ইবাদত

রোযার মাসআলা – নিয়ত, রোজা ভঙ্গ হওয়া, ফিদইয়া, ইফতার, সেহরি, কাফফারা এবং কাযা রোযার বিধান

রমযানের রোযা ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। ঈমান, নামায ও যাকাতের পরই রোযার স্থান। রোযার আরবি শব্দ সওম, যার আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা। পরিভাষায় সওম বলা হয়-প্রত্যেক সজ্ঞান, বালেগ মুসলমান নর নারীর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও রোযাভঙ্গকারী সকল কাজ থেকে বিরত থাকা। সুতরাং রমযান মাসের চাঁদ উদিত হলেই প্রত্যেক সুস্থ, মুকীম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্কা নারীর উপর পূর্ণ রমযান রোযা রাখা ফরয। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পার।

সূরা বাকারা (২) : ১৮৩

অন্য আয়াতে ইরশাদ করেছেন-

সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে।

সূরা বাকারা (২): ১৮৫

 

 

রোযার নিয়ত

নিয়ত করা অপরিহার্য

প্রত্যেকটি ইবাদত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য নিয়ত করা অপরিহার্য। বুখারী শরীফের প্রথম হাদীস এ কথার প্রমাণ বহন করে। রোযা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্যও নিয়ত অন্যতম শর্ত। নিয়ত ব্যতীত রোযা শুদ্ধ হবেনা। নিয়ত ব্যতীত পুরো দিন কিছু পানাহার থেকে বিরত থাকাকে রোযা বলা হবেনা।।

তবে হ্যাঁ, নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা জরুরী নয়, বরং সাহরীর সময় উঠা এবং সাহরী খাওয়াটাও নিয়তের মধ্যে গণ্য হবে। তবে মুখের দ্বারা নিয়ত প্রকাশ করা উত্তম।

রমযানের প্রত্যেক রোযাতেই নিয়ত করা অপরিহার্য। একদিন নিয়ত করলে প্রত্যেক দিনের জন্য যথেষ্ট হবেনা। (ইলমুল ফিক্বহ : ৩/১৮)

 

অর্ধদিন নির্ধারণ করার নিয়ম

অর্ধদিবস নির্ধারণ করার নিয়ম এই যে, প্রথমে লক্ষ করতে হবে, সুবহে সাদিক কয়টার সময় হয় এবং সূর্য কখন অস্ত যায়। এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সময় হিসাব করে তার অর্ধেক বের করতে হবে। এ অর্ধ সময়ের মধ্যে নিয়ত করলে রোযা হয়ে যাবে। আর যদি অর্ধ সময় পুরোটা অথবা তার চেয়ে বেশি অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে রোযা হবে না। (অর্ধ দিবসের পূর্বে) এক ঘন্টা সময়ের শর্ত সতর্কতামূলক করা হয়েছে। (হাশিয়াহ বেহেশতি জেওর : ৩/৩)

 

মনের ইচ্ছার নামই নিয়ত

রমযান শরীফের রোযার মধ্যে শুধু এতটুকু নিয়ত করাই যথেষ্ট যে, আমি আজ রোযা রাখব অথবা মনে মনে বলবে, আগামী কাল আমি রোযা রাখব। শুধু এতটুকু নিয়তের দ্বারাই রমযানের রোযা হয়ে যাবে। যদি সুনির্দিষ্ট করে রমযান শরীফের রোযা বা ফরজ রোযা বলে নিয়ত নাও করে তবুও রোযা হয়ে যাবে। (বেহেশতী জেওর : ৩/৩)

 

সাধারণ নিয়তের দ্বারাই রমযানের রোযা

রমযান মাসে যদি কেউ এ নিয়ত করে যে, আগামীকাল আমি নফল রোযা রাখব, রমযানের রোযা রাখব না। এ রমযানের রোযা অন্য এক সময় কাযা আদায় করব, তবুও রমযান মাসের রোযাই আদায় হবে, নফল রোযা হবে না । (বেহেশতী জেওর : ৩/৩)

 

নিয়তের বিধান

নফল রোযা, নির্দিষ্ট মান্নতের রোযা এবং রমযান এর রোযা সমূহের নিয়ত রাতে অথবা শরয়ী অর্ধদিবস পর্যন্ত করা যাবে। আর বাকি রোযা সমূহের জন্য রাত হতেই নিয়ত করে নেওয়া জরুরী। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম : ৬/৩৪৬)

 

নিয়ত মুখে করা উত্তম

মনে মনে নিয়ত করাই যথেষ্ট। কিছু বলার প্রয়োজন নেই। যখন কারো মনের মধ্যে খেয়াল থাকে যে, আজ আমি রোযা এবং সারাদিন রোযার নিষিদ্ধ বস্তু হতে বিরত থাকব, তাহলে তার রোযা হয়ে যাবে। আর যদি মুখে বলে-হে আল্লাহ! আগামীকাল আমি রোযা রাখব। অথবা মআরবীতে বলে- نَوَيْتُ بِصَوْمِ غَدٍ مِنْ شَهْرِ رَمَضَانَ – “আমি আগামীকাল রমযান মাসের রোযার নিয়ত করছি”, তাহলে এটা উত্তম। (বেহেশতি জেওর : ৩/৩)

 

রোযার নিয়ত না করে খাওয়ার বিধান কী?

যদি রোযাদার ব্যক্তি সূর্য ঢলার (দ্বিপ্রহরের) আগ পর্যন্ত নিয়ত না করে তাহলে তার রোযা শুদ্ধ হবে না। কিন্তু পানাহার করা রমযান শরীফের সম্মানের কারণে জায়েয নয়। আর যদি পানাহার করে ফেলে তাহলে শুধু কাযা জরুরী হবে। (ইমদাদুল ফাতাওয়া : ১/১৭৩)

 

 


যে সব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় আর যে সব কারণে ভঙ্গ হয়না

১। মাসআলাঃ রোযা রাখিয়া যদি রোযার কথা ভুলিয়া কিছু খাইয়া ফেলে, কিংবা ভুলে স্বামী-সহবাস হইয়া যায়, রোযার কথা মাত্রই মনে না আসে, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না। যদি ভুলে পেট ভরিয়াও পানাহার করে, কিংবা ভুলে কয়েক বার পানাহার করে, তবুও রোযা ভঙ্গ হয় না। (কিন্তু খাওয়া শুরু করার পর স্মরণ হইলে তৎক্ষণাৎ খাওয়া বন্ধ করিতে হইবে। কিছু জিনিস গিলিয়া ফেলিলেও রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে।)

২। মাসআলাঃ কোন রোযাদারকে ভুলবশতঃ খাইতে দেখিলে যদি রোযাদার সবল হয় এবং রোযা রাখিতে কষ্ট না হয়, তবে তাহাকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া ওয়াজিব। কিন্তু যদি রোযা রাখিবার মত শক্তি তাহার না থাকে, তবে স্মরণ করাইবে না; তাহাকে খাইতে দিবে।

৩। মাসআলাঃ রোযা রাখিয়া দিনে ঘুমাইলে ও স্বপ্নদোষ হইলে (বা স্বপ্নে কিছু খাইলে) রোযা ভঙ্গ হয় না।

৪। মাসআলাঃ রোযা রাখিয়া সুরমা বা তেল লাগানো অথবা খুশবুর ঘ্রাণ লওয়া বৈধল আছে। এমন কি, চোখে সুরমা লাগাইলে যদি থুথু কিংবা শ্লেষ্মায় সুরমার রং দেখা যায়, তবুও রোযাভঙ্গ হয় না, মকরূহ্ও হয় না।

৫। মাসআলাঃ রোযা রাখিয়া দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে শোয়া, হাত লাগানো বা পেয়ার করা সবকিছুই বৈধ আছে, কিন্তু যদি কামভাব প্রবল হইয়া স্ত্রীসহবাসের আশংকা হয়, তবে এরূপ করা মাকরূহ্। (এই জন্যই জওয়ান স্বামী-স্ত্রীর জন্য রোযা রাখিয়া চুম্বন অথবা কোলাকুলি করা মাকরূহ্) কিন্তু যে সব বৃদ্ধের মনে চাঞ্চল্য আসে না তাহাদের জন্য মাকরূহ্ নহে।)

৬। মাসআলাঃ আপনাআপনি যদি গলার মধ্যে মাছি, ধোঁয়া বা ধুলা চলিয়া যায়, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না; কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক এরূপ করিলে রোযা ভঙ্গ হইবে।

৭। মাসআলাঃ লোবান বা আগরবাতি জ্বালাইয়া তাহার ধোঁয়া গ্রহণ করিলে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে। এইরূপে যদি কেহ বিড়ি সিগারেট অথবা হুক্কার ধোঁয়া পান করে তবে তাহার রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে। কিন্তু গোলাপ, কেওড়া ফুল, আতর ইত্যাদি যে সব খুশবুতে ধোঁয়া নাই, তাহার ঘ্রাণ লওয়া বৈধ আছে।

৮। মাসআলাঃ দাঁতের ফাঁকে যদি কোন খাদ্যদ্রব্য আট্‌কিয়া থাকে এবং খেলাল বা জিহ্বার দ্বারা তাহা বাহির করিয়া গিলিয়া ফেলে, মুখের বাহির না করে এবং ঐ খাদ্যদ্রব্য একটি বুটের পরিমাণ অথবা তদপেক্ষা অধিক হয়, তবে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে। আর যদি একটি বুট অপেক্ষা কম হয়, তবে রোযা ভঙ্গ হইবে না; কিন্তু যদি মুখ হইতে বাহিরে আনিয়া তারপর গিলে, তবে তাহা একটি বুট হইতে কম হইলেও রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে।

৯। মাসআলাঃ মুখের থুথু যত বেশীই হউক না কেন তাহা গিলিলে রোযার কোনই ক্ষতি হয় না।

১০। মাসআলা: শেষ রাত্রে সাহরী খাওয়ার পর যদি কেহ পান খায়, তবে ছোব্‌হে ছাদেকের পূর্বেই উত্তমরূপে কুলি করিয়া মুখ ছাফ করিয়া লওয়া উচিত। উত্তমরূপে কুলি করার পরও যদি সকালে থুথু কিছু লাল দেখায়, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হইবে না। (রোযা অবস্থায় ইজেকশন নিলেও রোযা নষ্ট হয় না।)

১১। মাসআলা: রাত্রে যদি গোসল ফরয হয়, তবে ছোবহে ছাদেকের পূর্বেই গোসল করিয়া
লওয়া উচিত; কিন্তু যদি কেহ গোসল করিতে দেরী কবে, কিংবা সারাদিন গোসল নাও করে, তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হইবে না। অবশ্য ফরয গোসল অকারণে দেরীতে করিলে তার কারণে পৃথক গুনাহ হইবে।

১২। মাসআলা : নাকের শ্লেষ্মা জোরে টানার কারণে যদি হলকুমে চলিয়া যায়, তবে তাহাতে রোযা নষ্ট হয় না। এইরূপে মুখের লালা টানিয়া গিলিলেও রোযা নষ্ট হয় না।

১৩। মাসআলাঃ যদি কেহ সাহরী খাইয়া পান মুখে দিয়া চিবাইতে চিবাইতে ঘুমাইয়া পড়ে এবং পান মুখে থাকা অবস্থাতেই রাত্রি প্রভাত হইয়া যায়, তবে তাহার রোযা শুদ্ধ হইবে না । এই রোযা ভাঙ্গিতে পারিবে না বটে, কিন্তু উহার পরিবর্তে একটি রোযা ক্বাযা রাখিতে হইবে, কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না।

১৪। মাসআলাঃ কুলি করার সময় যদি (অসতর্কতাবশতঃ রোযার কথা স্মরণ থাকা সত্ত্বেও ) হলকুমের মধ্যে পানি চলিয়া যায়, (অথবা ডুব দিয়া গোসল করিবার সময় হঠাৎ নাক বা মুখ দিয়া পানি হলকুমের ভিতর চলিয়া যায়,) তবে রোযা ভঙ্গ হইবে। (কিন্তু পানাহার করিতে পারিবে না।) এই রোযা ক্বাযা করা ওয়াজিব, কাফ্ফারা ওয়াজিব নহে।

১৫। মাসআলাঃ আপনাআপনি যদি বমি হইয়া যায়, তবে বেশী হউক কি কম হউক,তাহাতে রোযা নষ্ট হয় না। কিন্তু যদি ইচ্ছা করিয়া মুখ ভরিয়া বমি করে, তবে রোযা নষ্ট হইয়া যায়, অল্প বমি করিলে রোযা নষ্ট হয় না ।

১৬। মাসআলা: যদি আপনাআপনিই সামান্য বমি হয় এবং আপনাআপনিই হলকুমের ভিতর চলিয়া যায়, তাহাতে রোযা নষ্ট হইবে না। অবশ্য যদি ইচ্ছাপূর্বক গিলে, তবে কম হইলেও রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে, (অথবা যদি বেশী পরিমাণ আপনাআপনিই হলকুমের নীচে চলিয়া যায়, তবে রোযা নষ্ট হইয়া যাইবে। কিন্তু পানাহার করিবে না।)

১৭। মাসআলাঃ যদি কেহ একটি কঙ্কর অথবা একটি লোহার (বা সীসার) গুলি (অথবা একটি পয়সা গিলিয়া ফেলে অর্থাৎ,) এমন কোন জিনিস গিলিয়া ফেলে যাহা লোকে সাধারণতঃ খাদ্যরূপেও খাওয়া হয় না বা ঔষধরূপেও সেবন করা হয় না তবে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে বটে, কিন্তু কাফ্ফারা দিতে হইবে না; শুধু একটি রোযার পরিবর্তে একটি রোযা কাযা করিতে হইবে। আর যদি এমন কোন জিনিস গিলিয়া ফেলে, যাহা লোকে খাদ্যরূপে খায়, অথবা পানীয়রূপে পান করে, বা ঔষধরূপে সেবন করে, তবে তাহাকে ক্বাযাও রাখিতে হইবে এবং কাফ্ফারাও দিতে হইবে।

১৮। মাসআলাঃ রোযা রাখিয়া দিনের বেলায় স্ত্রী-সহবাস করিলে এমন কি পুরুষের খৎনা স্থান স্ত্রীর যোনি দ্বারে প্রবেশ করিলে বীর্যপাত হউক বা না হউক রোযা ভঙ্গ হইবে, ক্বাযা এবং কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হইবে।

১৯। মাসআলা : স্বামী যদি স্ত্রীর গুহ্যদ্বারে পুরুষাঙ্গের খৎনাস্থান পর্যন্ত প্রবেশ করায়, তবুও উভয়ের রোযা ভঙ্গ হইবে।কাফ্ফারা, ক্বাযা উভয়ই ওয়াজিব হইবে।

২০। মাসআলাঃ রমযান শরীফের রোযা রাখিয়া ভাঙ্গিলে কাফ্ফারা ওয়াজিব হয়। রমযান ছাড়া অন্য কোন রোযা ভাঙ্গিলে কাফ্ফারা ওয়াজিব হয় না, যেরূপেই ভাঙ্গুক, যদিও রমযানের ক্বাযা রোযা রাখিয়া ভাঙ্গে। অবশ্য যদি রাত্রে রোযার নিয়্যত না করে, কিংবা রোযা ভাঙ্গার পর ঐ দিনই হায়েয আসে, তবে ঐ ভাঙ্গার কারণে কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না।

২১। মাসআলাঃ নাকে নস্য টানিলে বা কানে তেল ঢালিলে, অথবা পায়খানার জন্য ডুস লইলে রোযা ভঙ্গ হইয়া যায়, কিন্তু এইরূপ করিলে কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না, শুধু কাযা করিতে হইবে। কানে পানি টকাইলে তাহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না ।

২২। মাসআলা: রোযা রাখা অবস্থায় পেশাবের রাস্তায় কোন ঔষধ রাখা অথবা তেল ইত্যাদি কিছু টপকানো দুরুস্ত নাই। যদি কেহ ঔষধ রাখে, তবে রোযা ভঙ্গ হইবে এবং ক্বাযা ওয়াজিব হইবে, কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না।

২৩। মাসআলাঃ ধাত্রী যদি প্রসূতির প্রস্রাব দ্বারে আঙ্গুল ঢুকায় কিংবা নিজেই নিজ যোনিতে আঙ্গুল ঢুকায়, অতঃপর সম্পূর্ণ আঙ্গুল বা কিয়দংশ বাহির করার পর আবার ঢুকায়, তবে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে। কিন্তু কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না।

আর যদি বাহির করার পর আবার না ঢুকায় তবে রোযা ভঙ্গ হইবে না। অবশ্য যদি পানি ইত্যাদির দ্বারা আঙ্গুল ভিজা থাকে, তবে প্রথমবারে ঢুকাইলেই রোযা ভঙ্গ হইবে।

২৪। মাসআলাঃ দাঁত দিয়া রক্ত বাহির হইলে যদি থুথুর সঙ্গে সে রক্ত গিলিয়া ফেলে, তবে রোযা ভঙ্গ হইবে, কিন্তু যদি থুথুর চেয়ে কম হয়—যাহাতে রক্তের স্বাদ পাওয়া না যায়, তবে রোযা ভঙ্গ হইবে না ।

২৫। মাসআলাঃ কোন জিনিস জিহ্বার অগ্রভাগ দিয়া শুধু একটু স্বাদ দেখিয়া থুথু ফেলিয়া দিলে, রোযা ভঙ্গ হয় না; কিন্তু বিনা দরকারে এরূপ করা মাকরূহ্। অবশ্য যদি কাহারও স্বামী এত বড় যালেম এবং পাষাণ হৃদয় হয় যে, তরকারীতে লবণ একটু বেশী-কম হইলে যুলুম করা শুরু করে, তাহার জন্য তরকারীরর লবণ দেখিয়া থুথু ফেলিয়া দেওয়া বৈধ আছে,মাকরূহ্ নহে।

২৬। মাসআলাঃ রোযাবস্থায় শিশু সন্তানের খাওয়ার জন্য কোন জিনিস চিবাইয়া দেওয়া মাকরূহ্। অবশ্য শিশুর জীবন ওষ্ঠাগত হইলে এবং কেহ চিবাইয়া দেওয়ার না থাকিলে, এইরূপ অবস্থায় চিবাইয়া দিয়া মুখ পরিষ্কার করিয়া ফেলা জায়েয আছে ।

২৭। মাসআলাঃ রোযা রাখিয়া দিনের বেলায় কয়লা, বা মাজন (বা বালুর) দ্বারা দাঁত মাজা মকরূহ্ এবং ইহার কিছু অংশ যদি হলকুমের নীচে চলিয়া যায়, তবে রোযা ভঙ্গ হইয়া যাইবে। কাঁচা বা শুকনা মেওয়াক দ্বারা দাঁত মাজা দুরুস্ত আছে। এমন কি, যদি নিমের কাঁচা ডালের মেসওয়াক দ্বারা মেসওয়াক করে এবং তাহার তিক্ততার স্বাদ মুখে অনুভব করে, তাহাতেও রোযার কোন ক্ষতি হইবে না, মত্ত হইবে না।

২৮। মাসআলাঃ কোন স্ত্রীলোক অসতর্ক অবস্থায় ঘুমাইয়াছে, কিংবা অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছে, কেহ তাহার সহিত সহবাস করিলে তাহার রোযা ভঙ্গ হইবে এবং ক্বাযা ওয়াজিব হইবে।কিন্তু পুরুষের কাফ্ফারাও ওয়াজিব হইবে।

২৯। মাসআলাঃ ভুলে পানাহার করিলে রোযা ভেংগে যায় না, কিন্তু এইরূপ করার পর তাহার রোযা ভঙ্গ হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া যদি কিছু খায়, তবে তাহার রোযা অবশ্য ভঙ্গ হইয়া যাইবে কিন্তু শুধু ক্বাযা করিতে হইবে, কাফ্ফারা দিতে হইবে না।

৩০। মাসআলাঃ কাহারও যদি আপনাআপনি বমি হয়, তাহাতে রোযা ভঙ্গ হয় না, কিন্তু রোযা ভঙ্গ হইয়া গিয়াছে মনে করিয়া যদি পরে কিছু খায়, তবে তাহার রোযা অবশ্য ভঙ্গ হইয়া যাইবে; কিন্তু শুধু ক্বাযা করিতে হইবে, কাফ্ফারা দিতে হইবে না ।

৩১। মাসআলাঃ যদি কেহ সুরমা অথবা তেল লাগাইয়া অজ্ঞতাবশতঃ মনে করে যে, তাহার রোযা ভাঙ্গিয়া গিয়াছে এবং এই কারণে ইচ্ছা করিয়া কিছু খাওয়া-দাওয়া করে, তবে ক্বাযা ও কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হইবে।

৩২। মাসআলাঃ রমযান মাসে কোন কারণবশতঃ যদি কাহারও রোযা ভাঙ্গিয়া যায়, তবুও দিনের বেলায় তাহার জন্য কিছু খাওয়া-দাওয়া বৈধ নহে, পুরা দিন রোযাদারের ন্যায় না খাইয়া থাকা তাহার উপর ওয়াজিব।

৩৩। মাসআলাঃ যদি কেহ রমযানে রোযার নিয়্যতই করে নাই বলিয়া খাওয়া-দাওয়া করিতে থাকে, তাহার উপর কাফ্ফারা ওয়াজিব হইবে না। রোযার নিয়্যত করিয়া ভাঙ্গিলে কাফ্ফারা ওয়াজিব হয়।


যে সব কারণে রোযা না রাখা জায়েয আছে

১। মাসআলাঃ কেহ যদি এমন রোগাক্রান্ত হয় যে, যদি রোযা রাখে, তবে (ক) রোগ বাড়িয়া যাইবে, (খ) রোগ দুরারোগ্য হইয়া যাইবে, (গ) জীবন হারাইবার আশঙ্কা হয়, তবে তাহার জন্য তখন রোযা না রাখিয়া আরোগ্য লাভ করার পর ক্বাযা রাখা দুরুস্ত আছে। কিন্তু শুধু নিজের কাল্পনিক খেয়ালে রোযা ছাড়া জায়েয নহে, যখন কোন মুসলমান দ্বীনদার চিকিৎসক সার্টিফিকেট (সাক্ষ্য) দিবেন যে, রোযা তোমার ক্ষতি করিবে, তখন রোযা ছাড়া জায়েয হইবে।

২। মাসআলাঃ চিকিৎসক, ডাক্তার বা কবিরাজ যদি কাফের (অমুসলমান) হয়, অথবা এমন মুসলমান হয় যে, দ্বীন-ঈমানের পরওয়া রাখে না, তবে তাহার কথায় রোযা ছাড়া যাইবে না ।

৩। মাসআলাঃ রোগী যদি নিজেই বহুদর্শী জ্ঞানী হয় এবং বারবার পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত হইয়া থাকে যে, এই রোগে রোযা রাখিলে নিশ্চয় ক্ষতি হইবে এবং মনেও এইরূপ সাক্ষ্য দেয় তবে নিজের মনের সাক্ষ্যের উপর রোযা ছাড়িতে পারে। কিন্তু যদি নিজে ভুক্তভোগী জ্ঞানী না হয়, তবে শুধু কাল্পনিক খেয়ালের কোনই মূল্য নাই। কাল্পনিক খেয়ালের বশীভূত হইয়া কিছুতেই রোযা ছাড়িবে না। এইরূপ অবস্থায় দ্বীনদার চিকিৎসকের সাক্ষ্য (সনদ) ব্যতিরেকে রোযা ছাড়িলে কাফ্ফারা দিতে হইবে। রোযা না রাখিলে গোনাহ্গার হইবে।

৪। মাসআলাঃ রোগ আরোগ্য হওয়ার পর যে দুর্বলতা থাকে, সেই দুর্বল অবস্থায় যদি রোযা রাখিলে পুনরায় রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশংকা থাকে, তবে সে অবস্থায় রোযা না রাখা জায়েয আছে।

৫। মাসআলাঃ যে ব্যক্তি বাড়ী হইতে ৪৮ মাইল বা তদূর্ধ্ব দূরবর্তী স্থানে যাইবার এরাদা করিয়া নিজ বাসস্থানের লোকদের সীমা অতিক্রম করিয়াছে, তাহাকে শরীআতের পরিভাষায় ‘মুসাফির’ বলে। অবশ্য যাহারা শরীয়ত অনুসারে মুসাফির তাহারা সফরে থাকাকালীন রোযা ছাড়িয়া দিয়া অন্য সময় রাখিতে পারে।

৬। মাসআলাঃ শরয়ী সফরে যদি কোন কষ্ট না হয়, যেমন গাড়ীতে ভ্রমণ করিতেছে, ধারণা এই যে, সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ী পৌঁছিয়া যাইবে, কিংবা সঙ্গে আরামের দ্রব্য আছে। তবে রোযা রাখাই উত্তম, কিন্তু না রাখিলে গোনাহ্ হইবে না; অবশ্য রমযানের ফযীলত পাইবে না। যদি রোযা রাখিতে কষ্ট হয়, তবে রোযা না রাখাই ভাল ৷

৭। মাসআলাঃ যদি কেহ অসুস্থাবস্থায় মারা যায়, অথবা শরয়ী সফরেই মৃত্যু হয়, তবে যে কয়টি রোযা এই রোগের অথবা এই সফরের জন্য ছুটিয়াছে, আখেরাতে তাহার জন্য দায়ী হইবে না। কেননা, সে ক্বাযা রোযা রাখিবার সময় পায় নাই।

৮। মাসআলাঃ কেহ অসুস্থাবস্থায় ১০টি রোযা ছাড়িয়াছে এবং পরে পাঁচ দিন ভাল থাকিয়া মৃত্যু হইল, এখন পাঁচটি রোযা মা’ফ পাইবে, কিন্তু যে পাঁচ দিন ভাল ছিল অথচ ক্বাযা রোযা রাখে নাই, সেই পাঁচটি রোযার জন্য দায়ী হইবে এবং কিয়ামতের হিসাবের সময় তাহার জন্য ধর-পাকড় হইবে। আর যদি রোগ আরোগ্য হওয়ার পর পূর্ণ দশ দিন ভাল থাকিয়া থাকে, তবে পূর্ণ দশটি রোযার জন্যই দায়ী হইবে এবং কিয়ামতের দিন ধর-পাকড় হইবে। কাজেই যদি কাহারও এইরূপ অবস্থা হয় তবে তাহার মৃত্যুর আলামত দেখিলেই তাহার মাল থাকিলে বাকী রোযার ফিদয়া আদায় করার জন্য অছিয়ত করিয়া যাওয়া উচিত (মাল থাকা সত্ত্বেও যদি অছিয়ত না করে, তবে শক্ত গোনাহগার হইবে।)

৯। মাসআলা : এইরূপ যদি কেহ শরয়ী সফরের মধ্যে রোযা না রাখে এবং বাড়ীতে ফিরিয়া কয়েক দিন পর মারা যায়, তবে যে কয়দিন বাড়ীতে আসিয়া ভাল রহিয়াছে, সেই কয় দিনের জন্য ধর-পাকড় হইবে, সেই কয়টি রোযার ফিদ্‌য়ার জন্য অছিয়ত করিয়া যাওয়া তাহার উপর ওয়াজিব। যে কয়দিন বাড়ীতে রহিয়াছে, রোযা যদি তাহা অপেক্ষা বেশী ছুটিয়া থাকে,তবে বেশী রোযার ফিদ্‌য়া তাহার উপর ওয়াজিব নহে এবং সেজন্য মুয়াখাযা (জবাবদেহী করিতে)-ও হইবে না ।

১০। মাসআলাঃ শরয়ী সফরে বাহির হওয়ার পর যদি বিদেশে কোন স্থানে ১৫ দিন বা তাহার বেশী অবস্থান করিবার নিয়্যত করে, তবে সেখানে থাকাকালে রোযা ছাড়া দুরুস্ত নহে। কেননা, কমপক্ষে ১৫ দিন কোন স্থানে অবস্থান করার নিয়্যত করিলে শরিয়তের দৃষ্টিতে সে মুক্বীম হইয়া যায়, মুসাফির থাকে না। অবশ্য যদি ১৫ দিনের কম থাকার নিয়্যত করে, তবে রোযা না রাখা জায়েয আছে।

১১। মাসআলাঃ গর্ভবতী মেয়েলোকের অথবা সদ্যপ্রসূত শিশুর স্তন্যদায়িনী মেয়েলোকের রোযা রাখিলে রোযা যদি নিজের বা শিশুর জীবনের জন্য আশঙ্কা হয়, তবে তাহাদের জন্য রোযা না রাখা বৈধ আছে। তাহারা পরে অন্য সময় ক্বাযা রোযা রাখিয়া লইবে। অবশ্য যদি স্বামী মালদার হয় এবং অন্য কোন ধাত্রী রাখিয়া শিশুকে দুধ পান করাইতে পারে, তবে মায়ের জন্য রোযা ছাড়া জায়েয নহে। কিন্তু যদি শিশু এমন হয় যে, সে তাহার মায়ের দুধ ছাড়া অন্যের দুধ মুখেই লয় না, তবে (শিশুর দুধের জন্য) মায়ের রোযা না রাখা বৈধ আছে।

১২। মাসআলাঃ কোন মেয়েলোক ধাত্রীর চাকুরী লইয়াছে। তাহাকে কোন বড় লোকের ছেলেকে দুধ পান করাইতে হয়, অন্যথায় শিশু বাঁচে না। এই অবস্থায় যদি রমযান মাস আসিয়া পড়ে, তবে তাহার জন্য তখন রোযা না রাখিয়া পরে ক্বাযা রাখা বৈধ আছে।

১৩। মাসআলাঃ মেয়েলোকের যদি রোযার মধ্যে হায়েয বা নেফাস উপস্থিত হয়, তবে তদবস্থায় রোযা রাখা দুরুস্ত নহে, পরে রাখিবে।

১৪। মাসআলাঃ রাত্রে যদি মেয়েলোকের হায়েয বন্ধ হয়, তবে সকালে রোযা ছাড়িবে না, রোযার পর যদি রাত্রে গোসল নাও করে, তবুও রোযা ছাড়িতে পাড়িবে না। আর যদি ছোব্‌হে ছাদেক হওয়ার পর রক্ত বন্ধ হয়, তবে রোযার নিয়্যত করা জায়েয হইবে না। অবশ্য দিন ভরিয়া কিছু পানাহার করা বৈধ নয়। সারাদিন রোযাদারের মত থাকিবে ।

১৫। মাসআলাঃ যদি কেহ রমযান শরীফে দিনের বেলায় নূতন মুসলমান হয় বা বালেগ হয়, তবে তাহাদের জন্য অবশিষ্ট দিন কিছু খাওয়া-দাওয়া করা বৈধ নহে, কিন্তু যদি কিছু খায়, তবে যে দিনের বেলায় বালেগ হইয়াছে বা নূতন মুসলমান হইয়াছে, তাহার ঐ দিনের ক্বাযা ওয়াজিব নহে।

১৬। মাসআলা : কেহ যদি সফরের কারণে রোযার নিয়্যত না করে, কিন্তু কিছু খাওয়া-দাওয়ার পূর্বে দুপুরের এক ঘণ্টা পরে বাড়ী পৌঁছিয়া যায়, অথবা কোন স্থানে ১৫ দিন অবস্থানের নিয়্যত করে, তবে তাহার ঐ সময় রোযার নিয়্যত করিতে হইবে। [মাসআলাঃ কেহ রোযার নিয়্যত করার পর যদি সফর শুরু করে, তবে তাহার জন্য ঐ রোযাটি ছাড়িয়া দেওয়া জায়েয নহে। এইরূপে যে ব্যক্তি সকাল বেলায় সফরে যাইবে তাহার জন্য রোযার নিয়্যত না করা জায়েয নহে। এইরূপে মুছাফির যদি রোযার নিয়্যত করিয়া থাকে, তবে তাহার জন্য ঐ রোযাটি ছাড়া জায়েয নহে।]


রোযার ফিদইয়া

নামায বা রোযার পরিবর্তে যে ছদ্‌কা দেওয়া হয়, তাহাকে “ফিদয়া” বলে এবং রমযান শরীফের বরকত, রহমত ও হুকুম পালনে সক্ষম হওয়ার খুশীতে বান্দা ঈদের দিন নিজের তরফ হইতে এবং নিজের পরিবারবর্গের তরফ হইতে যাহাকিছু ছদকা করে, তাহাকে “ফেতরা” বলে ।

১। মাসআলাঃ যে ব্যক্তি এত বৃদ্ধ হইয়া গিয়াছে যে, তাহার আর রোযা রাখার শক্তি নাই, বা এত রোগা ও দুর্বল হইয়াছে যে, তাহার আর ভাল হইবার আশা নাই। এইরূপ লোকের জন্য শরীয়তে এই ব্যবস্থা করা হইয়াছে, যে, সে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে হয় একজন মিসকীনকে দুই ওয়াক্ত পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া দিবে, না হয় একটি রোযার পরিবর্তে একজন মিসকীনকে ছদকায়ে ফেতরা পরিমাণ গম বা তাহার মূল্যের চাউল বা পয়সা দান করিবে। ইহাকেই শরীয়তের ভাষায় ফিদ্‌য়া বলে।

২। মাসআলা: একটি ফিদ্‌য়া একজন মিসকীনকে দেওয়াই উত্তম। কিন্তু যদি একটি ফিদয়া কয়েকজন মিসকীনকে কিছু কিছু করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলেও দুরুস্ত আছে।

৩। মাসআলাঃ বৃদ্ধ যদি পুনরায় কখনও রোযা রাখার শক্তি পায়, অথবা চিররোগী নিরাশ ব্যক্তি পুনরায় আরোগ্য লাভ করে এবং রোযা রাখার শক্তি পায়, তবে যে সব রোযার ফিদয়া দিয়াছে সে সব রোযার ক্বাযা তাহাদের করিতে হইবে এবং যাহা ফিদ্‌য়া দান করিয়াছে তাহার সওয়াব পৃথকভাবে পাইবে।

৪। মাসআলাঃ যাহার যিম্মায় ক্বাযা থাকে, তাহার মৃত্যুর পূর্বে অছিয়ত করিয়া যাইতে হইবে যে, আমার এতগুলি রোযা ক্বাযা আছে, তোমরা ইহার ফিদ্‌য়া আদায় করিয়া দিও। এইরূপ অছিয়ত করিয়া গেলে তাহার স্থাবর-অস্থাবর ষোল আনা সম্পত্তি হইতে—(১) আগে তাহার কাফনের বন্দোবস্ত করিতে হইবে। (২) তারপর তাহার ঋণ পরিশোধ করিতে হইবে (যদি স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করিয়াও ঋণ পরিশোধ করার দরকার পড়ে, তাহাও করিতে হইবে। ঋণ পরিশোধের পূর্বে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে ওয়ারিশগণের কোন অধিকার থাকে না। (৩) তারপর যাহাকিছু অবশিষ্ট থাকে তাহার তিন ভাগের এক ভাগ দ্বারা অছিয়ত পূর্ণ করিতে ওয়ারিশগণ শরীয়তের আইন মতে বাধ্য। যদি অবশিষ্ট সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ দ্বারা সম্পূর্ণ অছিয়ত পূর্ণ না হয়, তবে যে পরিমাণ আদায় হয়, সেই পরিমাণ আদায় করা ওয়াজিব এবং যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহা যদি ওয়ারিশগণ নিজ খুশীতে আদায় করিয়া দেয়, তবে তাহাদের পক্ষে ইহা অতি উত্তম হইবে এবং মৃত ব্যক্তির পক্ষে নাজাতের উপায় হইবে ।

৫। মাসআলাঃ মৃত ব্যক্তি যদি অছিয়ত না করে এবং যাহারা ওলী-ওয়ারিশ থাকে তাহারা নিজের তরফ হইতে তাহার রোযা নামাযের ফিদ্‌য়া দেয়, তবুও আশা করা যায় যে, আল্লাহ্তা ‘আলা নিজ দয়াগুণে তাহা কবূল করিয়া নিবেন এবং মৃত ব্যক্তির অপরাধ ক্ষমা করিয়া দিবেন। যদি অছিয়ত না করিয়া থাকে, তবে মৃত ব্যক্তির মাল হইতে ফিদ্‌য়া দেওয়া জায়েয নাই । এইরূপে যদি ফিদ্‌য়া এক তৃতীয়াংশ হইতে বেশী হয়, তবে অছিয়ত করা সত্ত্বেও সকল ওয়ারিশের অনুমতি ছাড়া বেশী দেওয়া জায়েয নাই। অবশ্য যদি সকলে খুশী হইয়া অনুমতি দেয়, তবে উভয় অবস্থায় ফিদয়া দেওয়া দুরুস্ত আছে। কিন্তু শরীঅতে না-বালেগ ওয়ারিশের অনুমতির কোন মূল্য নাই। বালেগ ওয়ারিশগণ নিজ নিজ অংশ পৃথক করিয়া যদি উহা হইতে দেয়, তবে দুরুস্ত আছে।

৬। মাসআলাঃ যদি কাহারও নামায ক্বাযা হইয়া থাকে এবং অছিয়ত করিয়া মারা যায় যে, আমার নামাযের বদলে ফিদ্‌য়া দিয়া দিও, তাহারও এই হুকুম।

৭। মাসআলা ঃ প্রত্যেক ওয়াক্ত নামাযের ফিদয়া একটি রোযার ফিদয়ার পরিমাণ। এই হিসাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ফরয এবং বেতর এই ছয় নামাযের ফিদ্‌য়া ৮০ তোলা সেরের এক ছটাক কম পৌণে এগার সের (দশ সের বার ছটাক) গম দিবে। কিন্তু সতর্কতার জন্য পুরা বার সের দিবে।

৮। মাসআলাঃ যদি কাহারও যিম্মায় যাকাত থাকিয়া যায়, (অর্থাৎ, যাকাত ফরয হইয়াছিল, না দিতেই মৃত্যু হইয়া গিয়াছে) কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে যদি অছিয়ত করিয়া যায় যে, আমার যিম্মায় এত টাকা যাকাত ফরয হইয়া রহিয়াছে, তোমরা আদায় করিয়া দিও, তবে ঐ পরিমাণ যাকাত আদায় করা ওয়ারিশগণের উপর ওয়াজিব হইবে। যদি অছিয়ত না করিয়া থাকে এবং যদি ওয়ারিশগণ নিজ খুশীতে দেয়, তবে যাকাত আদায় হইবে না, (তবে দেওয়া ভাল।) আল্লামা শামী সিরাজুল ওয়াহ্হাজ হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন যে, যদি ওয়ারিশগণ অছিয়ত ব্যতীত আদায় করে, তবে আদায় হইয়া যাইবে। (খোদা তা’আলার দরবারে আশা করা যায় যে, মৃতব্যক্তি তদ্দ্বারা ও নাজাত পাইতে পারে।)

৯। মাসআলাঃ যদি ওলী মৃত ব্যক্তির পক্ষে ক্বাযা রোযা রাখে বা ক্বাযা নামায পড়ে, তবে দুরুস্ত নহে। অর্থাৎ, তাহার যিম্মার ক্বাযা আদায় হইবে না।

১০। মাসআলাঃ অকারণে রমযানের রোযা না রাখা দুরুস্ত নাই। ইহা অতি বড় গোনাহ্ । এরূপ মনে করিবে না যে, ইহার বদলে রোযা ক্বাযা করিয়া লইবে। কেননা, হাদীসে আছে—রমযানের এক রোযার বদলে যদি পূর্ণ বৎসর একাধারে রোযা রাখে, তবু এতটুকু সওয়াববপাইবে না, যতটুকু রমযানের একটি রোযার সওয়াব পাওয়া যায়।

১১। মাসআলাঃ দুর্ভাগ্যবশতঃ যদি কেহ রোযা না রাখে, তবে অন্যান্য লোকের সম্মুখে পানাহার করিবে না। ইহাও প্রকাশ করিবে না যে, আমি রোযা রাখি নাই। কেননা, গোনাহ্ করিয়া উহা প্রকাশ করাও গোনাহ্। যদি প্রকাশ্যে বলিয়া বেড়ায়, তবে দ্বিগুণ গোনাহ্ হইবে। একটি রোযা না রাখার এবং অপরটি গোনাহ্ প্রকাশ করার। বলিয়া থাকে—যখন খোদার কাছে গোপন নাই, তবে মানুষের কাছে গোপন করিয়া কি লাভ? ইহা ভুল। বরং কোন কারণে রোযা রাখিতে না পারিলে লোকের সামনে খাওয়া উচিত নহে।

১২। মাসআলাঃ ছেলেমেয়েরা যখন ৮/৯ বৎসর বয়সের হইয়া রোযা রাখার মত শক্তিসম্পন্ন হয়, তখনই তাহাদিগকে রোযা রাখার অভ্যাস করানো উচিত। যদি নাও রাখিতে পারে, তবুও কিছু অভ্যাস করান উচিত। ছেলেমেয়ে যখন দশ বৎসরের হইয়া যায়, তখন শাস্তি দিয়া হইলেও তাহাদের দ্বারা রোযা রাখান, নামায পড়ান উচিত।

১৩। মাসআলা : না-বালেগ ছেলেমেয়েরা যদি রোযা শুরু করিয়া শক্তিতে না কুলানের কারণে রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে চায়, তবে ভাঙ্গিতে দেওয়া ভাল নহে বটে; কিন্তু যদি ভাঙ্গিয়া ফেলে তবে রোযা আর দোরাইয়া রাখার দরকার নাই; কিন্তু যদি নামায শুরু করিয়া নিয়ত ছাড়িয়া দেয়,তবে নামায দোহরাইয়া পড়ানো উচিত।


সাহরী ও ইফতার এর মাসায়েল

১। মাসআলাঃ রোযা রাখিবার উদ্দেশ্যে শেষ রাতে যাহাকিছু খাওয়া হয়, তাহাকে সাহরী বলে। সাহরী খাওয়া সুন্নত। ক্ষুধা না থাকিলে অন্ততঃ ২/১টি খোরমা বা অন্য কোন জিনিস খাইবে। কিছু না হইলে একটু পানি পান করিবে। ইহাতেও সুন্নত আদায় হইবে।

২। মাসআলাঃ সাহরীর সময় যদি কেহ সাহরী না খাইয়া মাত্র (এক মুষ্টি চাউল পানি দিয়া খায় বা) একটি পান খায়, তাহাতেও সাহরী খাওয়ার সাওয়াব হাছেল হইয়া যাইবে।

৩। মাসআলাঃ সাহরী যথাসম্ভব দেরী করিয়া খাওয়া ভাল, এত দেরী করা উচিত নহে যাহাতে ছোবহে ছাদেক হইবার আশংকা হয় এবং রোযার মধ্যে সন্দেহ আসিতে পারে।

৪। মাসআলা : যদি সাহরী খুব জলদি খায় কিন্তু তাহার পর পান তামাক, চা, পানি ইত্যাদি অনেকক্ষণ পর্যন্ত খাইতে থাকে, ছোব্‌হে ছাদেক হওয়ার অল্প পূর্বে কুলি করিয়া ফেলে, তবুও দেরী করিয়া খাওয়ার সওয়াব পাইবে। ইহার হুকুমও দেরী করিয়া খাওয়ার হুকুম। সাহরী খাওয়ার আসল সময় সূর্যাস্ত হইতে ছোবহে ছাদেক পর্যন্ত যে কয় ঘণ্টা হয় তাহার ছয় ভাগের শেষ ষষ্ঠ ভাগ। যদি কেহ ইহার পূর্বে ভাত ইত্যাদি খায়, কিন্তু চা, পান ইত্যাদি এই শেষ ষষ্ঠাংশে করে, তবে তাহাতেও মুস্তাহাবের সওয়াব হাছেল হইবে।)

৫। মাসআলা: যদি রাত্রে ঘুম না ভাঙ্গে এবং সেই জন্য সাহরী খাইতে না পারে, তবে সাহরী না খাইয়া রোযা রাখিবে। সাহরী না খাওয়ার কারণে রোযা ছাড়িয়া দেওয়া বড়ই কাপুরুষতার লক্ষণ এবং বড়ই গোনাহের কাজ।

৬। মাসআলাঃ যে পর্যন্ত ছোব্‌হে ছাদেক না হয় অর্থাৎ, পূর্বদিকে সাদা বর্ণ না দেখা যায়, সে পর্যন্ত সাহরী খাওয়া বৈধ আছে। ছোব্‌হে ছাদেক হইয়া গেলে তারপর আর কিছুই খাওয়া-দাওয়া বৈধ নহে।

৭। মাসআলাঃ যদি কেহ দেরীতে ঘুম হইতে উঠিয়া ‘এখনও রাত আছে, ছোব্‌হে ছাদেক হয় নাই,’ এই মনে করিয়া সেহরী খায়, পরে জানিতে পারে যে, ঐ সময় রাত ছিল না, তবে ঐ রোযা ছহীহ্ হইবে না, ঐ রোযার পরিবর্তে আর একটি রোযা ক্বাযা করিতে হইবে; কাফ্ফারা দিতে হইবে না। কিন্তু ঐ দিনেও কিছু পানাহার করিতে পারিবে না। এইরূপ যদি সূর্য ডুবিয়া গিয়াছে, এই মনে করিয়া ইফতার করিয়া ফেলে এবং পরে জানেত পারে যে, সূর্য ডুবে নাই, তবে ঐ রোযা ছহীহ্ হইবে না। ঐ রোযার ক্বাযা করিতে হইবে; কাফ্ফারা দিতে হইবে না। অবশ্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবশিষ্ট সময়টুকুতে কিছুই পানাহার করিতে পারিবে না।

৮। মাসআলাঃ দেরী করিয়া উঠিয়া যদি সন্দেহ হয় যে, হয়ত ছোব্‌হে ছাদেক হইয়া গিয়াছে, তবে ঐ সময় কিছু খাওয়া-দাওয়া মাকরূহ্। ঐরূপ সন্দেহের সময় কিছু খাইলে গোনাগার হইবে এবং রোযার ক্বাযা করিতে হইবে। কিন্তু যদি একীনিভাবে জানিতে পারে যে, ছোব্‌হে ছাদেক হয় নাই, তবে রোযার ক্বাযা করিতে হইবে না। আর যদি কিছু ঠিক করিতে না পারে সন্দেহই থাকিয়া যায়, তবে ক্বাযা ওয়াজিব নহে, কিন্তু ক্বাযা রাখা ভাল।

৯। মাসআলা: যখন নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, সূর্য অস্ত গিয়াছে তখন আর দেরী না করিয়া শীঘ্রই ইফতার করা মুস্তাহাব। দেরী করিয়া ইফতার করা মকরূহ্।

১০। মাসআলাঃ আবরের (মেঘের) দিনে কিছু দেরী করিয়া ইফতার করা ভাল। শুধু ঘড়ি-ঘণ্টার উপর নির্ভর করা ভাল নয়। কারণ, ঘড়ি-ঘণ্টাও প্রায় সময় ভুল হয়। অতএব, আবরের দিনে যতক্ষণ ঈমানদার ব্যক্তির দিলে সূর্য অস্ত গিয়াছে বলিয়া সাক্ষ্য না দেয়, ততক্ষণ ইফতার করিবে না। কাহারও আযানের উপরও পূর্ণ নির্ভর করা উচিত নহে। কারণ, মোয়াযেনেরও ভুল হইতে পারে। কাজেই ঈমানদারের দিলে গাওয়াহী না দেওয়া পর্যন্ত ছবর করাই ভাল। ওয়াক্ত হইল কি না সন্দেহ হইলে ইফতার করা বৈধ নয়।

১১। মাসআলাঃ খোরমার দ্বারা ইফতার করা সবচেয়ে উত্তম। খোরমার অভাবে অন্য কোন মিষ্টি জিনিস দ্বারা এবং তদভাবে পানি দ্বারা ইফতার করা ভাল। কেহ কেহ লবণ দিয়া ইফতার করাকে সওয়াব মনে করে। এই আকীদা ভুল।

১২। মাসআলাঃ যে পর্যন্ত সূর্যাস্ত সম্বন্ধে কিছু মাত্র সন্দেহ থাকে, সে পর্যন্ত ইফতার করা জায়েয নহে।

 

সাহরী সংক্রান্ত মাসআলা

সাহরী খাওয়ার সুন্নাত সময়
১. মাসআলা : রোযাদারের জন্য রাতের শেষাংশে সুবহে সাদিকের আগে আগেই সাহরী খওয়া সুন্নাত এবং সওয়াব ও রবকতের কারণ। অর্ধ রাতের পরে যে সময়ই সাহরী খাবে সাহরীর সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু রাত্রের শেষাংশে সাহরী খাওয়া উত্তম। যদি মুয়াযিন সময় হওয়ার পূর্বেই ফজরের আযান দিয়ে দেন, তাহলে সাহরী খাওয়া নিষেধ নয়। যতক্ষণ সুবহে সাদিক না হয়, ততক্ষণ খেতে পারবে। সাহরী খাওয়ার পর রোযার নিয়ত অন্তরে করাই যথেষ্ট, মুখেও যদি নিম্নোক্ত শব্দগুলো বলে তাহলে ভালো। نويت بصوم غد من شهر رمضان. (যাওয়াহিরুল ফিকহ্ : ১/৩৮১)

সাহরী খাওয়ার সুন্নাত আদায়ে পান খাওয়া
২. মাসআলা : সাহরী খাওয়া সুন্নাত। যদি ক্ষুধা না লাগে এবং খানাও না খায়, কমপক্ষে দুই তিনটি খেজুর খেয়ে নিবে অথবা অন্য কোনো জিনিস সামান্য পরিমাণ অথবা বেশি পরিমাণ খেয়ে নিবে। যদি কেউ সাহরীর খানা না খায়, তাহলে উঠে একটি বা অর্ধেকটি পান খেয়ে নেবে, তাহলেও সাহরীর সওয়াব পেয়ে যাবে। (বেহেশতি জেওর : ৩/১৪)

তাড়াতাড়ি সাহরী এবং শেষ সময়ে পান খাওয়া
৩. মাসআলা : যথাসম্ভব সাহরী দেরী করে খাবে। কিন্তু এতটা নয় যে, রোযা হওয়ার ব্যাপারেই আশঙ্কা হয়। (বেহেশতি জেওর : ৩/১৪) ৪. মাসআলা : যদি কেউ সাহরী তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয় তারপর পান, তামাক ও চা ইত্যাদি দেরী করে পানাহার করে আর সুবহে সাদিক হওয়ার সামান্য সময় বাকি থাকতেই কুলি করে নেয়, তাহলে বিলম্ব করে সাহরী খাওয়ার সওয়াব পেয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে পান দেরী করে খাওয়া ও সাহরী দেরী করে খাওয়ার বিধান একই ( বেহেশতি জেওর : ৩/১৪)

আযান দেরী করে দেওয়া হলে
৫. মাসআলা : সুবহে সাদিকের পরে পানাহার করা যাবে না। চাই আযান হোক অথবা না হোক। এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকা আবশ্যক। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম : ৬/১১০)

আযানের সময় মুখের লোকমা গিলে ফেলা
৬. মাসআলা : আযান হতেই সাহরী খাওয়া বন্ধ করে দিল, কিন্তু মুখে যে দু’এক লোকমা ছিল তা গিলে ফেলল। যদি প্রবল ধারণা হয়, সুবহে সাদিক হওয়ার পরেই আযান আরম্ভ হয়েছে, তাহলে রোযা হবে না। আর যদি সন্দেহ হয়, তাহলে ঐ সময় পানাহার করা মাকরূহ। কিন্তু রোযা হয়ে যাবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : 4/432)

ভুলে সাহরী সুবহে সাদিকের পরে খাওয়া
৭. মাসআলা : যদি কারো ঘুম দেরি করে ভাঙ্গে এবং মনে হয় এখনও রাত বাকি আছে। এ ধারনায় সাহরী খাওয়ার পরে জানতে পারল, প্রভাত হয়ে যাওয়ার পরে সাহরী খেয়েছে, তাহলে রোযা হবে না। শুধু কাযা রাখবে। কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে না। এরপর সারা দিন কিছুই পানাহার করবে না, রোযাদার ব্যক্তির মত থাকবে। এমনিভাবে সূর্য ডুবে গেছে মনে করে ইফতার করার পর সূর্য দেখা গেল, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। এক্ষেত্রে কাযা করবে। কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত সূর্য না ডুবে, পানাহার করা ঠিক নয়। (বেহেশতি জেওর : ৩/১৪)

সাহরী খাওয়া ব্যতীত রোযা রাখা
৮. মাসআলা : যদি রাতে সাহরী খাওয়ার জন্য ঘুম না ভাঙ্গে তাহলে সাহরী খাওয়া ব্যতীতই রোযা রাখবে। সাহরী ছুটে যাওয়ার কারণে রোযা ছেড়ে দেওয়া কাপুরুষতার লক্ষণ এবং বড় গুনাহ। (বেহেশতি জেওর : ৩/১৪)

সাহরী খাওয়ার পর কুলি করা
৯. মাসআলা : যদি সাহরী খেয়ে কুলি না করে এমনিভাবে শুয়ে পড়ে, আর দাঁতের মধ্যে আটকে থাকা বস্তু চনা বুটের পরিমাণ হয় অথবা এর চেয়ে বেশি হয় এবং তা গলার মধ্যে চলে যায়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। শুধু কাযা ওয়াজিব হবে; কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে না । আর যদি চনা বুটের পরিমাণ থেকে কম হয়, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না। এ কারণে রোযা ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়ে কুলি করে শোয়া উচিত। (আহসানুল ফাতাওয়া : 8/883)

রমযানে ফজরের জামাতে তাড়াতাড়ি করা
১০.মাসআলা : রমযানে সাহরীর পরে প্রথম ওয়াক্তে ফজরের নামাযের জন্য নামাযীরা একত্রিত হলে এবং প্রতিদিনের সময় মত (রমযানের সময় ছাড়া অন্যান্য সময়ের ফজরের নামাযের মত) জামাত করতে গেলে অধিকাংশ লোকের জামাত ছুটে যাওয়ার, এমনকি নামাযই কাযা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হলে প্রথম সময়েই জামাত আদায় করে নেওয়া উত্তম। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১/১৬২)

 


রোযার কাফফারার বিধান

১। মাসআলাঃ রমযান শরীফের রোযা ভাঙ্গিয়া ফেলিলে একাধারে দুই মাস অর্থাৎ, ৬০টি রোযা রাখিতে হইবে। কিছু কিছু করিয়া রাখা বৈধ নয়। একলাগা ৬০টি রোযা রাখিতে হইবে। যদি মাঝখানে ঘটনাক্রমে দুই একদিনও বাদ পড়ে, তবে তাহার পর হইতে আবার ৬০টি গণনা করিয়া পূর্ণ করিতে হইবে, পূর্বেরগুলি হিসাবে ধরা যাইবে না। এমন কি, যদি এই ৬০দিনের মধ্যে ঈদের বা কোরবানীর দিনও আসে, তবুও কাফ্ফারা আদায় হইবে না, পূর্বগুলি বাদ দিয়া উহার পর হইতে ৬০টি পূর্ণ করিতে হইবে। অবশ্য এই ৬০ দিনের মধ্যে যদি মেয়েলোকের হায়েয আসে, তবে তাহা মাফ ; কিন্তু হায়েয হইতে পাক হইবার পর দিন হইতেই আবার রোযা রাখিতে হইবে এবং ৬০টি রোযা পূর্ণ করিতে হইবে।

২। মাসআলাঃ নেফাসের কারণে যদি মাঝে রোযা ভাঙ্গা পড়ে, তবে কাফ্ফারা আদায় হইবে না। নেফাস হইতে পাক হওয়ার পর ৬০টি পূর্ণ করিবে। নেফাসের পূর্বে যদি কিছু রোযা রাখিয়া থাকে, তাহা গণনায় ধরা যাইবে না ।

৩। মাসআলাঃ রোগের কারণে যদি মাঝখানে ভাঙ্গা পড়ে, তবে রোগ আরোগ্য হওয়ার পর নূতনভাবে ৬০টি রোযা পূর্ণ করিতে হইবে।

৪। মাসআলাঃ যদি মাঝে রমযানের মাস আসে, তবুও কাফ্ফারা আদায় হইবে না ।

৫। মাসআলাঃ যদি কাহারও কাফ্ফারার রোযা রাখার শক্তি না থাকে, তবে রমযান শরীফের একটি রোযা ভাঙ্গিলে তাহার পরিবর্তে ৬০ জন মিসকীনকে দুই ওয়াক্ত খুব পেট ভরিয়া খাওয়াইতে হইবে।

৬। মাসআলাঃ যদি এই ৬০ জনের মধ্যে কয়েকজন এমন অল্প বয়স্ক থাকে যে, তাহারা পূর্ণ খোরাক খাইতে পারে না, তবে তাহাদিগকে হিসাবে ধরা যাইবে না। তাহাদের পরিবর্তে অন্য পূর্ণ খোরাক খানেওয়ালা মিসকীনকে আবার খাওয়াইতে হইবে।

৭। মাসআলাঃ যদি গমের রুটি হয়, তবে শুধু রুটি খাওয়ানো বৈধ আছে, আর যদি যব, বজরা, ভুট্টা ইত্যাদির রুটি বা ভাত হয়, তবে উহার সহিত কিছু ভাল তরকারী দেওয়া উচিত। যাহাতে রুটি, ভাত খাইতে পারে।

৮। মাসআলাঃ পাকানো খাদ্য না খাওয়াইয়া যদি ৬০ জন মিসকীনকে গম বা তার আটা দেয়, তাহাও জায়েয আছে। কিন্তু প্রত্যেক মিসকীনকে ছায়ে ফেতরা পরিমাণ দিতে হইবে। ছদকায়ে ফেতরের বর্ণনা যাকাত অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য।ল

৯। মাসআলাঃ যদি এইপরিমাণ গমের দাম দেয় তাহাও জায়েয আছে।

১০। মাসআলাঃ কিন্তু যদি সে তাহার কাফ্ফারা আদায় করিবার জন্য কাহাকেও অনুমতি দেয় বা আদেশ করে এবং তারপর সেই ব্যক্তি আদায় করিয়া দেয়, তবে তাহার কাফ্ফারা আদায় হইয়া যাইবে। যাহার উপর কাফ্ফারা ওয়াজিব হইয়াছে তাহার অনুমতি ছাড়া যদি অন্য কেহ তাহার কাফ্ফারা আদায় করিয়া দেয়, তবে তাহাতে তাহার কাফ্ফারা আদায় হইবে না ।

১১। মাসআলাঃ যদি একজন মিসকীনকে ৬০ দিন সকাল বিকাল পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া
দেয় বা একই জনকে ৬০ দিন ৬০ বার (ছদ্‌কায়ে ফেতর পরিমাণ) গম বা তাহার মূল্য দেয় তাহাতে কাফ্ফারা আদায় হইয়া যাইবে ।

১২। মাসআলাঃ যদি ৬০ দিন পর্যন্ত খাওয়াইবার বা মূল্য দিবার সময় মাঝখানে ২/১ দিন বাকী পড়ে, তবে তাহাতে কোন ক্ষতি নাই। (একাধারে ৬০ দিন না হইলেও সর্বশুদ্ধ ৬০ দিন খাওয়ানো হইলে বা মূল্য দেওয়া হইলে তাহাতেই চলিবে)

১৩। মাসআলাঃ ৬০ দিনের আটা বা গম অথবা তাহার মূল্য হিসাব করিয়া একই দিন একজন মিসকীনকে দেওয়া বৈধ নয়। (দিলে মাত্র এক দিনের কাফ্ফারা আদায় হইবে, বাকী ৫৯ দিনের পুনরায় আদায় করিতে হইবে।) এইরূপে যদি এক দিন একজন মিসকীনকে ৬০ বার দেয়, তাবুও মাত্র একদিনেরই কাফ্ফারা আদায় হইবে, বাকী ৫৯ দিনের পুনরায় আদায় করিতে হইবে। সারকথা এই যে, একদিন একজন গরীবকে একটি রোযার বিনিময় হইতে অধিক দিলে তাহার হিসাব ধরা যাবে না, মাত্র এক দিনেরই ধরা যাইবে ।

১৪।মাসআলাঃ কোন মিসকীনকে সদকায়ে ফেতর পরিমাণের কম দিলে কাফ্ফারা আদায় হইবে না।

১৫। মাসআলাঃ যদি একই রমযানের ২ বা ৩টি রোযা ভাঙ্গিয়া থাকে, তবে একটি কাফ্ফারাই ওয়াজিব হইবে। (কিন্তু যে কয়টি রোযা ভাঙ্গিয়াছে সেই কয়টির ক্বাযা করিতে হইবে। যদি দুই রমাযানের দুইটি রোযা ভাঙ্গিয়া থাকে, তবে একটি কাফ্ফারা যথেষ্ট হইবে না, দুইটি কাফ্ফারা আদায় করিতে হইবে।)

 

কাযা রোযার বিধান

১। মাসআলা : কোন কারণবশতঃ যদি রমযানের সব রোযা বা কতেক রোযা রাখিতে না পারে, রমযানের পর যত শীঘ্র সম্ভব হয় ঐ সব রোযার ক্বাযা রাখিতে হইবে, দেরী করিবে না (হায়াত মউতের বিশ্বাস নাই,) বিনা কারণে ক্বাযা রোযা রাখিতে দেরী করিলে গোনাহগার হইবে।

২। মাসআলাঃ ক্বাযা রোযা রাখিবার সময় দিন তারিখ নির্দিষ্ট করিবে যে, ‘অমুক দিনের অমুক তারিখের রোযার ক্বাযা করিতেছি। অবশ্য এরূপ নিয়্যত করা জরুরী নহে। শুধু যে কয়টি রোযা ক্বাযা হইয়াছে, সে কয়টি রাখিলেই যথেষ্ট হইবে। অবশ্য যদি ঘটনাক্রমে দুই রমযানের ক্বাযা রোযা একত্র হইয়া যায়, তবে এই ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করিয়া নিয়্যত করিতে হইবে যে, “আজ অমুক বৎসরের রমযানের রোযা আদায় করিতেছি।”

৩। মাসআলাঃ ক্বাযা রোযার জন্য রাত্রেই নিয়্যত করা জরূরী (শর্ত)। ছোবহে ছাদেকের পরে ক্বাযা রোযার নিয়্যত করিলে ক্বাযা ছহীহ্ হইবে না, রোযা রাখিলে সে রোযা নফল হইবে। ক্বাযা রোযা পুনরায় রাখিতে হইবে।

৪। মাসআলাঃ কাফ্ফারার রোযারও একই হুকুম; যদি ছোব্‌হে ছাদেকের পূর্বে রাত্রেই কাফ্ফারার বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়া নিয়্যত না করে, তবে কাফ্ফারার রোযা ছহীহ্ হইবে না ; (সেই রোযা নফল হইয়া যাইবে, কাফ্ফারার রোযা পুনরায় রাখিতে হইবে।)

৫। মাসআলাঃ যে কয়টি রোযা ছুটিয়া গিয়াছে, তাহা সব একাধারে বা বিভিন্ন সময়ে রাখাও দুরুস্ত আছে। (একাধারে রাখা মোস্তাহাব।)

৬। মাসআলা : গত রমযানের কিছু রোযা ক্বাযা ছিল, তাহা ক্বাযা না করিতেই পুনরায় রমযান আসিয়া গেল, এখন রমযানের রোযাই রাখিতে হইবে, ক্বাযা রোযা পরে রাখিবে। এরূপ দেরী করা ভাল নহে ।

৭। মাসআলাঃ রমযান শরীফের সময় দিনের বেলায় যদি কেহ বেহুঁশ হইয়া পড়ে এবং কয়েকদিন যাবৎ বেহুঁশই থাকে, তবে যদি কোন ঔষধ ইত্যাদি হলকুমের নীচে না যাইয়া থাকে, তবে বেহুঁশীর প্রথম দিনের রোযার নিয়ত পাওয়া গিয়াছে, কাজেই প্রথম দিনের রোযা ছহীহ্ হইয়া যাইবে, পরে যে কয়দিন বেহুঁশ রহিয়াছে, সে কয়দিনের নিয়্যত পাওয়া যায় নাই বলিয়া কিছু পানাহার না হওয়া সত্ত্বেও সে কয়দিনের রোযা আদায় হইবে না, সে কয়দিনের রোযার ক্বাযা করিতে হইবে।

৮। মাসআলাঃ এইরূপে যদি রাত্রে বেহুঁশ হয়, তবুও প্রথম দিনের রোযার ক্বাযা করা লাগবে না। বেহুঁশীর অন্যান্য দিনের কাযা ওয়াজিব হইবে। অবশ্য যদি পরদিন রোযা রাখার নিয়্যত না করিয়া থাকে, অথবা কোন ঔষধাদি সকাল বেলায় হলকুমের নীচে যাইয়া থাকে, তবে ঐ দিনেরও ক্বাযা রাখিতে হইবে।

৯। মাসআলাঃ যদি কেহ সমস্ত রমযান মাস ব্যাপিয়া বেহুঁশ অবস্থায় থাকে, তবে সুস্থ হওয়ার পর সমস্ত রমযান মাসের রোযা ক্বাযা করিতে হইবে। ইহা মনে করিবে না যে, বেহুঁশ থাকার কারণে রোযা একেবারে মা’ফ হইয়া গিয়াছে। অবশ্য যদি কেহ সমস্ত রমযান মাস ব্যাপিয়া পাগল থাকে, মাত্রই ভাল না হয়, তবে তাহার রমযানের রোযার ক্বাযা করা লাগিবে না; কিন্তু যদি রমযানের মধ্যে ভাল হয়, তবে যে দিন হইতে ভাল হইয়াছে সে দিন হইতে রীতিমত রোযা রাখিবে ।

 

তথ্যসূত্রঃ
কিতাবঃ বেহেস্তী জেওর, 
লেখকঃ মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহঃ

 

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *