পুনরুত্থানের দিন কবর থেকে মানুষ যেভাবে উঠবে
আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য তিনটি জগৎকে নির্ধারিত করেছেন। দুনিয়ার জীবন, কবরের জীবন অতঃপর হাশরের ময়দানে প্রতিদান দিবসের পর পরকালের চিরস্থায়ী জীবন। পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের পূর্বে কবর থেকে মানুষের পুনরুত্থান ঘটানো হবে। অতঃপর হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশের পর চূড়ান্ত ফয়সালা অনুযায়ী চিরস্থায়ী আবাসস্থল নির্ধারণ হবে। সংক্ষেপে পুনরুত্থানের বর্ণনা তুলে ধরা হলো-
পুনরুত্থান
হজরত ইসরাফিল আলাইহিস সালাম যখন দ্বিতীয়বার শিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন তখনই সব মৃতব্যক্তি জীবিত হয়ে হবে। আর তাই পুনরুত্থান দিবস। তখন মানুষ আল্লাহ তাআলার দরবারে খালি পায়ে, বস্ত্রহীন শরীরে ও খাৎনা ছাড়াই দাঁড়াবে।
পুনরুত্থান সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-‘শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে তাদের রবের দিকে ছুটে চলবে। তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ। কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করল? রহমান আল্লাহ তো এরই ওয়াদা-প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং রাসুলগণ সত্য বলেছিলেন।’ (সুরা ইয়াসিন : আয়াত ৫১-৫২)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেন, ‘এরপর তোমরা মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন তোমরা পুনরুত্থিত হবে।’ (সুরা মুমিনুন : আয়াত ১৫-১৬)
পুনরুত্থানের বর্ণনা
আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন ফলে মানুষ তখন উদ্ভিদের ন্যায় কবর থেকে বের হতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বায়ু (বাতাস) পাঠিয়ে দেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি পানিপূর্ণ মেঘমালা বয়ে আনে, তখন আমি এ মেঘমালাকে একটি মৃত শহরের দিকে হাঁকিয়ে দেই। অতঃপর এ মেঘ থেকে বৃষ্টিধারা বর্ষণ করি। অতঃপর পানি দ্বারা সব ধরনের ফল উৎপন্ন করি। এমনিভাবে মৃতদেরকে বের করব। যাতে তোমরা স্মরণ কর। (সুরা আ’রাফ : আয়াত ৫৭)
হজরত ইসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় প্রথম ফুৎকার দেওয়ার পর পৃথিবী ধ্বংস হবে। সব মানুষের মৃত্যু হবে। মৃত্যু হবে জিব্রাইল-আজরাইল-ইসরাফিল (আ.)সহ সব ফেরেশতাও। অতঃপর আল্লাহ জমিনকে ভাঁজ করে ফেলবেন এবং তিনি তিনবার বলবেন, ‘আমিই প্রতাপশালী, আমিই প্রতাপশালী, আমিই প্রতাপশালী।’ অতঃপর তিনি তিনবার জিজ্ঞাসা করবেন, ‘আজকের রাজত্ব কার? আজকের সার্বভৌমত্ব কার? আজকের আধিপত্য কার? দুনিয়ার রাজা-বাদশারা কোথায়?
দুনিয়ার প্রতাপশালীরা কোথায়? দুনিয়ার অহঙ্কারীরা কোথায়?’ তখন জবাব দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না। আল্লাহ নিজেই উত্তর দেবেন, ‘আজকের রাজত্ব, আজকের সার্বভৌমত্ব, আজকের আধিপত্য, পরাক্রমশালী একমাত্র আল্লাহর।’
তারপর বহু বছর চলে যাবে। কত বছর অতিবাহিত হবে মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। অতঃপর এক দিন আল্লাহর নির্দেশে ইসরাফিল (আ.) শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুৎকার দেওয়ার সক্ষমতা লাভ করবেন। দ্বিতীয় ফুৎকারের মধ্য দিয়ে শুরু হবে পুনরুত্থান। সে সময় আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। মানুষ তখন উদ্ভিদের মতো বের হতে থাকবে।
মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের বিশ্বাস রাখা ঈমানের অন্যতম মৌলিক বিষয়। মৃত্যু যেমন সত্য। মৃত্যুর পর পুনরুত্থান ঠিক এমন সত্য। মহান আল্লাহ স্বীয় কুদরত ব্যবহার করে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মৃত সব শরীর একত্র করবেন। পৃথিবীতে কাউকে বাঘে খেয়ে ফেললে, পানিতে ডুবে মরলে, আগুনে পুড়ে মরলে বাহ্যত দেখা যায় এর কিছুই থাকে না। কিন্তু এসব কিছুর পুনরুত্থান ঘটাবেন মহান আল্লাহ। অতঃপর এগুলোতে তিনি রুহ ফিরিয়ে দেবেন। আল্লাহ বলেন, ‘শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, ফলে যাদেরকে আল্লাহ ইচ্ছা করেন তারা ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সবাই মূর্ছিত হয়ে পড়বে। অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দাঁড়িয়ে তাকাতে থাকবে।’ (সুরা জুমার : ৬৮)
কাফেররা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে অস্বীকার করত।
কাফেররা মৃত্যুর পর পুনরুত্থানকে অস্বীকার করত। একে অসম্ভব মনে করত। তারা মনে করত, একটা প্রাণী পচে-গলে যাওয়ার পর, হাড্ডি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর সেটি আবার কীভাবে জীবিত হবে? তারা বুঝতে চাইত না যে, এটি সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহর কাছে খুবই সহজ। ইরশাদ হয়েছে, ‘কাফেররা ধারণা করে যে, তারা কখনও পুনরুত্থিত হবে না। (হে নবী আপনি) বলুন, ‘নিশ্চয় হবে, আমার প্রতিপালকের শপথ! তোমরা অবশ্যই পুনরুত্থিত হবে। অতঃপর তোমরা যা করতে তোমাদের সে সম্বন্ধে অবশ্যই অবহিত করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ (সুরা তাগাবুন : ৭)।
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তারা বলে, আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণবিচূর্ণ হলেও কি নতুনরূপে উত্থিত হব? বলুন, তোমরা হয়ে যাও পাথর বা লোহা অথবা এমন কিছু, যা তোমাদের ধারণায় খুবই কঠিন, তারা বলবে, কে আমাদের পুনরুত্থিত করবে? বলুন, তিনিই, যিনি তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে এবং বলবে, তা কবে? বলুন, সম্ভবত তা শিগগিরই হবে।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৪৯-৫১)।
পুনরুত্থানপর্বে সর্বপ্রথম যে কবরটি ফেটে যাবে
পুনরুত্থানপর্বে সর্বপ্রথম যে কবরটি ফেটে যাবে, সেটি হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী (সা.)-এর কবর। হাদিসে এসেছে, ‘কেয়ামত দিবসে মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়বে এবং সর্বাগ্রে আমার (কবরের) জমিন ফেটে যাবে।’ (বুখারি : ২৪১২)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কিয়ামত দিবসে মানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়বে এবং আমি সর্বপ্রথম জ্ঞান ফিরে পাব।’ (২৪১২)।
পুনরুত্থান কেয়ামতের কঠিন একটি ধাপ। মানুষ ও জিন জাতির জন্য পুনরুত্থান হবে অনেক ভয় ও উৎকণ্ঠার। নবী-রাসুলরাও সেদিন ইয়া নাফসি (আমার কী অবস্থা হবে) ইয়া নাফসি (আমার কী অবস্থা হবে) বলতে থাকবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যখন শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে তখনই তারা কবর থেকে ছুটে আসবে তাদের প্রতিপালকের দিকে।
তারা বলবে, ‘হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠাল? দয়াময় আল্লাহ তো এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং রাসুলরা সত্যই বলেছিলেন। এটা হবে কেবল এক মহানাদ; তখনই তাদের সবাইকে উপস্থিত করা হবে আমার সামনে।’ (সুরা ইয়াসিন : ৫১-৫৩)। অনেক মানুষ সেদিন বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায় উত্থিত হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘অপমানে অবনমিত নেত্রে তারা কবর থেকে বের হবে বিক্ষিপ্ত পঙ্গপালের ন্যায়, তারা আহ্বানকারীর দিকে ছুটে আসবে ভীত-বিহ্বল হয়ে। কাফেররা বলবে, কঠিন এই দিন।’ (সুরা কামার : ৭-৮)। গ্রীষ্মকালে অনেক সময় দেখা যায় মাটি ফুঁড়ে পোকামাকড় বের হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে, পুনরুত্থানের সময় মানুষেরও তেমনি অবস্থা হবে। মাটি ফেড়ে তারা বের হতে থাকবে।
নিতান্ত অসহায়-নিঃস্ব হয়ে সেদিন সবাই পুনরুত্থিত হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় তোমরা নগ্নপদে, বস্ত্রহীন ও খতনাবিহীন অবস্থায় উত্থিত হবে।’ (মুসলিম : ২৮৬০)। প্রত্যেকে যে অবস্থায় ইন্তেকাল করবে সে সে অবস্থায় উঠবে। যে শহীদ হয়ে মরেছে সে শহীদ হয়ে উঠবে। যে হজব্রত পালন অবস্থায় মারা গেছে, সে হাজি হয়ে উঠবে।
পুনরুত্থান যেদিন শুরু হবে সেদিন হবে শুক্রবার। হজরত আওস ইবনে আওস সাকাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নিশ্চয় তোমাদের শ্রেষ্ঠ দিবস হলো শুক্রবার দিন। এদিনেই (প্রথম শিঙ্গায় ফুৎকারের ফলে) সবকিছু অজ্ঞান হয়ে পড়বে এবং এদিনেই দ্বিতীয় শিঙ্গায় ফুৎকার হবে।’ (নাসায়ি : ১৩৭৩)
তথ্যসূত্র:
মুফতি রাশেদুল ইসলাম
ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স