কুরআন তিলাওয়াতের ফজিলত ও গুরুত্ব
পবিত্র কোরআন আসমানি কিতাবগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। মর্যাদাপূর্ণ রমজান মাসে তা অবতীর্ণ হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সুপথপ্রাপ্তির সুস্পষ্ট পথনির্দেশ আর হক-বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের যে কেউ এ মাস পাবে সে যেন অবশ্যই এর রোজা রাখে।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৫)
প্রিয় নবীজি সাঃ এর কোরআন তিলাওয়াত:
কোরআনুল কারিম সময়ের ব্যবধানে প্রয়োজনের আলোকে অল্প অল্প করে দীর্ঘ ২৩ বছরে নাজিল হলেও আল্লাহ তাআলা প্রতি রমজানে হজরত জিবরিল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পুরো কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। আবার নবিজীও প্রত্যেক রমজানে জিবরিল আলাইহিস সালামকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হতেন এবং তাঁরা উভয়েই পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬)
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে নিজে তিলাওয়াত করতেন তেমনি সাহাবীদের থেকেও তিলাওয়াত শুনতেন। একবার নবীজী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে বললেন, তুমি আমাকে একটু তিলাওয়াত করে শোনাও তো। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে তিলাওয়াত শোনাব, আপনার উপরই তো কুরআন নাযিল হয়েছে! নবীজী বললেন, আমার মনে চাচ্ছে, কারো থেকে একটু তিলাওয়াত শুনি! এ শুনে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সূরা নিসা তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। পড়তে পড়তে যখন এ আয়াত পর্যন্ত আসলেন-
فَكَیْفَ اِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ اُمَّةٍۭ بِشَهِیْدٍ وَّ جِئْنَا بِكَ عَلٰی هٰۤؤُلَآءِ شَهِیْدًا.
সুতরাং (তারা ভেবে দেখুক) সেই দিন (তাদের অবস্থা) কেমন হবে, যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং (হে নবী), আমি তোমাকে ওইসব লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব? -সূরা নিসা (০৪) : ৪১]
এতটুকু তিলাওয়াত করার পর নবীজী বললেন, ঠিক আছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.বলেন, নবীজী থামতে বলার পর আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৫৫, ৪৫৮২, ৫০৪৯)
তিলাওয়াতকারীদের জন্য কুরআন সুপারিশ করবেঃ
যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে কুরআন কারীমকে নিজের সঙ্গী বানাবে কিয়ামতের দিন কুরআন তাকে ভুলবে না। কিয়ামতের সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে কুরআন তাকে সঙ্গ দেবে এবং তার জন্য সুপারিশ করবে। আবু উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
اقْرَؤُوا الْقُرْآنَ فَإِنّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ.
তোমরা কুরআন পড়। কেননা কিয়ামতের দিন কুরআন তার ‘ছাহিবের’ জন্য সুপারিশ করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮০৪
কুরআনের ছাহিব কে? মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, ‘ছাহিবে কুরআন’ বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যিনি কুরআন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকেন। কুরআনের হেদায়েত ও বার্তাগুলো গ্রহণ করেন। কুরআনের বিধানগুলো আমলে নেন। কুরআনের হিফয করেন। মোটকথা কুরআনই থাকে তার জীবনের আরাধনা। (দ্রষ্টব্য : কূতুবুল মুগতাযী আলা জামিইত তিরমিযী ২/৭৩২)
অতএব আমাদের ‘কুরআনের ছাহিব’ বা কুরআনওয়ালা হওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। আর কুরআনের ছাহিব হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হচ্ছে ইহতিমামের সাথে তিলাওয়াত করা। আল্লাহ আমাদের এমন তিলাওয়াতের তাওফীক দান করুন, যার মাধ্যমে আমরা ‘ছাহিবে কুরআন’-এর মাঝে পরিগণিত হব- আমীন।
কিয়ামতের দিন ছাহিবে কুরআনকে দেওয়া হবে বিশেষ মর্যাদাঃ
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবনে যেভাবে ছাহিবে কুরআন বান্দাদের সম্মানিত করে থাকেন তেমনি আখেরাতেও তাদেরকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করবেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
يُقَالُ – يَعْنِي لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ -: اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِي الدّنْيَا، فَإِنّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَأُ بِهَا.
(কেয়ামতের দিন) ছাহিবে কুরআনকে বলা হবে, তুমি তিলাওয়াত করতে থাক এবং(উপরের দিকে) চড়তে থাক। তুমি উত্তমরূপে তিলাওয়াত করতে থাক যেভাবে দুনিয়াতে সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করতে। কেননা তুমি যতটুকু পর্যন্ত পড়বে সেখানে হবে তোমার ঠিকানা। -জামে তিরমিযী, হাদীস:২৯১৪; মুসনাদেআহমাদ, হাদীস ৬৭৯৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৬৪
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কিয়ামতের দিন (ছাহিবে কুরআনের সুপারিশের জন্য) কুরআন আগমন করবে। সে বলবে, ইয়া রব! আপনি তার পোশাকের ব্যবস্থা করুন। তখন তাকে সম্মানের মুকুট পরানো হবে। এরপর কুরআন আবার বলবে, ইয়া রব! তাকে আরো সম্মানিত করুন। তখন তাকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। এরপর কুরআন বলবে, ইয়া রব! আপনি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। তখন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। তখন সেই ছাহিবে কুরআনকে বলা হবে, তুমি কুরআন পড়তে থাক আর (জান্নাতের সমুন্নত প্রাসাদে) চড়তে থাক। প্রতিটি আয়াতের বিনিময়ে তাকে কল্যাণ দেওয়া হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১৫
প্রতি অক্ষরে নেকী পাওয়া যায়:
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি অক্ষর তিলাওয়াত করল তার বিনিময়ে সে একটি নেকি পাবে, আর একটি নেকির বিনিময় হবে ১০ গুণ। এ কথা বলছি না যে আলিফ-লাম-মিম একটি অক্ষর, বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মিম একটি অক্ষর।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৯১০)
অন্য সময়ের তুলনায় রমজান মাসে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের সওয়াব বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কারণ, এ মাসে প্রতিটি আমলের অনেক গুণ বেশি ছওয়াব পাওয়া যায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
‘রমযানের ওমরা হজ্জ সমতুল্য।’ -জামে তিরমিযী, হাদীস ৯৩৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৯৮৬)
অন্য এক বর্ণনায় (যা সনদের দিক থেকে দুর্বল) বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে,
‘রমযান মাসে যে ব্যক্তি একটি নফল আদায় করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফযর আদায় করল। আর যে এ মাসে একটি ফরয আদায় করল সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করল। -শুআবুল ঈমান ৩/৩০৫-৩০৬
অর্থাৎ এ মাসে নফল আদায় করলে অন্য মাসের ফরযের ন্যায় ছওয়াব হয়। আর এ মাসের এক ফরযে অন্য মাসের ৭০ ফরযের সমান ছওয়াব পাওয়া যায়।
নবিজী সাঃ এর তিলাওয়াত পদ্ধতি :
পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের নিয়ম-পদ্ধতি শিখিয়েছেন নবীজি (সা.)। উম্মে সালমা (রা.) নবীজির তেলাওয়াতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, তাঁর তেলাওয়াত ছিল হরফগুলো পৃথক পৃথকভাবে উচ্চারিত। (আবু দাউদ : ১৪৬৬)। হাফসা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) যে সুরা পাঠ করতেন তা এতই ‘তারতিল’ রক্ষা করে অর্থাৎ স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে পাঠ করতেন যে, তা দীর্ঘ সুরার চেয়েও দীর্ঘ হয়ে যেত।’ (মুসলিম : ১/৫০৭)।
হজরত হুজাইফা (রা.) বলেন, এক রাতে আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ পড়লাম। তিনি সুরা বাকারা পড়তে আরম্ভ করলেন। আমি মনে মনে বললাম, তিনি একশো আয়াত পড়ে রুকুতে যাবেন। অতঃপর তিনি কিরাত চালিয়ে যেতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, এই সুরা এক রাকাতে সম্পূর্ণ করবেন; এটি পড়ে রুকু করবেন। কিন্তু তিনি সুরা নিসা আরম্ভ করলেন এবং তা সম্পূর্ণ পড়লেন। এরপর তিনি আলে ইমরান আরম্ভ করলেন। সেটিও সম্পূর্ণ পড়লেন। এত দীর্ঘ কেরাত সত্ত্বেও তিনি শান্তভাবে থেমে থেমে পড়েছিলেন। (মুসলিম : ১/৫৩৬)
আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন কোরআন পড়তেন, শ্রোতারা প্রতিটি হরফ বুঝতে পারত এবং অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারত। ইবনে বাত্তাল (রহ.) বলেন, উম্মে সালামা (রা.) নবী করিম (সা.)-এর কেরাতের বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নবীজির (সা.) কেরাতের প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে বোঝা যেত। তিনি তেলাওয়াত করতেন এক এক আয়াত করে থেমে থেমে। তিনি ধীরে ধীরে তেলাওয়াত করে উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন, তারা কীভাবে কোরআন পাঠ করবে এবং কীভাবে কোরআন নিয়ে চিন্তা করবে ও বুঝবে। একবার আলকামা (রা.) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.)-এর নিকট কোরআন পাঠ করলেন। আলকামা (রা.) একটু তাড়াহুড়ো করেছিলেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা.) বললেন, তারতিলের সঙ্গে পাঠ করো। কারণ তারতিল কোরআনের সৌন্দর্য। (শারহু সহিহিল বুখারি লি ইবনে বাত্তাল : ১০/২৭৪)। এসব কথা দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে, তারতিলই কোরআন অধ্যয়নের সর্বোত্তম পদ্ধতি ও পন্থা।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, কোরআন নাজিলের মাস রমজানে নবিজীর শেখানো পদ্ধতিতে কোরআন তেলাওয়াত করা। কোরআন বুঝে পড়ার চেষ্টা করা। কোরআনে ঘোষিত নেয়ামত পাওয়ার চেষ্টা করা। কোরআনের ঘোষিত আজাব থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। কোরআনের হুকুম-আহকাম যথাযথভাবে মেনে চলার চেষ্টা করা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের হক আদায় করে কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা মোতাবেক ইবাদত-বন্দেগি করার তাওফিক দান করুন। কোরআনের হেদায়েত দিয়ে নিজেদের আলোকিত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্রঃ. লেখকঃ মুফতি রাশেদুল ইসলাম ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা মিরপুর -১ (মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স)