যুহদের বাস্তব চিত্র ও কিছু উদাহরণ
যুহদ মানে দুনিয়া পুরোপুরি ত্যাগ করা নয়, বরং দুনিয়ার প্রতি অন্তরের মোহ ও আসক্তি কমিয়ে আখিরাতকে মূল লক্ষ্য বানানো। ইসলামের ইতিহাসে বহু ব্যক্তি বাস্তবে যুহদের চিত্র তুলে ধরেছেন, যারা দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত থেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবনযাপন করেছেন। নিচে যুহদের কিছু বাস্তব চিত্র ও উদাহরণ তুলে ধরা হলো—
১. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবনযাত্রা
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ছিলেন দুনিয়ার সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তি, কিন্তু তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন।
খাদ্যে সংযম
হযরত আয়িশা (রা.) বলেন: “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কখনো একটানা তিন দিন পেট ভরে রুটি খাননি, যতক্ষণ না তিনি দুনিয়া ছেড়ে চলে যান।”_(বুখারি: ৫৪১৬, মুসলিম: ২৯৭০)
বাস্তব চিত্র: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দুনিয়ার বিলাসিতা গ্রহণ না করে সহজ জীবনযাপন করেছেন, যদিও চাইলে রাজকীয় জীবন বেছে নিতে পারতেন।
বিছানার সরলতা
হযরত উমর (রা.) একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ঘরে এলেন এবং দেখলেন যে তিনি খেজুর পাতার বিছানায় শুয়ে আছেন, যার ফলে শরীরে দাগ পড়ে গেছে।উমর (রা.) কাঁদতে লাগলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: “উমর! তুমি কি এই ব্যাপারে সন্তুষ্ট নও যে, আমাদের জন্য আখিরাত আর তাদের জন্য দুনিয়া?” (মুসলিম: ১৪৭৯)
বাস্তব চিত্র: রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জানতেন যে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী, তাই তিনি বিলাসবহুল জীবন গ্রহণ করেননি।
২. হযরত আবু বকর (রা.)-এর যুহদ
হযরত আবু বকর (রা.) ছিলেন ইসলামের প্রথম খলিফা, কিন্তু তার জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সাধারণ।
সম্পদের প্রতি অনাসক্তি
খলিফা হওয়ার পরও তিনি নিজ হাতে ব্যবসা করতেন। কিন্তু যখন সরকারি তহবিল থেকে সামান্য ভাতা নির্ধারণ করা হলো, তখন তিনি সেটাকেও ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য বলেছিলেন।
মৃত্যুর আগে তিনি বলে যান: “আমার জন্য যে সামান্য ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা আমার সম্পদ থেকে রাষ্ট্রের তহবিলে ফেরত দিয়ে দিও।”_ (তারিখুল ইসলাম, ইমাম যাহাবি, ১/৩০৮)
বাস্তব চিত্র: ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্থানে গিয়েও তিনি যুহদ অবলম্বন করেছেন এবং দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হননি।
৩. হযরত উমর (রা.)-এর সরল জীবন
হযরত উমর (রা.)-এর খেলাফতের সময় মুসলিম সাম্রাজ্য বিশাল হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ জীবনযাপনের অধিকারী।
পোশাক ও খাদ্য
তার পোশাক সাধারণ ছিল, এমনকি জামার মধ্যে প্যাচ লাগানো থাকত। একদিন তিনি বলেন: “যদি আমি ভরপেট খাই, তবে আমার অন্তর নরম থাকবে না।”_
বাস্তব চিত্র: তিনি ছিলেন সবচেয়ে ক্ষমতাবান শাসকদের একজন, কিন্তু জীবনযাপন ছিল এক দরবেশের মতো।
৪. হযরত আলী (রা.)-এর যুহদ
হযরত আলী (রা.) ইসলামের চতুর্থ খলিফা ছিলেন, কিন্তু তার জীবন ছিল একেবারে সাধাসিধে।
অতি সাধারণ খাবার ও পোশাক
তিনি বলতেন: “আমি যদি চাই, তবে সবচেয়ে ভালো খাবার খেতে পারি, কিন্তু আমি চাই না। আমি চাই, আমার অন্তর দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত থাকুক।”_ (নহজুল বালাগা, খুতবা ৪৫)
বাস্তব চিত্র: তিনি সহজ খাবার খেতেন, সাধারণ পোশাক পরতেন এবং রাজকীয় জীবন থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন।
৫. হযরত হাসান বসরি (রহ.)-এর যুহদ
ইসলামের অন্যতম প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হাসান বসরি (রহ.) ছিলেন দুনিয়ার প্রতি সম্পূর্ণ অনাসক্ত একজন আলেম।
বিলাসিতা পরিত্যাগ
তিনি বলতেন: “দুনিয়া এমন এক সেতু, যা তোমাকে আখিরাতে পৌঁছে দেবে। কাজেই, এ সেতুতে বসতি গড়ো না, বরং এটাকে পার হও।”_ (হিলিয়াতুল আওলিয়া, ২/১৩৫)
বাস্তব চিত্র: তিনি সম্পদ ও ক্ষমতা প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সর্বদা আখিরাতের চিন্তায় জীবনযাপন করেছেন।
৬. ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর যুহদ
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী, কিন্তু তার অন্তর ছিল দুনিয়ার মোহমুক্ত।
হারাম সম্পদ গ্রহণ না করা
একবার এক ব্যবসায়ী তার কাছে কাপড় নিয়ে এলো, যার মধ্যে সামান্য ত্রুটি ছিল। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ত্রুটিযুক্ত কাপড় জানিয়ে সস্তা দামে বিক্রি করলেন, অথচ চাইলে মিথ্যা বলে বেশি দামে বিক্রি করতে পারতেন।
বাস্তব চিত্র: তিনি ব্যবসা করতেন, কিন্তু কখনো হারাম পথে উপার্জন করতেন না এবং দুনিয়ার প্রতি মোহী হতেন না।
উপসংহার
যুহদের প্রকৃত অর্থ হলো— দুনিয়ার প্রতি অন্তরের মোহ কমিয়ে আখিরাতের দিকে মনোনিবেশ করা। ইসলামের ইতিহাসে অনেক মহান ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত থেকে সত্যিকারের যুহদের উদাহরণ স্থাপন করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে শুরু করে খলিফারা এবং বিখ্যাত উলামাগণ যুহদের বাস্তব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
আমাদেরও উচিত দুনিয়ার প্রতি অন্ধ মোহ না দেখিয়ে আখিরাতের সফলতার দিকে মনোযোগ দেওয়া, কারণ সত্যিকারের সফলতা দুনিয়ায় নয়, বরং আখিরাতে।
সংকলক:
মুফতি রাশেদুল ইসলাম
ইফতা: জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকা,মসজিদুল আকবর কমপ্লেক্স