পিতা-মাতার অবাধ্যতা করলে দোয়া কবুল হয় না
দোয়া হল মুসলমানের জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। এটি আল্লাহর কাছে সরাসরি প্রার্থনা, যা ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু এমন কিছু গুনাহ আছে, যা দোয়া কবুল হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে। পিতা-মাতার অবাধ্যতা তেমনই একটি গুনাহ, যা দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেয়।
অনেক মানুষই দুঃখ-কষ্টে পড়ে আল্লাহর কাছে কাঁদে, দীর্ঘদিন দোয়া করে, কিন্তু ফল পায় না। তখন তারা ভাবে, হয়তো তাদের ভাগ্যে এসব লেখা ছিল। অথচ, এর পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে পিতা-মাতার প্রতি তাদের অবাধ্য আচরণ। অনেকেই অনুভব করতে পারেন না যে, তাদের জীবনের সমস্যাগুলোর মূল কারণ তাদের বাবা-মায়ের প্রতি দুর্ব্যবহার বা অবজ্ঞা।
একজন ব্যক্তি বহু বছর ধরে অসুস্থ, অনেক চিকিৎসা করিয়েও সুস্থ হতে পারছেন না। কিংবা কেউ দীর্ঘদিন চাকরির চেষ্টা করছেন, কিন্তু কোনোভাবেই সফলতা আসছে না। আবার অনেকে ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হন, দোয়া করেও উন্নতি দেখতে পান না। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, ব্যক্তি নিজের ভুল বুঝতে পারেন না—কিন্তু যখন তিনি বাবা-মায়ের সন্তুষ্টি অর্জন করেন, তখন তার সমস্যাগুলোও ধীরে ধীরে দূর হতে শুরু করে।
পিতা-মাতার অসন্তুষ্টি: দোয়া কবুল না হওয়ার একটি বড় কারণ
পিতা-মাতা সন্তানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নিয়ামত। তাদের প্রতি অবাধ্য হওয়া মানেই আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল করেন না: (১) পিতা-মাতার অবাধ্য, (২) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, (৩) মন্দ স্বভাবের ব্যক্তি।” (মুস্তাদরাক আল হাকিম, হাদিস: ৭৩৪৬)
এই হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, যে ব্যক্তি তার বাবা-মাকে কষ্ট দেয়, সে শুধু দুনিয়ার বরকত হারায় না, বরং তার দোয়াও কবুল হয় না।
পিতা-মাতার সন্তুষ্টি ও দোয়া কবুলের সম্পর্ক
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন: وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا “এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।” (সূরা আল-ইসরা: ২৩)
যদি কেউ পিতা-মাতার দুঃখের কারণ হয়, তবে তার প্রতি আল্লাহর রহমত কমে যেতে পারে। অনেকেই বলেন, “আমি এত কষ্ট করে পরিশ্রম করছি, তবু জীবনে সফলতা পাচ্ছি না।” কিন্তু যখন সেই ব্যক্তি নিজের আচরণের দিকে তাকিয়ে দেখে, তখন বোঝা যায়, হয়তো সে বাবা-মাকে কষ্ট দিয়েছে বা অবহেলা করেছে। পিতা-মাতার অন্তরের দুঃখ অনেক সময় সন্তানদের জীবনের বরকত কমিয়ে দেয় এবং তাদের দোয়া কবুলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দোয়া কবুল হওয়ার জন্য পিতা-মাতার যেমন আচরণ করা প্রয়োজন
১. পিতা-মাতার খেদমত করা
যদি কেউ চায় যে, তার দোয়া কবুল হোক, তবে প্রথমেই তার উচিত বাবা-মায়ের সন্তুষ্টি অর্জন করা। কারণ, তাদের দোয়া সন্তানের জন্য অনেক বড় বরকতের কারণ হতে পারে। ইতিহাসে বহু উদাহরণ আছে, যেখানে একজন ব্যক্তি তার পিতা-মাতার সন্তুষ্টি অর্জনের পর তার জীবন বদলে গেছে।
২. আন্তরিক তওবা করা
যদি কেউ আগে বাবা-মার অবাধ্যতা করে থাকে, তবে তাকে অবশ্যই আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। একই সঙ্গে বাবা-মার কাছেও দুঃখ প্রকাশ করা উচিত এবং ভবিষ্যতে তাদের প্রতি সদাচারী হওয়ার অঙ্গীকার করা জরুরি।
৩. পিতা-মাতার দোয়া গ্রহণ করা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:“পিতা-মাতার দোয়া সন্তানের জন্য বরকতের কারণ, আর তাদের অভিশাপ সন্তানের ধ্বংসের কারণ।”(তিরমিজি, হাদিস: ১৯০৫)
অনেক মানুষ দীর্ঘদিন জীবনের কঠিন সময় পার করে, অথচ বুঝতে পারে না কেন তার দোয়া কবুল হচ্ছে না। কিন্তু যখন সে বাবা-মায়ের দোয়া নেয়, তখন তার জীবন বদলাতে শুরু করে। তাই আমাদের উচিত সর্বদা পিতা-মাতার ভালোবাসা অর্জন করা, যেন তাদের দোয়া আমাদের জীবনে বরকত বয়ে আনে।
৪. দান-সদকা করা
যদি কেউ অনুভব করে যে, তার দোয়া কবুল হচ্ছে না, তবে সে গরিব-দুঃখীদের জন্য দান-সদকা করতে পারে। এটি আল্লাহর রহমত লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এবং অনেক সময় পিতা-মাতার অবাধ্যতার কুফল থেকে রক্ষা পেতে সহায়ক হতে পারে।
৫. পিতা-মাতার সঙ্গে কোমল ব্যবহার করা
শুধু দুঃসময়ে নয়, সব সময়ই পিতা-মাতার সঙ্গে নম্র ও ভালো ব্যবহার করা উচিত। তাদের কথা ধৈর্য ধরে শোনা এবং বিনয়ের সঙ্গে কথা বলা জরুরি। অনেক সময় দেখা যায়, সন্তান বাবা-মার প্রতি বিরক্তি দেখায় বা তাদের কথার মূল্য দেয় না। অথচ এই আচরণই দোয়া কবুল না হওয়ার কারণ হতে পারে।
উপসংহার
দোয়া হলো এমন একটি ইবাদত, যা আল্লাহর রহমত লাভের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। তবে যদি কেউ তার পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়, তাহলে তার দোয়া কবুল হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তাই আমাদের উচিত সর্বদা বাবা-মায়ের সন্তুষ্টি অর্জন করা, তাদের প্রতি সদাচারী হওয়া এবং তাদের দোয়া গ্রহণ করা। তবেই আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করবেন এবং আমাদের জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি দান করবেন।
সংকলক:
মুফতি রাশেদুল ইসলাম
ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স
মুহাদ্দিস: মিরপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ ও জামিয়া মুহাম্মাদীয়া আরাবিয়া মাদরাসা কমপ্লেক্স