তাকলীদ ও চার মাযহাব সম্বন্ধে আকীদা
তাকলীদ এর আভিধানিক অর্থ গলায় হার পরিধান করানো।
তাকলীদের পারিভাষিক সংজ্ঞা হল : পরিভাষায় তাকলীদ বলা হয় অন্যের কোন উক্তি বা কর্ম সঠিক-এরূপ সুধারণার ভিত্তিতে কোন দলীল প্রমাণ না দেখে তার অনুসরণ করা। যেন এই অনুসরণকারী ব্যক্তি অন্যের কথা বা কাজকে প্রমাণ তলব করা ছাড়া নিজের গলার হার বানিয়ে নিল।
তাকলীদের সারকথা হল কোন বুযুর্গ ও বিজ্ঞ আলেম ব্যক্তির হক্কানিয়্যাতের প্রতি আস্থা রেখে – যে, তিনি কুরআন ও হাদীছ মোতাবেক এ উক্তিটি করেছেন এবং সে মোতাবেক তিনি এ কাজটি করেছেন – তাঁর কথা ও কাজের অনুসরণ করা। আর এই অনুসরণকে সংশ্লিষ্ট কথা ও কাজের দলীল/প্রমাণ জানার উপর ঝুলন্ত না রাখা। কিন্তু তার দলীল/প্রমাণ যদি তখন জানা হয় অথবা পরবর্তীতে জানা যায়, তাহলে এটি তাকলীদের পরি পন্থী নয়। মোটকথা, তালীদে দলীল/প্রমাণ অন্বেষণ অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে দলীল/প্রমাণ জানা এর পরিপন্থী হয় না।
প্রত্যেক মুসলমানের উপর মূলতঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য ও অনুসরণ করা ফরয। কুরআন এবং হাদীছের অনুসরণের মাধ্যমেই এ ফরয আদায় হবে। কিন্তু সরাসরি যারা কুরআন হাদীছের ভাষা-আরবী বোঝেন না, কিংবা আরবী ভাষা বুঝলেও কুরআন হাদীছ যথাযথ ভাবে অনুধাবন ও তা থেকে মাসআলা-মাসায়েল চয়ন ও ইজতেহাদ করার জন্য আরবী ব্যাকরণ, আরবী অলংকার, আরবী সাহিত্য, উসূলে ফেকাহ, উসূলে হাদীছ, উসূলে তাফসীর ইত্যাদি যেসব আনুসাঙ্গিক শাস্ত্রগুলো বোঝা প্রয়োজন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে সেগুলো পাঠ করেননি বা পাঠ করলেও গভীরভাবে এসব বিদ্যায় পারদর্শী হতে পারেন নি, তাদের পক্ষে সরাসরি সব মাসআলা-মাসায়েল কুরআন হাদীছ থেকে চয়ন ও ইজতেহাদ (গবেষণা) করে বের করা যেমন সম্ভব নয় তেমনি তা নিরাপদও নয়। বরং গভীর বুৎপত্তি ও দক্ষতার অভাবে এরূপ লোকদের গবেষণা ও ইজতিহাদে অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ও গোমরাহীর শিকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই স্বভাবিক। তাই এসব শ্রেণীর লোকদের জন্য বিস্তারিত মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধানের নিমিত্তে এমন কোন বিজ্ঞআলেমের শরণাপন্ন হওয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই, যিনি উপরোক্ত বিদ্যাসমূহে পারদর্শী ও দক্ষ হওয়ার ফলে সরাসরি সব মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি-বিধান কুরআন হাদীছ থেকে চয়ন ও ইজতেহাদ করে বের করতে সক্ষম।
এরূপ বিজ্ঞ ও ইজতেহাদের ক্ষমতা সম্পন্ন আলেম তথা মুজতাহিদ ইমামের শরণাপন্ন হওয়া এবং তিনি কুরআন-হাদীছ থেকে চয়ন ও ইজতেহাদ করে সব মাসআলা-মাসায়েল ও বিধি- বিধান যেভাবে বলেন তার অনুসরণ করাকেই বলা হয় উক্ত ইমামের তাকলীদ করা বা উক্ত ইমামের মাযহাব অনুসরণ করা ৷ তাই উপরোক্ত শ্রেণী সমূহের লোকদের জন্য ওয়াজিব এবং যে ইমামেরই হোক এরূপ যেকোন এক জনেরই তাকলীদ করা ওয়াজিব। এক এক মাসআলায় এক এক জনের অনুসরণ করার অবকাশ নেই এবং সেরূপ করা জায়েযও নয়, কারণ তাতে সুবিধাবাদ ও খাহেশাতের অনুসরণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায় এবং তার ফলে গোমরাহী-র পথ উন্মুক্ত হয়।
ইতিহাসে অনুরূপ মুজতাহিদ ইমাম অনেকেই অতিবাহিত হয়েছেন। তবে তন্মধ্যে বিশেষভাবে চারজন ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছেন এবং তাঁদের চয়ন ও ইজতেহাদকৃত মাসআলা-মাসায়েল তথা তাঁদের মাযহাব ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়ে আসছে। তাই আমরা চার ইমাম ও চার মাযহাব-এর কথা শুনে থাকি। উক্ত চার জন ইমাম হলেন :
১. হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) ২. হযরত ইমাম শাফিঈ (রহঃ) ৩. হযরত ইমাম মালেক (রহঃ) ৪. হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ)।
তাঁদের মাযহাবকেই যথাক্রমে হানাফী মাযহাব, শাফিঈ মাযহাব, মালেকী মাযহাব, ও হাম্বলী মাযহাব বলা হয়ে থাকে। আমাদের আকীদা হল এ সব মাযহাবই হক, তবে অনুসরণ যে কোন একটারই করতে হবে, যেমন পূর্বে বলা হয়েছে। উপমহাদেশের মুসলমান সহ পৃথিবীর অধিক সংখ্যক মুসলমান হযরত ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর তথা হানাফী মাযহাব-এর অনুসারী।
সালাফী ও গায়রে মুকাল্লিদগণ তাকলীদের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেন এমনকি তারা তাকলীদকে প্রায় শির্ক পর্যায়ভুক্ত মনে করেন।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা