নবী ও রাসূল সম্বন্ধে ঈমান
তৃতীয় মৌলিক যে বিষয়ের উপর ঈমান রাখতে হয়, তা হল নবী রাসূলদের প্রতি ঈমান। জিন ও ইনসানের হেদায়েতের জন্য আল্লাহ তা’আলা আসমান থেকে যে কিতাব প্রেরণ করেন, সেই কিতাবের ধারক বাহক বানিয়ে, সেই কিতাব বুঝানো ও ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য তথা আল্লাহ্র বাণী হুবহু পৌঁছে দেয়ার জন্য এবং আমল করে আদর্শ দেখানোর জন্য আল্লাহ্ তা’আলা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং জিন ও মানব জাতির নিকট তাঁদেরকে প্রেরণ করেছেন । তাঁদেরকে বলা হয় নবী বা পয়গম্বর ।
মুহাক্কিক উলামায়ে কেরামের মতে নবীদের মধ্যে যারা বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁদেরকে বলা হয় রাসূল , যেমন নতুন কিতাব প্রাপ্ত হয়েছেন বা নতুন উম্মতের নিকট প্রেরিত হয়েছেন বা বিশেষভাবে বিরুদ্ধবাদীদের সাথে মোকাবালার নির্দেশ প্রাপ্ত হয়েছেন, তাদেরকে রাসূল বলা হয়। আর যাদের কাছে ওহী আগমন করে তাদেরকে নবী বলা হয়। এ হিসেবে নবী ব্যাপক আর রাসূল বিশিষ্ট্য। অর্থাৎ, সব রাসূল নবী তবে সব নবী রাসূল নন। রাসূল হওয়ার জন্য নতুন কিতাব প্রাপ্ত হওয়া আবশ্যক নয়। কেননা হযরত ইসমাঈল (আঃ) সর্বসম্মতিক্রমে রাসূল ছিলেন কিন্তু তাঁর নিকট কোন নতুন কিতাব আসেনি। তাছাড়া এক হাদীছ থেকে জানা যায় রাসূলদের সংখ্যা ৩১৩ জন । আর কিতাব ও সহীফার সংখ্যা সর্বমোট।
নবী ও রাসূল পরিভাষাদ্বয়ের মাঝে এই পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সাধারণভাবে নবী, রাসূল, পয়গম্বর সব শব্দগুলো একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
বিশুদ্ধ মতানুযায়ী নবীদের চেয়ে রাসূলদের মর্যাদা অধিক।
সাধারণভাবে সব নবী ও রাসূলদের প্রতি ঈমান রাখতে হবে তা হল :
১. নবুওয়াত ও রেসালাত আল্লাহর দান। আল্লাহ যাকে চান তাকেই তিনি নবী রাসূল হিসেবে মনোনীত করেন। নবুওয়াত সাধনা বলে অর্জিতব্য বিষয় নয়। কুর- আনে কারীমে বলা হয়েছে :আল্লাহ ফেরেশতা ও মানুষদের মধ্য থেকে রাসূল মনোনীত করেন। (সূরাঃ ২২-হাজ্জঃ ৭৫) আরো বলেন, আল্লাহ যাকে চান তাঁর রহমতের জন্য একান্ত (মনোনীত) করেন । (সূরাঃ ২-বাকারাঃ ১০৫) আরো বলেন, আল্লাহ তাঁর রিসালাতের ভার কার উপর অর্পন করবেন, তা তিনিই ভাল জানেন । (সূরাঃ ৬-আনআমঃ ১২৪) দার্শনিকগণ মনে করেন যে, কোন মানুষ যখন আত্মিক সাধনা বলে জড় জগতের আবিলতা থেকে মুক্তি লাভ করে এবং আত্মিক পরিচ্ছন্নতা অর্জিত হওয়ার ফলে অদৃশ্য বিষয় তার হৃদয়পটে উদ্ভাসিত হতে শুরু করে এবং সে জাগতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে সক্ষম হয়, তখনই সে নবী হয়ে যায়। এটা কুফুরী মতবাদ।
২. নবী রাসূলগণ থেকে কখনও নবুওয়াত ও রেসালাতকে কেড়ে নেয়া হয় না ৷ নবীগণ নবুওয়াত লাভ করার পর নবুওয়াতের পদে চির বহাল হয়ে থাকেন ।
৩. তাঁরা মানুষ, তাঁরা খোদা নন বা খোদার পুত্র নন বা খোদার রূপান্তর (অবতার) নন বরং তাঁরা খোদার প্রতিনিধি ও নায়েব-আল্লাহর বাণী অনুসারে জিন ও মানুষ জাতিকে হেদায়েতের জন্য তাঁরা দুনিয়াতে প্রেরিত হন। যারা নবী হযরত ঈসা (আঃ)কে খোদা বা নবী হযরত ঈসা ও উযায়ের (আঃ)কে খোদার পুত্র বলেছে, তাদের খন্ডনে আল্লাহ্তা ‘আলা ইরশাদ করেছেন : অর্থাৎ, যারা বলে মারয়াম তনয় মসীহই আল্লাহ, তারাতো কুফ্রী করেছে। (সূরাঃ ৫-মায়িদাঃ ১৭)
আল্লাহ আরো বলেন, ইয়াহুদীগণ বলে উযায়ের আল্লাহর পুত্র এবং নাসারাগণ বলে মসীহ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা । (সূরাঃ ৯-তাওবাঃ ৩০)
৪. নবী রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়ন ব্যতীত আল্লাহর প্রতি ঈমান গ্রহণযোগ্য হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের সাথে কুফুরী করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের মাঝে তারতম্য করতে চায় ও বলে আমরা কতকের প্রতি ঈমান রাখি এবং কতকের প্রতি ঈমান রাখিনা আর (এভাবে) এর মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়, তারা প্রকৃত পক্ষে কাফের। (সূরাঃ ৪-নিসাঃ ১৫০-১৫১)
৫.নবীগণ আল্লাহ্র বাণী হুবহু পৌঁছে দিয়েছেন। আল্লাহর বাণী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাঁদের দ্বারা কোন ত্রুটি সংঘটিত হয়নি। ইরশাদ হয়েছে : তাঁরা আল্লাহর বাণী প্রচার করত এবং তাঁকে ভয় করত, আর আল্লাহকে ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করত না। (সূরাঃ ৩৩-আহযাবঃ ৩৯)
আরও ইরশাদ হয়েছে : হে রাসূল ! তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তা প্রচার কর; যদি তা না কর, তাহলেতো তুমি তাঁর রেসালাত (বার্তা) পৌঁছে দিলে না । (সূরাঃ ৫-মায়িদাঃ ৬৭)
৬. সর্বপ্রথম নবী হযরত আদম (আঃ) এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সাঃ)। নবীদের ছিলছিলা হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর শেষ হয়েছে।
নবীদের সংখ্যা কত তা সীমাবদ্ধ করে উল্লেখ না করাই শ্রেয়। কেননা আল্লাহ তা’আলা বলেন :অর্থাৎ, তাঁদের কারও কারও কথা তোমার নিকট বিবৃত করেছি আর কারও কারও কথা তোমার নিকট বিবৃত করিনি। (সূরা : ৪০-মু’মিন : ৭৮)
অতএব নবীদের সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করলে হতে পারে নবী নন তাদের সংখ্যাও এসে গেল কিংবা নবী অথচ তার সংখ্যা বাদ পড়ে গেল।
৭. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের সর্বসম্মত মত অনুযায়ী নবীগণ কবরে জীবিত। শহীদগণের জীবনের চেয়েও তাঁদের জীবন অধিক অনুভূতি সম্পন্ন । তাঁদের কাছে উম্মতের আমল ও দুরূদ সালাম পৌঁছানো হয়। আমাদের নবী (সাঃ)ও কবরে জীবিত আছেন। মুসনাদে আবী ইয়া’লা গ্রন্থে হযরত আনাস (রাঃ) কতৃক বর্ণিত হাদীছে রাসূল (সাঃ) বলেন : নবীগণ কবরে জীবিত, তাঁরা তাঁদের কবরে নামায পড়েন।(মুসনাদে আবী ইয়ালা)
হযরত আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন : মে’রাজের রাত্রে আমি মূসা (আঃ)-এর কাছ দিয়ে অতিক্রম করি লাল টীলার নিকটে, তখন তিনি স্বীয় কবরে নামায পাঠ করছিলেন।(মুসলিম,আহমদ)
আল্লামা সামহুদী বলেনঃ নবীগণের কবরে জীবিত হওয়া সম্পর্কিত দলীলাদি থেকে বোঝা যায় তাঁরা দুনিয়ার মতই দৈহিক জীবন-যাপন করে থাকেন, তবে সেখানে তাঁদের খাদ্য-খাবারের প্রয়োজন হয় না ।
নবী (সাঃ) কবরে জীবিত বিধায় তাঁর রওজায় সালাম দেয়া হলে তিনি শুনতে পান এবং উত্তর প্রদান করে থাকেন। অন্য কোন স্থানে থেকে নবীর প্রতি দুরূদ সালাম পাঠ করা হলে নির্ধারিত ফেরেশতারা নবী (সাঃ)-এর নিকট তা পৌঁছে দেন।
৮. হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত যত পয়গম্বর এসেছেন, তাঁদের সকলেই হক ও সত্য পয়গম্বর ছিলেন, সকলের প্রতিই ঈমান রাখতে হবে। কারও প্রতি ঈমান আনা হবে আর কারও প্রতি ঈমান আনা হবে না, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে : আমরা তাঁর রাসূলদের মাঝে (ঈমার আনয়নের ক্ষেত্রে) কোন তারতম্য করি না। (সূরাঃ ২-বাকারা ২৮৫)
রাসূল (সাঃ)ও সকল নবীকে সত্য বলে স্বীকার করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : সে হক সহকারে আগমন করেছে এবং প্রেরিত রাসূলদের সত্যায়ন করেছে। (সূরাঃ ৩৭-সাফ্ফাতঃ ৩৭)
সকল নবী রাসূলের প্রতি ঈমান আনা আবশ্যক বলে আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলদের প্রতি ঈমান আনার বর্ণনার ক্ষেত্রে রাসূল শব্দের বহুবচন ব্যবহার করেছেন। ইরশাদ হয়েছে ঃ তারা সকলে ঈমান এনেছে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রাসূলদের প্রতি। (সূরাঃ ২- বাকারা ২৮৫)
তদুপরি কোন একজন নবীর প্রতি ঈমান না আনা সকলের প্রতি ঈমান না আনার শামিল । কেননা সকলের শিক্ষার মূলনীতিমালা অভিন্ন ছিল। নূহ, আদ, ছামূদ প্রভৃতি সম্প্রদায় তাদের স্ব স্ব নবী/রাসূলকে অস্বীকার করেছিল অর্থাৎ, তাদের প্রত্যেক সম্প্রদায় এক একজন নবী/রাসূলকে অস্বীকার করেছিল, তবুও সেটা বয়ান করতে গিয়ে কুরআনে বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে যে, একজন নবী/রাসূলকে অস্বীকার করা সমস্ত নবী/রাসূলকে অস্বীকার করার নামান্তর। ইরশাদ হয়েছে ঃ নূহের সম্প্রদায় প্রেরিত রাসূলদের প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল। (সূরাঃ ২৬-শু’আরাঃ ১০৫)
সকল নবী রাসূলের প্রতি ঈমান আনার অর্থ হল প্রত্যেক নবী রাসূল তাঁদের স্ব স্ব যুগে সত্য ছিলেন, তাঁদের যুগে তাঁদের আনিত দ্বীনের আনুগত্য অপরিহার্য ছিল। তবে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনের পর অন্য সব নবী রাসূলের শরী’আত রহিত হয়ে গিয়েছে, এখন শুধু হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর শরী’আত ও তাঁর আনুগত্যই চলবে।
৯. নবী রাসূলদের দ্বারা তাঁদের সত্যতা প্রমাণিত করার জন্য অনেক সময় অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। এসব অলৌকিক ঘটনাকে ‘মু’জিযা’ বলে। মু’জিযায় বিশ্বাস করাও ঈমানের অঙ্গীভূত। যেমন হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর জন্য আগুন ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, হযরত মূসা (আঃ)-এর জন্য লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া, হযরত ঈসা (আঃ)-এর দুআয় মৃতদের জীবিত হয়ে যাওয়া, হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হাত মুবারকের আঙ্গুল থেকে পানি ফুটে বের হওয়া যার দ্বারা সমস্ত সৈন্যবাহিনী তৃপ্তি সহকারে পান করে নেয়, ইত্যাদি।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬