ইবাদত

পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবেনা

পিতা-মাতার কাছে আমরা সব সময় ঋণী। এই ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। সন্তানের প্রতি মাতাপিতার অনুগ্রহ এতোটাই যে, সন্তান চাইলেও সারাজীবনে সেটা পরিশোধ করতে পারবে না। তবে আল্লাহ তায়ালা মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কিছু কর্তব্য বলে দিছেন, যেগুলোর মাধ্যমে মাতাপিতার হক কিছুটা হলেও আদায় হয়।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। যদি পিতামাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তুমি তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না বরং তাদের সাথে বিনম্রভাবে সম্মানসূচক কথা বলো। আর তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত কর। আর দোয়া কর, হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি রহমতের আচরণ করুন, যেভাবে তাঁরা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন (সূরা বনী ঈসরাইল আয়াত: ২৩-২৪)।’

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, কোন কিছুর সাথে তার শরিক করো না এবং পিতামাতার সাথে উত্তম ব্যবহার কর (সূরা নিসা ৩৬ আয়াত)।

সুরা লোকমানে আল্লাহ বলেন, আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর এবং তোমার মাতাপিতারও কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর (আয়াত-১৪)।

আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদি. হতে বর্ণিত, হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, যে নেক্কার ছেলে নিজ মাতাপিতার প্রতি রহমত ও আন্তরিকতার দৃষ্টিতে একবার তাকাবে, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে তার জন্য একটি মাবরুর হজ্বের (মকবুল হজ্বের) ছওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। সাহাবাগণ আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি উক্ত ব্যক্তি দৈনন্দিন একশত বার তাকায়, তাহলে? তিনি উত্তরে বলেন, হ্যাঁ! আল্লাহ তায়ালা সুমহান ও বড় করুণাময়। (বায়হাক্বী: শুয়াবুল ঈমান ১০/২৬৫)।

অন্য বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পিতা-মাতা জান্নাতের মাঝের দরজা। যদি চাও, দরজাটি নষ্ট করে ফেলতে পারো, নতুবা তা রক্ষা করতে পারো। (তিরমিযী, তুহফাতুল আহওয়াযী, ৬/২৫)।

আবু উমামা রাদি. হতে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরয করলো, হে আল্লাহর রাসুল! সন্তানের ওপর পিতামাতার হক কি আছে? তিনি বললেন, তারা তোমার বেহেশত ও দোযখ (ইবনে মাজাহ-৪৯৪১)।

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মাতাপিতার সাথে সদাচরণ করলে আমরা জান্নাতী হবো এবং অসদাচরণ করলে জাহান্নামী হবো। এ ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের চেয়েও পিতামাতার প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ যত্নশীল হতে হবে।

মাতাপিতার প্রতি অবাধ্যতার ক্ষেত্রে কুরআন হাদিসে ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “তার নাক ধূলায় মলিন হোক (৩ বার)। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেই হতভাগ্য ব্যক্তিটি কে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, সে হলো ঐ ব্যক্তি, যে তার পিতামাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তাঁদের সেবা করে জান্নাত হাসিল করতে পারলো না” (মুসলিম-৪/১৯৭৮, হা-২৫৫১)।

অর্থাৎ পিতামাতার সাথে ভালো খারাপ আচরণের মাঝেই সন্তানের জান্নাত-জাহান্নাম নিহিত। তাছাড়া পিতামাতার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির উপর আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি নিহিত। কেননা রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতামাতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতামাতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত।” (তিরমিযি-১৮৯৯)।

তাছাড়া সন্তানের জন্য পিতামাতার দোয়া আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি বলেছেন, “তিন প্রকারের দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। ১.পিতামাতার দোয়া তাঁর সন্তানের জন্যে। ২.মুসাফিরের দোয়া। ৩. মাযলুমের দোয়া।” (আবু দাউদ-১৫৬৩, ইবনে মাজাহ৩৮৬২, তিরমিযি১৯০৫)।

তাছাড়া উত্তম রিযিক ও দীর্ঘায়ু নিহিত রয়েছে মাতাপিতার সাথে আচরণের মাঝে। হযরত ছাওবান রাদি. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, দোয়া ব্যতিত অন্য কিছুই ভাগ্যকে বদলাতে পারে না এবং পিতামাতার প্রতি সদাচার ব্যতিত অন্য কিছুই আয়ুকে প্রলম্বিত করতে পারে না। কোন ব্যক্তি তার পাপের কারণে তার রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়। (ইবনে মাজাহ-৮৭)।

আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক নাফরমানীর শাস্তি সাধারণত আখেরাতে দেন। তবে মাতাপিতার সাথে অবাধ্যতার শাস্তি দুনিয়া ও আখেরাতে দেন। হযরত আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, পিতামাতার নাফরমানী ব্যতিত। আর তিনি পিতামাতার অবাধ্যতার শাস্তি মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতেই দিয়ে দেন। (মুসতাদরাক-৭৩৪৫)।

যাদের পিতামাতা দুনিয়াতে নেই তাদের জন্য করণীয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ডুবন্ত ত্রানপ্রার্থী ব্যক্তির যে অবস্থা , অবিকল সেই অবস্থা হলো কবরে শায়িত মৃত ব্যক্তির। সে দোয়ার অপেক্ষায় থাকে, যে দোয়া পিতামাতা, ভাই-বন্ধুদের পক্ষ থেকে তার কাছে পৌঁছবে। যখন এরূপ কোন দোয়া তার কাছে পৌছে তখন তা তার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার সকল সম্পদ অপেক্ষা প্রিয়তর মনে হয় (বায়হাকী: ৬/২০৩)।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পিতামাতার সাথে সদাচরণের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাউফীক দান করুন।

লেখক: আলেম, প্রাবন্ধিক

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *