ইসলাম

সাহাবীদের সম্বন্ধে আকীদা

সাহাবী বলা হয় : যে ব্যক্তি মুসলমান অবস্থায় নবী (সাঃ)-এর সাক্ষাত পেয়েছে এবং মুসলমান অবস্থায় তার মৃত্যু হয়েছে।

সমস্ত নবী রাসূলের পর উম্মতের মধ্যে খাতামুল আম্বিয়া মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সাহাবীগণের মর্যাদা অধিক।

সকল সাহাবী আদিল অর্থাৎ, নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী, মুত্তাকী, পরহেযগার,ন্যায়পরায়ণ এবং ইসলাম ও উম্মতের স্বার্থকে উর্ধ্বে স্থান দানকারী। প্রত্যেক সাহাবীর মধ্যে হেদায়েতের নূর এবং আলো রয়েছে- কারও মধ্যে অন্ধকার নেই।

সাহাবীদের প্রতি মহব্বত ও ভক্তি শ্রদ্ধা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের অন্যতম শি‘আর বা প্রতীক। সাহাবায়ে কেরামকে ভালবাসা নবী (সাঃ) কেই ভালবাসা।

রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেছেন : তোমরা আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, তোমরা আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর! আমার পরে তোমরা তাঁদেরকে সমালোচনার পাত্র বানিও না। বস্তুতঃ যে তাঁদেরকে ভালবাসল, সে আমার প্রতি ভালবাসার কারণেই তাঁদেরকে ভালবাসল, আর যে তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ রাখল, সে আমার প্রতি বিদ্বেষ রাখার কারণেই তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ রাখল। (তিরমিযী, হাদীস: ৩৪৬২)

শায়েখ শিবলী বলেন : যে রাসূল (সাঃ)-এর সাহাবীগণকে তা’জীম ও সম্মান করল না, সে প্রকৃতপক্ষে রাসুলের প্রতি ঈমান আনেনি।

যেসব ক্ষেত্রে সাহাবীদের মধ্যে দ্বিমত বা বাহ্যিক বিরোধ দেখা দিয়েছে, সে সব ক্ষেত্রেও প্রত্যেক সাহাবী হক ছিলেন। তাঁদের পারষ্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং সংঘর্ষের ক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে কোন পক্ষের এজতেহাদী ভুল চুক থাকতে পারে, তবে তাঁরা সেটা ব্যক্তিগত হিংসা-বিদ্বেষ বা ব্যক্তি স্বার্থে করেননি বরং দ্বীনের খাতিরে এবং এখলাছের সাথেই করেছেন-এই আকীদা বিশ্বাস রাখতে হবে। এরূপ ক্ষেত্রেও যে কোন একজন বা এক পক্ষের অনুসরণ করলে হেদায়েত, মুক্তি ও নাজাত পাওয়া যাবে। কিন্তু একজনের অনুসরণ করে অন্যজনের দোষ চর্চা করা যাবে না। দোষ চর্চা করা হারাম হবে।

সাহাবীদের মর্যাদা সমস্ত ওলী আউলিয়াদের উর্ধ্বে। উম্মতের সবচেয়ে বড় ওলী (যিনি সাহাবী নন) তার মর্যাদাও একনে নিম্ন স্তরের সাহাবীর সমান হতে পারে না বরং সাহাবী আর সাহসী নন-এমন দুই স্তরের মধ্যে মর্যাদার তুলনাই অবান্তর।

সমস্ত সাহাবাদের মধ্যে চারজন সর্বোত্তম এবং তাদের মর্যাদা উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশী। তম্মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এবং তিনি প্রথম খলীফা। তারপর (২) হযরত ওমর (রাঃ) এবং তিনি দ্বিতীয় খলীফা। তারপর হযরত উসমান গনী (লং) এবং তিনি তৃতীয় খলীফা। তারপর (৪) হযরত ভালী (রাহ), তিনি চতুর্থ খলীফা।

খলীফা হওয়ার ক্ষেত্রে উপরোক্ত তারতীব হক ও যথার্থ।

সকল সাহাবীর প্রতি আল্লাহ তা’আলা চির সন্তুষ্টির খোশ-খবরী দান করেছেন। বিশেষভাবে একসাথে নবী (সাঃ)-এর দ্বারা দশজন সাহাবীর নাম উল্লেখ পূর্বক তাঁদের জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। উক্ত দশজনকে আশারায়ে মুবাশশারাহ্ (সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন) বলা হয়। তাঁরা হলেন (১) আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) (২) ওমর (রাঃ) (৩) উসমান (রাঃ) (৪) আলী (রাঃ) (৫) তালহা (রাঃ) (৬) যোবায়ের (রাঃ) (৭) আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রাঃ) (৮) সা’আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) (৯) সাঈদ ইবনে যায়েদ (রাঃ) এবং (১০) আবূ উবায়দা ইবনে জাররাহ (রাঃ)। এই দশ জনের মর্যাদা উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বেশী। এর মধ্যে চার খলীফা ব্যতীত অপর ছয় জনের মর্যাদা চার খলীফার পর।

এছাড়াও রাসূল (সাঃ) আরও কতিপয় সাহাবী সম্পর্কে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করেছেন।

আশারায়ে মুবাশশারার পর বদরী সাহাবীদের মর্যাদা অধিক। যাদের সম্পর্কে হাদীছে বলা হয়েছে ঃ সম্ভবতঃ আল্লাহ তা’আলা বদরী সাহাবীদের ব্যাপারে অবগত আছেন, তাই তাঁদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ তোমরা যা ইচ্ছা করতে পার, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

বদরী সাহাবীদের পর ওহুদ যুদ্ধে শরীক হওয়া সাহাবীদের মর্যাদা। তারপর বাই‘আতুর রিদওয়ানে শরীক হওয়া সাহাবীগণের মর্যাদা, যাদের সম্পর্কে কুরআন শরীফে বলা হয়েছে : মু’মিনরা যখন বৃক্ষ তলে তোমার নিকট বাইআত গ্রহণ করল, তখন আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন। তাঁদের অন্তরস্থিত অবস্থা সম্বন্ধে তিনি অবগত ছিলেন। (সূরাঃ ৪৮-ফাত্হঃ ১৮)

মর্যাদার ক্ষেত্রে উল্লেখিত সাহাবীগণের মধ্যকার উপরোক্ত তারতীব বা বিন্যাস উম্মতের সর্বসম্মত বিষয়।’ অতপর সকল সাহাবীর মর্যাদা তাঁদের ইলম ও তাওয়ার তারতম্য অনুসারে । যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন : অবশ্যই তোমাদের মধ্যে যে অধিক তাকওয়ার অধিকারী, সে আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানী । (সূরাঃ ৪৯-হুজুরাতঃ ১৩)

প্রত্যেক সাহাবী সত্যের মাপকাঠি। ঈমান ও আমল সবক্ষেত্রে তাঁরা মাপকাঠি । সাহাবায়ে কেরামের ঈমান ঈমানের কষ্টিপাথর, যার নিরিখে অবশিষ্ট সকলের ঈমান পরীক্ষা করা হবে। আমল এবং দ্বীনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁরা মাপকাঠি। সাহাবায়ে কেরাম হকের মাপকাঠি, তাঁদের নিরিখে নির্ণিত হবে পরবর্তীদের হক বা বাতিল হওয়া।

ঈমানের ক্ষেত্রে তাঁদের মাপকাঠি হওয়ার দলীল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত ঃ অর্থাৎ, তোমরা ঈমান আনয়ন কর এই লোকেরা (সাহাবীরা) যেমন ঈমান এনেছে। (সূরা : ২-বাকারা : ১৩) অন্য আর এক আয়াতে বলা হয়েছে : তাঁরা (সাহাবীগণ) যেমন ঈমান এনেছে, তারা যদি তদ্রূপ ঈমান আনে, তাহলে নিশ্চিত তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হল। (সূরা : ২-বাকারা : ১৩৭)

আমলের ক্ষেত্রে তাঁদের মাপকাঠি হওয়ার দলীল কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত : অর্থাৎ, কারও নিকট সৎপথ প্রকাশ পাওয়ার পর সে যদি এই রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং এই মু’মিনদের (সাহাবীদের) পথ (মাসলাক/আমল) ব্যতীত অন্য পথ (মাসলাক/ আমল) অনুসরণ করে, তাহলে যেদিকে সে ফিরে যায়, সেদিকে তাকে ফিরিয়ে দিব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব। (সূরা : ৪- নিসা : ১১৫ )

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা হল- সকল সাহাবী সমালোচনার উর্ধ্বে। তাঁদেরকে দোষ-ত্রুটির উর্ধ্বে মনে করা বিধেয়। তাঁদের ভাল আলোচনা করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নীতি।

শরহে ফিকহিল আকবার গ্রন্থে আছে , আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা হল-সকল সাহাবীর পবিত্রতা বর্ণনা করা এবং তাঁদের প্রশংসা করা, যেমন আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসূল তাঁদের প্রশংসা করেছেন।

সাহাবীদের প্রতি মহব্বত রাখা ওয়াজিব। তাঁদের সমালোচনা করা, দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করা গোমরাহী এবং সম্পূর্ণ অমার্জনীয় অপরাধ। সাহাবীদের সমালোচনাকারীগণ ফাসেক ফাজের ও গোমরাহ্।

তথ্য সূত্রঃ

কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ

লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *