রিয়া বা লৌকিকতা থেকে বেঁচে থাকার উপায়
রিয়া বা লৌকিকতা এমন এক আত্মিক ব্যাধি, যা মানুষের নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয় এবং শিরকের একটি ক্ষুদ্র রূপ। এটি থেকে মুক্ত থাকার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপায় অনুসরণ করা প্রয়োজন। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত পদ্ধতিগুলোর আলোকে রিয়া থেকে বাঁচার কার্যকর উপায়সমূহ নিচে আলোচনা করা হলো।
১. আমল শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য করার দৃঢ় নিয়ত গঠন করা
কোনো ইবাদত করার আগে এই নিয়ত করা জরুরি যে, এটি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং দুনিয়ার কোনো স্বীকৃতি বা প্রশংসার জন্য নয়। ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা, তাই আমলের সময় এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন—“নিশ্চয়ই প্রতিটি আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল, এবং মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।” (সহিহ বুখারি: ১, সহিহ মুসলিম: ১৯০৭)
যদি কোনো ভালো কাজ করার সময় মনে হয় যে, অন্য কেউ দেখছে, তখন নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, আমল শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হচ্ছে, অন্য কারও জন্য নয়।
২. নফল ইবাদত ও দান-সাদকা গোপনে করা
লৌকিকতা থেকে বাঁচতে হলে গোপনে ইবাদত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। বিশেষ করে নফল নামাজ, রোজা, দান-সাদকা ইত্যাদি যতটা সম্ভব গোপনে করা উচিত।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন—“সাত শ্রেণির লোককে আল্লাহ তাআলা তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন কোনো ছায়া থাকবে না। এর মধ্যে একজন হলো সেই ব্যক্তি, যে এমনভাবে গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা দান করে, বাম হাতও তা জানতে পারে না।” (সহিহ বুখারি: ৬৬০, সহিহ মুসলিম: ১০৩১)
যখন কোনো নেক আমল গোপনে করা হয়, তখন তাতে রিয়া প্রবেশের সম্ভাবনা কমে যায়।
৩. লৌকিকতার কুপ্রভাব ও পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করা
রিয়ার ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে জানা থাকলে মানুষ এতে পড়তে ভয় পাবে।
কোরআনে আল্লাহ বলেন—“যারা লোক দেখানোর জন্য দান করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না, তাদের দৃষ্টান্ত হলো সেই পাথরের মতো, যার উপর মাটি পড়ে ছিল; অতঃপর প্রবল বৃষ্টি তাকে ধুয়ে পাথরটিকে অনাবৃত করে ফেললো। তারা তাদের কৃতকর্মের কিছুই অর্জন করতে পারবে না।” (সূরা আল-বাকারা: ২৬৪)
এই আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যারা লোক দেখানোর জন্য দান করে, তাদের আমল সম্পূর্ণ বৃথা যাবে এবং তারা কোনো প্রতিদান পাবে না।
৪. আল্লাহর কাছে ইখলাস অর্জনের জন্য দোয়া করা
রিয়া থেকে বাঁচতে হলে আল্লাহর সাহায্য কামনা করা জরুরি। রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদের একটি বিশেষ দোয়া শিখিয়েছেন—
اللهم إني أعوذ بك أن أشرك بك وأنا أعلم، وأستغفرك لما لا أعلم
“হে আল্লাহ! আমি জেনে-বুঝে আপনার সাথে কোনো শিরক করা থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই, আর যা আমি জানি না, তার জন্য ক্ষমা চাই।” (মুসনাদ আহমদ: ৩৭২২)
নিয়মিত এই দোয়া পড়লে আল্লাহ আমাদের অন্তরকে লৌকিকতা থেকে মুক্ত রাখবেন এবং ইখলাস দান করবেন।
৫. দুনিয়ার প্রশংসা ও স্বীকৃতির লোভ ত্যাগ করা
দুনিয়ার প্রশংসা লাভের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে রিয়ার দিকে ঠেলে দেয়। একজন মুমিনের উচিত এই চিন্তা করা যে, মানুষের প্রশংসা সাময়িক, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি চিরস্থায়ী।
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন—
“যে ব্যক্তি মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করবে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন লজ্জিত করবেন এবং অপমানজনক শাস্তি দেবেন।” (সহিহ বুখারি: ৬৪৯৯, সহিহ মুসলিম: ২৯৮৬)
অর্থাৎ, যারা ইবাদতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, তারা দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত হবে এবং আখিরাতেও কঠিন শাস্তি পাবে।
৬. আত্মসমালোচনা করা ও নিয়মিত নিজের আমল পর্যালোচনা করা
রিয়া কখনো কখনো মনের গভীরে প্রবেশ করে, যা বোঝা কঠিন হয়। তাই নিয়মিতভাবে নিজের আমল ও নিয়ত পরীক্ষা করা জরুরি।
উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন—
“তোমরা নিজেদের হিসাব নাও, এর আগে যে তোমাদের হিসাব নেওয়া হয়।” (তিরমিজি: ২৪৫৯)
প্রতিদিন নিজের আমল পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে যে, কোথাও রিয়া প্রবেশ করেছে কি না।
৭. নিজের অন্তরকে আল্লাহর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করা
যদি একজন ব্যক্তি আল্লাহর ভালোবাসাকে নিজের অন্তরে সর্বোচ্চ স্থানে রাখে, তাহলে সে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাজ করবে এবং মানুষের প্রশংসা তার কাছে মূল্যহীন হয়ে যাবে।
কোরআনে আল্লাহ বলেন—
“তারা (মুমিনরা) বলে, আমরা তোমাদের খাওয়াই শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য; আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা চাই না।” (সূরা আদ-দাহর: ৯)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, যারা প্রকৃত মুমিন, তারা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করে এবং মানুষের প্রশংসা কামনা করে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রিয়া থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন এবং আমাদের সকল ইবাদত একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কবুল করুন। আমিন।