামে পতিত করবেন। আমি বললাম, নামাযের মধ্যেও কি আপনার এ অবস্থা হয়ে থাকে? তিনি বললেন, তুমি আমাকে এটা জিজ্ঞাসা করছ কেন? আমি বললাম, হতে পারে আল্লাহ্ তা’আলা তা দ্বারা আমাকে উপকৃত করবেন। তিনি বললেন, কসম আল্লাহ্! এ অবস্থা তো আমার ঐ সময়েও হয়ে থাকে, যখন আমি আমার পরিবার-পরিজনের নিকট থাকি। এ অবস্থা আমার এবং আমার ইচ্ছার মাঝেও অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। আমার সামনে যখন খানা রাখা হয়, তখনও আমার ঐ অবস্থা হয়। আমার এ অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী-পুত্ররাও কাঁদতে থাকে। কিন্তু তারা তো অবগত নয় যে, তাদেরকে কোন জিনিস কাঁদাল । আবার কখনও তো আমার স্ত্রী আমাকে খুব তিরস্কার শুরু করে ও বলতে থাকে, হায়রে! কোন জিনিস তোমাকে দীর্ঘ দুশ্চিন্তায় ফেলে রাখল? তোমাকে দেখে আমার নয়নদ্বয় কখনো শীতল হয় না । –কিতাবুয যুহদ
হযরত হাসান বসরী (রহঃ) এবং উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ)
হযরত ইয়াযীদ ইবনে হাওশাব (রহঃ) বলেন, আমি হযরত হাসান বসরী (রহঃ) এবং হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ) অপেক্ষা অধিক ভীত- সন্ত্রস্ত আর কাউকে দেখতে পাইনি। তাদেরকে দেখলে মনে হত, যেন জাহান্নাম তাদের ছাড়া আর কারো জন্য নির্মিতই হয়নি ৷
একদা হযরত হাসান বসরী (রহঃ) ক্রন্দন করছিলেন। কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, হুযূর! আপনাকে কোন্ বস্তু কাঁদাল? তিনি উত্তরে বললেন, আমার ভয় হচ্ছে যে, আগামী কাল আমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আর আমি বেপরোয়া দুনিয়াতে বসবাস করছি।
হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, মু’মিন সম্প্রদায় সর্বদা বিনয়াবনত থাকেন এবং বিনয়ভাব অবলম্বন করে থাকেন। অথচ তাদেরকেও আল্লাহ্তা ‘আলা কান, নাক ও চোখ প্রদান করেছেন। কিন্তু মূর্খ লোকেরা তাদেরকে অসুস্থ ও রুগ্ন ব্যক্তি জ্ঞান করে থাকে । অথচ তাঁরাই হল আহলে-দিল লোক । হে লোক! তোমার কি এ খবর নেই যে, কেয়ামতের দিবসে নেয়ামত প্রাপ্ত হয়ে তারা বলতে থাকবে— اَلْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَذْهَبَ عَنَّا الْحَزَنَ প্রশংসা সেই সত্তার, যিনি আমাদের থেকে দুঃশ্চিন্তাকে দূর করে দিয়েছেন।
এ সকল লোক পার্থিব জীবনে চিন্তিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে । তাদেরকে চিন্তায় ফেলে রাখে না এমন বস্তু যা অন্যদেরকে চিন্তিত করে। তাদেরকে চিন্তিত করে ও কাঁদিয়ে তোলে একমাত্র জাহান্নামের ভয়-ভীতি। —ইবনে মুবারক
হযরত ইবনে হানযালার অবস্থা
হযরত আবদুর রহমান ইবনে হারেস (রহঃ) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা যখন রোগ-শয্যায় শায়িত ছিলেন এবং আমি তাঁর শুশ্রূষায় রত ছিলাম, জনৈক লোক তাঁর নিকট এসে এ আয়াত তেলাওয়াত করল— لَهُمْ مِّنْ جَهَنَّمَ مِهَادُ وَ مِنْ فَوْقِهِمْ غَوَاشُ ‘তাদের জন্য নরকাগ্নির শয্যা রয়েছে এবং উপর থেকে রয়েছে আচ্ছাদনও।’ —সূরা আ’রাফ-৪১
হযরত ইবনে হানযালা এ আয়াত শুনে কেঁদে দিলেন। তাঁর এমন অবস্থা হয়ে গেল যে, আমার মনে হতে লাগল যে, হয়ত তাঁর প্রাণ বায়ু উড়ে গিয়েছে। এরপর যখন তাঁর হুশ ফিরে আসল, তখন তিনি উক্ত আয়াতের ভাবার্থের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এটা হবে জাহান্নামের একটি অংশ বিশেষ । অতঃপর তিনি নিজ পায়ে দাঁড়াতে চাইলে কেউ বলল, হে আবদুর রহমান! আপনি বসে যান। তিনি বলে উঠলেন, জাহান্নামের স্মরণ আমাকে বসতে দিচ্ছে না। আমার জানা নেই যে, আমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাই কি না? –ইবনে আবীদ্দুনয়া
হযরত আলী ইবনে ফুযায়েল ইবনে আয়ায
হযরত আবু বকর ইবনে আইয়াশ (রহঃ) বলেন, আমি একদা হযরত ফুযায়েল ইবনে আয়ায (রহঃ)-এর পেছনে মাগরিবের নামায পড়লাম । তখন আমার এক পাশে তাঁরই পুত্র আলীও নামাযে শরীক ছিল। হযরত ফুযায়েল ইবনে আয়ায (রহঃ) যখন সূরা তাকাসুর পাঠ করেন । (নিশ্চয় তোমরা জাহান্নামকে দেখতে পাবে) পর্যন্ত পৌঁছলেন, তখন পুত্র আলী বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল । হযরত ফুযায়েল (রহঃ)-এর সাহস হল না যে, সামনের আয়াত তেলাওয়াত করবেন । অতঃপর বহু কষ্টে আমাদেরকে নামায পড়িয়েছেন ।
হযরত আবু বকর (রহঃ) বলেন, আমি আলীর শিয়রে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অর্ধরাত কেটে যাওয়ার পর তার চেতনা ফিরল ।
ইমাম আবু নুআইম (রহঃ) থেকে বর্ণিত, হযরত ফুযায়েল (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, আমি এক রাতে উঁকি মেরে আলীকে দেখতে পেলাম যে, সে নির্জনে বসে বসে বলছে, ‘হায়! জাহান্নাম, জাহান্নাম থেকে কবে মুক্তি পাব ?’ উক্ত আলী ইবনে ফুযায়েল একদা হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার নিকট গমন করল । ইবনে উয়াইনা একটি হাদীস পাঠ করলেন, যার মধ্যে জাহান্নামের উল্লেখ ছিল। উল্লেখ্য, হযরত আলীর হাতে হাদীস লেখার একটি কাগজ ছিল ।
উক্ত হাদীস শুনার পর তিনি স্বজোরে এক চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন । কাগজটিও হাত থেকে পড়ে গেল । অতঃপর যখন ইমাম সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহঃ) তার দিকে ফিরে তাকালেন বললেন, আমি যদি জানতাম,সে এখানে উপস্থিত রয়েছে, তাহলে আমি কখনো এ হাদীস বয়ান করতাম না।
এরপর দীর্ঘক্ষণ অতীত হওয়ার পর তার চেতনা ফিরে আসে। হযরত আলী ইবনে খাশরাম (রহঃ) থেকে বর্ণিত, হযরত মানসূর ইবনে আম্মার (রহঃ) বলেন যে,একদা আমি মসজিদে হারামে বসে কথোপকথনে লিপ্ত ছিলাম। কথার মাঝে জাহান্নামের আলোচনা হতে থাকল । তখন আমি ফুযায়েল ইবনে আয়াযকে দেখতে পেলাম যে, তিনি জাহান্নামের দুরাবস্থার কথা শুনা মাত্রই চিৎকার করে বেহুশ হয়ে গেলেন এবং মাটিতে পড়ে গেলেন ৷
হযরত আবু নুআইম, হুলিয়া নামক গ্রন্থে লিখেন, আলী ইবনে ফুযায়েল (রহঃ) একবার ইমামের পেছনে নামায পড়ছিলেন । ইমাম সাহেব নামাযে সূরা আররহমান তেলাওয়াত করলেন। সালাম ফিরানোর পর কেউ আলী ইবনে ফুযায়েলকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি ইমামকে এ আয়াত পাঠ করতে শুনেন নি ? حُوْرُ مَقْصُوْرَاتُ فِي الْحَيَامُ ‘তাবুতে অবস্থানকারী হুরগণ।’ –সূরা আররহমান-৭২
তিনি উত্তরে বললেন, আমি তার আগের আয়াতে মশগুল ছিলাম। তা হল يُرْسِلُ عَلَيْكُمَا شُوَاظٌ مِنْ نَّارٍ وَ تُحَاسُ فَلَا تَنْتَصِرَانِ তোমাদের উপর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এবং ধুম্রকুঞ্জ নিক্ষেপ করা হবে,তখন তোমরা তা প্রতিহত করতে পারবে না। —সূরা আররহমান-৩৫
হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ)
ইবনে আবি যি’ব (রহঃ) বলেন, হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ) মদীনার আমীর থাকাকালে যে ব্যক্তি তার কাছে থাকত সে আমাকে বলেছে, একদা জনৈক ব্যক্তি তার সামনে এ আয়াত পাঠ করল— إِذَا الْقُوْا مِنْهَا مَكَانًا ضَيِّقًا مُقَرَّنِيْنَ دَعَوْا هُنَالِكَ ثُبُوْرًا
যখন তাদেরকে শিকলে বাঁধা অবস্থায় জাহান্নামের সংকীর্ণ স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, তখন সেখানে তারা নিজেদের মৃত্যু কামনা করবে।—সূরা ফুরকান-১৩
এ আয়াত শুনামাত্রই হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ) কেঁদে দিলেন। তিনি এত বেশি কাঁদতে থাকলেন যে, তিনি হিচকি মারতে থাকলেন । এক পর্যায়ে তিনি মজলিস থেকে উঠে ঘরে চলে গেলেন। অন্যান্য লোকেরাও মজলিস ছেড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ।
হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রহঃ)-এর নামায
হযরত আবূ নূহ আনসারী (রহঃ) বলেন, হযরত আলী ইবনে হুসাইন (রহঃ) -এর ঘরে একদা আগুন লেগে গেল, তখন তিনি সেজদায় ছিলেন। লোকেরা তাঁকে উচ্চস্বরে বলতে লাগল হে রাসূলের নাতী! আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করুন। তখনও তিনি মাথা উঠালেন না। এক পর্যায়ে আগুন নিভে গেল । তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, এ আগুন থেকে আপনাকে কোন জিনিস গাফেল বানিয়ে রাখল? তিনি উত্তরে বললেন, জাহান্নামের আগুন ।
হযরত আবু সুলায়মান দারানী (রহঃ)
আহমাদ ইবনে আবুল হাওয়ারী (রহঃ) বলেন, আমি আবু সুলায়মান দারানীকে একথা বলতে শুনেছি যে, নিজেকে রক্ষা করুন, অধিকাংশ সময় এমন অবস্থা হয়ে যায় যে, মনে হয় আমার মাথা জাহান্নামের দুই পাহাড়ের মধ্যখানে রয়েছে। আবার কখনো দেখতে পাই আমি জাহান্নামে ঝুলন্ত রয়েছি, এমনকি এক পর্যায়ে জাহান্নামের গভীরে গিয়ে পতিত হচ্ছি। যার এ অবস্থা সে দুনিয়াতে কিভাবে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারে ?
হযরত সায়ীদ ইবনে আবদুল আযীয (রহঃ)
হযরত আবু আবদুর রহমান আসাদী (রহঃ) বলেন, আমি হযরত সায়ীদ ইবনে আবদুল আযীযের নিকট আযর করলাম, আপনি নামায অবস্থায় কেন এত ক্রন্দন করে থাকেন। তিনি বললেন, ভাই! তুমি এ বিষয়ে আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করছ? আমি বললাম, চাচা জান! হতে পারে আল্লাহ্ তা’আলা তা দ্বারা আমাকে উপকৃত করবেন। তখন তিনি বললেন, আমি যখনই নামায শুরু করি, তখনই দোযখ আমার সামনে উপস্থিত হয়ে যায়। সুতরাং জাহান্নামের ভয়েই ক্রন্দন করি ।
হযরত আতা সুলামী (রহঃ)
সররার (রহঃ) বলেন, আমি আতা সুলামীকে নামাযের মধ্যে কাঁদার কারণে ধমক দিলাম । অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, হে সররার! তুমি আমাকে এমন বিষয়ে কেন ধমকাচ্ছ, যা আমার ইচ্ছার বাইরে। আমি যখন জাহান্নামীদের এবং তাদের উপর পতিত হওয়া আযাবের কথা স্মরণ করি, তখন আমার একটি আকৃতিও সেখানে দেখতে পাই। তাহলে আশংকা আছে যে, আমাকেও জাহান্নামীদের সাথে বেঁধে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। যদি তাই হয়, তাহলে কেনই বা কাঁদব না, কেনই বা আর্তচিৎকার করব না। যেই দেহকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে, সেই দেহ কেনই বা কান্নাকাটি করবে না?
আবদুল্লাহ ইবনে আবুল হুযায়েল (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি বুদ্ধিমান, তাকে জান্নাতের আলোচনা অপেক্ষা জাহান্নামের আলোচনা বেশি প্রভাবান্বিত করে। হযরত ইয়াযীদ রুকাশীর ভয়কাতরতা হযরত ইয়াযীদ রুকাশীকে একদা তার অধিক ক্রন্দনের কারণে নিন্দা করা হল। তাকে বলা হল, যদি জাহান্নামকে একমাত্র তোমার জন্যই বানানো হয়ে থাকে, তবুও তুমি একজন জাহান্নামী অপেক্ষা বেশি কাঁদতে পার না । (কারণ, তুমি তো জান্নাতীও।) অর্থাৎ, তুমি একজন জান্নাতী এবং মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও এত কাঁদছ, যত বেশি কাঁদা দরকার ছিল একজন জাহান্নামী ব্যক্তির? তখন তিনি উত্তরে বললেন, জাহান্নাম তো আমার এবং আমার জিন ও ইন্সান ভাইদের ছাড়া আর কারও জন্যে তৈরী করা হয়নি । তুমি কি এ আয়াত পাঠ করনি— سَنَفْرُغُ لَكُمْ أَيُّهَا الثَّقَلَانِ হে মানব ও দানব গোষ্ঠি! আমি অচিরেই তোমাদের হিসাব-নিকাশের জন্য ফারেগ হয়ে যাচ্ছি। —সূরা আররহমান-৩১
তুমি কি এ আয়াত পাঠ করনি— يُرْسَلُ عَلَيْكُمَا شُوَاظٌ مِنْ نَّارٍقَ تُحَاسُ فَلَا تَنْتَصِرْنِ فَبِأَيِّ الَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبْنِ فَإِذَا انْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَالدِهَانِ فَبِأَي الَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبْن فَيَوْمَيذٍ لَّا يُسْتَلُ عَنْ ذَنْبِةٍ إِنْسٌ وَ لَا جَانٌّ فَبِأَيِّ الآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبْن يُعْرَفُ الْمُجْرِمُوْنَ بِسِيْمُهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِي وَ الْأَقْدَامِ فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبُنِ هَذِهِ جَهَنَّمُ الَّتِي يُكَذِّبُ بِهَا الْمُجْرِمُوْنَ يَطُوْفُوْنَ بَيْنَهَا وَ بَيْنَ حَمِيمٍ أَن
যার অর্থ হল—তোমাদের প্রতি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ এবং ধুম্রকুঞ্জ ছাড়া হবে, তখন তোমরা তা প্রতিহত করতে পারবে না। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? যে দিন আকাশ বিদীর্ণ হবে, তখন সেটি রক্তবর্ণে রঞ্জিত চামড়ার মত হয়ে যাবে। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? সে দিন না মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হবে তার অপরাধ সম্পর্কে আর না জিনকে। অতএব, তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ নেয়ামতকে অস্বীকার করবে। অপরাধিদেরকে চেনা যাবে তাদের চেহারা থেকে। অতঃপর তাদের কপালের চুল ও পা ধরে টেনে নেয়া হবে। অতএব, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কোন্ কোন্ অবদানকে অস্বীকার করবে? এটাই হল জাহান্নাম, যাকে অপরাধিরা মিথ্যা বলত। তারা জাহান্নামের আগুন ও তার ফুটন্ত পানির মাঝখানে প্রদক্ষিণ করবে। —সূরা রহমান ঃ ৩৫-৪৪
এ আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে তিনি এক চিৎকার দিলেন এবং কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে গেলেন।
হযরত মুয়াযা (রহঃ)-এর বিবাহ
যখন হযরত মুয়াযা আদাবিয়্যাহকে তার স্বামীর হাতে তথা সেলা ইবনে আশয়ামের হাতে বিদায় করা হল, তখন আশয়ামের ভাতিজা তাকে গোসল করার জন্য গরম পানির গোসলখানায় পাঠাল। গোসলের পর তাকে একটি পরিচ্ছন্ন ও সুগন্ধিযুক্ত কক্ষে পাঠিয়ে দিল। কক্ষে ঢুকে তিনি নামাযে দাড়িয়ে গেলেন। নামায পড়তে পড়তেই সকাল হয়ে গেল। তার বধু মুয়াযা ও নামাযে দাঁড়াল এবং নামায পড়তে পড়তে সকাল করে ফেলল। সকাল হওয়ার পর আশয়ামের ভাতিজা তাকে খুব ধমকাল । তখন তিনি উত্তরে বললেন, গতকাল তুমি আমাকে প্রথমে গরম পানি-যুক্ত গোসলখানায় প্রবেশ করিয়েছ, যা জাহান্নামের আভাস বহন করে। তাই তখন আমার জাহান্নামের কথা স্মরণ হয়ে গেল ।
অতঃপর তুমি আমাকে একটি আরামদায়ক কক্ষে প্রবেশ করিয়েছ, যা জান্নাতের আভাস বহন করে। তখন আমার জান্নাতের কথা মনে পড়ে গেল। আমি তো সারা রাত এ দুয়ের চিন্তাতেই ডুবে ছিলাম আর এভাবেই সকাল হয়েছে ।
ইমাম আওযায়ী (রহঃ)
প্রখ্যাত মুহাদ্দেস ইমাম আওযায়ী (রহঃ) যখন দোযখের কথা স্মরণ করতেন, তখন তিনি সেই চিন্তাতেই ব্যস্ত হয়ে থাকতেন। কারও সাহসও হত না যে, তাকে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবে। হ্যাঁ, যদি তিনি নিজে নিজেই তা থেকে ফিরে আসতেন, তাহলে তা ভিন্ন কথা। হযরত ওলীদ (রহঃ) বলেন, একদা আমি আমাকে সম্বোধন করে বললাম, কোন লোক যতক্ষণ পর্যন্ত তার মজলিসে বসে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তার অন্তরের আক্ষেপ প্রকাশ করতে থাকবেন।
জনৈক আবেদা নারীর ঘটনা
আমেনা বিনতে আবিল ওয়ারা (রহঃ) ছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত আবেদা নারীদের অন্যতম এক নারী। তার সামনে যখন জাহান্নামের আলোচনা করা হত, তখন তিনি বলতেন, জাহান্নামে প্রবেশ কর, তা থেকে খাও-দাও আর আয়েশ কর, অতঃপর তিনি এত বেশি ক্রন্দন করতেন যে, কেমন যেন পাতিলের মধ্যে কোন শস্য সিদ্ধ করা হচ্ছে। জাহান্নামের আলোচনায় তিনি নিজেও কাঁদতেন এবং অন্যান্যদেরকেও কাঁদাতেন।
সমুদ্র তীরের এক জাতি
হযরত আবদুল ওয়াহিদ ইবনে যায়েদ (রহঃ) বলেন, আমি ঐ জাতির মত আর কোন জাতি দেখতে পাইনি, যারা এক সমুদ্র তীরে বসবাস করত। তারা জাহান্নামের ভয়ে রাতভর কান্নাকাটি করত এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করত। আমি তাদের থেকে এছাড়া আর কিছু শুনতে পাইনি। সকালে যখন আমি তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলতে থাকলাম, তখন আর কাউকে দেখতে পেলাম না ৷
হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ)-এর ঘটনা
হযরত আবু হাইয়্যান তাইমী (রাযিঃ) বলেন, আমি ত্রিশ বৎসর যাবৎ একথা শুনে এসেছি যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) ঐ সকল কামারের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতেন, যারা হাপরে ফুক দেয়। সেখানে গিয়ে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতেন । —ইবনে আবীদ্দুনয়া
হযরত ওয়ায়েস করণী (রহঃ)-এর ঘটনা
হযরত আতা খোরাসানী (রহঃ) বলেন, হযরত ওয়ায়েস করণী (রহঃ) কামারের দোকানে গিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করতেন, তারা কিভাবে হাপরে ফুঁক দেয় তা খেয়াল করতেন। অনুরূপভাবে তিনি আগুনের আওয়াজ শুনে চিৎকার মেরে বেহুশ হয়ে পড়ে যেতেন।
হযরত তলহা এবং যায়েদ (রাযিঃ) -এর ঘটনা
ইবনে আবী যুবাব (রহঃ) বলেন, হযরত তলহা এবং হযরত যায়েদ (রাযিঃ) একদা কামারের হাপরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন। সেখানে দাড়িয়ে তারা আগুনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন এবং কাঁদতে থাকেন।
হযরত রবী ইবনে খাইছাম (রহঃ)-এর ঘটনা
ইমাম আ’মাশ (রহঃ) বলেন, আমাকে এমন লোক বর্ণনা করেছে, যে হযরত রবী ইবনে খাইছামের সাক্ষাৎ লাভ করেছে। সে বলল যে, হযরত রবী ইবনে খাইছাম কামারের নিকট গিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড ও হাপরের লেলিহান দৃশ্য দেখে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন।
হযরত হামামা এবং হারম ইবনে হাইয়ানের ঘটনা
মাতর আল ওয়াররাক (রহঃ) বলেন, হামামা এবং হারম ইবনে হাইয়ান যখন সকাল বেলা কামারদের হাপরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করতেন, তখন প্রত্যক্ষ করতেন কিভাবে লোহাকে জ্বালানো হয় এবং তাতে ফুঁক দেয়া হয়, তখন তিনি তথায় দাঁড়িয়ে ক্রন্দন করতেন এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন।
বিশর ইবনে কা’ব এবং কুরায়ে বসরার ঘটনা
প্রখ্যাত মুহাদ্দেস হযরত হাম্মাদ ইবনে সালামা (রহঃ) থেকে বর্ণিত, বিশর ইবনে কা’ব এবং কুরায়ে বসরা কামারদের নিকট গমন করতেন এবং আগুনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতেন এবং আল্লাহ্ তা’আলার নিকট জাহান্নামের আগুন থেকে আশ্রয় প্রর্থনা করতেন।
হযরত আতা সুলামী (রহঃ)-এর ঘটনা
আলা ইবনে মুহাম্মাদ (রহঃ) বলেন, আমি হযরত আতা সুলামী (রহঃ)-এর নিকট এসে দেখলাম যে, তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে আছেন। আমি তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার এ অবস্থা কেন? স্ত্রী উত্তরে বললেন, আমাদের এক প্রতিবেশি তন্দুর জ্বালিয়েছিল । তা দেখেই তিনি বেহুশ হয়ে গেছেন ।
হযরত মুয়াবিয়া কিন্দী (রহঃ) বলেন, একদা আতা সুলামী (রহঃ) এক বালকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যার হাতে একটি অগ্নিশিখা ছিল। বাতাসের কারণে আগুন বেড়েই চলছিল । তা দেখে তিনি বেহুশ হয়ে গেলেন।
ফায়দা ঃ হযরত সালেহ ইবনে বশীর (রহঃ) বলেন, আমি একদা হযরত আতা সুলামীকে স্বপ্নে দেখা পেয়ে বললাম, আল্লাহ্ তা’আলা আপনার উপর দয়া করুন। আপনি তো দুনিয়াতে খুব বেশি চিন্তিত থাকতেন। এ দীর্ঘ চিন্তার পর আখেরাতে আপনি কী পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছেন? তিনি উত্তরে বললেন, এ দীর্ঘ চিন্তা ও অস্থিরতার পরে আমি দীর্ঘ আরাম ও প্রশান্তি প্রাপ্ত হয়েছি । এরপর আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সেখানে আপনার পদমর্যাদা কী? তিনি বললেন, আমি এখানে আম্বিয়া, সিদ্দীকীন, শুহাদা ও সালেহীনগণের পদমর্যাদা প্রাপ্ত হয়েছি; যাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলা পুরস্কৃত করেছেন । —এহইয়াউল উলূম
হযরত উমর (রাযিঃ)-এর ঘটনা
হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, হযরত উমর (রাযিঃ)-এর সামনে যখনই আগুন প্রজ্জ্বলিত হত, তখনই তিনি নিজ হাত তার খুব কাছে নিয়ে যেতেন। নিজেকে সম্বোধন করে বলতেন, হে ইবনে খাত্তাব! দেখ, এ আগুন সহ্য করা কি তোমার পক্ষে সম্ভব?
আহনাফ ইবনে কায়েস (রহঃ)-এর ঘটনা
আহনাফ ইবনে কায়েস (রহঃ) রাতের বেলা প্রদীপের কাছে আসতেন এবং তাতে নিজ আঙ্গুল রেখে বলতেন, উহ! উহ!! এরপর বলতেন, হে আহনাফ! অমুক দিন অমুক গোনাহের জন্য তোকে কোন্ বস্তু উৎসাহিত করেছিল ?
তথ্যসূত্র:
বই :জাহান্নামের বর্ণনা মূল :আল্লামা মুফতী মোহাম্মদ এমদাদুল্লাহ আনওয়ার অনুবাদ :মাওলানা নাজমুল হুদা মিরপুরী