ইসলাম

পুলসিরাত অতিক্রমের অবস্থা

পুলসিরাত অতিক্রমের অবস্থা

যাদের আমলের পরিমাণ বেশি তারা অতিদ্রুত চোখের পলকের মতো পুলসিরাত পার হয়ে যাবে। আর যার আমল কম তারা হামাগুড়ি দিয়ে পার হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘সেদিন তুমি ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের দেখতে পাবে যে, তাদের সামনে ও ডান পাশে তাদের নূর ছোটাছুটি করছে। বলা হবে ‘আজ তোমাদের সুসংবাদ হলো জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়, সেখানে তোমরা চিরস্থায়ী হবে। এটাই হলো মহাসাফল্য। সেদিন মুনাফিক পুরুষ ও নারীরা ঈমানদারদের বলবে, ‘তোমরা আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা কর, তোমাদের নূর থেকে আমরা একটু নিয়ে নেই’। বলা হবে, ‘তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরে যাও এবং নূরের সন্ধান কর,’ তারপর তাদের মাঝখানে একটি দেওয়াল তুলে দেওয়া হবে, যাতে একটি দরজা থাকবে। তার ভেতরের দিকে থাকবে রহমত আর বাইরের দিকে থাকবে আজাব। মুনাফিকরা মুমিনদেরকে ডেকে বলবে, ‘আমরা কি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম না? তারা বলবে ‘হ্যাঁ, কিন্তু ‘তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে বিপদগ্রস্ত করেছ। আর তোমরা অপেক্ষা করেছিলে এবং সন্দেহ পোষণ করেছিলে এবং আকাক্সক্ষা তোমাদেরকে প্রতারিত করেছিল, অবশেষে আল্লাহর নির্দেশ এসে গেল। আর মহা প্রতারক তোমাদেরকে আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারিত করেছিল। সুতরাং আজ তোমাদের কাছ থেকে কোনো মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না এবং যারা কুফরি করেছিল তাদের কাছ থেকেও না। জাহান্নামই তোমাদের আবাসস্থল। সেটাই তোমাদের উপযুক্ত স্থান। আর কতই না নিকৃষ্ট সেই গন্তব্যস্থল!’ (সুরা হাদিদ : ১২-১৫)

পুলসিরাত অতিক্রমের গতিবেগ

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সেদিন কেউ বিদ্যুতের গতিতে, কেউ বাতাসের গতিতে, কেউ ঘোড়ার গতিতে, কেউ আরোহীর গতিতে, কেউ দৌড়িয়ে, আবার কেউ হাঁটার গতিতে পুলসিরাত অতিক্রম করবে।’ (তিরমিজি : ৩১৫৯)।

উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জাহান্নামের ওপর একটি পুল আছে, যা চুলের চেয়েও বেশি চিকন আর তরবারির চেয়েও বেশি ধারালো। এর ওপর লোহার শিকল ও কাঁটা থাকবে। মানুষ এর ওপর দিয়েই গমন করবে। কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ বায়ুবেগে আর কেউ উত্তম ঘোড়া ও উটের গতিতে পুলসিরাত পার হবে। আর ফেরেশতারা বলতে থাকবে, হে প্রভু! সহিসালামতে অতিক্রম করাও, হে প্রভু! নিরাপদে পার করাও। কেউ নাজাত পাবে, কেউ আহত হবে, কেউ উপুড় হয়ে পড়ে যাবে আর কেউ অধঃমুখী হয়ে জাহান্নামে পড়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৪৮৪৭)

পুলসিরাত অতিক্রমে মুনাফিকদের পরিণাম

পৃথিবীতে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোরআন ও হাদিসের বিধান অনুসারে জীবন পরিচালনা করেছে, তারা সহজেই সে ভয়ঙ্কর পুলসিরাত অতিক্রম করে জান্নাতে পৌঁছতে সক্ষম হবে। কিন্তু মুনাফিক ও পাপী বান্দারা সে পথ অতিক্রম করতে পারবে না। তারা পুলসিরাত থেকে পড়ে গিয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

হজরত আবু বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মানুষকে পুলসিরাতের ওপর অতিক্রম করতে বলা হবে। তখন অপরাধীরা পুলসিরাতের দুই প্রান্তে জাহান্নামের অতলে একজনের ওপর আরেকজন পড়ে যেতে থাকবে। এভাবে জাহান্নামের শয্যা রচিত হতে থাকবে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ২০৪৫৭; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ : ১০/৩৬২)

পরে গুনাহগার ঈমাদারদেরক গুনাহ অনুপাতে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করার পর জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। আর মুনাফিকরা চিরকালের জন্য জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে থাকবে। (আন নিহায়া, ইবনুল আসির : ৪/২৪)

পুলসিরাত অতিক্রমকালে কাফিরদের অবস্থা

আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমাদের প্রত্যেকে তা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে। এটা তোমার রবের অনিবার্য সিদ্ধান্ত।’ (সুরা, মারিয়াম, আয়াত : ৭১)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতি তাকি ওসমানি বলেন, এর দ্বারা পুলসিরাত বোঝানো হয়েছে, যা জাহান্নামের ওপর স্থাপিত। মুসলিম-কাফির ও পুণ্যবান-পাপিষ্ঠ-নির্বিশেষে সবাইকে তা পার হতে হবে। হ্যাঁ, পার হতে গিয়ে তার অবস্থা কেমন হবে তা পরবর্তী আয়াতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মুমিন ও নেককার লোক তো এমনভাবে পার হবে যে জাহান্নামে কোনো কষ্ট তাদের স্পর্শ করবে না। তারা নিরাপদে তা পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে। পক্ষান্তরে যারা কাফের ও পাপী, তারা তা পার হতে পারবে না। তারা জাহান্নামে পতিত হবে। (তাওজিহুল কোরআন ২/৩২২)

ঈমান ও আমলের তারতম্য অনুযায়ী পুলসিরাত অতিক্রমকারী

১. নিরাপদে অতিক্রমকারী

যারা পূর্ণ ঈমানদার, সৎকর্মশীল, কবিরা গুনাহ থেকে মুক্ত, মৃত্যুর আগে খালেস তাওবাকারী—তারা নিরাপদে আগুনের তাপ ও স্পর্শ অনুভব না করেই পুলসিরাত পার হয়ে যাবেন। দুনিয়াতে নেক আমলে যিনি যত অগ্রগামী ছিলেন, পুলসিরাতে তার গতিও হবে অনুরূপ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আগুনের (পুলসিরাতের) ওপর দিয়ে লোকজন অতিক্রম করবে। তারা তাদের আমল অনুপাতে অতিক্রম করতে থাকবে। তাদের প্রথম দল বিদ্যুৎ চমকানোর মতো দ্রুত বেগে পার হয়ে যাবে। পরবর্তী দলটি বাতাসের বেগে, তারপর দ্রুতগামী ঘোড়ার বেগে, তারপর উষ্ট্রারোহীর বেগে, তারপর মানুষের দৌড়ের গতিতে, তারপর হেঁটে চলার গতিতে অতিক্রম করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩১৫৯)

২. ক্ষতবিক্ষত হয়ে অক্রিমকারী

মুসলিমদের মধ্যে যারা পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল, তারা তাদের পাপের পরিমাণ অনুযায়ী পুলসিরাতে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুলসিরাত জাহান্নামের দুই তীরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। তাতে থাকবে সাদান বৃক্ষের কাঁটাসদৃশ কাঁটাসমূহ। মানুষকে তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে বলা হবে। তাদের কতক ব্যক্তি কাঁটার আঁচড় খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হবে, তারপর নাজাত পাবে…।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১১০৮১)

এই দলের লোকদের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে তারাই, যারা পাপকাজ করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের ভুল-ত্রুটি করেছে। পুলসিরাতের আঁকড়া তাদের আক্রমণ করবে, ফলে তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হবে। অতঃপর তারা তাদের পার্থিব জীবনের প্রেরিত নেক আমলের কারণে আল্লাহর দয়ায় মুক্তি পেয়ে যাবে।’ (আল মাওসুআতুল আকাদিয়াহ ৫/১৪)

৩. জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত

পুলসিরাত অতিক্রমকারীদের মাঝে বড় দলটি তাদের পাপের কারণে আটকে যাবে এবং জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুলসিরাত জাহান্নামের দুই তীরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। মানুষকে তার ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে বলা হবে।…কতক ব্যক্তি সেখানে আটকে যাবে এবং মুখ থুবড়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১১০৮১)

পুলসিরাত অতিক্রমকারী প্রথম ব্যক্তি

আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَإِنْ مِنْكُمْ إِلا وَارِدُهَا كَانَ عَلَى رَبِّكَ حَتْمًا مَقْضِيًّا – ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِينَ فِيهَا جِثِيًّا –

‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তথায় (পুলছিরাত) পৌঁছবে না । এটা তোমার রবের অনিবার্য ফায়ছালা। অতঃপর আমি পরহেযগারদেরকে উদ্ধার করব এবং যালেমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব’ (সূরা মারয়াম ১৯/৭১-৭২)।

হাদীছে এসেছে, আবু সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল! কিয়ামত দিবসে আমরা কি আমাদের রবকে দেখতে পাব? তিনি বললেন, প্রজ্জ্বলিত চন্দ্র-সূর্য দর্শনে তোমাদের কি কোন অসুবিধা হয়? আমরা বললাম, না। তিনি বললেন, সে দিন তোমাদের রবের দর্শনে চন্দ্ৰ-সূর্য দর্শনে যতটুকু অসুবিধা হয় ততটুকু ছাড়া আর কোনরূপ অসুবিধা হবে না। অতঃপর বললেন, প্রতিটি কওম, যে যার ইবাদ করত তার কাছে যাওয়ার অতঃপর বললেন, প্রতিটি কওম, যে যার ইবাদ করত তার কাছে যাওয়ার জন্য একজন আহবানকারী আহবান করবে। অতঃপর খৃষ্টান ব্যক্তি খৃষ্টানদের সাথে যাবে । প্রতিমা পুজকরা তাদের প্রতিমার কাছে যাবে এবং সকল বাতিল উপাস্যের পুজারীরা তাদের উপাস্যের কাছে যাবে। এমনকি সৎ-অসৎ যাই হোক যারা আল্লাহ্র ইবাদত করত তারা এবং আহলে কিতাবের কিছু লোক (নিজ স্থানে) বাকী থাকবে। এরপর জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে, তখন সেটাকে মরিচিকার মত মনে হবে। তখন ইহুদীদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা কার ইবাদত করতে? তারা বলবে আল্লাহ্ পুত্র উযাইরের! তাদেরকে বলা হবে মিথ্যা বলছ। আল্লাহ্ কোন স্ত্রী ও সন্তান নেই। তোমরা এখন কি চাও? তারা বলবে, আমরা পানি পান করতে চাই। পানি পান করতে বলা হবে এবং (পান করতে গিয়ে) জাহান্নামে পতিত হতে থাকবে। এরপর খৃষ্টানদেরকে ডেকে বলা হবে, তোমরা কার ইবাদত করতে? তখন তারা বলবে, আল্লাহর পুত্র ঈসার! ‘মাসীহর’। বলা হবে, তোমরা মিথ্যা বলছ। আল্লাহর কোন স্ত্রী ও পুত্র নেই। তোমরা এখন কি চাও? তারা বলবে, আমরা পানি পান করতে চাই। পানি পান করতে বলা হবে এবং (পান করতে গিয়ে জাহান্নামে পতিত হতে থাকবে। অবশেষে আল্লাহ্র ইবাদতকারী সৎ-অসৎ যাই হোক যারা বাকী থাকবে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে, সব মানুষতো চলে গেছে, তোমাদেরকে কে আটকিয়ে রেখেছে? উত্তরে তারা বলবে, প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে বর্জন করেছি। আর সকল কওম যে যার ইবাদত করত তার কাছে যাক, এ আহবান একজন আহবানকারীকে করতে শুনেছি, (তারা সকলে চলে গেছে) আর আমরা আমাদের রবের অপেক্ষায় আছি। রাসূল (ছাঃ) বলেন, এরপর আল্লাহ তাদের নিকট ঐ বেশে আসবেন যে বেশেতাঁকে (আল্লাহকে) তারা এরপূর্বে দেখেনি। আল্লাহ এসে বলবেন, আমি তোমাদের প্রতিপালক! তারা বলবে, আপনি আমাদের রব। বুখারীর অন্য বর্ণনায় এসেছে, এটি আমাদের স্থল। এখানে আমরা আমাদের প্রতিপালক আসা পর্যন্ত অবস্থান করব। আমাদের প্রতিপালকের যখন আগমন ঘটবে তখন আমরা তাঁকে চিনে নিব । আল্লাহ তাদের নিকট ঐ বেশে আসবেন যাতে তারা চিনতে সক্ষম হয়। নবীগণ ব্যতীত কেউ আল্লাহ্র সাথে কথা বলবেন না।

আল্লাহ এসে জিজ্ঞেস করবেন, তোমাদের কাছে এমন কোন নিদর্শন আছে কি যা দ্বারা আল্লাকে চিনতে পারবে? তারা বলবে, হ্যাঁ, পিগুলি । অতঃপর আল্লাহ তা’আলা নিজ ‘পিণ্ডলি’ উন্মুক্ত করবেন এবং সকল মুমিন ব্যক্তিরা সিজদায় পড়ে যাবে। বাকী থাকবে রিয়াকারীরা। এরাও পরে সিজদা করতে যাবে কিন্তু তাদের পিঠ কাঠের মত শক্ত হয়ে যাবে। সিজদা করতে সক্ষম হবে না। এরপর পুলছিরাতকে জাহান্নামের মাঝখানে রাখা হবে। (ছাহাবায়ে কেরাম বলেন), আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্র রাসুল! পুলছিরাত কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সেটি পিচ্ছিল বস্তু। (মাছ ধরা) বড় বড়শির ন্যায় অগ্রভাগ বাঁকা করা লম্বা লোহা খাড়া করা আছে। মুমিনগণ পুলছিরাতের উপর দিয়ে চোখের পলক, বিদ্যুত, হাওয়া, দ্রুতগামী ঘোড়া এবং যানবাহনের গাড়ীর ন্যায় পেরিয়ে যাবে। সুতরাং কেউ নিখুঁতভাবে আরামের সাথে পুলছিরাত অতিক্রম করে মুক্তি পাবে। আবার কেউ পুলছিরাতে আটকা পড়ে জাহান্নামে পতিত হবে। এভাবে সর্বশেষ ব্যক্তি কোন রকম টেনে-টুনে পুলছিরাত অতিক্রম করবে। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা যে সত্য জিনিস সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করছ, তা তো সেদিন মুমিনদের জন্য প্রভাবশালী আল্লাহ্র সামনে প্রকাশ হয়ে যাবে। পুলছিরাত অতিক্রমকারীরা যখন দেখবে যে তারা পুলছিরাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে গেছে, তখন তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! এরা (যারা পুলছিরাত অতিক্রম করতে গিয়ে জাহান্নামে পতিত হয়েছে) আমাদের ভাই, আমাদের সাথে ছালাত আদায় করত, ছিয়াম পালন করত এবং আমল করত । তখন আল্লাহ বলবেন, তোমরা যাও এবং দেখ, যার অন্তরে এক দীনার সমপরিমাণ ঈমান আছে তাকে (জাহান্নাম) থেকে বের কর, আল্লাহ তাদের উপর জাহান্নাম হারাম করবেন।

তারা তাদের (যারা জাহান্নামে পতিত হয়েছে) কাছে এসে প্রত্যক্ষ করবে যে তাদের কারোর ‘পা’ জাহান্নামের আগুনে ধ্বসে গেছে, আবার কারোর অর্ধেক পিণ্ডলী’ পর্যন্ত (আগুনে ঢুকে গেছে)। যাদেরকে তারা চিনবে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে আল্লাহ্র নিকট ফিরে আসবে। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, তোমরা যাও এবং দেখ, যার অন্তরে অণু পরিমাণ ঈমান আছে তাকে জাহান্নাম থেকে বের কর। অতঃপর তারা যাকে চিনবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করবে। হাদীছ বর্ণনাকারী আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, তোমরা যদি আমাকে বিশ্বাস না কর তাহলে আল্লাহ্ এই বাণী পাঠ কর, إِنَّ اللهَ لاَ يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِنْ تَكُ حَسَنَةٌ يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِنْ لَدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا –

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অণু পরিমাণও যুলম করেন না। আর যদি সেটি ভাল কাজ হয়, তিনি তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে মহা প্রতিদান দান করেন’ (নিসা ৪/৪0 ) ।

অতএব নবীগণ, ফেরেশ্তাগণ এবং মুমিনগণ সুপারিশ করবেন। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, আমার শাফা’আত অবশিষ্ট্য রয়ে গেল। এই বলে জাহান্নাম হতে এক মুষ্ঠি গ্রহণ করবেন যাতে এক গোছা পুড়া মানুষকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন এবং জান্নাতের সামনে এক নদীতে চুবাবেন, যাকে আবে হায়াত (জীবনের পানি) বলা হয়। এরপর তারা নদীর কিনারায় ঐভাবে গজিয়ে উঠবে যেভাবে পলী মাটিতে ঘাস গজায়। কোন পাথরের গায়ে গজিয়ে উঠা লতা-পাতা তোমরা দেখে থাকবে যে, যে দিকে সূর্যের কিরণ পায় সে দিকটি সবুজ হয়, আর যে দিকে আলো পায় না সে দিকটি সাদাটে হয়। তাই যারা জাহান্নাম থেকে বের হবে তাদের চেহারা হবে মতির ন্যায় উজ্জ্বল । তাদের গলায় অলংকার রিং ঝুলিয়ে দেওয়া হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে।তাদেরকে দেখে জান্নাতীরা বলবে, এরা রহমানের ক্ষমাপ্রাপ্ত লোক, যাদেরকে আল্লাহ বিনা আমলে ও সৎ কর্ম ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন। অতঃপর তাদেরকে বলা হবে তোমরা জান্নাতে যা দেখছ তা এবং তার সাথে অনুরূপ আরো (ভোগ সামগ্রী) তোমাদের জন্য । মুসলিম হা/১৮৩; মিশকাত হা/৫৫৭৯।

অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, কতিপয় মানুষ জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! ক্বিয়ামতের দিন আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে দেখব? রাসূল (ছাঃ) বললেন, মেঘ বিহীন স্বচ্ছ আকাশে সূর্য দর্শনে তোমাদের কি কোন অসুবিধা হয়? তারা বলল, না হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)। তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, মেঘ বিহীন আকাশে পূর্ণিমা রাতে চন্দ্র দেখতে তোমাদের কোন অসুবিধা হয় কি? তারা বলল, না হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তোমরা কিয়ামতের দিন আল্লাহকে ঐরূপ দেখবে। সেদিন আল্লাহ মানুষকে একত্রিত করে বলবেন, (দুনিয়াতে) যে যার ইবাদত করতে সে তার পেছন ধর। সুতরাং সূর্যপূজক সূর্যের, চন্দ্র পূজক চন্দ্রের এবং গায়রুল্লাহর ইবাদতকারী গায়রুল্লাহর পেছন ধরবে। বাকী থাকবে এই উম্মত, যার মধ্যে মুনাফিকও থাকবে। অতঃপর আল্লাহ তাদের কাছে এসে বলবেন, আমিই তোমাদের রব। তখন তারা বলবে, আমরা এই স্থানেই থাকলাম, আমাদের প্রতিপালক যখন আমাদের নিকট আসবেন তখন আমরা তাঁকে চিনে নিব। এরপর আল্লাহ তাদের কাছে ঐ বেশে আসবেন যে বেশে তারা তাঁকে চিনবে। এসে বলবেন, আমি তোমাদের প্রতিপালক! তখন তারা বলবে, আপনি আমাদের প্রতিপালক। এই বলে তারা আল্লাহ্র পেছন ধরবে। অতঃপর জাহান্নামের উপর পুলছিরাত রাখা হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, সর্বপ্রথম আমাকে (অতিক্রম করার) অনুমতি দেওয়া হবে। সেদিন সকল নর-নারী দো’আ করবে,

‘হে আল্লাহ নিরাপদে পুলছিরাত অতিক্রম করার তাওফীক্ব দাও’। কেননা পুলছিরাতে সা‘দানের কাঁটার মত মাথা বাকানো লোহা বা বড়শি আছে। তোমরা কি সা‘দানের কাঁটা দেখনি? ছাহাবায়ে কেরাম বললেন, দেখেছি হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! রাসূল (ছাঃ) বললেন, সেটি সা‘দানের কাঁটার মত হলেও তা কত বিশাল তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মানুষের আমল অনুযায়ী পুলছিরাতের কাঁটা তাদেরকে গেঁথে নিবে। কেউ একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার কেউ তার আমল অনুযায়ী টেনে-হেঁচড়ে ক্ষত অবস্থায় পুলছিরাত অতিক্রম করবে এবং পরিত্রাণ পাবে। আল্লাহ তা’আলা যখন বান্দাদের বিচার শেষ করবেন তখন যারা এখলাছের সাথে তাওহীদের সাক্ষ্য প্রদান করেছে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করার ইচ্ছা পোষণ করবেন এবং তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করার জন্য ফেরেশ্তাদেরকে নির্দেশ দিবেন। ফেরেশতামণ্ডলী কপালে সিজদার ঐ দাগ দেখে তাদেরকে চিনে নিবেন, যে দাগকে আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামের উপর হারাম করেছেন।

অতঃপর ফেরেশতামণ্ডলী দাহিত ব্যক্তিদের জাহান্নাম থেকে বের করবেন। তারপর তাদের উপর পানি ঢালা হবে, যাকে আবে হায়াত বলা হয়। মূলতঃ তারা ঐভাবে গজিয়ে উঠবে যেভাবে পলি মাটিতে ঘাস গজিয়ে উঠে জাহান্নামের দিকে মুখ করা এক ব্যক্তি বলবে, হে আমার প্রতিপালক! জাহান্নামের দুর্গন্ধ আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলছে এবং তার উত্তাপ আমাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। জাহান্নামের দিক হতে আমার চেহারাকে ফিরিয়ে দিন। সর্বক্ষণ সে এভাবে আহবান করতে থাকবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলবেন, আমি যদি তা করি তাহলে তুমি অন্য কিছু চাইবে। সে বলবে, আপনার ইয্যতের কসম! অন্য কিছু আপনার কাছে চাইব না। তার চেহারা জাহান্নামের দিক হতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এরপর সে বলবে, হে আল্লাহ! আমাকে জান্নাতের গেটের নিকটবর্তী করুন। আল্লাহ বলবেন, আর কিছু না চাওয়ার প্রতিশ্রুতি তুমি দাওনি? হে আদম সন্তান! তোমার খারবী হোক, তুমি কত বড় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী! তা সত্ত্বেও সে তার আহবান করতে থাকবে। তখন আল্লাহ বলবেন, আমি যদি তোমাকে তা দেই তাহলে তুমি আরো অন্য কিছু চাইবে। সে বলবে, আপনার ইয্যতের কসম! আপনার কাছে আমি আর কিছু চাইব না। তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে জান্নাতের গেটের নিকটবর্তী করবেন। এমতাবস্থায় সে জান্নাতের সবকিছু দর্শন করবে। তখন আল্লাহ্ই চ্ছায় যতক্ষণ নিরব থাকার নিরব থাকবে। তারপর বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন। আল্লাহ বলবেন, আর কিছু না চাওয়ার প্রতিশ্রুতি তুমি দাওনি? হে আদম সন্তান! তোমার খারবী হোক, তুমি কত বড় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী! সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আপনি আমাকে আপনার নিকৃষ্ট সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত করেন না। আল্লাহ্র হাঁসা পর্যন্ত ঐ কথা বলতেই থাকবে। আল্লাহ যখন হাঁসবেন তখন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি দান করবেন। যখন সে জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন তাকে বলা হবে, অমুক জিনিস গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ কর। সে তা করবে। পুনরায় বলা হবে, তুমি অমুক জিনিস গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ কর। সে ইচ্ছা পোষণ করবে। এমনকি তার সকল আশা পূর্ণ হয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ বলবেন, এ সকল ভোগ-সামগ্রী তার সাথে অনরূপ আরো ভোগ-সামগ্রী তোমার জন্য। (বুখারী হা/৭৪৩৭; মুসলিম হা/১৮২)

সর্বশেষ পুলসিরাত অতিক্রমকারী

সবশেষে যে পুলসিরাত অতিক্রম করবে তার ব্যাপারে হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘অতঃপর তোমাদের সর্বশেষ ব্যক্তি পেটে ভর করে করে পুলসিরাত অতিক্রম করবে। সে বলতে থাকবে, হে রব! আমাকে এত বিলম্ব করানো হলো কেন? তখন আল্লাহ বলবেন, আমি কেন তোমাকে বিলম্ব করাব? তোমাকে তো তোমার আমল বিলম্ব করিয়েছে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৮৫১৯)

পুলসিরাতের পরে আরো এক সেতু

জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে অবস্থিত কণ্টকাকীর্ণ অতীব সুক্ষ্ণ পুলছিরাত অতিক্রম করে যখন মানুষ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তিলাভ করবে, ঠিক তখনই উপস্থিত হবে আরো এক সেতু যাতে এক শ্রেণীর মানুষ আটকা পড়বে। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيَّ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَيُقَصُّ يَخْلُصُ الْمُؤْمِنُوْنَ مِنَ النَّارِ، فَيُحْبَسُونَ عَلَى قَنْطَرَةٍ بَيْنَ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ، لِبَعْضِهِمْ مِنْ بَعْضٍ، مَظَالِمُ كَانَتْ بَيْنَهُمْ فِي الدُّنْيَا حَتَّى إِذَا هُذَّبُوا وَنُقُوْا أَذنَ لَهُمْ فِي دُخُولِ الْجَنَّةِ، فَوَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَأَحَدُهُمْ أَهْدَى بِمَنْزِلِهِ فِي الْجَنَّةِ مِنْهُ بِمَنْزِلِهِ كَانَ فِي الدُّنْيَا –

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, মুমিনগণ যখন জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করবে (পুলছিরাত অতিক্রম করবে)। তখন তারা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে এক সেতুতে আটকা পড়বে। অতঃপর দুনিয়াতে পরষ্পরের মধ্যে যে যুলুম অত্যাচার হয়েছিল তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে। অবশেষে যখন তারা (তাদের পাপ থেকে) পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন হবে, তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। ঐ সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ! মুমিনদের প্রত্যেকে দুনিয়াতে তার নিজ বাড়ী যেমনিভাবে চিনত, উহা অপেক্ষা জান্নাতে তার স্থান ভালভাবে চিনতে পারবে। বুখারী হা/৬৫৩৫; মিশকাত হা/৫৫৮৯, ‘হাউযে কাউছার ও শাফা’আতের বর্ণনা’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ১০/১২৬ পৃঃ।

সংকলক

মুফতি রাশেদুল ইসলাম

ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *