মর্ম সহকারে পূর্নাঙ্গ নামাজ

আমরা প্রায়ই নামাজে গভীর মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হই। কিন্তু নামাজের পূর্ণতার জন্য গভীর মনোযোগ একান্ত জরুরি। নামাজে আমরা যা বলি, তার অর্থ যদি জানা থাকে, তাহলে নামাজে অন্য চিন্তা মাথায় আসবে না। নামাজে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাকবিরে তাহরিমার সময় দৃষ্টি সেজদার জায়গায় রাখতে হবে। দাঁড়ানো অবস্থায়ও দৃষ্টি সেজদার জায়গায় রাখতে হবে।

এরপর রুকু অবস্থায় দৃষ্টি পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির দিকে; পুনরায় দাঁড়ানো অবস্থায় দৃষ্টি সিজদার জায়গায়; সিজদা অবস্থায় দৃষ্টি নাকের আগায়; বসা অবস্থায় দৃষ্টি নাভিতে রাখতে হবে। সালাম দেওয়ার সময় দৃষ্টি কাঁধে নিবদ্ধ থাকবে। এভাবে নামাজ আদায় করলে মনোনিয়ন্ত্রণ ও আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। নামাজের প্রকৃত উদ্দেশ্যও সফল হবে।

নিয়ত করার পর, নামাজের মধ্যে আমরা কি পড়ি, বা বলি ?

( ১ ) নামাজে দাড়িয়েই প্রথমে আমরা বলি ﺍﻟﻠﻪﺍڪﺒﺮ ”আল্লাহু আকবার’ অর্থ – আল্লাহ্ সবচেয়ে বড় !

( ২ ) তারপর পড়ি সানা। সানায় আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি, নিজের জন্য দুয়া করি।

( ﺳُﺒْﺤَﺎﻧَﻚَ ﺍَﻟَﻠﻬُﻢَّ ﻭَﺑِﺤَﻤْﺪِﻙَ ﻭَﺗَﺒَﺎﺭَﻙ ﺍَﺳْﻤُﻚَ ﻭَﺗَﻌَﺎﻟَﻰ ﺟَﺪُّﻙَ ﻭَﻻَ ﺇِﻟَﻪَ ﻏَﻴْﺮُﻙَ )

সানা : ”সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা ওয়াতাবারাকাস্মুকা ওয়া তা’আলা যাদ্দুকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা” অর্থঃ হে আল্লাহ ! তুমি পাক-পবিত্র , তোমারই জন্য সমস্ত প্রশংসা, তোমার নাম পবিত্র এবং বরকতময়, তোমার গৌরব অতি উচ্চ , তুমি ছাড়া অন্য কেহ উপাস্য নাই ।

( ৩ ) তারপর আমরা শয়তানের প্রতারনা থেকে আশ্রয় চাই এবং বলি, ( ﺃﻋُﻮْﺫُ ﺑِﺎﻟﻠَّﻪِ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ﺍﻟﺮَّﺟِﻴْﻢِ )

আ‘ঊযু বিল্লা-হি মিনাশ শায়ত্বা-নির রাজিম। অর্থ: বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

( ৪ ) আল্লাহর পবিত্র নাম দিয়ে আল্লাহর দয়া করুণার গুন দিয়ে নামাজ এগিয়ে নিয়ে যাই। এবং বলি, ( ﺑِﺴْﻢِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟﺮَّﺣْﻤَﻦِ ﺍﻟﺮَّﺣِﻴْﻢِ ’বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অর্থঃ পরম করুনাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি।

( ৫ ) এরপর আমরা সূরা ফাতেহা দিয়ে নামাজ শুরু করি ( ২ রাকাত / ৪ রাকাত , ফরয / সুন্নতের নিয়ম অনুযায়ী নামাজ পড়ি )

সুরা ফাতিহায় আমরা যখন বলি, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন (সকল প্রশংসা বিশ্বজগতের মালিক আল্লাহর জন্যই)।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হামিদা নি, আবদি (আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল)।’ অতঃপর আমরা যখন বলি—‘আর রাহমানির রাহিম (তিনি পরম করুণাময় অতি দয়ালু)’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আছনা আলাইয়া আবদি (আমার বান্দা আমার বিশেষ প্রশংসা করল)।’

এরপর যখন আমরা বলি, ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দিন (তিনি বিচারদিনের মালিক)।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মাজ্জাদানি আবদি (আমার বান্দা আমাকে সম্মানিত করল)।’ এরপর আমরা যখন বলি, ‘ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তায়িন (শুধু আপনারই ইবাদত করি আর শুধু আপনার কাছেই সাহায্য চাই)।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হাজা বাইনি ওয়া বাইনা আবদি (এই ফয়সালাই হলো আমার ও আমার বান্দার মধ্যে—বান্দা আমার ইবাদত ও আনুগত্য করবে, আমি তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করব)।’

আমরা যখন বলি, ‘ইহদিনাছ ছিরাতল মুস্তাকিম, ছিরাতল্লাজিনা আনআমতা আলাইহিম, গয়রিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্দল্লিন! (আমাদের সঠিক পথ দেখান, তাদের পথ যাদের আপনি নিয়ামত দিয়েছেন; তাদের পথ নয় যারা পথভ্রষ্ট; আর না যারা অভিশপ্ত)।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘লিআবদি মা ছাআল (আমার বান্দা যা চায়, তার জন্য তা-ই)।’ (সহিহ মুসলিম, ৩৯৫)

( ৬ ) আমরা রুকুতে আল্লাহ্ -র উদ্দেশ্যে শরীর অর্ধেক ঝুঁকিয়ে দিয়ে মাথা নুয়িয়ে দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা করি এবং ক্ষমা চাই, তিনবার বলি (,ﺳُﺒْﺤَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻲَ ﺍﻟْﻌَﻈِﻴْﻢِ) সুবাহানা রাব্বি-আল আজিম, অর্থ: আমার মহান রবের পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি।

( ৭ ) তারপর রুকু থেকে উঠে আমরা বলি – (ﺳَﻤِﻊَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻟِﻤَﻦْ ﺣَﻤِﺪَﻩُ) সামি আল্লাহু লিমান হামিদা অর্থ : আল্লাহ সেই ব্যক্তির কথা কবুল করেন, যে তার প্রশংসা করে।

তারপর পরই আমরা আবার আল্লাহর প্রশংসা করে বলি –(ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﻟَﻚَ ﺍﻟْﺤَﻤْﺪُ) আল্লাহুম্মা ‘রাব্বানা ওয়া লাকাল হামদ’ অর্থ : হে আল্লাহ! যাবতীয় প্রশংসা কেবল তোমারই।

( ৮ ) তারপর আমরা সমস্ত শরীর নুয়িয়ে দিয়ে মাথাকে মাটিতে লুটিয়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট সিজদা দেই। তিনবার বলি ( ﺳُﺒْﺤَﺎﻥَ ﺭَﺑِّﻲَ ﺍﻻَﻋْﻠَﻰ) ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’ অর্থ: আমার মহান রবের পবিত্রতা বর্ণনা করছি।

বি: দ্র: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একটি সিজদা করে, আল্লাহ তার জন্য একটি নেকী লেখেন ও তার একটি পাপ দূর করে দেন এবং তার মর্যাদার স্তর একটি বৃদ্ধি করে দেন।‘

( ৯ ) দুই সিজদার মাঝখানে আমরা বলি, ( ﺍَﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺍﻏْﻔِﺮْﻟِﻰْ ﻭَ ﺍﺭْﺣَﻤْﻨِﻰ ﻭَ ﺍﻫْﺪِﻧِﻰْ ﻭَﻋَﺎﻓِﻨِﻰْ ﻭﺍﺭْﺯُﻗْﻨِﻰْ) ”আল্লাহুম্মাগ ফিরলি,ওয়ার হামনী, ওয়াহদীনি, ওয়া আফিনী, ওয়ার-ঝুকনী” অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমায় মাফ কর, আমাকে রহম কর, আমাকে হেদায়েত দান কর, আমাকে শান্তি দান কর এবং আমাকে রিজিক দাও ।

( ১০ ) এভাবে সালাত শেষে , মধ্য ( ২ রাকাত , ৪ রাকাত ভিত্তিতে ) বৈঠক আর শেষ বৈঠকে তাশাহুদে, আল্লাহর প্রশংসা করি । রাসুল (সাঃ) এর প্রতি দুরুদ পেশ করে নিজেদের জন্য দুয়া করি । দুআ মাসুরা পড়ি ।

তাশাহুদ : ﺍﻟﺘﺤﻴﺎﺕ ﻟﻠﻪ ﻭ ﺍﻟﺼﻠﻮﺍﺕ ﻭﺍﻟﻄﻴﺒﺎﺕ ﺍﻟﺴﻼﻡ ﻋﻠﻴڪ ﺍﻳﻬﺎ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﻭﺭﺣﻤﺔ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﺑﺮڪﺎﺗﻪ ﺍﻟﺴﻼﻡ ﻋﻠﻴﻨﺎ ﻭﻋﻠﻲ ﻋﺒﺎﺩ ﺍﻟﻠﻪ ﺍﻟﺼﻠﺤﻴﻦ ﺍﺷﻬﺪ ﺍﻻ ﺍﻟﻪ ﺍﻻ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﺍﺷﻬﺪ ﺍﻥ ﻣﺤﻤﺪﺍ ﻋﺒﺪﻩ ﻭﺭﺳﻮﻟﻪ

‘আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াস্ সালাওয়াতু, ওয়াত্ তাইয়িবাতু। আস্সালামু ‘আলাইকা আইয়্যুহান নাবীয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আস্সালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস্ সালিহীন। আশহাদু আল-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশ্হাদু আননা মুহাম্মাদান আদুহু ওয়া রাসুলুহু। অর্থঃ “সকল তাযীম ও সম্মান আল্লাহর জন্য, সকল সালাত আল্লাহর জন্য এবং সকল ভাল কথা ও কর্মও আল্লাহর জন্য। হে নবী! আপানার প্রতি শান্তি, আল্লাহর রহমত ও তাঁর বরকত বর্ষিত হোক। আমাদের উপরে এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের উপরে শান্তি বর্ষিত হোক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল।”

দুরুদ : ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺻﻞ ﻋﻠﻲ ﻣﺤﻤﺪ ﻭ ﻋﻠﻲ ﺍﻝ ﻣﺤﻤﺪ ڪﻤﺎ ﺻﻠﻴﺖ ﻋﻠﻲ ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢ ﻭ ﻋﻠﻲ ﺍﻝ ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢ ﺍﻧڪ ﺣﻤﻴﺪ ﻣﺠﻴﺪ ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺑﺎﺭڪ ﻋﻠﻲ ﻣﺤﻤﺪ ﻭ ﻋﻠﻲ ﺍﻝ ﻣﺤﻤﺪ ڪﻤﺎ ﺑﺎﺭڪﺖ ﻋﻠﻲ ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢ ﺭ ﻋﻠﻲ ﺍﻝ ﺍﺑﺮﺍﻫﻴﻢ ﺍﻧڪ ﺣﻤﻴﺪ ﻣﺠﻴﺪ

আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়ালা আলি মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহীমা ওয়ালা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ, আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিওঁ ওয়ালা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাক্তা আলা ইব্রাহীমা ওয়ালা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ”। অর্থ: “ হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ ও তার বংশধরদের উপর রহমত বর্ষণ করুন, যেরূপভাবে আপনি ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ও তার বংশধরদের উপর রহমত বর্ষণ করেছিলেন। নিশ্চয় আপনি প্রশংসিত সম্মানিত।”

দুআ মাসুরা :

ﺍﻟﻠﻬﻢ ﺍﻧﻲ ﻇﻠﻤﺖ ﻧﻔﺴﻲ ﻇﻠﻤﺎ ڪﺜﻴﺮﺍ ﻭ ﻻ ﻳﻐﻔﺮ ﺍﻟﺬﻧﻮﺏ ﺍﻻ ﺍﻧﺖ ﻓﺎﻏﻔﺮﻟﻲ ﻣﻐﻔﺮﺓ ﻣﻦ ﻋﻨﺪڪ ﺍﻧڪ ﺍﻧﺖ ﺍﻟﻐﻔﻮﺭ ﺍﻟﺮﺣﻴﻢ

আল্লাহুম্মা ইন্নি জলামতু নাফসি যুলমান কাছিরা, ওয়ালা ইয়াগ ফিরূজ যুনুবা ইল্লা আন্তা ফাগফিরলি মাগফিরাতাম মিন ইনদিকা ওয়ার হামনি ইন্নাকা আনতাল গাফুরুর রাহিম। অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আমার উপর অত্যাধিক অন্যায় করেছি এবং তুমি ব্যতীত পাপ ক্ষমা করার কেউ নেই । সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। ক্ষমা একমাত্র তোমার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আমার প্রতি রহম কর। নিশ্চই তুমি ক্ষমাশীল দয়ালু ।

( ১১ ) ২ কাঁধে সালাম দিয়ে আমরা নামাজ শেষ করি। ব্যস্ততার কারনে হোক বা তাড়াহুড়োর কারনে হোক, বা যে কোন কারনেই হোক আমরা সব সময় নামাজে গভীর মনোযোগ দিতে ব্যার্থ হই। কিন্তু সব সময় না পারি মাঝে মাঝে তো আমরা মনোযোগ দিতে পারি। তা-ই না ?

এই মনোযোগ বিষয়টা কাজ করবে, যখন আমরা বুঝব যে, নামাজে আমরা আসলে কি করছি। যখন আমরা নামাজে ব্যবহৃত শব্দ বাক্যগুলোর অর্থ বুঝব বা অনুভব করব তখন মনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ঘটবে এবং আমাদের সাহায্য করবে নামাজ কে আরও বেশি সুন্দর ও খাটি করতে। এর জন্য যে সম্পুর্ন অর্থ মুখস্ত করতে হবে তাও নয়।

যদি শুধুমাত্র জানা থাকে যে এই এই অর্থ তাহলেই তা কাজ করবে ইনশা আল্লাহ্। তাই আসুন আজ থেকে সবাই ট্রাই করি ।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *