ইবাদত

যুহদের শাব্দিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা এবং প্রকারভেদ

যুহদের শাব্দিক সংজ্ঞা

যুহদ (الزهد) শব্দটি আরবি “زهد” ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার শাব্দিক অর্থ হলো বিমুখ হওয়া, উদাসীনতা প্রদর্শন করা এবং গুরুত্ব না দেওয়া। এটি সাধারণত কোনো কিছুকে গুরুত্ব না দেওয়া বা তার প্রতি অনাসক্ত থাকার অর্থে ব্যবহৃত হয়।

আরবী ভাষার প্রসিদ্ধ অভিধানসমূহে যুহদের অর্থ:

লিসানুল আরব: “যুহদ হলো দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও বিমুখতা।”

মুজাম মাকায়িসুল লুগাহ: “যুহদ এমন অবস্থাকে বোঝায়, যখন কোনো ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং আখিরাতের প্রতি মনোযোগ দেয়।”

যুহদের পারিভাষিক সংজ্ঞা

ইসলামি পরিভাষায় যুহদ বলতে দুনিয়ার প্রতি অতি আসক্তি ত্যাগ করা, আখিরাতের প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া এবং দুনিয়ার বিলাসিতাকে মূল লক্ষ্য না বানানো বোঝায়। তবে এর অর্থ এই নয় যে, বৈধ সম্পদ উপার্জন করা বা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ; বরং দুনিয়ার প্রতি অতি মোহ পরিহার করে আল্লাহ ও আখিরাতের সফলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়াই প্রকৃত যুহদ।

কুরআনে যুহদ প্রসঙ্গে:

আল্লাহ বলেন,

ذَٰلِكَ ٱلدَّارُ ٱلْـَٔاخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِى ٱلْأَرْضِ وَلَا فَسَادًۭا ۚ وَٱلْعَٰقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ

“এ পরকালীন আবাস তো আমি তাদের জন্য নির্ধারণ করি, যারা পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠত্ব ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না এবং সৎ পরিণাম তো মুত্তাকিদের জন্যই।” (সুরা আল-কাসাস: ৮৩)

উলামাদের সংজ্ঞা

১. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (রহ.) বলেন:

“যুহদ হলো— যা হারিয়েছো তার প্রতি দুঃখ না করা এবং যা পেয়েছো তার কারণে আনন্দিত না হওয়া।”(ইবনুল জাওজি, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃ. ১৬৭; ইবন রজব, জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম, হাদিস ১৯-এর ব্যাখ্যা)

২. ইবনু তাইমিয়া (রহ.) বলেন:

“যুহদ হলো— হারাম বস্তু বর্জন করা, অপ্রয়োজনীয় বিষয় থেকে বিরত থাকা এবং আখিরাতকে দুনিয়ার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া।”(মাজমূআ’ আল-ফাতাওয়া, ১০/৫৭৭)

৩. ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন:

“যুহদ তিন প্রকার— ১) হারাম থেকে বিরত থাকা, ২) অপ্রয়োজনীয় বিষয় পরিহার করা, ৩) দুনিয়ার প্রতি হৃদয়ের আসক্তি দূর করে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা।”(মাদারিজুস সালিকীন, ২/১০)

যুহদের প্রকারভেদ

যুহদ সাধারণত তিন প্রকারে বিভক্ত করা হয়:

১. ফরয যুহদ (অবশ্যক যুহদ)

এটি সেই যুহদ যা পালন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য আবশ্যক (ফরয)। এর অন্তর্ভুক্ত—

  • হারাম থেকে বিরত থাকা: যেমন সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, মদ্যপান ইত্যাদি পরিত্যাগ করা।
  • সকল প্রকার পাপাচার থেকে বেঁচে থাকা: যেমন অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করা, মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা।
  • আখিরাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া: অর্থাৎ দুনিয়ার লাভের জন্য ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘন না করা।

قَالَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : “اتَّقِ الْمَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ

“হারাম থেকে বেঁচে থাকো, তাহলে তুমি সর্বোত্তম ইবাদতকারী হবে।” (তিরমিজি: ২৩১৮, সহিহ হাদিস)

২. মন্দ থেকে বেঁচে থাকার জন্য যুহদ (অতিরিক্ত যুহদ)

এটি এমন যুহদ যা ফরয নয়, তবে এটি অবলম্বন করলে ব্যক্তির ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি পায়। এর অন্তর্ভুক্ত—

  • অতিরিক্ত সম্পদ ও বিলাসিতা থেকে দূরে থাকা: হালাল হলেও অপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকে বিরত থাকা।
  • অপ্রয়োজনীয় দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে ইবাদতে বেশি মনোযোগী হওয়া।
  • অহেতুক সময় অপচয় না করা এবং বিনোদনের নামে গুনাহে লিপ্ত না হওয়া।

প্রমাণ:

قَالَ:النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ**”ازْهَدْ فِي الدُّنْيَا يُحِبَّكَ اللَّهُ، وَازْهَدْ فِيمَا فِي أَيْدِي النَّاسِ يُحِبَّكَ النَّاسُ”**

“দুনিয়ার প্রতি যুহদ অবলম্বন করো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন। আর মানুষের হাতে যা আছে, তার প্রতি অনাসক্ত থাকো, তাহলে মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।”(ইবনু মাজাহ: ৪১০২, হাসান হাদিস)

৩. উচ্চ পর্যায়ের যুহদ (সুন্নাত পর্যায়ের যুহদ)

এটি সবচেয়ে উচ্চস্তরের যুহদ, যা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও সাহাবারা অনুসরণ করতেন। এর অন্তর্ভুক্ত—

  • দুনিয়ার প্রতি অন্তরের মোহ সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা।
  • সাধারণ জীবনে সন্তুষ্ট থাকা, অতি বিলাসিতা এড়িয়ে চলা।
  • সবসময় আল্লাহর স্মরণ ও আখিরাতের চিন্তায় নিমগ্ন থাকা।

“وَمَا ٱلْحَيَوٰةُ ٱلدُّنْيَآ إِلَّا مَتَـٰعُ ٱلْغُرُورِ”

“এই দুনিয়ার জীবন তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া কিছুই নয়।” (সুরা আলে ইমরান: ১৮৫)

উপসংহার:

যুহদ মানে দুনিয়া সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা নয়, বরং দুনিয়াকে অন্তরে স্থান না দিয়ে, আখিরাতকে মুখ্য হিসেবে গ্রহণ করা। প্রকৃত যুহদ হলো দুনিয়ার প্রতি অন্তরের আসক্তি ত্যাগ করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য বানানো। এটি ইসলামি আত্মশুদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা মানুষকে তাকওয়া ও ইখলাসের উচ্চতায় নিয়ে যায়।

সংকলক:

মুফতি রাশেদুল ইসলাম

ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *