পুলসিরাত কী ?কেমন হবে পুলসিরাত ?
হাশরের মাঠ থেকে বের হয়ে গন্তব্যে যেতে একটি পুল স্থাপন করা হবে। আরবিতে পুলকে বলা হয় সিরাত। সিরাত হাশরের ময়দান থেকে জাহান্নামের ওপর দিয়ে জান্নাত পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে এবং অনেক ভয়ঙ্কর হবে। মানুষের আমলনামা ওজন এবং হিসাব-নিকাশের পর সবাইকে ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে পুলসিরাত দেখিয়ে দিয়ে বলবেন, ‘এটা তোমাদের গন্তব্যে পৌঁছার পথ। এ পুল পেরিয়েই তোমাদের যেতে হবে।’
কিন্তু সবার জন্য পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। পাপী বান্দারা সেটাকে চুল থেকেও চিকন দেখতে পাবে। তাদের জন্য সেটি হবে অত্যন্ত ধারালো। তারা ওই পুলে আরোহণ করা মাত্রই তাদের পা কেটে নিম্নস্থ জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আর নেককারদের জন্য হবে সুপ্রশস্ত সুগম পথ। তারা তাদের নেকির তারতম্য অনুযায়ী গতিতে জান্নাতে পৌঁছে যাবে।
পুলসিরাত কী?
‘পুল’ ফারসি শব্দ। এর অর্থ সেতু। আর আরবি শব্দ ‘সিরাত’-এর অর্থ রাস্তা বা পথ। তবে ইসলামী পরিভাষায় এর অর্থ, পারলৌকিক সেতু বা পুল। কেয়ামত হওয়ার পর সব মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করে হাশরের ময়দানে সমবেত করা হবে এবং ইহলৌকিক জীবনের বিচার করা হবে।এ বিচারের পর হাশরের মাঠ থেকে ‘পুলসিরাত’ পার হয়ে জান্নাতের দিকে যেতে হবে।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসের কোথাও সরাসরি ‘পুলসিরাত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। বরং বিভিন্ন জায়গায় শুধু ‘সিরাত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে, তাকে এটা পার হতে হবে না। এটা তোমার প্রতিপালকের অবধারিত ফয়সালা। তারপর আমি ধর্মভীরুদের নিস্তার দেব এবং অত্যাচারীদের অধঃমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।’ (সূরা মারিয়াম : ৭১-৭২)।
উম্মুল মোমিনিন হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জাহান্নামের ওপর একটি পুল আছে, যা চুলের চেয়েও বেশি চিকন আর তরবারির চেয়েও বেশি ধারালো। এর ওপর লোহার শিকল ও কাঁটা থাকবে। মানুষ এর ওপর দিয়েই গমন করবে। কেউ চোখের পলকে, কেউ বিদ্যুৎ গতিতে, কেউ বায়ুবেগে আর কেউ উত্তম ঘোড়া ও উটের গতিতে পুলসিরাত পার হবে। আর ফেরেশতারা বলতে থাকবে, হে প্রভু! সহি-সালামতে অতিক্রম করাও, হে প্রভু! নিরাপদে পার করাও। কেউ নাজাত পাবে, কেউ আহত হবে, কেউ উপুড় হয়ে পড়ে যাবে আর কেউ অধঃমুখী হয়ে জাহান্নামে পড়ে যাবে। (মুসনাদে ইমাম আহমদ: ২৪৮৪৭)।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন পুলসিরাত সম্পর্কে আল্লাহর দিদার ও সিরাতের বর্ণানায় এসেছে- ‘অতপর পুলসিরাতকে এনে জাহান্নামের উপরে রাখা হবে। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! পুলসিরাত কি? তিনি বললেন, (পুলসিরাত) বড় পিচ্ছিল হবে; তার উপর আঁকশি ও আঁকড়া থাকবে। আরো থাকবে প্রশস্ত কাঁটালো যার কাঁটাগুলো হবে বাঁকানো। এ ধরণের গাছ নাজদ এলাকায় হয় যাকে ‘সাদান’ তথা কাঁটাদার গাছ বলা হয়। মুমিন তার (পুলসিরাতের) উপর দিয়ে চোখের পলকে, বিদ্যুতের ন্যায়, বাতাসের মত ও উন্নত মানের দ্রুততগামী ঘোড়ার মতো দৌড়ে পার হয়ে যাবে। কিছু নিরাপদে নাজাতপ্রাপ্ত হবে আবার কেউ আঁচড় খেয়ে নাজাত পাবে। আর কেউ খামচি খেয়ে জান্নামে পতিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইমাম গাজালি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, ‘পুলসিরাত হলো জাহান্নামের ওপর প্রলম্বিত সেতু, যা তলোয়ারের চেয়ে ধারালো হবে এবং চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম হবে। কাফির ও পাপাচারীরা সেখানে পদস্খলিত হয়ে নিচে পতিত হবে। সেখানে জাহান্নাম অবস্থিত থাকবে। আর মহান আল্লাহ ঈমানদারদের পা সুদৃঢ় রাখবেন। ফলে তারা চিরস্থায়ী নিবাসে পৌঁছে যাবে।’ (কাওয়াইদুল আকায়িদ)
ইমাম আশআরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘পুলসিরাত হলো জাহান্নামের ওপর স্থাপন করা দীর্ঘ সেতু। মানুষ তার আমল অনুযায়ী তা পার হবে। মানুষের আমলভেদে পুলসিরাত পার হওয়ার সময় চলার গতির ক্ষেত্রেও তারতম্য হবে।’ (রিসালাতুন ইলা আহলিস সাগার)
সকল নবীর প্রার্থনা
পুলসিরাতের কঠিন পরীক্ষায় সবাই খুব পেরেশান থাকবে। নবীরাও সেদিন আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে থাকবেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তাতে রয়েছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সব মানুষকে একত্র করে বলবেন, দুনিয়ায় তোমরা যে যে জিনিসের উপাসনা করেছিলে, সে তার সঙ্গে চলে যাও। অতএব সূর্যের উপাসনাকারী সূর্যের সঙ্গে, চন্দ্রের উপাসনাকারী চন্দ্রের সঙ্গে এবং মূর্তিপূজারি মূর্তির সঙ্গে চলে যাবে। অবশিষ্ট থাকবে এই উম্মতের লোকেরা। তাদের মধ্যে মুনাফিকরাও থাকবে। তখন জাহান্নামের ওপর পুলসিরাত স্থাপন করা হবে। সেদিন সর্বপ্রথম আমি সেই পুলসিরাত অতিক্রম করব। আর সেদিন সব রাসুলের দোয়া হবে ‘আল্লাহুম্মা সাল্লিম, আল্লাহুম্মা সাল্লিম’, অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ! রক্ষা কর, রক্ষা কর।’ (বুখারি : ৬২০৪; মুসলিম : ১৯৫)
পুলসিরাতের কঠিন পরীক্ষা
পুলসিরাত হচ্ছে জান্নাতে যাওয়ার পথে চূড়ান্ত পরীক্ষা। জাহান্নামিদের জন্য হাশরের মাঠ থেকে সরাসরি জাহান্নামের পথে নিয়ে যাওয়া হবে। আর যারা জান্নাতে যাবে তাদের জন্য এই ভয়ঙ্কর পথ অতিক্রমের পরীক্ষা হবে। মুমিন ও মুনাফিকদের এই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমার রবের কসম, আমি অবশ্যই তাদের ও শয়তানদের (হাশরের মাঠে) সমবেত করব, অতঃপর জাহান্নামের চারপাশে নতজানু অবস্থায় তাদের উপস্থিত করবো। তারপর প্রত্যেক দল থেকে পরম করুণাময়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অবাধ্যকে আমি টেনে বের করবই। আমি পরিপূর্ণ অবগত তাদের সম্পর্কে, যারা জাহান্নামে দগ্ধীভূত হওয়ার অধিকতর যোগ্য এবং তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যাকে এই পুলসিরাত পার হতে হবে না। এটা তোমার প্রতিপালকের অবধারিত ফয়সালা। সেদিন আমি তাকওয়া অবলম্বনকারীদের নাজাত দেব। আর জালিমদের আমি সেখানে রেখে দেব নতজানু অবস্থায়।’ (সুরা মারয়াম : ৬৮-৭২)
কেমন হবে পুলসিরাত
পুলসিরাত হবে অনেক ভয়ঙ্কর। চুলের মতো সূক্ষ্ম ও চিকন হবে। তরবারির মতো ধারালো হবে। নিচে থাকবে জাহান্নাম। দুই পাশে থাকবে লোহার তপ্ত শলাকা। কোনো আলোর ব্যবস্থা থাকবে না। যার যার আমলের আলো দিয়ে সে পথ অতিক্রম করতে হবে। হজরত আবু সায়িদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! পুলসিরাত কেমন হবে? নবীজি বললেন, তা মসৃণ ও পিচ্ছিল হবে, তাতে থাকবে অসংখ্য লৌহ শলাকা ও আংটা। আর থাকবে অসংখ্য কাঁটাযুক্ত দাঁতালো মাথা।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৩৯; মুসলিম, হাদিস : ১৮৩)
মুনাফিকদের এবং যেসব ঈমানদার গুনাহ করেছে তাদের জাহান্নাম থেকে উত্থিত সেসব শলাকা টেনে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘পুলসিরাতের দুই প্রান্তে অসংখ্য আংটা যুক্ত করা থাকবে। আল্লাহ যাকে আদেশ করবেন তাকেই সে টেনে ধরবে এবং জাহান্নামে ফেলে দেবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৯৫)।
পুরো পুলসিরাত জুড়েই থাকবে অসংখ্য লৌহ শলাকা। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘পুলসিরাতে থাকবে কাঁটাযুক্ত বৃক্ষের মতো অসংখ্য আংটা। তোমরা কি কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ দেখনি? সাহাবারা বললেন, অবশ্যই ইয়া রাসুলুল্লাহ! নবীজি বললেন, অবশ্যই সেসব আংটা হবে কাঁটাযুক্ত বৃক্ষের মতো। তার পরিমাণ সম্পর্কে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।’ (বুখারি : ৭৪৩৭; মুসলিম : ১৮২)।
ভয়ঙ্কর এই পুল হবে তরবারির ধারের মতো চিকন। হজরত সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘পুলসিরাত হবে ধারালো তরবারি মাথার মতো সূক্ষ্ম ও তীক্ষ্ম।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৪/৬২৯)
ঈমানদারদের নূর দেওয়া হবে
হাশরের মাঠ থেকে রওনা হওয়ার সময় সবাইকে বিশেষ আলো দেওয়া হবে। প্রত্যেকেই যার যার আমল অনুপাতে আলো পাবে। সবাইকে তাদের নূর পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানদার ও মুনাফিক সবাইকে একটি করে নূর ও আলো দেওয়া হবে। প্রত্যেকেই যার যার আলো দিয়ে পুলসিরাত অতিক্রম করবে।’ (মুসলিম : ১৯১)। প্রত্যেকেই যার যার আমলনামা অনুযায়ী নূর দেওয়া হবে।
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সবাইকে সবার আমল অনুপাতে নূর দেওয়া হবে। কারো সামনে পাহাড় পরিমাণ নূর দেওয়া হবে। কারও হাতে মশাল পরিমাণ নূর দেওয়া হবে। কারও নূর হবে একটি বৃক্ষের পরিমাণ। এভাবে সবচেয়ে কম নূর যাকে দেওয়া হবে তার নূর হবে পায়ের একটা আঙুলের মাথা পরিমাণ। একবার জ্বলবে একবার নিভবে। যখন আলো জ্বলবে তখন পথ চলবে, আর যখন নিভে যাবে তখন দাঁড়িয়ে থাকবে।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ৩৪২৪)