মেসওয়াক প্রিয় নবীর প্রিয় সুন্নাত
মিসওয়াক শব্দটি সিওয়াক শব্দমূল থেকে নিষ্পন্ন। এর আভিধানিক অর্থ হলো- ঘষা-মাজা বা মর্দন করা। এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো দাঁতন। ইসলামী পরিভাষায়- দাঁত থেকে হলুদ বর্ণ বা এ জাতীয় ময়লা দূর করার জন্য কাঠ বা গাছের ডাল ব্যবহার করাকে মিসওয়াক বলা হয়।
মিসওয়াক প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় একটি সুন্নত। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত এটি। আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ، مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ.
মিসওয়াক মুখের পবিত্রতা, রবের সন্তুষ্টির মাধ্যম। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৮৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৩৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১০৬৭
মিসওয়াক ইসলামের উন্নত রুচি ওপরিচ্ছন্নতার পরিচায়ক। মুমিনের ভেতরটা যেমন স্বচ্ছ ও কলুষতামুক্ত থাকবে তেমনি তার বাহিরও হবে সুন্দর ও পরিপাটি, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। সবধরনের কদর্যতা ও মন্দ স্বভাবমুক্ত।
পাক-পবিত্রতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মুমিনের অনন্য ও স্বভাবজাত রুচি-বৈশিষ্ট্যের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। হাদীস শরীফে এসেছে-
عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ: قَصُّ الشَّارِبِ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكُ…
দশটি বিষয় স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। মোচ খাটো করা, দাড়ি লম্বা রাখা, মিসওয়াক করা…। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬১
উক্ত হাদীসে মিসওয়াককে স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য ও গুণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বভাবজাত বিষয় তো এমন, যা জীবনের সাথে মিশে থাকে। যা ছুটে যাওয়ার মত নয়।
সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, মিসওয়াক একটি ছোট আমল। কিন্তু প্রতিদান কত বড়- আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে মুমিনের জীবনে?
আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই তো মুমিনের সবচেয়ে বড় চাওয়া ও পরম পাওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ رِضْوَانٌ مِّنَ اللّٰهِ اَكْبَرُ.
আর আল্লাহর সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড় বিষয়। -সূরা তাওবা (৯) : ৭২
যার প্রতি মালিক সন্তুষ্ট, দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানের কল্যাণই তো তার সাধিত হয়ে গেল। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, এত সহজসাধ্য ও মূল্যবান সুন্নতটি আমাদের কারো কারো জীবনে অবহেলিত। বলতে গেলে আমভাবেই মিসওয়াকের সুন্নতটি আমাদের থেকে ছুটে যাচ্ছে।
অনেক নামাযী আছেন, যারা মিসওয়াক যে অযুর সময়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত- তা-ই জানেন না। আরেক শ্রেণি এ সুন্নতের গুরুত্ব জানেন ঠিকই, কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে তাদের বেশ অবহেলা লক্ষ করা যায়।
অথচ মিসওয়াকের গুরুত্ব কী অপরিসীম তা হাদীস এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাস্তব আমল থেকে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। এখানে মিসওয়াকের গুরুত্ব সম্পর্কিত দুয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হল।
মিসওয়াকের গুরুত্বঃ
১. ওয়াসিলা ইবনুল আসকা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أُمِرْتُ بِالسِّوَاكِ حَتَّى خَشِيتُ أَنْ يُكْتَبَ عَلَيَّ.
আমাকে মিসওয়াকের আদেশ দেয়া হয়েছে। আমার আশঙ্কা হতে লাগল, না জানি তা আমার উপর ফরয করে দেয়া হয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬০০৭
২. অপর বর্ণনায় তিনি বলেন-
لَقَدْ أُمِرْتُ بِالسِّوَاكِ، حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيَنْزِلُ بِهِ عَلَيَّ قُرْآنٌ، أَوْ وَحْيٌ.
আমাকে মিসওয়াকের আদেশ করা হয়েছে। আমার ধারণা হতে লাগল, এ সম্পর্কে আমার উপর কুরআন নাযিল হবে বা (বলেছেন,) ওহী নাযিল হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩১২২
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বোঝা গেল, মিসওয়াকের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কী পরিমাণ তাকীদ করা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত নির্দেশ কীভাবে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেছেন তার দুয়েকটি নমুনা উদ্ধৃত করছি। এগুলো থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারব- মিসওয়াকের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্পর্ক কত গভীর ছিল:
১. ঘরে প্রবেশ করে মিসওয়াক
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: كَانَ إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ بَدَأَ بِالسِّوَاكِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঘরে প্রবেশ করতেন প্রথমে মিসওয়াক করতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৩
শুরাইহ রাহ. বলেন-
سَأَلْتُ عَائِشَةَ، قُلْتُ: بِأَيِّ شَيْءٍ كَانَ يَبْدَأُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ؟ قَالَتْ: بِالسِّوَاكِ.
আমি আয়েশা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘরে প্রবেশ করে প্রথমে কোন্ কাজটি করতেন? উত্তরে তিনি বলেন, প্রথমে মিসওয়াক করতেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৩
২. শয্যার পাশে মিসওয়াক
عَنْ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَنَامُ إِلاَّ وَالسِّوَاكُ عِنْدَهُ، فَإِذَا اسْتَيْقَظَ بَدَأَ بِالسِّوَاكِ.
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমানোর সময় মিসওয়াক পাশে রাখতেন। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে প্রথমেই তিনি মিসওয়াক করতেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৯৬৯
৩. ওযুর পূর্বে মিসওয়াক
আম্মাজান আয়েশা রা. বলেন-
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَرْقُدُ مِنْ لَيْلٍ وَلَا نَهَارٍ، فَيَسْتَيْقِظُ إِلاَّ تَسَوَّكَ قَبْلَ أَنْ يَتَوَضَّأَ.
দিনে বা রাতে যখনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুম হতে জাগ্রত হতেন ওযুর পূর্বে মিসওয়াক করে নিতেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪৯০০
৪. মৃত্যুর আগমুহূর্তেও মিসওয়াক!
আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে আমার ‘পালা’র দিনে এবং আমার বুকে মাথা রাখা অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। তিনি অসুস্থ হলে আমাদের মধ্যকার কেউ দুআ পড়ে তাঁকে ঝাড়ফুঁক করতেন। আমি তাঁকে ঝাড়ফুঁক করছিলাম এসময় আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর আগমন করল। তার হাতে মিসওয়াকের একটি তাজা ডাল ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সেদিকে তাকালেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি মিসওয়াকের প্রয়োজন বোধ করছেন। তখন আমি সেটি নিয়ে চিবিয়ে প্রস্তুত করে তাঁকে দিলাম। তিনি এর দ্বারা সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন, যেমনটি তিনি (সুস্থতার সময়) করে থাকেন। অতঃপর তিনি তা আমাকে দিলেন। পরক্ষণই তাঁর হাত ঢলে পড়ল। আল্লাহ তাআলা আমার থুথুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থুথুর সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন তাঁর এ দুনিয়ার শেষ দিনে এবং আখিরাতের প্রথম দিনে। -সহীহ বুখারী হাদীস ৪৪৫১
এ হাদীস থেকে বোঝা গেল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মিসওয়াক কী পরিমাণ প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও এ সুন্নাহর প্রতি কেমন আকর্ষণ ও ভালবাসা ছিল। একজন নবী প্রেমিকের এ সুন্নাহর অনুসরণ এবং নিজের জীবনে বাস্তবায়নের জন্য এর চেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় আর কী হতে পারে?
আমরা তো মিসওয়াককে শুধু ওযু-নামাযের আমল মনে করে থাকি। সেটাতেও কত উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। অথচ প্রিয় নবীর জীবন থেকে বুঝা যায় মিসওয়াকের আমল শুধু ওযু-নামাযের সাথে সীমাবদ্ধ নয়।
মিসওয়াকের প্রতি সাহাবীদের গুরুত্বঃ
পূর্বোক্ত হাদীসে লক্ষ করা গেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোটা জীবনে মিসওয়াকের প্রতি মহব্বত ও আকর্ষণ কী পরিমাণ ছিল। মৃত্যু পর্যন্ত মিসওয়াকের সাথে কী মায়াবী সম্পর্ক ও টান ছিল। এখানে দেখব তাঁর প্রিয় সাহাবাদের প্রতি এ সুন্নাহ পালনের গুরুত্ব প্রদান। আর সাহাবাদের উক্ত নির্দেশ পালনের কিছু বাস্তব নমুনা। যা আমাদের আমলের জন্য বড় সহায়ক হবে আশা করি ইনশাআল্লাহ।
১. সহীহ বুখারীতে আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:
أَكْثَرْتُ عَلَيْكُمْ فِي السِّوَاكِ.
আমি তোমাদেরকে অধিকমাত্রায় মিসওয়াকের নির্দেশ দিয়েছি। অর্থাৎ তোমরা বেশি বেশি মিসওয়াক করো। সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৮৮
২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন-
لَقَدْ كُنَّا نُؤْمَرُ بِالسِّوَاكِ حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهُ سَيَنْزِلُ فِيهِ.
আমাদেরকে মিসওয়াকের প্রতি গুরুত্বের সাথে নির্দেশ দেয়া হত। আমাদের ধারণা হতে লাগল যে, এ সম্পর্কে হয়ত শীঘ্রই কোনো আয়াত নাযিল হবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ১৮০৪
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আদেশ সাহাবায়ে কেরাম কীভাবে পালন করেছেন লক্ষ করুন।
৩. সালেহ ইবনে কায়সান রাহ. বলেন-
إنَّ عُبَادَةَ بْنَ الصَّامِتِ، وَأَصْحَابَ رَسُولِ اللهِ صَلَّّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانُوا يَرُوحُونَ وَالسِّوَاكُ عَلَى آذَانِهِمْ.
উবাদা ইবনে সামেত রা. এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্য সাহাবীগণ চলাফেরা করতেন। তারা কানের উপর মিসওয়াক গুঁজে রাখতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ১৮০৫
তাঁরা এজন্য কানের সাথে মিসওয়াক গুঁজে রাখতেন যে, ওযু নামাযের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থায়ই যেন মিসওয়াকের আমল ছুটে না যায়।
৪. সুনানে আবু দাউদে যায়েদ বিন খালেদ আলজুহানী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
لولا أن أشُقَّ على أُمَّتي لأمَرتُهُم بالسّواكِ عندَ كُلِّ صلاةٍ.
আমার উম্মতের জন্য কষ্টের আশঙ্কা না হলে তাদের উপর মিসওয়াককে প্রতি নামাযের জন্য ফরয করে দিতাম।
قال أبو سلمة: فرأيتُ زيداً يَجلِسُ في المَسجِدِ، وإنَّ السِّواكَ مِن أُذُنِهِ مَوضِعَ القَلَمِ من أُذُنِ الكاتِبِ، فكُلَّما قامَ إلى الصَّلاة استَاكَ.
৫. আবু সালামা রাহ. বলেন, আমি যায়েদ রা.-কে দেখেছি, তিনি মসজিদে বসে থাকতেন, আর মিসওয়াক তার কানের ঐ স্থানে থাকত, যেখানে লেখকের কলম থাকে। অতঃপর যখনই তিনি নামাযের জন্য যেতেন মিসওয়াক করে নিতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৭
৬. আবু আতীক রাহ. জাবের রা. সম্পর্কে বলেন-
كَانَ يَسْتَاكُ إِذَا أَخَذَ مَضْجَعَهُ وَإِذَا قَامَ مِنَ اللَّيْلِ وَإِذَا خَرَجَ إِلَى الصُّبْحِ قَالَ فَقُلْتُ لَهُ قَدْ شَقَقْتَ عَلَى نَفْسِكَ بِهَذَا السِّوَاكِ فَقَالَ إِنَّ أُسَامَةَ أَخْبَرَنِي أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَسْتَاكُ هَذَا السِّوَاكَ.
জাবের রা. যখন শয্যা গ্রহণ করতেন, মিসওয়াক করতেন। ঘুম থেকে যখন জাগ্রত হতেন মিসওয়াক করতেন। ফজর নামাযের জন্য যখন বের হতেন মিসওয়াক করতেন। (এ অবস্থা দেখে)
আবু আতীক রাহ. বলেন, মিসওয়াক নিয়ে আপনি নিজেকে বড় কষ্টে ফেলে দিচ্ছেন! তখন জাবের রা. বললেন, উসামা রা. আমাকে সংবাদ দিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে মিসওয়াক করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, বর্ণনা ১৭৯৯
৭. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-
لأَنْ أَكُونَ اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِي مَا اسْتَدْبَرْتُ ، يَعْنِي : فِي السِّوَاكِ ، أَحَبُّ إلَيَّ مِنْ وَصيفَيْنِ ، قَالَ : وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ لاَ يَأْكُلُ الطَّعَامَ إِلاَّ اسْتَنَّ ، يَعْنِي : اسْتَاكَ.
আমি মিসওয়াক সম্পর্কে যা জানি তা যদি পূর্বে জানতাম তবে তা আমার নিকট দুটি গোলাম থেকেও অধিক প্রিয় হতো।
বর্ণনাকারী বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. যখনই কোনো খাবার খেতেন এরপর তিনি মিসওয়াক করে নিতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ১৮১৫
৮. আলী রা. মিসওয়াকের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেন-
عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: أُمِرْنَا بِالسِّوَاكِ.
আমাদেরকে মিসওয়াকের আদেশ দেয়া হয়েছে।
এরপর তিনি কী চমৎকার বলেছেন-
إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا قَامَ يُصَلِّي أَتَاهُ الْمَلَكُ فَقَامَ خَلْفَهُ يَسْتَمِعُ الْقُرْآنَ وَيَدْنُو، فَلَا يَزَالُ يَسْتَمِعُ وَيَدْنُو حَتَّى يَضَعَ فَاهُ عَلَى فِيهِ، فَلَا يَقْرَأُ آيَةً إِلاَّ كَانَتْ فِي جَوْفِ الْمَلَكِ.
বান্দা যখন নামাযে দাঁড়ায় তার নিকট ফেরেশতা আগমন করে। অতঃপর কুরআন মনোযোগসহ শোনার জন্য তার পেছনে দাঁড়ায় এবং নিকতবর্তী হতে থাকে। এভাবে শুনতে থাকে আর কাছে আসতে থাকে। এমনকি ফেরেশতা তার মুখ তিলাওয়াতকারীর মুখ বরাবর রাখে। এ অবস্থায় সে যখন কোনো আয়াত তিলাওয়াত করে তা ফিরিশতার ভেতরে চলে যায়। -সুনানে কুবরা, বাইহাকী, হাদীস ১৬২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১৯৩৭; আলআহাদীসুল মুখতারাহ, যিয়া আলমাকদিসী, হাদীস ৫৮০
উক্ত বর্ণনার কোনো কোনো সূত্রে এসেছে-
فطهروا أفواهكم.
তাই তোমরা তোমাদের মুখ পবিত্র-পরিচ্ছন্ন করে নাও। -মুসনাদের বাযযার (আলবাহরুয যাখবার), হাদীস ৬০৩
মিসওয়াক কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আলী রা.-এর উপরোক্ত বর্ণনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। তিনি প্রথমে মিসওয়াকের কথা বলেছেন। এরপর ফিরিশতাগণের তিলাওয়াত শ্রবণের কথাটি উদ্ধৃত করেছেন। ফিরিশতাগণ বড় পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রুচি ও বৈশিষ্ট্যের মাখলুক। দুর্গন্ধ ও অপরিচ্ছন্নতা তাদের স্বভাব-বহির্ভুত। তাই নামাযের জন্য যখন দাঁড়াবে এর পূর্বে ওযুতে ভালোভাবে মিসওয়াক করে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়াবে।
এখানে মাত্র দুয়েকটি হাদীস-আসার উল্লেখ করা হল। অন্যথায় হাদীস-আসারের কিতাবে সাহাবা-তাবেয়ীনের মিসওয়াকের সাথে গভীর সম্পর্ক ও মহব্বত সংক্রান্ত বহু বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে।
জুমার দিনে মিসওয়াকের গুরুত্বঃ
আমরা হাদীস শরীফে জুমার দিন গোসল করা সুন্নত জেনে এসেছি। কিন্তু আমরা কখনো কি খেয়াল করেছি জুমার দিন আমাদের শুধু গোসলেরই বিধান দেয়া হয়নি, বরং হাদীসে মিসওয়াকেরও কথাও এসেছে। সহীহ মুসলিমের হাদীসটির প্রতি লক্ষ করুন। আবু সায়ীদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
জুমার দিন প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির গোসল ও মিসওয়াক করা কর্তব্য এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সে সুগন্ধিও ব্যবহার করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৪৫
ওযুর সময় মিসওয়াক করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতঃ
হাদীস শরীফে এসেছে, বান্দা যখন নামাযে দাঁড়ায় সে তখন রবের সাথে কথাপোকথন করে। ফিরিশতাগণ জামাতের নামাযে তার সাথে কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়ায়। তার তিলাওয়াত খুব নিকট থেকে শোনে। এজন্য নামাযে দাঁড়ানোর পূর্বে বান্দার কর্তব্য হল, পাকসাফ হয়ে সবধরনের পবিত্রতা অর্জন করে নামাযে দাঁড়ানো। নোংরা ময়লা পোশাক নিয়ে দুর্গন্ধময় মুখ ও শরীর নিয়ে প্রভুর সম্মুখে দাঁড়ানো কিছুতেই কাম্য নয়।
এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযুতে মিসওয়াকের এত গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কোনো কোনো বর্ণনার ভাষা লক্ষ করুন-
لَوْلَا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ وُضُوءٍ.
আমার উম্মতের উপর যদি (অধিক) কষ্টের আশঙ্কা না হত তাহলে আমি তাদের উপর প্রত্যেক ওযুর সময় মিসওয়াক আবশ্যকীয় করে দিতাম। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৯২৮
অপর বর্ণনায় এসেছে-
لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ عِنْدَ كُلِّ صَلاَةٍ.
প্রত্যেক নামাযের সময় মিসওয়াক আবশ্যকীয় করে দিতাম। -সহীহ বুখারী, ৮৮৭
হাদীস শরীফে উত্তমরূপে ওযু করার কথা বলা হয়েছে। উত্তমরূপে ওযু করার দ্বারা আমাদের গুনাহগুলো ঝরে যায়।
সহীহ মুসলিমে উসমান রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
منْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الوضوءَ، خَرَجَت خَطَايَاهُ مِنْ جسَدِهِ حتَّى تَخْرُجَ مِنْ تحتِ أَظفارِهِ.
যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করল তার শরীর থেকে গুনাহসমূহ বের হয়ে গেল। এমনকি তা আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে তা বের হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৫
উত্তমরূপে ওযু তো তখনই হবে, যখন ওযুর প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুন্নতসহ যথাযথভাবে আদায় করা হবে। আর মিসওয়াক ওযুর গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। উত্তমরূপে ওযু আদায় হওয়ার জন্য মিসওয়াক জরুরি অনুষঙ্গ।
ওযুতে কুলি করা নাকে পানি দেয়া সুন্নত। তেমনি ওযুর সময় মিসওয়াকও একটি সুন্নত। কুলি ছুটে গেলে বা নাকে পানি দিতে ভুলে গেলে প্রশ্ন করা হয় ওযু হবে কি না? অথচ মিসওয়াক নিয়মিত ছুটে যাচ্ছে কি না- এ প্রশ্ন কি মনে জাগে! এ অবস্থার সংশোধন হওয়া জরুরি।
মিসওয়াক করার সুন্নত পদ্ধতিঃ
১. মিসওয়াক যয়তুনের ডালের হওয়া উত্তম।
২. মিসওয়াক কনিষ্ঠ আঙ্গুলের মতো মোটা ও এক বিঘত পরিমাণ লম্বা হওয়া উত্তম।
৩. মিওয়াক কাঁচা ডালের এবং নরম হওয়া ভালো।
৪. মিসওয়াক ডান হাতে ধরা মুস্তাহাব।
৫. মিওয়াক ধরার সুন্নত পদ্ধতী হলো- কনিষ্ঠ আঙ্গুল মিসওয়াকের নিচে, বৃদ্ধ আঙ্গুলের সামনের অংশ উপরের দিকে এবং বাকি আঙ্গুলগুলো (মাঝের তিন আঙ্গুল) মিসওয়াকের ওপরে রাখবেন।
৬. বিসমিল্লাহ বলে মিসওয়াক শুরু করা উত্তম।
৭. মিসওয়াক করার আগে ভিজিয়ে নেওয়া ভালো।
৮. ডান হাতে মিসওয়াক নিয়ে ডান দিক থেকে মিসওয়াক শুরু করা এবং দাঁতের প্রস্থে ও জিহ্বায় লম্বালম্বি মিসওয়াক করা সুন্নত।
মিসওয়াক করবেন যেসব সময়ে
১. নামাজের আগে।
২. ঘুম থেকে উঠার পর।
৩. খাবার খাওয়ার পর।
৪. অজুতে কুলি করার আগে মিসওয়াক করা। অনেকে ওজুর শুরু করার আগে মেসওয়াক করার কথা বলেছেন।
৫. মানুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত বা কোনও মজলিসে যাওয়ার আগে।
৬. মুখে দুর্গন্ধ ছড়ালে মেসওয়াক করা।
৭. জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে মেসওয়াক করা।
(আল বিনায়াহ : ১/২০৪, আদ্দুররুল মুখতার : ১/১১৩, রদ্দুল মুহতার ১/১১৪, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ৩/৪৪)
যে জিনিস দ্বারা মিসওয়াক করা উত্তমঃ
তিক্ত,কাঁচা ও নরম গাছের ডাল দ্বারা মিসওয়াক করা উত্তম। মহানবী (সা.) জয়তুন ও খেজুর গাছের ডাল দ্বারা মিসওয়াক করতেন। পিলুগাছের মিসওয়াক ব্যবহারে মস্তিষ্ক সতেজ হয়। দাঁতের ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অভাব পূরণ করে। ব্রাশ ব্যবহারে মুখ পরিষ্কার হয়, দুর্গন্ধ দূর হয় ও সুন্নত আদায় হয়। কিন্তু ডাল ব্যবহারে যে ফায়দা তা পাওয়া যায় না।
মিসওয়াক করার পদ্ধতি :
মিসওয়াক করার সুন্নত পদ্ধতি হলো মুখের ডান দিক থেকে শুরু করা এবং ওপর থেকে নিচে মিসওয়াক করা। আড়াআড়িভাবে না করা। মাড়ির ভেতর ও বাইরে জিহ্বার গোড়া পর্যন্ত মিসওয়াক করা। মিসওয়াক ধরার সময় ডান হাতের কনিষ্ঠাঙ্গুলি মিসওয়াকের নিচে থাকবে। মধ্যমা ও তর্জনী ওপর এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি নিচে থাকবে।
আসুন প্রিয় নবীর এ সুন্নতটিকে প্রিয় করে নিই। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করি। ফিরিশতাদের প্রিয় হই। আল্লাহ ও রাসূলের প্রিয় হই।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন- আমীন।
সূত্রঃ আল কাউসার ও অন্যান্য ওয়েবসাইট