ইসলাম

কুদৃষ্টির তিনটি বড় ক্ষতি

কুদৃষ্টির কারণে মানুষের অন্তরে যৌন উদ্দামতার ঝড় সৃষ্টি হয়। মানুষ এ বন্যার তীব্রতায় ভেসে যায়‌ এর কারণে তিনটি বড় ক্ষতি অস্তিত্বে আসে।

এক. কুদৃষ্টির কারণে মানুষের অন্তরে কল্পিত প্রিয়ার ছবি তৈরি হয়। সুন্দর চেহারা তার দেল-দেমাগে জেঁকে বসে। সে জানে, কল্পিত চেহারার অধিকারীণী পর্যন্ত পৌঁছতে সে পারবে না, তবুও সে নির্জনে তার কথা ভেবে মজা ভোগ করে। অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার সাথে কল্পনার জগতে গল্প করে। বিষয়টা এ পর্যন্ত গড়ায় যে,কবির ভাষায়- تم میرے پاس ہوتے ہو گویا – جب کوئ دوسرا نہیں ہوتا ‘তুমি যেন আমার পাশে তখন থাকো, যখন কেউ থাকে না।’

কুদৃষ্টিকে বাহন বানিয়েই শয়তান মানুষের মনমস্তিষ্কে জেঁকে বসে এবং তাকে শয়তানি কর্মকান্ড করার প্রতি তাড়া দেয়। ফাঁকা নির্জনস্থানে যেমনিভাবে অন্ধকার তার গাঢ় প্রভাব বিস্তার করে, অনুরূপভাবে শয়তানও ওই ব্যক্তির অন্তরে বিষাক্ত প্রভাব ঢেলে দেয়। যাতে করে সে তার সামনে নিষিদ্ধ বিষয়গুলো খুবই আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে উপস্থাপন করতে পারে এবং তার সামনে একটি নয়নলোভন মূর্তি তৈরি দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এমন ব্যক্তির অন্তর দিবানিশি ওই মূর্তিটার পূজায় লিপ্ত থাকে। ইতরামিপূর্ণ আশা ও কামনা নিয়ে সে মেতে ওঠে। এটাকেই বলা হয় কামপূজা প্রবৃত্তিপূজা নফসপূজা। বরং এটা এক প্রকার মূর্তিপূজাও। এটা শিরকে খফী তথা গোপন শিরিক।

আল্লাহতাআলা বলেন- وَلَا تُطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطاً ‘আর ওইব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে দিয়েছি। যে তার খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।’ (সূরা কাহাফ : ২৮) এসব কল্পিত উপাস্য থেকে নিজের অন্তপ্রাণকে মুক্ত করা ছাড়া ঈমানের স্বাদ ভাগ্যে জুটবে না এবং আল্লাহর নৈকট্যের স্নিগ্ধ বাতাস পাওয়া যাবে না। কবির ভাষায় – بتو ں کو توڑ کر تخیل کے ہو ں کے پتھر کے ‘মূর্তিগুলো ভেঙ্গে কল্পনায় হয়ে আছ পাথরের।’

দুই. কুদৃষ্টির দ্বিতীয় ক্ষতি হল, মানুষের মনমস্তিষ্ক বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ঘরে সতী-সাধবী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তার অন্তর স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয় না। স্ত্রী ভাল লাগে না। খুটিনাটি বিষয় নিয়েও স্ত্রীর ওপর রাগ করে। ঘরোয়া পরিবেশ তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়। বাইরের মহিলাদের প্রতি সে কুকুর যেমন শিকারের দিকে তাকায়, সেভাবে তাকায়। অনেক সময় কাজকর্মেও তার মন বসে না, ছাত্র হলে পড়ালেখা ছাড়া বাকি সব ভালো লাগে। ব্যবসায়ী হলে ব্যবসা থেকে তার মন ওঠে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুমালেও শান্তির ঘুম আসে না। কেউ দেখে মনে করবে যে, সে ঘুমিয়ে আছে, মূলত সে কল্পিত প্রিয়ার কল্পনায় ডুবে আছে।

তিন. কুদৃষ্টির তৃতীয় বড় ক্ষতি হল, হৃদয় সুন্নাত-বিদআত ও হক বাতিলের মাঝে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়ে যায়। অন্তর্দৃষ্টিশক্তি চলে যায়। দীনের প্রজ্ঞা ও ইলমি বৈভব থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। গুনাহর কাজ তার কাছে গুনাহ মনে হয় না। এরূপ পরিস্থিতিতে দীনের ব্যাপারে শয়তান তাকে সন্দেহ- সংশয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। নেককারদের সম্পর্কে তার অন্তরে বদধারণা সৃষ্টি হয়। এমনকি পোশাক আশাকে ও অবয়বে দীনপালনকারী ব্যক্তিবর্গ তার কাছে ঘৃণার পাত্র মনে হয়। সে বাতিল ঘরানার হয়েও নিজেকে হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত মনে করে। অবশেষে ঈমানহারা হয়ে জাহান্নামী হয়ে যায়।

কুদৃষ্টি সম্পর্কে পূর্বসূরী সলফেসালেহীন যা বলেছেন

এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- لَعَنَ اللهُ النَّاظِرَ وَالْمَنْظُوْرَ إِلَيْهِ ‘কুদৃষ্টিদানকারী ও কুদৃষ্টিদানে সুযোগদানকারী উভয়ের ওপর আল্লাহ লা’নত করেছেন।'(বাইহাকী, মেশকাতশরীফ : ২৭০)

দুই. হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজের ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, ‘বাঘ ও অজগরের পেছনে ছুটতে পার, কিন্তু কোনো নারীর পেছনে নয়।’ উদ্দেশ্য হল, বাঘ ও অজগর উল্টো তেড়ে আসলে মরণঘাটে চলে যাবে। কিন্তু নারী তেড়ে আসলে জাহান্নামের ফাঁদে ফেঁসে যাবে।

তিন. হযরত ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করা হল, ব্যভিচারের শুরুটা কিভাবে হয়? তিনি বললেন, চোখ থেকে।

চার. হযরত উমর রাযি. বলেন, দুটো জীর্ণপুরনো হাড়ও একসাথে মিলিত হলে পরস্পরের প্রতি আসক্ত হবে। (জীর্ণহাড় দ্বারা উদ্দেশ্য হল, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা।)

পাঁচ. হযরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব রহ. বলেন, যখন তুমি কাউকে দেখ যে, সে কোনো সুশ্রীবালকের প্রতি অপলক তাকিয়ে থাকে, তাহলে বুঝে নাও ‘ডাল মে কুচ কালা হায়।

ছয়. ফতেহমুসিলী রহ. বলেন, আমি ত্রিশজন মাশায়েখের সাথে সাক্ষাত করেছি, যাদেরকে অলি- আবদাল মনে করা হয়, প্রত্যেকেই বিদায়কালে আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, কমবয়সী ছেলেদের সংশ্রব থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবে।

সাত. ইবনুযাহির মাকদিসী রহ. বলতেন, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো পুরুষের প্রতি আসক্ত থাকে তাহলে তার জন্য ওই পুরুষকে দেখা হারাম।

আট. ইমাম গাযালী রহ. বলতেন, মুরিদের ওপর হিংস্র প্রাণীর থাবাকে আমি ওই পরিমাণ ভয় করি না, যে পরিমাণ ভয় করি তাকে কোনো কমবয়সী ছেলের সান্নিধ্যে দেখলে।

নয়. হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রহ. বলতেন, কুদৃষ্টি স্মরণশক্তির জন্য প্রাণনাশকারী বিষতুল্য।

দশ. মুজাদ্দিদে আলফেছানী রহ. তাঁর মাকতুবাতে লিখেছেন, যার দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণে নেই, তার অন্তরও নিয়ন্ত্রণে নেই। আর যার অন্তর নিয়ন্ত্রণে নেই, তার লজ্জাস্থানও নিয়ন্ত্রণে নেই।

কুদৃষ্টিমুক্ত থাকার পুরস্কার

যে ব্যক্তি দৃষ্টির হেফাজত করবে পরকালে সে দুটি পুরস্কার পাবে। প্রথমত, প্রতিটি দৃষ্টির হেফাজতের বিনিময়ে আল্লাহর সাক্ষাত লাভ দ্বারা সে ধন্য হবে। দ্বিতীয়ত, এমন চোখ কেয়ামতের দিন কান্না থেকে নিরাপদ থাকবে। পবিত্র হাদীসে আছে- عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللَّهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُلُّ عَيْنٍ بَاكِيَةٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِلَّا عَيْنٌ غَضَتْ عَنْ مَحَارِمِ اللَّهِ وَ عَيْنٌ سَهِرَتْ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ وَ عَيْنٌ خَرَجَ مِنْهَا مِثْلُ رَأْس الدُّبَاب مِنْ خَشْيَةِ اللهِ ‘হযরত আবুহুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কেয়ামতের দিন সকল চোখ থেকেই পানি ঝরবে। তবে, কেবলমাত্র আল্লাহ ঘোষিত নিষিদ্ধ দৃষ্টি থেকে যে তার চোখ অবনমিত করেছে, যে চোখ আল্লাহর পথে পাহারায় কেটেছে এবং যে চোখ থেকে আল্লাহর ভয়ে মাছির মাথার পরিমাণ পানি বেরিয়েছে। তা ব্যতীত।’ (আততারগীব ওয়াততারহীব, খন্ড : ০৩, পৃষ্ঠা : ৩৪)

কুদৃষ্টির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা

কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। পুরুষদের জন্য কেবল পরনারীকে দেখা নয়; বরং যদি মাহরাম নারীকে দেখলেও কামনা জাগে তখন তাদেরকেও দেখা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। বালকদেরকে দেখার ক্ষেত্রেও একই কথা। বরং কোনো পুরুষকে দেখলে যদি গুনাহর চিন্তা আসে তাহলে তাকেও দেখবে না। একই বিষয় নারীদের ক্ষেত্রেও। তাদের জন্য কেবল পরপুরুষ নয়; বরং কোনো ছোট ছেলেকে দেখার পর যদি কুকল্পনা আসে তাকেও দেখা থেকে বিরত থাকবে।

হযরত আবু হুরাইরা রাযি. ছোটছেলেদের প্রতি স্থির দৃষ্টিতে তাকানো থেকে নিষেধ করতেন। আমাদের মাশায়েখ বলেছেন, তোমরা বালকদের সাথে বসো না। কারণ এটা মেয়েঘটিত দুর্ঘটনা থেকেও খতরনাক। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হল, পরমেয়ের সাথে বসার ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে, পক্ষান্তরে কমবয়সী ছেলেদের সাথে বসার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। সুতরাং এক্ষেত্রে ফেতনার আশঙ্কা বেশি। অনুরূপভাবে মহিলাদের জন্য পরপুরুষ পর্যন্ত পৌঁছার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা থাকে। কিন্তু নারী নারীর পাশে বসা সহজ। সুতরাং কোনো নারী যদি এই আশঙ্কা করে যে, অমুক মেয়ের পাশে বসলে গুনাহয় জড়িয়ে পড়ার ভয় আছে, তাহলে তার থেকেও পরপুরুষের মতই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। প্রয়োজনে তার চেহারার প্রতিও তাকাবে না। তার সাথে গল্প করবে না। قدم قدم پہ یہا ں احتیاط لازم ہے- کہ منتظر ہے یہ دنیا کسی بہانے کی এজগতে প্রতিটি পদক্ষেপে প্রয়োজন সতর্ক থাকার – কারণ দুনিয়া অপেক্ষায় থাকে কোনো বাহানার

তথ্যসূত্র: বই: কুদৃষ্টি

লিখক: আল্লমা যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *