ইসলাম

কেয়ামতের বড় বড় আলামত সম্বন্ধে আকীদা

হযরত ঈসা (আঃ) এর পৃথিবীতে অবতরণ সম্বন্ধে আকীদা

দাজ্জালের বাহিনী বায়তুল মুকাদ্দাসের চতুর্দিক ঘিরে ফেলবে এবং মুসলমানগণ আবদ্ধ হয়ে পড়বে। ইত্যবসরে একদিন ফজরের নামাযের একামত হওয়ার পর হযরত ঈসা (আঃ) আকাশ থেকে ফেরেশতাদের উপর ভর করে অবতরণ করবেন। মুসলিম শরীফের এক হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী দামেস্কের এক মসজিদের পূর্ব দিকের মিনারার নিকট তিনি অবতরণ করবেন এবং হযরত মাহ্দী উক্ত নামাযের ইমামতি করবেন। হযরত ঈসা (আঃ) দাজ্জালকে হত্যা করবেন। তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হযরত ঈসা (আঃ) হাতে ছোট একটা বর্শা নিয়ে বের হবেন। তাঁকে দেখেই দাজ্জাল পালায়ন করতে আরম্ভ করবে। হযরত ঈসা (আঃ) তার পশ্চাদ্ধাবন করবেন এবং “বাবে লুদ” নামক স্থানে গিয়ে তাকে নাগালে পেয়ে বর্শার আঘাতে তাকে বধ করবেন।

মুসলমানদের আকীদা অনুযায়ী হযরত ঈসা (আঃ) – কে আল্লাহ তা’আলা স্বশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণও করেননি কিংবা ইয়াহূদীরা তাঁকে শূলীতে চড়িয়ে হত্যাও করতে পারেনি।

কুরআন শরীফে বলা হয়েছে : তারা তাঁকে হত্যাও করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি, কিন্তু তাদের এরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তাঁর সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা নিশ্চিতই এ ব্যাপারে সন্দেহে ছিল, এ সম্পর্কে অনুমান ব্যতীত তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাঁকে হত্যা করেনি, বরং আল্লাহ তাঁকে নিজের নিকট তুলে নিয়েছেন। আল্লাহ পরাক্রমশালী, হেকমতের অধিকারী। (সূরাঃ ৪-নিছাঃ ১৫৭)

হযরত ঈসা (আঃ) আকাশে জীবিত আছেন। দাজ্জালের আবির্ভাবের পর তিনি দুনিয়াতে আগমন করবেন, বিবাহ করবেন, তার সন্তান হবে এবং এক বর্ণনা অনুযায়ী বৎসর রাজত্ব পরিচালনা করার পর ইন্তেকাল করবেন। আর এক বর্ণনায় পৃথীবিতে অবতরণের পর হযরত ঈসা (আঃ)-এর ৪০ বৎসর অবস্থান করার কথা জানা যায়। হতে পারে হযরত ঈসা (আঃ)-এর আকাশে তুলে নেয়ার পূর্বের ৩৩ বৎসর ও পরের ৭ বৎসর সহ মোট ৪০ বৎসরকেই এখানে একত্রে বলা হয়েছে। আর এক বর্ণনায় ৪৫ বৎসরের কথা উল্লেখিত হয়েছে। তাঁকে আমাদের নবী (সাঃ)-এর রওযা শরীফের পার্শ্বেই (রাসূল [সাঃ] এবং আবূ বকর ও ওমরের মাঝে) দাফন করা হবে।

নিম্নোক্ত হাদীছে এ বর্ণনাই প্রদান করা হয়েছে। হযরত ঈসা (আঃ) নবী হিসেবে আগমন করবেন না বরং তিনি আমাদের নবী (সাঃ)-এর উম্মত হিসেবে আগমন করবেন এবং এই শরী’আত অনুযায়ীই তিনি জীবন যাপন ও খেলাফত পরিচালনা করবেন।

হাদীছে বর্ণিত আছে : ঈসা ইবনে মারইয়াম একজন ইনসাফগার শাসক হিসেবে অবতরণ করবেন। অতঃপর তিনি ক্রশ চিহ্নকে ভেঙ্গে ফেলবেন, শুকরকে বিনাশ করবেন আর জিয়াকে রহিত করবেন । তখন সম্পদের এরূপ প্রবাহ ঘটবে যে, কেই তা গ্রহণ করার মত থাকবে না। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২১০৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৪০৬, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-২২৩৩}

ইয়া’জূজ মা’জূজ সম্বন্ধে আকীদা

দাজ্জালের ফেত্না ও তার মৃত্যুর পর আসবে ইয়া’জূজ ও মা’জুজের ফেত্না। হযরত ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ ও দাজ্জালের ধ্বংস হওয়ার কিছুকাল পর হযরত মাহ্দীর ইন্তেকাল হবে। তখন হযরত ঈসা (আঃ) রাজত্ব পরিচালনা করতে থাকবেন। এরই মধ্যে এক সময় ইয়া’জূজ মা’জুজের আবির্ভাব হবে। ইয়া’জূজ মা’জূজ অত্যন্ত অত্যাচারী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের সংখ্যা অনেক বেশী হবে। তারা দ্রুত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং ভীষণ উৎপাত শুরু করবে, হত্যা এবং লুটতরাজ চালাতে থাকবে। তখন হযরত ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা তূর পর্বতে আশ্রয় নিবেন। হযরত ঈসা (আঃ) ও মুসলমানরা কষ্ট লাঘবের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করবেন। আল্লাহ তা’আলা মহামারীর আকারে রোগ-ব্যাধি প্রেরণ করবেন। বর্ণিত আছে-সেই রোগের ফলে তাদের গর্দানে এক ধরনের পোকা সৃষ্টি হবে, ফলে অল্প সময়ের মধ্যে ইয়া’জূজ মাজূজের গোষ্টী সকলেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে। তাদের অসংখ্য মৃত দেহের দূর্গন্ধ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। তখন হযরত ঈসা (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের দুআয় আল্লাহ তা’আলা এক ধরনের বিরাটকায় পাখী প্রেরণ করবেন, যাদের ঘাড় উটের ঘাড়ের মত। তারা মৃতদেহগুলো উঠিয়ে নিয়ে সাগরে বা যেখানে আল্লাহর ইচ্ছা ফেলে দিবে। তারপর বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং সমস্ত ভূ-পৃষ্ঠ পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আকাশের এক ধরনের ধোঁয়া সম্বন্ধে আকীদা

হযরত ঈসা (আঃ)-এর ইন্তেকালের পর কয়েকজন নেককার লোক ন্যায়পরায়ণতার সাথে রাজত্ব পরিচালনা করবেন। তারপর ক্রমান্বয়ে ধর্মের কথা কমে যাবে এবং চতুর্দিকে বে-দ্বীনী শুরু হবে। এ সময় আকাশ থেকে এক ধরনের ধোঁয়া আসবে, যার ফলে মু’মিন মুসলমানের সর্দির মত ভাব হবে এবং কাফেররা বেহুশ হয়ে যাবে। ৪০ দিন পর ধোঁয় পরিষ্কার হয়ে যাবে। কুরআন শরীফে এই ধোঁয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে ঃ অতএব তুমি অপেক্ষা কর সেদিনের যেদিন আকাশ স্পষ্ট ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হবে। (সূরাঃ ৪৪-দুখানঃ ১0 )

পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয়ের আকীদা

তার কিছু দিন পর একদিন হটাৎ একটি রাত তিন রাতের পরিমাণ লম্বা হবে। মানু ঘুমাতে ঘুমাতে ত্যক্ত হয়ে যাবে। গবাদি পশু বাইরে যাওয়ার জন্য চিৎকার শুরু করবে। শিশুরাও চিৎকার শুরু করবে। মুসাফিরগণ ভয়াবহ কি ঘটতে যাচ্ছে ভেবে ঘাবড়ে যাবে।

তারপর সূর্য গ্রহণের সময়ের মত সামান্য আলো নিয়ে পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে। সূর্য মধ্য আকাশ পর্যন্ত এসে আবার আল্লাহর হুকুমে পশ্চিম দিকে গিয়েই অস্ত যাবে। তারপর আবার যথারীতি পূর্বের নিয়মে পূর্বদিক থেকে উদয় এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যেতে থাকবে। পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় কিয়ামতের বড় বড় আলামত সমূহের একটি অন্যতম আলামত।

কুরআন শরীফে এই আলামত সম্বন্ধে বলা হয়েছে ঃ তারা কি শুধু এরই অপেক্ষা করছে যে, তাদের নিকট আসবে ফেরেশতা কিংবা আসবেন তোমার প্রতিপালক, অথবা আসবে তোমার প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহের একটি। (সূরাঃ ৬-আনআমঃ ১৫৮)

বোখারী মুসলিমসহ অন্য আরও কিতাবের সহীহ হাদীছ সমূহে উল্লেখিত হয়েছে যে, এখানে (তোমার প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহের একটি) দ্বারা পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়কে বোঝানো হয়েছে।

সহীহ হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়ের পর কোন কাফেরের ঈমান আনয়ন ও কোন ফাসেকের তওবা কবূল হবেনা। কুরআন শরীফেও এ বক্তব্য রয়েছে ঃ যেদিন আসবে “তোমার প্রতিপালকের নিদর্শনসমূহের একটি” সেদিন ইতিপূর্বে যে ঈমান আনেনি বা ঈমান অবস্থায় কোন ভাল কাজ করেনি তার ঈমান তার কোন উপকারে আসবেনা। (সূরাঃ ৬-আনআমঃ ১৫৮)

হাদীছে বর্ণিত হয়েছে : তিনটি জিনিস যখন প্রকাশ পাবে, তখন ইতিপূর্বে যে ঈমান আনেনি বা ঈমান অবস্থায় কোন ভাল কাজ করেনি তার ঈমান তার কোন উপকারে আসবেনা। সে তিনটি জিনিস হল : পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, দাজ্জাল ও দাব্বাতুল আরদ-এর আত্মপ্রকাশ।

দাব্বাতুল আরদ সম্বন্ধে আকীদা

পশ্চিম দিক থেকে সূর্য উদয়ের দিন বা একদিন পর মক্কা শরীফের সাফা পাহাড় ফেটে অদ্ভুত আকৃতির এক জন্তু বের হবে। একে বলা হয় দাব্বাতুল আরদ (ভূমির জন্তু ) এ প্রাণীটি মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। সে অতি দ্রুত বেগে সারা পৃথিবী ঘুরে আসবে। সে মু’মিনদের কপালে একটি নূরানী রেখা টেনে দিবে, ফলে তাদের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যাবে এবং বেঈমানদের নাকের অথবা গর্দানের উপর সীল মেরে দিবে, ফলে তাদের চেহারা মলিন হয়ে যাবে। সে প্রত্যেক মু’মিন ও কাফেরকে চিনতে পারবে। এ জন্তুর আবির্ভাব কিয়ামতের সর্বশেষ আলামত সমূহের অন্যতম। উপরোক্ত বর্ণনা ব্যতীত দাব্বাতুল আরদের আকার-আকৃতি সম্পর্কে ইবনে কাছীরে আরও বিভিন্ন রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করা হয়েছে, যার অধিকাংশই নির্ভরযোগ্য নয়।

কুরআন শরীফে দাব্বাতুল আরদের বহিঃপ্রকাশ সম্বন্ধে বলা হয়েছেঃ যখন ঘোষিত শাস্তি তাদের নিকট আসবে, তখন আমি ভূমি থেকে বের করব এক জীব; যা তাদের সাথে কথা বলবে এ জন্য যে, মানুষ আমার নিদর্শনে বিশ্বাস করে না। (সূরাঃ ২৭-নাম্‌লঃ ৮২)

হাদীছে দাব্বাতুল আরদের বহিঃপ্রকাশ সম্বন্ধে এসেছে : অর্থাৎ, তিনটি জিনিস যখন প্রকাশ পাবে, তখন ইতিপূর্বে যে ঈমান আনেনি বা ঈমান অবস্থায় কোন ভাল কাজ করেনি তার ঈমান তার কোন উপকারে আসবেনা। সে তিনটি জিনিস হল :পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয়, দাজ্জাল ও দাব্বাতুল আরদ-এর আত্মপ্রকাশ।

এক ধরনের আগুনের বহিঃপ্রকাশ সম্বন্ধে আকীদা

কিয়ামতের আলামত সমুহের মধ্যে সর্বশেষ আলামত হল মধ্য ইয়ামান থেকে একটা আগুন বের হবে। যার আলোতে শাম দেশ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে যাবে। এই আগুন মানুষকে বেষ্টন করে হাশরের ময়দানের দিকে হাকিয়ে নিয়ে যাবে, অর্থাৎ, শাম দেশের দিকে নিয়ে যাবে। দিবা রাত্র কখনই এ আগুন মানুষ থেকে পৃথক হবে না।

মুসলিম শরীফে হযরত হুযাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে – রাসূল (সাঃ) কিয়ামতের দশটি আলামত বর্ণনা করেছেন, তন্মধ্যে সর্বশেষ আলামত হল এটি। তিনি বলেন : একটা আগুন বের হবে ইয়ামান থেকে, যা মানুষকে তাদের হাশরের ময়দানের দিকে হাকিয়ে নিয়ে যাবে। অন্য এক বর্ণনায় আছে- এডেনের এক গুহা থেকে যে আগুন বের হয়ে লোকদেরকে ময়দানে হাশরের দিকে পরিচালিত করবে।

তথ্য সূত্রঃ

কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *