ইবাদত

যুহদ বা দুনিয়াবি বিমুখতার উপকারিতা

যুহদ বা দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ইসলামি আত্মশুদ্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। এটি শুধু আখিরাতের সফলতার জন্যই নয়, বরং দুনিয়াতেও শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনে। একজন ব্যক্তি যখন দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি ত্যাগ করে, তখন তার মন-মানসিকতা, চরিত্র ও ইবাদতের মান আরও উন্নত হয়। নিচে কুরআন, হাদিস ও উলামাদের বক্তব্যের আলোকে যুহদের উপকারিতা তুলে ধরা হলো—

১. আল্লাহর ভালোবাসা অর্জন করা

যুহদ অবলম্বনকারীদের প্রতি আল্লাহ তাআলা বিশেষ অনুগ্রহ করেন এবং তাদের ভালোবাসেন।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন,

“ازْهَدْ فِي الدُّنْيَا يُحِبَّكَ اللَّهُ، وَازْهَدْ فِيمَا فِي أَيْدِي النَّاسِ يُحِبَّكَ النَّاسُ”

“দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের হাতে যা আছে, তার প্রতি অনাসক্ত থাকো, তাহলে মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে।”(ইবনু মাজাহ: ৪১০২, হাসান হাদিস)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি দুনিয়ার মোহ কমিয়ে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করে, আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন।

২. অন্তরের প্রশান্তি ও মানসিক শান্তি লাভ

দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ বাড়ায়। অন্যদিকে, যুহদ অবলম্বনকারী ব্যক্তি কম চাহিদা রাখার কারণে অল্পতেই সুখী হয়।

কুরআনে এসেছে: وَمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَآ إِلَّا مَتَـٰعُ ٱلْغُرُورِ

“এই দুনিয়ার জীবন তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়।”(সূরা আলে ইমরান: ১৮৫)

যে ব্যক্তি এই সত্য বুঝতে পারে, সে দুনিয়ার প্রতি মোহ কমিয়ে দেয় এবং একপ্রকার মানসিক প্রশান্তি লাভ করে।

৩. গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়

দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি মানুষের ঈমান ও আমলের জন্য ক্ষতিকর। দুনিয়ার লোভ ও মোহ অনেক সময় হারাম পথে পরিচালিত করে, যেমন— সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, অন্যের হক নষ্ট করা।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:

“إِنَّ مِمَّا أَخَافُ عَلَيْكُمْ بَعْدِي: مَا يُفْتَحُ عَلَيْكُمْ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا وَزِينَتِهَا”

“আমি আমার পরে তোমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি যে জিনিস নিয়ে আশঙ্কা করি, তা হলো— তোমাদের সামনে দুনিয়ার শোভা ও সৌন্দর্যের দুয়ার উন্মুক্ত হওয়া।” (বুখারি: ১৪৬৫, মুসলিম: ১০৫২)

যে ব্যক্তি যুহদ অবলম্বন করে, সে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকায় সহজ হয়।

৪. আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা তৈরি হয়

যুহদ অবলম্বনকারী ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি আসক্ত না হয়ে আল্লাহর উপর নির্ভর করে। ফলে তার তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা) বৃদ্ধি পায়।

কুরআনে আল্লাহ বলেন: “وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُۥ ۚ”

“যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।” (সূরা আত-তালাক: ৩)

যুহদ ব্যক্তি দুনিয়ার মোহ ও দুশ্চিন্তা পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভর করে, যার ফলে তার জীবন সহজ ও প্রশান্ত হয়।

৫. মানুষ তাকে ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে

যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি লোভী হয় না এবং মানুষের সম্পদের প্রতি লালসা দেখায় না, তাকে মানুষ ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যুহদ অবলম্বন করো, তাহলে মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।”_ (ইবনু মাজাহ: ৪১০২)

যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি আসক্ত নয়, সে কারো সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না এবং কারো হক নষ্ট করে না। ফলে সমাজে তার অবস্থান উচ্চতর হয়।

৬. আখিরাতের সফলতা অর্জন করা

যুহদ অবলম্বনকারী ব্যক্তি তার দুনিয়ার জীবনকে আখিরাতের জন্য প্রস্তুত করার কাজে ব্যস্ত রাখে। ফলে সে আখিরাতে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা লাভ করে।

আল্লাহ বলেন: “وَٱلْـَٔاخِرَةُ خَيْرٌۭ وَأَبْقَىٰ”

“আখিরাতই উত্তম এবং স্থায়ী।” (সূরা আল-আলা: ১৭)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “الدُّنْيَا سِجْنُ الْمُؤْمِنِ وَجَنَّةُ الْكَافِرِ”

“দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার এবং কাফিরের জন্য জান্নাত।” (মুসলিম: ২৯৫৬)

৭. চরিত্রের উন্নতি ঘটে ও অহংকার দূর হয়

যুহদ ব্যক্তি অহংকার, আত্মতুষ্টি ও দুনিয়াবি প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত থাকে। ফলে তার চরিত্র উন্নত হয়।

ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন, “যুহদ হলো— দুনিয়ার প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা এবং আল্লাহর জন্য বিনম্র থাকা।”

(মাজমু‘আ আল-ফাতাওয়া, ১০/৫৭৭)

যে ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হয়, তার মধ্যে বিনয় ও ধৈর্য সৃষ্টি হয় এবং অহংকার দূর হয়।

উপসংহার

যুহদ অবলম্বন করা মানে দুনিয়া সম্পূর্ণ ত্যাগ করা নয়, বরং দুনিয়ার প্রতি অন্তরের মোহ কমানো এবং আখিরাতকে প্রধান লক্ষ্য বানানো। এটি ব্যক্তির আত্মিক ও মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি করে, গুনাহ থেকে বাঁচায় এবং আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের মাধ্যম হয়। দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি মানুষকে গাফিল করে, কিন্তু যুহদ তাকে আল্লাহমুখী ও সফল করে তোলে।

তাই, প্রকৃত মুমিনের উচিত দুনিয়ার প্রতি সীমিত আসক্তি রেখে আখিরাতের সফলতার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

সংকলক:

মুফতি রাশেদুল ইসলাম

ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *