রাগ নিয়ন্ত্রণে বুযুর্গানে দ্বীনের কর্ম পন্থা
অধিকাংশ আল্লাহওয়ালা বুযুর্গানে দ্বীনের ব্যাপারে আপনারা শুনেছেন যে, তাঁরা নিজেদের সমস্ত মুরীদ ও মুতাআল্লিকীনের সাথে স্নেহ ও মহব্বতপূর্ণ আচরণ করেন। রাগারাগি বা গোস্বা করেন না। কিন্তু আল্লাহ ওয়ালাদের রং বিভিন্ন ধরনের হয়। কারো উপর দয়ার প্রাধান্য, তো তিনি দয়া ও মায়ার মাধ্যমে তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষদের রূহানী চিকিৎসা করতে থাকেন। আবার কারো উপর জালালী তবিয়তের প্রাবল্য হয় তিনি ঐ জালালের মাধ্যমে চিকিৎসা করেন। কিন্তু ঐ জালাল বা কড়া মেযাজ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেটা সীমার বাইরে যায় না ।
এই যে একটা কথা প্রসিদ্ধ যে, অমুক বুযুর্গ খুব জালালী প্রকৃতির ছিলেন। তো ‘জালালী’ হওয়ার মর্ম এটা নয় যে, তিনি যেখানে সেখানে শুধু গোস্বাই করতে থাকেন। আর স্বাভাবিক সীমার বাইরে গোস্বা করেন। বরং যে সময় যার সাথে যতটুকু গোস্বা করা দরকার তার সাথে ঐ সময় ততটুকুই গোস্বা করেন। আর ‘তরবিয়্যতে বাতেনী’ তথা আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য তাঁরা এটার প্রয়োজন অনুভব করতেন। সেই অনুপাতেই তাঁরা গোস্বা করতেন।
তাইতো আমাদের বুযুর্গ হাকীমুল উম্মাত হযরত থানভী রহ. এর ব্যাপারে এই যে একটা কথা প্রসিদ্ধ যে, তিনি বড় জালালী বুযুর্গ ছিলেন। ফারূকী ছিলেন অর্থাৎ হযরত উমর ফারূক রাযি. এর বংশোদ্ভূত ছিলেন। এজন্য তবিয়তে গাইরত বা আত্মমর্যাদাও বেশি ছিল। কিন্তু তাঁর তরবিয়্যাতের অধীনে যে সব সালিক বা আল্লাহর পথের পথিক ছিলেন তাঁদের ব্যাপারে কখনোই তাঁর গোস্বা সীমার বাইরে যায়নি। আর সাধারণ অবস্থায় তাঁর মধ্যে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা বিরাজমান থাকত ।
গোস্বার সময় ধমক দেয়া নিষেধ
হযরত হাকীমুল উম্মাত থানভী রহ. বলতেন, আমি অন্যদেরকেও এ কথা বলি আর আমার নিজের আমলও এটাই যে, যারা আমার তরবিয়্যাতের অধীনে আছে, তার সাথে আমি গোস্বা করি বটে, কিন্তু যে আমার তরবিয়্যাতের অধীনে নয় তার উপর আমি কখনো গোস্বা করি না। হযরত থানভী রহ. আরো বলতেন: “যখন মনের মধ্যে গোস্বা থাকে, তখন কাউকে ধমক দিবে না বরং তখন খামুশ হয়ে যাও। পরবর্তী সময়ে যখন গোস্বা ঠান্ডা হয়ে যাবে, তখন কৃত্রিম গোস্বা পয়দা করে পুনরায় বকা দাও। কেননা কৃত্রিম গোস্বা কখনো সীমার বাইরে যাবে না। পক্ষান্তরে প্রচন্ড উত্তেজিত অবস্থায় গোস্বা করলে সেটা সীমার বাইরে চলে যাবে।”
হযরত হাকীমুল উম্মাত রহ. বলতেন: “আলহামদুলিল্লাহ, যখন আমি কাউকে আদব দেয়ার জন্য শাস্তি দিই, তখন ঠিক ঐ শাস্তি প্রদানের মুহূর্তেও মনের মধ্যে এ কথাটা থাকে যে, তার মর্যাদা আমার থেকে বেশি। এবং সে আমার থেকে উত্তম । আমি তো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এ কাজের জন্য আদিষ্ট। এজন্য এ কাজ করছি।”
অতঃপর উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন: যেমন কোন বাদশাহ নিজ শাহজাদার কোন অন্যায় কাজের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে জল্লাদকে নির্দেশ দিল যে, “এই শাহজাদাকে বেত্রাঘাত কর”, তো এখন ঐ জল্লাদ বাদশাহর নির্দেশে শাহজাদাকে বেত্রাঘাত করবে সত্য, কিন্তু আঘাত করার সময়ও জল্লাদ এটাই চিন্তা করবে যে, সে হল শাহজাদা আর আমি হলাম জল্লাদ। তার মর্যাদা বেশি। কিন্তু বাদশাহর নির্দেশের কারণে বাধ্য হয়ে বেত্রাঘাত করছি।
”অতঃপর হযরত হাকীমুল উম্মাত বলেন: আলহামদুলিল্লাহ।পুরোপুরি গোস্বার মুহূর্তেও আমার অন্তরে এ খেয়াল জাগ্রত থাকে, এরমর্যাদা আমার থেকে বেশি। কিন্তু প্রয়োজনের খাতিরে বাধ্য হয়ে এদায়িত্ব পালন করছি। এজন্য তাকে বকা দিচ্ছি বা শাস্তি দিচ্ছি। তো হযরত থানভী রহ. বলতেন: একদিকে আমি তাকে বকাঝকাকরছি, পাকড়াও করছি আর অপরদিকে আমি দিলে দিলে এই দু’আকরছি, ইয়া আল্লাহ! যেভাবে আমি তাকে পাকড়াও করছি, সেভাবে আখেরাতে আপনি আমাকে পাকড়াও করবেন না। আর যেভাবে আমি তাকে বকাঝকা করছি, ইয়া আল্লাহ! কিয়ামতের দিন আমার সাথে সেরকম মুআমালা করবেন না। কেননা যা কিছু আমি করছি, আপনার নির্দেশ মনে করেই করছি।
যাই হোক, ইসলাহ ও তারবিয়্যাতের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রসমূহে এইছিল হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. এর গোস্বা। অথচ লোকেরা তাঁর ব্যাপারে এমনিতেই প্রসিদ্ধ করে দিয়েছে যে, তিনি বড় জালালী মেযাজের বুযুর্গ ছিলেন ।
হযরত হাকীমুল উম্মাত থানভী রহ. এর ঘটনা
হযরত হাকীমুল উম্মাত থানভী রহ. এর একজন পুরানো খাদেম ছিলেন। নাম হল ভাই নিয়ায ছাহেব রহ.। থানাভবন খানকায় হযরত থানভী রহ. এর নিকট থাকতেন। যেহেতু দীর্ঘদিন যাবত হযরতের খেদমত করে আসছিলেন এজন্য কিছুটা মুখরা হয়ে গিয়েছিলেন। একবার কেউ একজন হযরতের নিকট এসে তার ব্যাপারে অভিযোগ করেন যে, ভাই নিয়ায খুব মুখরা হয়ে গেছেন অনেক সময় খানকাহে আগন্তুকদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন।
হযরতওয়ালা এটা শুনে বিষণ্ন হলেন যে, আরে এটা তো খুবই খারাপ কথা। আগন্তুক মেহমানদের সাথে এমন আচরণ। ফলশ্রুতিতে হযরত তাকে ডেকে বললেন, ভাই নিয়ায! তুমি নাকি আগন্তুকদেরসাথে লড়াই ঝগড়া কর আর অভদ্রভাবে কথাবার্তা বল?
এটা শুনে ভাই নিয়াযের মুখ থেকে এ বাক্য বের হয়ে যায় হযরত! মিথ্যা বলবেন না। আল্লাহকে ভয় করুন। বাহ্যিকভাবে ভাই নিয়ায সাহেব এটা বলতে চাচ্ছিলেন যে, যারা আমার ব্যাপারে আপনার নিকট অভিযোগ পেশ করেছে যে, আমি মানুষদেরকে বকাঝকা দেই, তারা যেন মিথ্যা না বলে, আল্লাহকে ভয় করে। কিন্তু মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে “মিথ্যা বলবেন না, আল্লাহকে ভয় করুন।
দেখুন একজন সামান্য খাদেম তার মনিবকে বলছে, মিথ্যা বলবেননা আল্লাহকে ভয় করুন। এ পরিস্থিতিতে তো ঐ খাদেম আরো বেশি তিরস্কার ও ভর্ৎসনার উপযুক্ত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হযরত হাকীমুল উম্মাত থানভী রহ. একথাটা শোনা মাত্রই দৃষ্টি নত করে ফেললেন এবং আসতাগফিরুল্লাহ আসতাগফিরুল্লাহ বলতে বলতে সেখান থেকে চলেগেলেন।
আসল কথা হল, ভাই নিয়াযের এ কথা শুনে হযরত হাকীমুল উম্মাতের চৈতন্যোদয় হল যে, আমি তো এক তরফা কথা শুনে তাকে ধমক দেয়া আরম্ভ করেছি। তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করিনি। তার ব্যাপারে কেউ একজন আমাকে জানানোর প্রেক্ষিতে তাকে বকা ঝকাদেয়া শুরু করেছি। এ কাজটি আমি ঠিক করিনি ।এজন্য সঙ্গে সঙ্গে “ইসতিগফার” করতে করতে সেখান থেকে চলে গেছেন। এমন মহান ব্যক্তির ব্যাপারেই কিনা মন্তব্য করা হচ্ছে তিনি জালালী বুযুর্গ ছিলেন। মানুষদেরকে খুব বকাঝকা দিতেন।
বকাঝকার সময়ও খেয়াল রাখতে হবে
আমার সম্মানিত পিতা হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফীছাহেব রহ. বলতেন: বাস্তবিক পক্ষে আমরা হযরত থানভী রহ. এর ওখানে স্নেহ ও ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। অবশ্য অনেক সময় মানুষের ইসলাহ বা সংশোধনের উদ্দেশ্যে বকাঝকার প্রয়োজন হত, তো সেটাও খুব লক্ষ্য রেখে করতেন।
যাই হোক ছোট কাউকে বকার প্রয়োজন হলে মানুষের উচিত এসব বিষয় লক্ষ্য করে তরবিয়্যাত করা। উদাহরণস্বরূপ, সর্ব প্রথম এটা খেয়াল করবে যে, একে বকাঝকা করার দ্বারা আমার গোস্বা বেরকরা যেন উদ্দেশ্য না হয়। বরং আসল উদ্দেশ্য হল তার ইসলাহ ওসংশোধন। যার পদ্ধতি সম্পর্কে হযরত হাকীমুল উম্মাত থানভী রহ.-বলেন যে, পুরোপুরি গোস্বার মুহূর্তে কোন পদক্ষেপ নিবে না বরং যখনগোস্বা ঠান্ডা হয়ে যাবে তখন চিন্তা-ভাবনা করে যতটুকু গোস্বা করা দরকার, কৃত্রিম গোস্বা সৃষ্টি করে অতটুকুই গোস্বা কর । এর থেকে যেনকমও না হয়, বেশিও না হয়। কিন্তু যদি উত্তেজিত অবস্থায় গোস্বারউপর আমল করে ফেলে, তবে দেখা যাবে যে, গোস্বা নিয়ন্ত্রণে থাকবেনা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দ্বারা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ।
শাহ আব্দুল কুদ্দূস গাঙ্গুহী রহ. এর ছেলের মুজাহাদা
আমাদের বুযুর্গানে দ্বীনের নিকট যখন কেউ নিজ ইসলাহ বা সংশোধনের উদ্দেশ্যে যেত, তখন তাওবার পর তাকে এ সবক দেয়া হত যে, স্বীয় গোস্বাকে বিলকুল খতম করে দিবে। আর এই গোস্বাকে খতম করানোর জন্য বড় বড় মুজাহাদা করানো হত। হযরত শাহ আব্দুল কুদ্দূস গাঙ্গুহী রহ. অনেক বড় বুযুর্গ ছিলেন। আর সারা দুনিয়া থেকে মানুষ তাঁর নিকট নিজ ইসলাহের উদ্দেশ্যে আসত। তাঁর ছেলে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কোন মূল্যায়ন করেনি। এমনটি প্রায় হয়ে থাকে যে, যতদিন পর্যন্ত নিজের মুরব্বী হায়াতে থাকেন, তো দিলের মধ্যে তাঁর কোন কদর থাকে না। তাইতো প্ৰবাদ প্রসিদ্ধ আছে “ঘরের মুরগী ডাল বরাবর”।
পিতা ঘরে বিদ্যমান, সারা দুনিয়া এসে তাঁর থেকে ফয়েয হাসিল করছে। কিন্তু ছেলের এ সবের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপই নেই। সে নিজ খেলাধুলায় মত্ত। যখন পিতার ইন্তিকাল হয়ে গেল, তখন চোখ খুলল। আর এটা চিন্তা করল যে, ঘরের মধ্যে কত বড় দৌলত বিদ্যমান ছিল। সারা দুনিয়া এসে তাঁর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে কিন্তু আমি তো সময় নষ্ট করেছি আর তাঁর থেকে কিছুই অর্জন করতে পারিনি। এখন খোঁজ-খবর নিলেন যে, আমার মরহুম পিতার কাছে যাঁরা আসতেন এবং যাঁরা আমার পিতার মাধ্যমে নিজেদের ইসলাহ করিয়েছেন, ইনাদের মধ্যে কে আছেন এমন যিনি আমার আব্বাজান থেকে সবচেয়ে বেশি ফয়েয হাসিল করেছেন। যাতে করে কমপক্ষে আমি তাঁর নিকট গিয়ে ফয়েয হাসিল করতে পারি ।
অনুসন্ধানের পর জানা গেল যে, এমন একজন বুযুর্গ বলখে থাকেন। আর ইনি নিজে ইউপি তথা উত্তর প্রদেশের গাঙ্গুহে থাকেন । ফলশ্রুতিতে তিনি বলখ যাওয়ার নিয়্যত করে ফেলেন এবং শাইখকে জানিয়ে দেন যে, আমি বলখ আসছি।
এই বুযুর্গ যখন সংবাদ পেলেন যে, আমার শাইখের ছেলে আগমন করছেন তখন তিনি খাদেম নফর সহ শহরের বাইরে গিয়ে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং খুব ইজ্জত-সম্মান করে বাসায় নিয়ে আসেন। তাঁর জন্য শানদার খানা রান্না করেন, খুব দাওয়াত করেন। এভাবে এক দুই দিন যাওয়ার পর ছাহেবযাদা আরয করলেন যে, হযরত! আপনি আমার সাথে অত্যন্ত ভালবাসাপূর্ণ আচরণ করেছেন এবং আমার মূল্যায়ন করেছেন কিন্তু আমি মূলত অন্য একটি উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। শাইখ জিজ্ঞেস করলেন সেই উদ্দেশ্য কী? ছাহেবযাদা আরয করলেন, হযরত! আমি তো এ উদ্দেশ্যে এসেছি যে, আমার মরহুম আব্বাজান থেকে যে বাতেনী দৌলত আপনি নিয়ে এসেছেন সেটার কিছু অংশ আপনার থেকে হাসিল করব। কেননা তাঁর জীবদ্দশায় আমি তাঁর থেকে নিতে পারিনি।
সুলুকের লাইনে সাহেবজাদার প্রথম পরীক্ষা
শাইখ বললেন, আচ্ছা তুমি এ উদ্দেশ্যে এসেছ। তো এখন থেকে এই খাতির আপ্যায়ন, মেহমানদারী সব বন্ধ থাকবে। এই ইজ্জত ও সম্মান এই দাওয়াতের শানদার খানা সব বন্ধ । এখন তুমি যেটা করবে সেটা হল মসজিদের পাশে একটি হাম্মাম আছে। ঐ হাম্মামের পাশে হবে তোমার ঠিকানা। সেখানেই তোমাকে ঘুমাতে হবে। আর হাম্মামের আগুন জ্বালিয়ে সব সময় সেটার পানি গরম রাখতে হবে, আর সেটার জন্য কাঠ-লাকড়ী সংগ্রহ করে এনে এতে ফুঁক দিবেন।
যেহেতু শীত মৌসুম ছিল। নামাযী মানুষদের উযূর জন্য গরম পানির ব্যবস্থা করা হত। ঐ ছাহেবযাদাকে বলে দিলেন: ব্যস তোমার কাজ স্রেফ এটাই । কোন ওয়াযীফা কোন তাসবীহ ইত্যাদি বলেননি। কোথায় সেই ইজ্জত-সম্মান! আর কোথায় এই মুজাহাদা ও খেদমত!
যেহেতু ইনি ইখলাসের সাথে নিজের ইসলাহের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন, এজন্য শাইখের নির্দেশ পালনার্থে ঐ স্থানে গেলেন এবং ঐ কাজে গেলেন। এখন একটা লম্বা সময় পর্যন্ত তাঁর দায়িত্বে ব্যস স্রেফ একাজই ছিল যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া ও মসজিদ এর হাম্মাম আলোকিত করা।
ঐ বুযুর্গ জানতেন যে, এ ছাহেবযাদাদের মধ্যে বংশীয় আভিজাত্য থাকলেও অন্তর থাকে পবিত্র। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একটা দোষ অবশ্যই থাকে। আর সেটা হল অহংকার ও দাম্ভিকতা। এটার চিকিৎসা মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। এজন্যই এমন কাজ তাঁর উপর সোপর্দ করেছেন যাতে তাঁর এই ব্যাধির চিকিৎসা হয়ে যায়।
কিছুদিন পর শাইখ এটা দেখার জন্য যে, শাহযাদেগীর খেয়াল ও কল্পনা এখনো তাঁর অন্তরে আছে নাকি খতম হয়ে গেছে? তাঁর পরীক্ষার জন্য শাইখ নিজের বাসার মেথর যে বাসার ময়লা আবর্জনা উঠিয়ে নিয়ে যেত তাকে বললেন: আজ যখন ময়লা নিয়ে যাবে, তখন হাম্মামের পাশে হাম্মামের আগুন আলোকিত করার জন্য যে লোকটি নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার পাশ দিয়ে যাবে। আর সে তোমাকে যা কিছু বলবে সেটা এসে আমাকে জানাবে। ফলশ্রুতিতে যখন ঐ মেথর ময়লা আবর্জনা নিয়ে সেই ছাহেবযাদার পাশ দিয়ে গেল, তখন তার প্রচন্ড গোস্বা আসল এবং বলল যে, আজ যদি আমার এলাকা গাঙ্গুহ হত তাহলে তুমি এইময়লা-আবর্জনা নিয়ে আমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সাহসই পেতে না ৷
মেথর শাইখকে জানিয়ে দিল যে, এই মন্তব্য করেছে। শাইখ চিন্তা করলেন ও বুঝলেন যে, সুলূকের পথে সে এখনো কাঁচা। এখনো কিছু অহংকার আছে। ফলে ঐ হাম্মামের পানি গরমের আদেশ বলবৎ রাখা হল।
দ্বিতীয় পরীক্ষা
কিছুদিন যাওয়ার পর শাইখ পুনরায় ঐ মেথরকে বলেছেন যে, এখন ময়লা উঠিয়ে নিয়ে যাও। আর এবার একদম তার পাশ ঘেঁষে যাবে। ফলে ঐ মেথর আরো বেশি কাছ দিয়ে গেল। ফলে ছাহেবযাদা ঐ মেথর এর দিকে গোস্বার দৃষ্টিতে তাকালেন। কিন্তু এবার মুখে কিছু বললেন না। ঐ মেথর গিয়ে শাইখকে জানিয়ে দিল যে, আজ এই ঘটনা হয়েছে। শাইখ অনুধাবন করতে পারলেন যে, ঔষধ কার্যকর হচ্ছে।
তৃতীয় পরীক্ষা
কিছুদিন পর শাইখ তাকে নির্দেশ দিয়ে বললেন: এবার তার এতটুকু পাশ দিয়ে যাবে যেন ময়লা-আবর্জনা তার গায়েও লেগে যায়। আর সেখান থেকে কিছু ময়লা যেন তার গায়েও পড়ে। ফলে মেথরটি যখন তার পাশ দিয়ে গেল, আর কিছু ময়লা তার গায়েও ফেলে দিল, তখন ঐ ছাহেবযাদা নজর উঠিয়েও দেখেননি। মেথর শাইখকে হালত জানাল । শাইখ বললেন: হ্যাঁ উপকার হচ্ছে।
চতুর্থ পরীক্ষা
কিছুদিন পর শাইখ পুনরায় মেথরকে নির্দেশ দিলেন যে, এবার ময়লার টুকরী নিয়ে তার পাশ দিয়ে যাবে। আর কোন কিছুর সাথে টক্কর খেয়ে তার পাশে এমনভাবে পড়বে যেন পুরো ময়লা-আবর্জনা তার উপর পড়ে। এরপর সে কী করে তা আমাকে জানাবে। ফলে ঐ মেথর গেল আর হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। যখন ছাহেবযাদা দেখল যে, মেথর পড়ে গেছে, তখন তার নিজের চিন্তার পরিবর্তে মেথরের চিন্তা হল। আর তাকে জিজ্ঞেস করল যে, ভাই! তুমি কোন চোট্ পাওনি তো? নিজের কোন চিন্তা নাই যে, আমার কাপড় নোংরা হয়েগেছে। মেথর শাইখকে ঘটনার বিবরণ শুনাল । শাইখ বললেন: এবার সফলতার আশা করা যায়।
বড় পরীক্ষা এবং দৌলতে বাতেনী লাভ
এরপর আরেকটি ঘটনা ঘটল। সেটা হল শাইখ বলখী রহ.-শিকারের উদ্দেশ্যে বাইরে যেতেন। সঙ্গে শিকারী কুকুরও থাকত। সম্ভবত এর মধ্যে তিনি কোন দ্বীনী হেকমত দেখেছেন। আর শিকারী কুকুরের মাধ্যমে শিকার করা কোন নাজায়িয কাজও না বরং জায়িয আছে।
যাই হোক ঐ শাইখ একবার শিকারের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়এই ছাহেবযাদাকেও সাথে নিয়ে নিলেন আর শিকারী কুকুরের লৌহশিকল ছাহেবযাদার হাতে ধরিয়ে দিলেন। ঐ শিকারী কুকুরগুলো ছিল খুব শক্তিশালী ও স্বাস্থ্যবান। অথচ এই বেচারা ছিল ক্ষুধার্ত ওদুর্বল। ফলশ্রুতিতে যখন শিকারী কুকুরগুলো শিকারের পিছনে দৌড়তে লাগাল আর এই বেচারা দুর্বল হওয়ার কারণে ঐ কুকুরগুলোর সাথে পেরে উঠতে পারল না। তখন সে পড়ে গেল। যেহেতু শাইখের পক্ষথেকে নির্দেশ ছিল কোন অবস্থাতেই শিকল হাতছাড়া করা যাবে না। এজন্য তিনি শিকল ছাড়েননি। হেঁচড়ে চলার কারণে রক্তাক্ত হয়ে যান। কিন্তু শাইখের নির্দেশ পালনার্থে শিকল হাত থেকে ছেড়ে দেননি ।এ ঘটনার পর রাত্রে শাইখ নিজ পীর ও মুরশিদ হযরত মাওলানা আব্দুল কুদ্দূস গাঙ্গুহী রহ. কে স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি বলছেন: “আমিতো তোমার থেকে এত মেহনত নিইনি।” কেননা পিতার অন্তরে সবসময় সন্তানের খেয়াল থাকে। ফলে পরের দিন শাইখ সকালে তাঁকে ডেকে বুকের সাথে লাগালেন এবং বললেন যে, যে দৌলত ও নেয়ামত আমি তোমার আব্বা থেকে নিয়ে এসেছিলাম, তুমি সে দৌলত চেয়েছিলে, যা তোমার আমানত ছিল। সেই দৌলতই আমি তোমার কাছে সমৰ্পণকরে দিলাম। আর যেহেতু এই কর্মপদ্ধতি ব্যতীত ঐ দৌলত পাওয়া অসম্ভব ছিল। এজন্য আমি এরূপ অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছি।
বই : হিংসা ও গোস্বা: দুটি ধ্বংসাত্বক ব্যাধি