ইবাদত

যাকাতের বিবিধ ১৯ টি মাসআলা।

মুসাফিরের যাকাতের বিধান ০১. মাসআলা : মুসাফির যেহেতু প্রতিনিধির মাধ্যমে নিজ সম্পদের লেনদেন করতে পারে, এজন্য তার সম্পদে (যদি নেসাব পরিমাণ হয়) যাকাত ওয়াজিব । (ফাওয়ায়ে আলমগীরী : ৪/৭) বর্তমান মূল্যের যাকাত আসবে। ০২.মাসআলা : যাকাত আদায়ের সময় যে মূল্য বর্তমান থাকবে, তা ধর্তব্য হবে। আর সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ তথা ২.৫০% যাকাত দেওয়া জরুরী : (রদ্দুল মুহতার : ২/৩০)

০৩.মাসআলা : যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে যাকাত প্রদানকারী যে স্থানে থাকে, সে স্থানের মূল্য ধর্তব্য হবে না; বরং যেখানে সম্পদ থাকবে, সেখানের মূল্য গ্রহণযোগ্য হবে এবং সেখানের হিসেবেই বছর পূর্ণ হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/২৬৮)

যাকাতের টাকা দিয়ে হজ্জ করানো। ০৪.মাসআলা : যাকাতের টাকা হজ্জ পালনকারীকে (যদি নেসাবের মালিক না হয়) মালিক বানিয়ে দিলে সে এর দ্বারা হজ্জ করুক বা অন্য কোন খাতে ব্যয় করুক উভয়টাই সহীহ হবে এবং যাকাতও আদায় হয়ে যাবে। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলূম : ৬/২৭৩)

ট্যাক্সিক্যাবের ভাড়ার যাকাত। ০৫. মাসআলা : গাড়ীর মাধ্যমে যে লাভ অর্জিত হয়, তা যদি নেসাব পরিমাণ হয় এবং তাতে বছর অতিবাহিত হয়, তবে যাকাত ওয়াজিব হবে। গাড়ীর উপর এককভাবে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কেননা গাড়ী আয়ের উপকরণ, এতে যাকাত নেই। মনে রাখতে হবে যে, কেউ কেউ গাড়ী ক্রয়ের সময় এ নিয়ত করে যে, যদি ভালো দাম পাওয়া যায়, তবে বিক্রয় করে দেব, আর এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়; তবে উক্ত নিয়তে ক্রয়কৃত গাড়ী ব্যবসার পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তার মূল্যের উপর যাকাত ওয়াজিব হবে।(হাশিয়াতুত তাহতাবী : ১/৩৯২)

জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যাকাত দেওয়া ০৬.মাসআলা : যে সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, তারা যাকাতের টাকা যথাযথ খাতে ব্যায় করে, তবে এ জাতীয় সংস্থার ও প্রতিষ্ঠানে যাকাত দেওয়া চাই। আর যে সব প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না,তাদের যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে না । যাকাত দাতাদের পূণরায় যাকাত দিতে হবে। (আপকে মাসায়েল : ৩/803)

নিকৃষ্ট মানের বস্তু যাকাত দেওয়া ০৭.মাসআলা : কিছু কিছু লোক নিকৃষ্ট ও বেকার বস্তুসমূহ যাকাত হিসেবে দিয়ে থাকে। যেমন : কিতাব ব্যবসায়ীগণ অচল কিতাব যাকাত হিসেবে প্রদান করে । এমনিভাবে কাপড় ব্যবসায়ীরা পুরাতন থান দ্বারা যাকাত দিয়ে থাকে। তদ্রুপ ফল, ফসল ব্যবসায়ীরা বিক্রয় অযোগ্য শস্য ও ফল যাকাত হিসেবে দিয়ে থাকে। অধিকাংশ ব্যবসায়ীই এভাবে করে থাকে। এ ক্ষেত্রে যে মূল্য ধরে সে যাকাত আদায় করেছে বাজারে উক্ত পণ্যের ঐ মূল্য পাওয়া না গেলে যাকাত আদায় হবে না।এ পরিমাণ মূল্য ঘাটতি থাকবে,তা তার দায়িত্বে (যাকাত হিসেবে) থেকে যাবে। আর যদি ঐ পরিমাণ মূল্য বাজারে বিক্রয় হয়, তবে সে ক্ষেত্রে যাকাত আদায় হয়ে গেলেও আন্তরিকতার কমতির কারনে গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে কমতি থেকে যাবে । (কিতাবুল ফিকহ : ১/৯৭৩)

যাকাতের মাঝে কোন্ দেশী মুদ্রা ধর্তব্য হবে। ০৮. মাসআলা: যাকাত দাতা যে রাষ্ট্রের মুদ্রায় যাকাত আদায় করেছে, মূল্যই ধর্তব্য হবে। সে দেশের মুদ্রা দ্বারা যে পরিমাণ যাকাত আদায় করেছে, সে পরিমাণ মালের যাকাত আদায় হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। অন্য দেশের মুদ্রা চাই কম হোক বা বেশী হোক। অন্যভাবে বুঝে নেওয়া যেতে পারে যে, (যাকাত হিসেবে) যে অর্থ অসহায় ও মুখাপেক্ষীদের দেওয়া হয়, তা (যাকাত দাতার) সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ হওয়া জরুরী। সুতরাং যে মুদ্রায় যাকাত আদায় করা হবে, সে মুদ্রা হিসেবেই চল্লিশ ভাগের এক ভাগের বিবেচনা করা হবে। (আপকে মাসায়েল : ৩/৪১৩)

অনুমান করে যাকাত দেওয়া। ০৯. মাসআলা : যাকাত পরিপূর্ণভাবে হিসাব-নিকাশ করে দিতে হবে। অনুমান করে যাকাত দেওয়া উচিত নয়। যদি অনুমান করে কেউ যাকাত দিয়ে দেয় এবং অনুমানে কম হয়, তাহলে যাকাত আদায় করার জিম্মাদারী তার উপর থেকে পরিপূর্ণরূপে আদায় হবে না এবং এর কারণে পরকালে শাস্তি ভোগ করতে হবে। যদি কোন কারণে পরিপূর্ণ হিসেব করা অসম্ভব হয়, তাহলে বেশী বেশী অনুমান করা উচিত, যেন যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে কম না হয় । (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী : ১/১৭৫)

রাস্তা নির্মাণে যাকাত দেওয়া। ১০. মাসআলা : সরকারী বা ব্যক্তিগত নির্মাণে যাকাতের টাকা ব্যয় করা জায়েয নেই। যদি কোন ব্যক্তি রাস্তা নির্মাণে যাকাতের টাকা দেয়, তাহলে তার যাকাত আদায় হবে না। এ পরিমাণ যাকাত দ্বিতীয়বার আদায় করা আবশ্যক। (শামী : ২/৩৪৪)

অতিরিক্ত দেওয়া টাকাকে আগামী বছরের যাকাতে অন্তর্ভূক্ত করা। ১১. মাসআলা : যদি অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার সময় আগামী বছরের আগাম যাকাত দেওয়ার নিয়ত করে, তাহলে আগামী বছরের যাকাতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা জায়েয হবে। অন্যথায় জায়েয হবে না।

যাকাত দিয়ে তা বলে বেড়ানো। ১২. মাসআলা : কিছু লোক যাকাত খাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে যাকাত দেওয়ার পর উপকার করে বলেও বেড়ায় যে, আমি আপনাকে যাকাতের এত টাকা দিয়েছি। আর আপনি আমার অমুক কাজ করে দিলেন না। এভাবে উপকার করে বলে বেড়ানো ঠিক নয়। এই সূরতে যাকাত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না এবং প্রতিদান থেকেও মাহরূম হবে। (আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাহ : ২/৮৯৬)

যাকাতের ঘোষনা করণ। ১৩. মাসআলা : ধোকাবাজি প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে যাকাতের ঘোষনা করা জায়েয নেই; বরং তার দ্বারা সাওয়াব বাতিল হয়ে যাবে।(মিশকাত : পৃ. ৪৫৪)

সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার পরও যাকাত দেওয়া। ১৪. মাসআলা : যদি কারও এটা সন্দেহ হয় যে, যাকাত দিচ্ছে জানা নাই যে, সে ধনী কি গরীব। তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত নিশ্চিত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে যাকাত দিবে না। যদি নিশ্চিত হওয়া ছাড়া দিয়ে দেয়, তাহলে প্রবল ধারণাটা ধর্তব্য হবে। যদি অন্তর এটা সাক্ষী দেয় যে, সে যাকাত খাওয়ার উপযুক্ত, তখন যাকাত আদায় হবে। আর যদি অন্তর এ কথা বলে যে, সে ধনী, তাহলে যাকাত আদায় হবে না এবং যাকাত দ্বিতীয়বার আদায় করা আবশ্যক হবে। যদি দেওয়ার পর জানতে পারে যে, সে গরীবই ছিল তখন যাকাত আদায় হয়ে যাবে । দ্বিতীয়বার যাকাত দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। (হিন্দিয়া : ১/১৯০)

অমুসলিমকে দিয়ে যাকাতের বন্টন ১৫. মাসআলা : যাকাতের বন্টনের কাজ অমুসলিমের হাতে সোপর্দ করা জায়েয নেই। তার দ্বারা মুসলমানদের মানহানি হয় এবং একজন অমুসলিমের নেতৃত্ব মুসলমানদের উপর কায়েম হয় এবং যাকাতের টাকার ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার হবে।এতে যাকাত আদায়কারী দের যাকাত আদায় হবে না। এ সকল সমস্যার দায়ভার ঐ ব্যক্তিকে নিতে হবে। যে,অমুসলিমকে যাকাত বন্টনের দায়িত্ব দিয়েছে। (শামী : ২/৩০৯)

যাকাতের অর্থে কুরআন শরীফ বন্টন করা। ১৬. মাসআলা : কুরআন শরীফ যাকাতের অর্থে ক্রয় করে গরীব শিশুদেরকে এবং বড়দেরকে মালিক বানিয়ে দেওয়া জায়েয। এতে যাকাত আদায় হয়ে যাবে এবং সদকায়ে জারিয়ার সাওয়াব পাওয়া যাবে; বরং এতে দ্বিগুণ সাওয়াব পাওয়া যাবে।(ফাতাওয়ায়ে শামী : ২/২৮৫)

যাকাতের মাল পাঠানোর ভাড়া/খরচ। ১৭.মাসআলা : যদি যাকাতের মাল- সামানা আশপাশের অথবা দূরবর্তী কোন এলাকায় গাড়ি ইত্যাদির দ্বারা যাকাত খাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য পাঠানো হয়, তখন তার ভাড়া যাকাতের টাকা থেকে দেওয়া জায়েয নেই। কেননা যাকাত আদায় হওয়ার জন্য যাকাতের টাকা যাকাত খাওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিকে বিনিময় ছাড়া মালিক বানানো জরুরী৷
আর যদি যাকাতের সামানা এবং টাকা কোন উপযুক্ত ব্যক্তি অথবা তার উকিলকে মালিক বানিয়ে দিয়ে দেয়, তখন সে ভাড়া দিয়ে সামানা নিয়ে যেতে পারবে। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া : ১/১৭০)

যাকাতের মধ্যে কেমন মাল দিবে। ১৮.মাসআলা : যদি সব মাল উত্তম হয়, তাহলে যাকাতের মধ্যে উত্তম মাল দেওয়া উচিত। আর যদি সব মাল খারাপ হয়, তাহলে খারাপ মাল দিবে। আর যদি কিছু মাল উত্তম হয় আর কিছু মাল খারাপ হয়, তাহলে যাকাতের মধ্যে মধ্যম ধরণের মাল দেওয়া উচিত (আদ্দুররুল মুখতার : ২/২৮৭)

হারানো মালের হুকুম। ১৯.মাসআলা : কোন ব্যক্তির নিকট নেসাব পরিমাণ অথবা তার চেয়ে অধিক অলংকার, টাকা- পয়সা, অথবা ব্যবসায়িক মাল ইত্যাদি এক বছর অথবা দুই বছর পর্যন্ত ছিল এবং সে এখন পর্যন্ত যাকাত আদায় করেনি তাহলে তাকে বিগত বছরগুলোর যাকাত আদায় করতে হবে। আর যদি সে মাল নিজে নিজে হারিয়ে যায়, তখন বিগত বছর সমূহের যাকাত রহিত হয়ে যাবে। (আলমগীরী : ১/১১০)

তথ্যসূত্রঃ

যাকাত আদায় করি, দোযখ থেকে বাচি।

লেখকঃমাওলানা মুমিনুল হক জাদীদ, ফেনী

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *