তাকলীদে শাখসীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
তাকলীদে শাখসী বা ব্যক্তি বিশেষের অনুসরণ বলতে বুঝানো হয়- কোন বিশেষ মুজতাহিদের সাথে সম্পর্ক যুক্ত মাযহাবের চূড়ান্ত পর্যায়ের আইনসমূহের উপর দলীল-প্রমাণ তলব করা ব্যতীত আমল করে যাওয়া। চাই উক্ত বিধানাবলি সরাসরি মাযহাব প্রতিষ্ঠাতার গবেষণালব্ধ হোক অথবা তার রচিত মূলনীতির আলোকে তার শিষ্যরা গবেষণা করে বের করুক। কিন্তু এই মাযহাবেরই হওয়া চাই। আর তাকলীদে গায়রে শাখসী বলতে বুঝানো হয়, দলীল-প্রমাণ তলব ব্যতীত একাধিক মুজতাহিদের চূড়ান্ত পর্যায়ের বিধি-বিধান অনুযায়ী আমল করতে থাকা। যেমন, এক মাসআলা এই মাযহাবের, অন্য মাসআলা অন্য মাযহাবের। মোটকথা শুধু বিশেষ কোন মাযহাব অনুসরণ না করা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর যুগ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় শতাব্দির শেষপ্রান্ত পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের অনুসরণ প্রচলন ছিল না। কারণ, তখন পর্যন্ত মুজতাহিদের গবেষণালব্ধ ধর্মীয় বিধি-বিধানের মূলনীতি সমূহ সুশৃংখল ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিসমাপ্তিতে পৌছেনি। সুতরাং কোন বিশেষ মুজতাহিদের বের কৃত বিধি-বিধানের উপর আমল করা কঠিন ছিল। তাছাড়া উক্ত যুগটি ছিল সোনালী যুগ। তাই একাধিক মুজতাহিদের অনুসরণে কোনরূপ কুপ্রবৃত্তির তাড়নার সম্ভাবনাও ছিল না।
হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন, কেননা, লোকজন সাহাবাদের যুগ থেকে শুরু করে মাযহাব চতুষ্টয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আলিম সাহাবাদের অনুসরণ করে আসছিল নিজে নিজ সুবিধানুযায়ী। (অর্থাৎ, তারা আশেপাশে যেখানে যাকে পেয়েছেন সেই আলিম সাহাবীর কথা অনুযায়ী আমল করেছেন।) এতে দ্বিমত করার মত কাউকে পাওয়া যায়নি; বা উক্ত তাকলীদকে কেউ মন্দও ভাবেনি অথবা সমালোচনাও করেনি। যদি উক্তরূপ তাকলীদ মন্দ হত, তবে অবশ্যই অন্যান্য সাহাবীগণ তা প্রতিহত বা প্রতিরোধ করতেন।
হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে তখনকার উলামায়ে রব্বানীগণ শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও বিধানাবলীকে মূলনীতি আকারে ও শাখা-প্রশাখা আকারে রূপান্তরিত করতে শুরু করলেন এবং তাদের যোগ্যতম শিষ্যগণ তা সুশৃংখলিত এবং সুনিয়ন্ত্রিত করলেন। এরপর তৃতীয় শতাব্দীর অসংখ্য মুসলমান তা তাকলীদে শাখসী আকারে পালন করতে থাকে বা গ্রহণ করে নেয়।
উক্ত মূলনীতি মূলক বিধানাবলী এবং শাখা-প্রশাখামূলক বিধানাবলী সম্পূর্ণ কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী প্রনয়ণ করা হয়েছে। তা ছাড়া এগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই বাছাইকারীগণও প্রজ্ঞা ও নির্ভরযোগ্যতায় সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিলেন। উক্ত মুজতাহিদদের গবেষণালব্ধ বিধি-বিধান যেহেতু অত্যন্ত সুন্দর ও সহজলভ্য ছিল, তাই তা দ্রুত পরস্পরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.) বলেন, তদানীন্তন সময়ে বর্তমানকার এই তাকলীদই ওয়াজিব ছিল। দ্বিতীয় শতাব্দির পরে মুসলমানদের মধ্যে নির্দিষ্ট মুজতাহিদদের মাযহাব অনুযায়ী তাকলীদের প্রচলন শুরু হয়। খুব নগণ্য সংখ্যক লোকই এমন পাওয়া যেত যে, তারা নির্দিষ্ট কোন গবেষকের প্রতি আস্থাবান ছিলেন না।আর বর্তমানকার তাকলীদও ঐ সেই যুগের ওয়াজিব তাকলীদের অন্তর্ভুক্ত।
চতুর্থ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত মাযহাব চতুষ্টয় ব্যতীত অপরাপর মুজতাহিদদেরও তাকলীদ করা হত। কিন্তু উক্ত মাযহাব ছাড়া অন্যান্য মুজতাহিদদের মাযহাব তেমন সংরক্ষিত হয়নি; যাতে করে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। যদ্দরুণ চতুর্থ শতাব্দীর পরে আর কোন মাযহাব অবশিষ্ট থাকেনি। আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে উক্ত চার মাযহাবেই তাকলীদ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে ।
হযরত শাহ সাহেব (রহ.) বলেন,”আর যখন সব মাযহাব নিঃশেষ হয়ে শুধু চার মাযহাবই অবশিষ্ট থাকল তখন এ চার মাযহাবের অনুসরণ মানে বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত থাকা এবং এতে রয়েছে বিরাট কল্যাণ। আর উক্ত চার মাযহাবের (কোন একটির) অনুসরণ বিমুখ হওয়া মানে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহ থেকে বের হয়ে যাওয়া । আর এতে রয়েছে বিরাট ক্ষতি।
আল্লামা ইবনে খালদূন (রহ.) তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ “মুকাদ্দিমা”য় বলেন,“উক্ত চার ইমামের তাকলীদ গোটা বিশ্বে চালু হয়ে গেছে। অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বগণ তথা আলিমগণ অন্যান্যদের শিক্ষা দিতে শুরু করলেন এবং সর্ব সাধারণের মধ্যে মতবিরোধ ও মতানৈক্যর দ্বার বন্ধ করে দিলেন। কারণ, দ্বীনি ইলমের পরিভাষাসমূহ অনেক শাখা-প্রশাখায় ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। আর ইজতিহাদের স্তরে পৌছার মত প্রতিভাও বিরল হয়ে যাচ্ছে। … অতঃপর আর তাদের মাযহাব ব্যতীত অন্য কোন মাযহাবের ধারাবাহিকতা অবশিষ্ট রইল না। প্রত্যেক মুকাল্লিদ ব্যক্তি নিজ নিজ মাযহাব সঠিক সূত্র পরম্পরা ও পরিশুদ্ধি বজায় রেখে আমল করে আসছেন। যা কিনা বর্তমানে আমাদের সামনে ফিক্হ নামে বিদ্যমান। তা ছাড়া এ যুগে যারা মুজতাহিদ হওয়ার দাবী করবে, তারা প্রত্যাখ্যাত। তাদের তাকলীদ বা অনুসরণ নিষিদ্ধ। কেননা, বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব উক্ত চার ইমামের তাকলীদেই সীমিত হয়ে গেছে।
বিখ্যাত উসূলবিদ ও গ্রন্থকার আল্লামা মোল্লা জীওয়ান (রহ.) এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত সুন্দর উক্তি করেছেন। প্রকৃত নিরপেক্ষ কথা হল, (উক্ত বিশেষ কোন মাযহাব মেনে নেওয়া প্রসঙ্গে) এটাই যে, মাযহাবগুলো চারের মধ্যে সীমিত হয়ে যাওয়া এবং তা মুসলমানদের অনুসরণ করে যাওয়া, আল্লাহ তা’আলার বিশেষ করুণা এবং অনুমোদন। এতে দলীল-প্রমাণ তালাশ করে বা বেশী মাথা ঘামিয়ে কোন ফায়দা নেই।
তথসূত্র:
তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ
মুফতি হিফজুর রহমান
প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।