ইসলাম

কারামত, কাশফ, এল্হাম ও পীর-বুযুর্গ ও মাজার সম্বন্ধে আকীদা

নবী-রাসূল ব্যতীত আল্লাহর যেসব খাস বান্দারা আল্লাহর হুকুম এবং নবীজীর তরীকা মত চলেন, নাফরমানী করেন না এবং যারা আল্লাহ্ তা’আলাকেই স্বীয় কর্মের অভিভাবক মনে করেন পরিভাষায় তাদেরকে ওলী/বুযুর্গ বলা হয়। আল্লাহ্ তা’আলা কখনো কখনো ওলী/বুযুর্গদের থেকে কারামত এর বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তবে ওলী হওয়ার জন্য কারামত শর্ত নয় ৷

কারামত এর আভিধানিক অর্থ হল, সম্মান, মর্যাদা, মহত্ত্ব ইত্যাদি। পরিভাষায় কারামত বলা হয় নবী নন-এমন কোন বুযুর্গ ব্যক্তি থেকে প্রচলিত রীতির ব্যতিক্রম কোন বিষয় সংঘটিত হওয়াকে কারামত বলা হয়।

বুযুর্গ এবং ওলী আউলিয়াদের দ্বারা আল্লাহ তা’আলা যেসব অসাধারণ কাজ দেখিয়ে থাকেন, তাকে বলা হয় কারামত। আর জাগ্রত বা নিদ্রিত অবস্থায় তারা যে সব ভেদের কথা জানতে পারেন বা চোখের অগোচর জিনিসকে দেলের চোখে দেখতে পারেন, তাকে বলা হয় কাশফ ও এল্হাম।

বুযুর্গদের কারামত ও কাশফ এল্হাম সত্য। কুরআন-হাদীছ দ্বারা কারামত সত্য হওয়া প্রমাণিত।’ হযরত মারয়ামের কাছে অমৌসুমী ফল আসা এবং (আসিফ ইবনে বারখিয়া কর্তৃক) মূহুর্তে ইয়ামান হতে বিলকীসের সিংহাসন স্থানান্তরের ঘটনা কুরআন দ্বারা প্রমাণিত।

ইরশাদ হয়েছে : যখনই যাকারিয়া তার (মারয়ামের) কাছে ইবাদতখানায় প্রবেশ করত, তার কাছে পেত আহার্য। সে বলত হে মারয়াম! এটা কোত্থেকে তোমার কাছে এল ? সে বলত, আল্লাহর কাছ থেকে । (সূরাঃ ৩-আলু ইমরানঃ ৩৭)

অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে ঃ অর্থাৎ, যার নিকট কিতাবের জ্ঞান ছিল সে (অর্থাৎ, আসিফ ইবনে বারাখিয়া) বলল আপনার চক্ষুর পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দেব। অতঃপর যখন সে (সুলাইমান) সেটাকে সন্মুখে অবস্থিত দেখল তখন সে বলল এটা আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। (সূরাঃ ২৭-নাম্‌লঃ ৪০)

মারয়াম ও আসিফ ইবনে বারাখিয়া-র ঘটনা মু’জিযা নয়। কেননা মারয়াম (আঃ) বা হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর সহচর আসিফ ইবনে বারখিয়া-এতদুভয়ের কেউই নবী ছিলেন না। তাই এগুলো পয়গম্বরীর প্রমাণজ্ঞাপক অলৌকিক ঘটনা (মু’জিযা) হতে পারে না। বরং এ হচ্ছে কারামতের অন্তর্ভুক্ত।

আবূ নুআইম ও আবূ ইয়া’লা কর্তৃক বর্ণিত রেওয়ায়েতে আছে – হযরত ওমর (রাঃ) নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে হযরত সারিয়াকে সেনাপতি বানিয়ে প্রেরণ করেন। একদিন কাফেররা পাহাড়িয়া ঘাটিতে ওঁত পেতে থেকে মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন হযরত ওমর (রাঃ) মদীনায় জুমুআর খুতবা দিচ্ছিলেন তিনি (অর্থাৎ হে সারিয়া! পাহাড়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখ।) বলে চিৎকার দেন। আল্লাহ তা’আলা এই আওয়াজ সারিয়ার সৈন্যবাহিনী পর্যন্ত পৌঁছে দেন।

মৃত্যুর পরও কোন বুযুর্গের কারামত প্রকাশিত হতে পারে।

কারামত ও কাশ্ফ এল্হাম হয়ে থাকে বুযুর্গ এবং ওলীদের দ্বারা। বুযুর্গ এবং ওলী বলা হয় আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে আর শরী’আতের রবখেলাফ করে কেউ আল্লাহর প্রিয় তথা ওলী বা বুযুর্গ হতে পারে না, অতএব যারা শরী’আতের বরখেলাফ করে যেমন নামায রোযা করে না, গাঁজা, শরাব বা নেশা খায়, বেগানা মেয়েলোককে স্পর্শ করে বা দেখে, গান-বাদ্য করে ইত্যাদি, তারা কখনও বুযুর্গ নয়। তারা যদি অলৌকিক কিছু দেখায় তাহলে সেটা কারামত নয় বরং বুঝতে হবে হয় সেটা যাদু বা কোনরূপ তুকতাক ও ভেল্কিবাজী, কিংবা যে কোন রূপ প্রতারণা । অনেক সময় শয়তান এসব লোকদেরকে গায়েব জগতের অনেক খবর জানিয়ে দেয়, যাতে করে এটা শুনে মূর্খ লোকেরা তাদের ভক্ত হয়ে যায় এবং এভাবে তারা বিভ্রান্তির শিকার হয় । এসব দেখে তাদের ধোঁকায় পড়া যাবে না।

কাশফ এবং এল্হাম যদি শরী’আতের মোতাবেক হয় তাহলে তা গ্রহণযোগ্য, অন্যথায় তা গ্রহণযোগ্য নয়।

ওলীগণের কাশফ ও এল্হাম দলীল নয় অর্থাৎ, তার দ্বারা কোন আমল প্রমাণিত হয় না । কোন বুযুর্গ বা পীর সম্বন্ধে এই আকীদা রাখা শির্ক যে, তিনি সব সময় আমাদের অবস্থা জানেন।

কোন পীর বা বুযুর্গকে দূর দেশ থেকে ডাকা এবং মনে করা যে তিনি জানতে পেরেছেন-এটা শির্ক। কোন পীর বুযুর্গ গায়েব জানেন না, তবে কখনও কোন বিষয়ে তাদের কাশফ এল্হাম হতে পারে, তাও আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।

কোন পীর বুযুর্গের মর্যাদা- চাই সে যতবড় হোক- কোন নবী বা সাহাবী থেকে বেশী বা তাঁদের সমানও হতে পারে না।

কোন আকেল বালেগ কখনও এই স্তরে উপনিত হয় না যে, তার উপর থেকে ইবাদত-বন্দেগী মাফ হয়ে যায়। কেউ আল্লাহ্র ওলী হয়ে গেলেও তার ব্যাপারে এই নীতি প্রযোজ্য। ইয়াকীন তথা মৃত্যু আসা পর্যন্ত তোমার প্রতিপালকের ইবাদত করতে থাক। (সূরাঃ ১৫-হিজ্বরঃ ৯৯)

এ আয়াত দ্বারা যারা বলতে চায় যে, ইয়াকীনের দরজা হাসিল হয়ে গেলে তার ইবাদতের প্রয়োজন থাকে না, তাদের ব্যাখ্যা ভুল। কারণ সব মুফাসসির এ ব্যাপারে একমত যে, এখানে আল ইয়াকিন দ্বারা মৃত্যুকে বুঝানো হয়েছে। এখানে আমরণ ইবাদতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বুযুর্গানে দ্বীন ও ওলী আল্লাহদের নিদর্শন থেকে বরকত লাভ হয়ে থাকে। বুযুর্গানে দ্বীন ও ওলী আল্লাহদের নিদর্শন থেকে বরকত লাভ দুই ভাবে হয়ে থাকে ৷

১. তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত বস্তু দ্বারা বরকত লাভ। এটাকে বলা হয় নি। যেমন নবী করীম (সাঃ)-এর চুল মুবারক, তার জুব্বা মুবারক, ইত্যাদি। এমনিভাবে ওলী-আউলিয়াগণের এ জাতীয় কোন বস্তু।

২. তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান থেকে বরকত লাভ। এটাকে বলা হয় তাবাররুক বিল মাকান যেমন নবী করীম (সাঃ)-এর জন্মস্থান, তাঁর উপর প্রথম ওহী আগমন ও তাঁর সুদীর্ঘ ধ্যানমগ্ন থাকার স্থান হেরা গুহা, হাজার বার ওহী আগমনের স্থান খাদীজার গৃহ, হিজরতের সময় তাঁর আত্মগোপন থাকার স্থান গারে ছাওর, দারে আরকাম, আবূ বকর, ওমর প্রমুখ সাহাবীদের গৃহ ইত্যাদি।

দ্বিতীয় প্রকার সম্বন্ধে সালাফী ও গায়রে মুকাল্লিদগণের মতবিরোধ ও তা নিয়ে তাদের বাড়াবাড়ি রয়েছে। ২য় খণ্ডে এ বিষয়ে কুরআন, হাদীছ, ইজমা ও কিয়াসের দলীল প্রমাণাদি ও সালাফীগণের দলীলের জওয়াব সহ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । দেখুন 9:880-8891

মাজার সম্বন্ধে আকীদা

“মাজার” শব্দের অর্থ যিয়ারতের স্থান। সাধারণ পরিভাষায় বুযুর্গদের কবর -যেখানে যিয়ারত করা হয়- তাকে ‘মাজার’ বলা হয়। সাধারণ ভাবে কবর যিয়ারত দ্বারা বেশ কিছু ফায়দা হয় যেমন কল্‌ব নরম হয়, মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়, আখেরাতের চিন্তা বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি। বিশেষ ভাবে বুযুর্গদের কবর যিয়ারত করলে তাদের রূহানী ফয়েযও লাভ হয় ।

মাযারের এতটুকু ফায়দা অনস্বীকার্য, কিন্তু এর অতিরিক্ত সাধারণ মানুষ মাযার ও মাযার যিয়ারত সম্পর্কে এমন কিছু গলত ও ভ্রান্ত আকীদা রাখে, যার অনেকটা শির্ক-এর পর্যায়ভুক্ত, যেগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য । যেমনঃ

মাজার সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা সমূহ ঃ

১. মাযারে গেলে বিপদ আপদ দূর হয়। ২. মাযারে গেলে আয়-উন্নতিতে বরকত হয় । ৩. মাযারে গেলে ব্যবসা বাণিজ্য বেশী হয়। ৪. মাযারে সন্তান চাইলে সন্তান লাভ হয় । ৫. মাযারে গেলে মকসূদ হাসেল হয়। ৬. মাযারে মান্নত মানলে উদ্দেশ্য পূরণ হয়। ৭. মাযারে টাকা-পয়সা নযর-নিয়ায দিলে ফায়দা হয়। ৮. মাযারে ফুল, মোমবাতি, আগরবাতি ইত্যাদি দেয়াকে ছওয়াবের কাজ মনে করা ইত্যাদি।

তথ্য সূত্রঃ

কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *