মে’রাজ সম্বন্ধে আকীদা :
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)কে আল্লাহ তা’আলা একদা রাত্রে জাগরিত অবস্থায় স্বশরীরে মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত নিয়ে যান। সেখান থেকে সাত আসমানের উপর এবং সেখান থেকেও আরও উপরে যতদূর আল্লাহর ইচ্ছা নিয়ে যান। সেখানে আল্লাহর সাথে রাসূল (সাঃ)-এর কথাবার্তা হয়। তখনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের বিধান দেয়া হয় এবং সেই রাতেই রাসূল (সাঃ) আবার দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তন করেন। একে মে’রাজ বলে। মে’রাজ হক ও সত্য। কুরআন হাদীছ দ্বারা এটা প্রমাণিত। এ বিষয়ে উম্মতের ইজমাও সংঘটিত হয়েছে।
মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত গমনকে ইসরা বলা হয়। এটা কুরআন ও হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত।
কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : অর্থাৎ, পবিত্র ও মহিমাময় ঐ সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায়; যার পরিবেশ আমি করেছি বরকতময়, তাঁকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য । (সূরাঃ ১৭-বানী ইসরাঈলঃ ১)
মুসলিম শরীফের হাদীছে ইরশাদ হয়েছে ; হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত- রাসূল (সাঃ) বলেন : আমার কাছে আনা হল বোরাক। সেটি ছিল একটি প্রাণী সাদা, গাধার চেয়ে বড় এবং খচ্চরের চেয়ে ছোট। সেটি তার দৃষ্টির শেষ সীমানায় এক একটা পদক্ষেপ চালায়। তখন আমি তাতে আরোহন করলাম। এমনকি বায়তুল মুকাদ্দাস এলাম।
ইসরা শব্দের আভিধানিক অর্থ কোন বস্তুকে রাত্রে চালানো বা রাতে নিয়ে যাওয়া। আর পরিভাষায় মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমনকে ইসরা বলা হয়।
বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে সপ্তম আসমানের উপর সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমনকে মে’রাজ বলা হয়। হাদীছে খবরে ওয়াহেদ দ্বারা এটা প্রমাণিত।
মে’রাজ শব্দের আভিধানিক অর্থ ঊর্ধ্বে আরোহন করা। মে’রাজ শব্দটির অর্থ উর্ধ্বে আরোহন করা। পরিভাষায় মসজিদে আকসা থেকে উর্ধ্ব জগতে সিদ্রাতুল মুন্তাহা পর্যন্ত রাসূল (সাঃ)-এর ভ্রমনকে মে’রাজ বলা হয়। কেউ কেউ বলেন মে’রাজ শব্দের অর্থ সিড়ি। যেহেতু রাসূল (সাঃ)কে একটা চলন্ত সিঁড়িতে করে উর্ধ্বলোকে আরোহন করানো হয়েছিল, তাই এই ভ্রমনকে মে’রাজ বলে অভিহিত করা হয়। কখনো কখনো উভয় ভ্রমনকে ইসরা ও মে’রাজ বলা হয়।
সাহাবা, তাবিয়ীন ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের গবেষক উলামায়ে কেরামের মতে মে’রাজ হয়েছিল রাসূল (সাঃ)-এর জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে। মে’রাজ সম্পর্কিত উপরোল্লেখিত আয়াত-এর بعبده শব্দটিও (যার অর্থ তাঁর বান্দাকে) শারীরিক মে’রাজকেই প্রমাণিত করে। তদুপরি কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল (সাঃ)কে মে’রাজে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে আল্লাহর কুদরত প্রত্যক্ষ করানো। আর এটা স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় দেখানোকেই বোঝায়।
কারও কারও ধারণা-এটা স্বপ্নের মাধ্যমে ঘটিত বিষয়। তাদের ধারণার ভিত্তি হল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত : আমি যে দৃশ্য তোমাকে দেখিয়েছি তা এবং কুরআনে উল্লেখিত অভিশপ্ত বৃক্ষটিও কেবল মানুষের জন্য পরীক্ষা বানিয়েছি। (সূরাঃ ১৭-বানী ইসরাঈলঃ ৬০)
তারা বলতে চান এ আয়াত الرؤيا শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ হল স্বপ্ন। কিন্তু তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। কেননা এ আয়াতে উল্লেখিত الرؤيا শব্দটি বদর যুদ্ধের সময়ের স্বপ্ন অথবা হুদায়বিয়ার ঘটনা সম্পর্কে দেখা স্বপ্ন কিংবা মক্কায় উমরা পালনের ব্যাপারে দেখা স্বপ্নের উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়েছে । একান্তই এ আয়াতকে মে’রাজের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট বললে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর ভাষ্যমতে এখানে না শব্দটি তথা দেখার অর্থে ব্যবহৃত হবে।
কেউ কেউ মে’রাজের ঘটনাকে আধ্যাত্মিক ঘটনা বলে মন্তব্য করেছেন। এ ধারণা ঠিক নয় এ কারণে যে, সেরূপ হলে এ ঘটনা শুনে মক্কার মুশরিকদের এত বিস্ময় বোধ করা এবং এটাকে নিয়ে তাদের এত হৈ চৈ করার কোন অবকাশ থাকত না। কেননা আধ্যাত্মিক উপায়ে এর চেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাও একজন সাধারণ মানুষ থেকেও ঘটতে পারে।
প্রাচীন দার্শনিকগণ মে’রাজকে অসম্ভব মনে করত। কেননা আসমান বিদীর্ণ হওয়া বা তাতে ছিদ্র করা আবার তাতে জোড়া লাগানো অসম্ভব। কিন্তু খোদার অস্তিত্বকে মেনে নিলে এ সব প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে না। খোদার পক্ষেতো সবই সম্ভব। তদুপরি আসমানের দরজা আছে বলে মেনে নিলে বিদীর্ণ হওয়া বা ছিদ্র করার প্রশ্নও উত্থাপিত হয়না। মে’রাজের বর্ণনা সম্বলিত হাদীছে প্রত্যেক আসমানে গিয়ে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) কর্তৃক মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পরিচয় প্রদান এবং তাঁকে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে মর্মে অবগতি প্রদানের পর খুলে দেওয়ার কথা বর্ণিত আছে, যা আসমানের দরজা থাকার দিকে ইংগিত বহন করে।
আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকেও মে’রাজ অসম্ভব মনে হতে পারে। কারণ :
১. বিজ্ঞানে এখনও আসমানের অস্তিত্ব আছে বলে প্রমাণিত হয়নি।
২. এ পৃথিবীর উপরে যে বায়ুর স্তর আছে তার উচ্চতা মাত্র ৫২ মাইল। এর উপরে কোন বায়ুর স্তর নেই। অতএব সেখানে কোন প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
৩. প্রাচীন ও আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতে বায়ুর স্তরের উর্ধ্বে শ্বৈত্যমণ্ডল অবস্থিত। প্রাচীন বিজ্ঞানীদের মতে আরও রয়েছে অগ্নিমণ্ডল। মে’রাজে যেতে হলে উল্লেখিত দুটি স্তর অতিক্রম করে যেতে হবে। অথচ এ স্তরে জড়দেহ বিশিষ্ট কোন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় ৷
৪. মধ্যাকর্ষণের যুক্তি দিয়েও কেউ কেউ মে’রাজে স্বশরীরে গমনকে অসম্ভব বলেছিল।
প্রথম প্রশ্নের উত্তর হল : আকাশের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি বলেই তার অস্তিত্ব নেই বলা অবৈজ্ঞানিক। কোন কিছু দৃষ্টির অধিগম্য না হওয়ায় সেটার অস্তিত্বকে অস্বীকার করলে মহা বিশ্বের অনেক কিছুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে হবে। এমন অনেক কিছু আছে যা আমরা দেখতে পাই না।
দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ প্রশ্নের উত্তর হল : এখন উর্দ্ধ জগতে বিজ্ঞানীদেন গমন এসব প্রশ্নকে অবান্তর প্রমাণিত করেছে। এরপরও স্বশরীরে মে’রাজে গমনকে অস্বীকার করা হলে তা সত্য বিদ্বেষ বলেই প্রমাণিত হবে।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬