ইবাদত

ইখলাছ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা

সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক। দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক নবী ও রাসূলকুলের শ্রেষ্ঠজন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ), তাঁর পরিবারবর্গ ও ছাহাবীদের সকলের প্রতি।

অতঃপর মহান আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমার পক্ষে অন্তরের আমল সমূহ (أعمال القلوب) বিষয়ে বারটি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রাখার সুযোগ হয়েছিল। এই আলোচনাগুলো তৈরীতে যাদ গ্রুপের একদল চৌকস জ্ঞানী-গুণী আমাকে সহযোগিতা করেছে। আজ তা ছাপার অক্ষরে বের হ’তে যাচ্ছে।

অন্তরের এই আমল সমূহের প্রথমেই রয়েছে ‘ইখলাছ’। ইখলাছই সকল ইবাদতের সার ও প্রাণ। কোন ইবাদত কবুল হওয়া না হওয়া ইখলাছের উপর নির্ভর করে। এটি অন্তরের আমল সমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সবার উপরে এবং সকলের মূলভিত্তি। যুগে যুগে আগত নবী-রাসূলদের দাওয়াতের চাবিকাঠি ছিল ইখলাছ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে। (বাইয়েনাহ ৯৮/৫)

তিনি আরও বলেন,أَلاَ لِلَّهِ الدِّيْنُ الْخَالِصُ، ‘সাবধান, খালেছ দ্বীন বা ইবাদত কেবল আল্লাহর’ (যুমার ৩৯/৩)

আমাদের নিয়ত খালেছ হোক, আমাদের মন পাপের কালিমা মুক্ত হোক এবং আমাদের আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হোক মহান আল্লাহর দরবারে আমাদের এটাই বিনীত প্রার্থনা। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও দো‘আ কবুলকারী।

আভিধানিক অর্থে ইখলাছ :

ইখলাছ শব্দটি আরবী أَخْلَصَ ক্রিয়া থেকে গঠিত। এর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়াবাচক শব্দ يُخْلِصُ এবং মাছদার বা ক্রিয়ামূল إخْلاَصًا। যার অর্থ কোন জিনিস পরিশুদ্ধ করা, অন্য কোন কিছুর সাথে তাকে না মেশানো। আরবীতে أَخْلَصَ الرَّجُلُ دِيْنَهُ لِلّهِ অর্থাৎ লোকটি তার দ্বীনকে শুধুই আল্লাহর জন্য নির্ভেজাল করেছে; তার দ্বীনের মধ্যে আল্লাহর সাথে আর কাউকে মেশায়নি।

আল্লাহ বলেন, إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ ‘তবে তাদের মধ্য থেকে তোমার নির্বাচিত বান্দারা ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৪০)

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ছা‘লাব (রহঃ) বলেছেন, আল-মুখলিছীন তারাই যারা নির্ভেজালভাবে আল্লাহর জন্য ইবাদত

করে। আর আল-মুখলাছীন তারা, যাদেরকে আল্লাহ খালেছ, নির্ভেজাল ও নিষ্কলুষ করেছেন।

আল্লাহর বাণী,وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ مُوسَى إِنَّهُ كَانَ مُخْلَصًا- ‘তুমি এই কিতাবে মূসার বৃত্তান্ত বর্ণনা কর। নিশ্চয়ই সে ছিল নির্বাচিত’ (মারিয়াম ১৯/৫১)। এখানে ‘মুখলাছ’ শব্দ সম্পর্কে যুজাহ বলেছেন, মুখলাছ সেই, যাকে আল্লাহ খালেছ করেছেন; সকল আবিলতা বা পাপ থেকে তাকে মুক্ত করেছেন। আর মুখলিছ সেই, যে নিরেট নির্ভেজালভাবে আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহীদে বিশ্বাসী। এজন্য (قُلْ هُوَ اللهُ أَحَدٌ) সূরাকে সূরাতুল ইখলাছ বলা হয়।

ইবনুল আছীর (রহঃ) বলেছেন, এই সূরা ইখলাছে নির্ভেজালভাবে কেবলই মহামহিম আল্লাহর গুণ বর্ণিত হয়েছে। তাই সূরাটির নাম হয়েছে ইখলাছ। অথবা এই সূরাটি পড়ে সে খালেছ বা নির্ভেজালভাবে আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি দেয় বলে সূরাটির নাম ইখলাছ। কালেমায়ে তাওহীদকে এজন্য ‘কালেমায়ে ‘ইখলাছ’ও বলা হয়।

আবার খালেছ জিনিস (الشيئ الخالص) বলতে,الصّافِي الَّذِيْ زَالَ عَنْهُ شَوْبُه الَّذِيْ كانَ فِيْه- ‘খাঁটি জিনিসকে বুঝায়, যার থেকে সব রকম মিশ্রণ দূরীভূত করা হয়েছে’।ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ৭/২৬; তাজুল ‘আরাস, পৃঃ ৪৪৩৭

আল্লামা ফীরোযাবাদী (রহঃ) বলেছেন, أَخْلَصَ لِلَّهِ: تَرَكَ الرِّياءَ ‘লৌকিকতা বর্জন করে কোন কাজ আল্লাহর জন্য করা’।ফীরোযাবাদী, আল-কামূসুল মুহীত্ব, পৃঃ ৭৯৭

জুরজানী (রহঃ) বলেছেন, الإخلاص في اللغة ترك الرياء في الطاعات ‘আভিধানিক অর্থে ইখলাছ হ’ল, সৎকাজে লৌকিকতা পরিহার করা’।জুরজানী, আত-তা‘রীফাত, পৃঃ ২৮

পারিভাষিক অর্থে ইখলাছ :

আলেমগণ ইখলাছের বেশ কয়েকটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে প্রদত্ত হ’ল :

ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন,الإخلاص : هو إفراد الحق سبحانه بالقصد في الطاعة- ‘স্বেচ্ছায় একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইবাদত নিবেদনকে ইখলাছ বলে’।ইবনুল ক্বাইয়িম, মাদারিজুস সালিকীন, ২/৯১ পৃঃ

জুরজানী (রহঃ) বলেছেন, ‘অন্তরকে পরিস্কার করার জন্য সকল দূষিত পদার্থের মিশ্রণ থেকে মুক্ত করা। বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- প্রত্যেক বস্তুর সাথেই কোন না কোন কিছু মিশে আছে বলে ধারণা করা হয়। সুতরাং যখন তা মিশ্রণ থেকে পরিস্কার ও মুক্ত হয় তখন তাকে ‘খালেছ’ বা খাঁটি বলে। আবার পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত কাজকে বলে ইখলাছ।

আল্লাহ বলেছেন,نُسْقِيكُمْ مِمَّا فِيْ بُطُوْنِهِ مِنْ بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ لَبَنًا خَالِصًا سَائِغًا لِلشَّارِبِيْنَ- ‘আমরা তোমাদেরকে তাদের থেকে বিশুদ্ধ দুধ পান করাই, যা পানকারীদের জন্য অতীব উপাদেয়। যা নিঃসৃত হয় উক্ত পশুর উদরস্থিত গোবর ও রক্তের মধ্য হ’তে’ (নাহল ১৬/৬৬)। এখানে দুধের নির্ভেজালতা বা পিওরিটি অর্থ- তাতে গোবর ও রক্তের মিশ্রণ না থাকা।আত-তা‘রীফাত, পৃঃ ২৮

কেউ কেউ বলেছেন,الإخلاص تصفية الأعمال من الكدورات، ‘আমল বা কাজকে দূষণমুক্ত করাই ইখলাছ’।

হুযায়ফা আল-মার‘আশী (রহঃ) বলেছেন,الإخلاص استواء أفعال العبد في الظاهر والباطن- ‘বান্দার কাজ ভেতর-বাহির থেকে এক রকম হওয়াকে ইখলাছ বলে’।ইবনুল ক্বাইয়িম, আত-তিবইয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআন, পৃঃ ১৩

কেউ কেউ বলেছেন, الإخلاص أن لا تطلب على عملك شاهدا غير الله ولا مجازيا سواه- ‘নিজের আমলের উপর আল্লাহ ছাড়া কাউকে সাক্ষী এবং প্রতিদানদাতা হিসাবে না মানার নাম ইখলাছ’।মাদারিজুস সালিকীন ২/৯২

সালাফে ছালেহীন থেকে ইখলাছের আরো কিছু অর্থ বর্ণিত হয়েছে। যেমন- (১) আমল শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হবে, তাতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের কোন অংশ থাকবে না। (২) সৃষ্টিকুলের মনঃস্ত্তষ্টি সাধন থেকে আমলকে মুক্ত করা। (৩) সবরকম কলুষ-কালিমা থেকে আমলকে মুক্ত রাখা।

আর মুখলেছ সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর সঙ্গে তার আন্তরিক সম্পর্ক তৈরী হওয়ার কারণে জনগণের অন্তরে তার প্রতি যত রকম শ্রদ্ধা-ভক্তি জন্মে সে তার কোন পরোয়া করে না এবং তার আমলের বিন্দু-বিসর্গও মানুষ টের পাক তা সে পসন্দ করে না। শরী‘আতে যেমন তেমনি মানুষের কথাতেও বহু ক্ষেত্রে ইখলাছের স্থলে নিয়ত শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

ফকীহদের মতে নিয়ত হ’ল ইবাদতকে অভ্যাস থেকে এবং এক ইবাদতকে অন্য ইবাদত থেকে পৃথক করা।ইবনু রজব, জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১/১১ পৃঃ।

ইবাদতকে অভ্যাস থেকে আলাদা করার উদাহরণ যেমন দেহ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করার জন্য গোসল একটি অভ্যাসমূলক আমল। অপরদিকে জানাবাত বা দৈহিক অপবিত্রতা জনিত গোসল ইবাদতমূলক আমল। এখানে জানাবাতের গোসলের নিয়ত করলে তা অভ্যাসমূলক গোসল থেকে পৃথক হয়ে যাবে।

আবার এক ইবাদত থেকে অন্য ইবাদত পৃথক করার উদাহরণ যেমন, যোহর ছালাত থেকে আছর ছালাত পৃথক করা। উক্ত সংজ্ঞানুসারে নিয়ত ইখলাছের অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু যখন শর্তহীন ভাবে নিয়ত শব্দ উল্লেখ করা হবে এবং তা দ্বারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত ইবাদতকে পৃথক করা বুঝাবে যেমন ইবাদত কি অংশীদারমুক্ত এক আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে নাকি অন্যের উদ্দেশ্যে- তখন অবশ্য নিয়ত ইখলাছের অর্থে আসবে।

ইবাদতে ইখলাছ আর ইবাদতে সত্য উভয়ই কাছাকাছি অর্থবোধক। অবশ্য উভয়ের মধ্যে কিছু তফাৎও রয়েছে। প্রথম পার্থক্য : সত্য মূল এবং ইখলাছ তার শাখা ও অনুগামী। দ্বিতীয় পার্থক্য : কাজে মশগূল না হওয়া পর্যন্ত ইখলাছ আছে কি-না তা বুঝা যায় না। কিন্তু কাজে নামার আগেও কখনো কখনো সত্য উদ্ভাসিত হয়।আত-তা‘রীফাত, পৃঃ ২৮

ইখলাছ অবলম্বনের আদেশ

ইখলাছ সম্পর্কে আল্লাহর বাণী :

আল্লাহ তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে তাঁর বান্দাদেরকে ইখলাছ অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন,وَمَا أُمِرُوْا إِلاَّ لِيَعْبُدُوْا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَاءَ، ‘অথচ তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা খালেছ অন্তরে একনিষ্ঠভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৫)

নবী করীম (ছাঃ) নিজে যে ইখলাছের সাথে আল্লাহর ইবাদত করে থাকেন সে কথা মানুষকে জানিয়ে দিতে তিনি তাঁকে আদেশ দিয়েছেন। এ মর্মে তিনি বলেন,قُلِ اللهَ أَعْبُدُ مُخْلِصًا لَهُ دِيْنِيْ- ‘বল, আমি আল্লাহর ইবাদত করি তাঁর জন্য আমার আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করার মাধ্যমে’ (যুমার ৩৯/১৪)

তিনি আরো বলেন,قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ- لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ- ‘বল, আমার ছালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ, সবই বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই। আর এ ব্যাপারেই (অর্থাৎ শরীক না করার ব্যাপারে) আমি আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম’ (আন‘আম ৬/১৬২-১৬৩)

আল্লাহ নিজে জন্ম-মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন, মানুষের মাঝে কে অধিকতর ভাল কাজ করে তা দেখার জন্য। তিনি বলেছেন, الَّذِيْ خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً وَهُوَ الْعَزِيْزُ الْغَفُوْرُ- ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে। আর তিনি মহা পরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (মুল্ক ৬৭/২)

ফুযায়েল বিন ইয়ায (রহঃ) সুন্দর আমল সম্পর্কে বলেছেন, সুন্দর আমল তাই যা অধিকমাত্রায় ইখলাছপূর্ণ এবং অধিকমাত্রায় সঠিক। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আবু আলী! অধিকমাত্রায় ইখলাছপূর্ণ এবং অধিকমাত্রায় সঠিক আমল কী? তিনি বললেন, আমল ইখলাছপূর্ণ হ’লেও যদি সঠিক নিয়মে না হয়, তবে তা কবুল হবে না; আবার সঠিক নিয়মে হ’লেও যদি ইখলাছপূর্ণ না হয় তবে তাও কবুল হবে না। ইখলাছপূর্ণ ও সঠিক হ’লেই কেবল তা কবুল হবে। যা আল্লাহর জন্য করা হয় তাই ইখলাছপূর্ণ এবং যা সুন্নাত অনুযায়ী হয় তাই সঠিক।

ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) তাঁর কথার সাথে যোগ করে বলেছেন, এ যেন ঠিক আল্লাহর বাণী,فَمَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحًا وَلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا- ‘অতএব যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে’ (কাহফ ১৮/১১০)-এর প্রতিধ্বনি।মাজমূ ফাতাওয়া ১/৩৩৩

কবি আমীর ছান‘আনী বলেছেন, তোমার জীবনের সময়গুলো কেটে গেছে আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া। তুমিতো তোমার মনপসন্দ কাজে বিভোর ছিলে- যা কিনা শুধুই মরীচিকা। যখন তোমার কাজ শুধুই আল্লাহর জন্য না হবে তখন যত কিছুই তুমি বানাও না কেন তা সবই বরবাদ হবে। আমল কবুলের জন্য ইখলাছ থাকা শর্ত, সে সঙ্গে তা হ’তে হবে কুরআন ও সুন্নাহ মাফিক।

মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য ইহসানের পথে নিবেদিত আমলকে সর্বোত্তম দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন,وَمَنْ أَحْسَنُ دِيْنًا مِمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ، ‘তার চাইতে উত্তম দ্বীন কার আছে, যে তার চেহারাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সমর্পণ করেছে ও সৎকর্ম করেছে’ (নিসা ৪/১২৫)। আল্লাহর কাছে সমর্পণ হ’ল ইখলাছ আর ইহসান বজায় রাখা অর্থ সুন্নাতের অনুসরণ।

আল্লাহ তাঁর নবীকে এবং সেই সাথে তাঁর উম্মতকে মুখলেছ বান্দাদের সাথে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَهُ، ‘আর তুমি নিজেকে ধরে রাখো তাদের সাথে যারা সকালে ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে আহবান করে তাঁর চেহারা কামনায়’ (কাহফ ১৮/২৮)

যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কাজ করে তিনি তাদের সফল বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন,فَآتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ ذَلِكَ خَيْرٌ لِلَّذِيْنَ يُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ- ‘অতএব নিকটাত্মীয়কে তার প্রাপ্য দিয়ে দাও এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকে। এটা তাদের জন্য উত্তম, যারা আল্লাহর চেহারা কামনা করে। আর তারাই হ’ল সফলকাম’ (রূম ৩০/৩৮)

ইখলাছওয়ালাদের প্রতি আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন সন্তুষ্ট থাকার এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন,وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى- الَّذِيْ يُؤْتِيْ مَالَهُ يَتَزَكَّى- وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِعْمَةٍ تُجْزَى- إِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى-وَلَسَوْفَ يَرْضَى- ‘সত্বর এ থেকে দূরে রাখা হবে আল্লাহভীরু ব্যক্তিকে। যে তার ধন-সম্পদ দান করে আত্মশুদ্ধির জন্য এবং কারু জন্য তার নিকটে কোনরূপ অনুগ্রহ থাকে না যা প্রতিদান যোগ্য। কেবলমাত্র তার মহান পালনকর্তার চেহারা অন্বেষণ ব্যতীত। আর অবশ্যই সে অচিরেই সন্তোষ লাভ করবে’  (লায়েল ৯২/১৭-২১)

আল্লাহ জান্নাতবাসীদের গুণাবলী বলতে গিয়ে দুনিয়াতে তাদের ইখলাছ অবলম্বনের কথা বলেছেন। আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لاَ نُرِيْدُ مِنْكُمْ جَزَاءً وَلاَ شُكُوْرًا- ‘(এবং তারা বলে) শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমরা তোমাদের খাদ্য দান করে থাকি এবং তোমাদের নিকট থেকে আমরা কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না’ (দাহর ৭৬/৯)

তিনি ইখলাছ ওয়ালাদের পরকালে মহাপুরস্কার দানের ঘোষণা দিয়ে বলেন, لاَ خَيْرَ فِيْ كَثِيْرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلاَّ مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوْفٍ أَوْ إِصْلاَحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيْهِ أَجْرًا عَظِيْمًا- ‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন মঙ্গল নেই। কিন্তু যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের  উদ্দেশ্যে সেটা করে, সত্বর আমরা তাকে মহা পুরস্কার দান করব’ (নিসা ৪/১১৪)

তিনি আরও বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِيْ حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيْبٍ- ‘যে কেউ পরকালের ফসল কামনা করে, আমরা তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি ইহকালের ফসল কামনা করে, আমরা তাকে সেখান থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু পরকালে তার কোনই অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)

ইখলাছ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী :

নবী করীম (ছাঃ) ইখলাছের গুরুত্ব ও নিয়তে সততার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি এ দু’য়ের উপর সকল আমলের ভিত্তি রেখেছেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، ‘নিশ্চয়ই প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পায়’।বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদীছ। কেননা এতে শরী‘আতের এমন একটি মূলনীতি বিধৃত হয়েছে যার আওতায় সকল ইবাদত এসে পড়ে। কোন ইবাদতই তার থেকে বাদ যায় না। সুতরাং ছালাত, ছিয়াম, জিহাদ, হজ্জ, যাকাত, দান-ছাদাক্বা ইত্যাদি প্রত্যেক ইবাদত সৎ নিয়ত ও ইখলাছের মুখাপেক্ষী। রাসূল (ছাঃ) মানুষের জন্য শুধু এই মূলনীতি বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তিনি বেশ কিছু আমলও উল্লেখ করেছেন এবং তাতে নিয়তের গুরুত্ব হেতু তা বিশুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এমন কিছু আমল নিম্নে তুলে ধরা হ’ল-

তাওহীদ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,مَا قَالَ عَبْدٌ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ قَطُّ مُخْلِصًا إِلاَّ فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ حَتَّى تُفْضِىَ إِلَى الْعَرْشِ مَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ-

‘যে ব্যক্তি একনিষ্ঠচিত্তে ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’ বলবে, তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হবে। এমনকি আরশ পর্যন্ত এর নেকী পৌঁছানো হবে; যদি সে কাবীরা গোনাহ সমূহ থেকে বিরত থাকে’।তিরমিযী  হা/৩৫৯০; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৬৪৮, সনদ হাসান

মসজিদে যাওয়া :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,صَلاَةُ الرَّجُلِ فِى الْجَمَاعَةِ تُضَعَّفُ عَلَى صَلاَتِهِ فِىْ بَيْتِهِ وَفِىْ سُوقِهِ خَمْسًا وَعِشْرِيْنَ ضِعْفًا، وَذَلِكَ أَنَّهُ إِذَا تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ، ثُمَّ خَرَجَ إِلَى الْمَسْجِدِ لاَ يُخْرِجُهُ إِلاَّ الصَّلاَةُ، لَمْ يَخْطُ خَطْوَةً إِلاَّ رُفِعَتْ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ، وَحُطَّ عَنْهُ بِهَا خَطِيْئَةٌ، فَإِذَا صَلَّى لَمْ تَزَلِ الْمَلاَئِكَةُ تُصَلِّى عَلَيْهِ مَا دَامَ فِى مُصَلاَّهُ اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَيْهِ، اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ. وَلاَ يَزَالُ أَحَدُكُمْ فِى صَلاَةٍ مَا انْتَظَرَ الصَّلاَةَ-

‘ব্যক্তির নিজ বাড়ীতে কিংবা বাজারে ছালাত আদায় অপেক্ষা জামা‘আতে ছালাত আদায়ে ২৫ গুণ বেশী ছওয়াব হয়। কেননা সে যখন উত্তমরূপে ওযূ করে মসজিদ পানে বের হয় এবং ছালাত আদায় ব্যতীত তার অন্য কোন উদ্দেশ্য না থাকে তখন প্রতি পদক্ষেপে তার একটি পদমর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং একটি গোনাহ বিদূরিত হয়। তারপর যখন সে ছালাত শেষ করে তখন ছালাতের স্থানে তার অবস্থান করা অবধি ফেরেশতারা তার জন্য এই বলে দো‘আ করতে থাকে যে, হে আল্লাহ! তাকে তুমি শান্তি দাও এবং তাকে দয়া কর। আর তোমাদের কেউ যতক্ষণ (মসজিদে) জামা‘আতে ছালাতের অপেক্ষায় থাকে ততক্ষণ সে ছালাত আদায়ে রত বলে গণ্য হ’তে থাকে’।বুখারী হা/৬৪৭; মিশকাত হা/৭০২

ছিয়াম :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ-

‘যে ব্যক্তি রামাযানে ঈমানের সাথে ও ছওয়াব লাভের আশায় ছিয়াম পালন করে, তার পূর্ববর্তী গোনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়’।বুখারী হা/৩৮; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮

তিনি আরো বলেন,مَنْ صَامَ يَوْمًا فِى سَبِيلِ اللهِ بَعَّدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِيْنَ خَرِيْفًا- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি ছিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার চেহারাকে জাহান্নামের আগুন হ’তে সত্তর বছরের পথ দূরে রাখবেন’।বুখারী হা/২৮৪০; মুসলিম হা/১১৫৩; মিশকাত হা/২০৫৩

রাতের ছালাত :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ-

‘যে ব্যক্তি রামাযানের রাত্রিতে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রাত্রির ছালাত আদায় করে, তার বিগত সকল গোনাহ মাফ করা হয়’।বুখারী হা/৩৭; মুসলিম হা/৭৫৯; মিশকাত হা/১২৯৬

ছাদাক্বা ও আল্লাহকে স্মরণ :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,

سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ تَعَالَى فِى ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ إِمَامٌ عَادِلٌ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِى عِبَادَةِ اللهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِى الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِى اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّى أَخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ-

‘সাত শ্রেণীর লোকদের আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন তাঁর বিশেষ ছায়ার নিচে স্থান দিবেন। যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না। ১. ন্যায়পরায়ণ শাসক ২. ঐ যুবক যে তার প্রভুর আনুগত্যে যৌবনকে অতিবাহিত করেছে ৩. সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে লটকানো থাকে ৪. সেই দুই ব্যক্তি যারা পরস্পরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ভালবাসে এবং তারা সেকারণে পরস্পরে মিলিত হয় এবং পরস্পর পৃথকও হয়। ৫. সেই ব্যক্তি যাকে কোন সম্ভ্রান্ত বংশের সুন্দরী নারী (ব্যভিচারের জন্য) আহবান করে আর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। ৬. সেই ব্যক্তি যে গোপনে এমনভাবে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করে তা বাম হাত জানে না। ৭. সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দুই চক্ষু অশ্রু বিসর্জন করে’।বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১

জিহাদ :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ غَزَا فِى سَبِيلِ اللهِ وَلَمْ يَنْوِ إِلاَّ عِقَالاً فَلَهُ مَا نَوَى- ‘যে ইকাল (রশি) লাভের আশা ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে জিহাদ করে না তার জন্য তাই মিলবে যার সে নিয়ত করবে’।নাসাঈ হা/৩১৩৮; মিশকাত হা/৩৮৫০

জানাযায় অংশগ্রহণ :

রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنِ اتَّبَعَ جَنَازَةَ مُسْلِمٍ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا، وَكَانَ مَعَهُ حَتَّى يُصَلَّى عَلَيْهَا، وَيَفْرُغَ مِنْ دَفْنِهَا، فَإِنَّهُ يَرْجِعُ مِنَ الأَجْرِ بِقِيرَاطَيْنِ، كُلُّ قِيرَاطٍ مِثْلُ أُحُدٍ، وَمَنْ صَلَّى عَلَيْهَا ثُمَّ رَجَعَ قَبْلَ أَنْ تُدْفَنَ فَإِنَّهُ يَرْجِعُ بِقِيرَاطٍ-

‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় কোন মুসলমানের জানাযার গমন করে এবং তার জানাযার ছালাত আদায় ও দাফন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সঙ্গে থাকে, সে দুই ক্বীরাত ছওয়াব নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। প্রতিটি ক্বীরাত হ’ল ওহোদ পর্বতের মতো। আর যে ব্যক্তি শুধু তার জানাযা আদায় করে, তারপর দাফন সম্পন্ন হবার পূর্বেই চলে আসে, সে এক ক্বীরাত ছওয়াব নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে’।বুখারী হা/৪৭; মিশকাত হা/১৬৫১

পূর্বসূরি মনীষীদের কথা :

বর্ণিত আয়াত ও হাদীছসমূহ অধ্যয়ন করে আমাদের পূর্বসূরিরা ইখলাছের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ইখলাছশূন্যতার কুফল কী এবং ইখলাছ রক্ষায় কী সুফল পাওয়া যায় তা তাঁরা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এজন্য তাঁরা তাঁদের রচনাবলীর শুরুতেই নিয়ত সংক্রান্ত হাদীছ তুলে ধরেছেন। যেমন ইমাম বুখারী (রহঃ) নিম্নোক্ত হাদীছ দ্বারা তাঁর ছহীহ বুখারীর সূচনা করেছেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘নিশ্চয়ই সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১।

আব্দুর রহমান বিন মাহদী (রহঃ) বলেছেন,لَوْ صَنَّفْتُ كِتَابًا فِي الْأَبْوَابِ، لَجَعَلْتُ حَدِيْثَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ فِي الْأَعْمَالِ بِالنِّيَّاتِ فِي كُلِّ بَابٍ- ‘আমি যদি একাধিক অধ্যায় সম্বলিত গ্রন্থ রচনা করতাম তাহ’লে আমি প্রত্যেক অধ্যায়ের সূচনাতে ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বর্ণিত নিয়তের হাদীছটি উল্লেখ করতাম’।জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/৮।

তাঁরা তো কাজের থেকে নিয়তের গুরুত্ব বেশী বলেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু আবু কাছীর বলেছেন, তোমরা কিভাবে নিয়ত করতে হয় তা শেখ। কেননা তা আমলের থেকেও বেশী গুরুত্ব বহন করে।হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/৭০; জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/১৩।

মনীষীগণ সাধারণ লোকদের ইখলাছ শিক্ষাদানের উপর খুব গুরুত্ব দিতেন। ইবনু আবী জামরা (রহঃ) বলেন, আমার মন বলে ফক্বীহদের মধ্যে এমন কেউ হওয়া চাই যার কাজই হবে কেবল লোকদের আমলের উদ্দেশ্য শেখানো। কোন আমলের নিয়ত কী হবে কেবল তা শিক্ষাদানে সে নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রাখবে।কেননা অনেকেই অনেক কিছু পায় বটে, কিন্তু তাদের নিয়ত শুদ্ধ থাকে না।

এর বিপরীতে যারা লোক দেখানো কাজ করে এবং যারা দুনিয়ার সুবিধা লাভের জন্য কাজ করে আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিন্দা করেছেন এবং তাদের পরিণাম কী দাঁড়াবে তা বর্ণনা করেছেন।

আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لاَ يُبْخَسُونَ- أُولَئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلاَّ النَّارُ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘যে ব্যক্তি পার্থিব জীবন ও তার জাঁকজমক কামনা করে, আমরা তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই পূর্ণভাবে দিয়ে দিব। সেখানে তাদেরকে কোনই কমতি করা হবে না’। এরা হ’ল সেইসব লোক যাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নেই। দুনিয়াতে তারা যা কিছু (সৎকর্ম) করেছিল আখেরাতে তা সবটাই বরবাদ হবে এবং যা কিছু উপার্জন করেছিল সবটুকুই বিনষ্ট হবে (বাতিল আক্বীদা ও লোক দেখানো সৎকর্মের কারণে)’ (হূদ ১১/১৫-১৬)

অন্যত্র তিনি বলেছেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيْهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيْدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلاَهَا مَذْمُوْمًا مَدْحُوْرًا- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়া কামনা করে, আমরা সেখানে যাকে যা ইচ্ছা করি দিয়ে দেই। পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি। সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায়’ (ইসরা ১৭/১৮)

তিনি আরও বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِيْ حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيْدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيْبٍ- ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে, আমরা তার ফসল বৃদ্ধি করে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে সেখান থেকে কিছু দেই। কিন্তু আখেরাতে তার জন্য কোনই অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ. قَالُوْا وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ: الرِّيَاءُ، يَقُوْلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِىَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ اذْهَبُوْا إِلَى الَّذِيْنَ كُنْتُمْ تُرَاءُوْنَ فِى الدُّنْيَا فَانْظُرُوْا هَلْ تَجِدُوْنَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً-

‘সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসের ভয় আমি তোমাদের জন্য করি তা হ’ল ছোট শিরক। তারা বললেন, ছোট শিরক কী হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, রিয়া বা লোক দেখানো কাজ। ক্বিয়ামতের দিন যখন মানুষকে তাদের আমলের প্রতিদান দেওয়া হবে, তখন আল্লাহ তাদের বলবেন, তোমরা তাদের কাছে যাও, দুনিয়াতে তোমরা যাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আমল করতে। দেখ তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কি-না’।আহমাদ হা/২৩৬৮০, ২৩৬৮৬; মিশকাত হা/৫৩৩৪; ছহীহ আত-তারগীব হা/৩২।

সুতরাং হে আমার মুসলিম ভাই-বোন! আপনি নিজের জন্য উল্লিখিত দু’টি পন্থার একটি নির্বাচন করুন। হয় আল্লাহর জন্য ইখলাছ ও তাঁর সন্তোষ লাভের জন্য ইবাদত হবে, নয় রিয়া বা লোক দেখানো কাজ ও দুনিয়ার স্বার্থ থাকবে। আপনি আরও জেনে রাখুন, মানুষ তাদের নিয়ত অনুযায়ী হাশরের ময়দানে উত্থিত হবে। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّمَا يُبْعَثُ النَّاسُ عَلَى نِيَّاتِهِمْ ‘মানুষ কেবলই তাদের নিয়ত অনুসারে উত্থিত হবে’।ইবনু মাজাহ হা/৪২২৯; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৩।

এসব জানার পর ভাই-বোন আমার! আপনি নিজেকে যেন কখনই ভৎর্সনা না করেন। যদি কিনা আপনি রিয়াকারীদের সাথে ধ্বংসপ্রাপ্তদের তালিকাভুক্ত হয়ে পড়েন।

ইখলাছের ফল :

ইখলাছের যেমন অনেক উপকারিতা রয়েছে, তেমনি বহু ফলও রয়েছে। নেককার ঈমানদার বান্দার অন্তরে যখন ইখলাছ বিদ্যমান থাকে তখন সে এসব উপকারিতা ও ফল লাভ করে থাকে। এখানে ইখলাছের কিছু ফল তুলে ধরা হ’ল :

১. আল্লাহর নিকট আমল কবুল হওয়া :

আবু উমামা আল-বাহেলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ আমল কবুল করেন না, যা তার জন্য খালেছ হয় না এবং যা স্রেফ তাঁর চেহারা অন্বেষণের লক্ষ্যে না হয়’।নাসাঈ হা/৩১৪০, হাদীছ ছহীহ।

২. ছওয়াব লাভ :

সা‘দ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِى بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ عَلَيْهَا- ‘তুমি যা কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে খরচ করবে অবশ্যই তার পুরস্কার পাবে’।বুখারী হা/৫৬; মুসলিম হা/১৬২৮; মিশকাত হা/৩০৭১।

৩. ইখলাছ গুণে ছোট আমলও বড় আমলে রূপান্তরিত :

ইবনুল মুবারক (রহঃ) বলেন,رُبَّ عَمَلٍ صَغِيْرٍ تُعَظِّمُهُ النِّيَّةُ، وَرُبَّ عَمَلٍ كَبِيْرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةُ ‘নিয়ত গুণে অনেক ছোট আমলও বড় আমলে পরিণত হয়; আবার অনেক বড় আমলও ছোট আমলে পরিণত হয়’।জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম ১/১৩।

৪. পাপ ক্ষমা :

ইখলাছ গোনাহ মাফের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, একটা আমলও যদি বান্দা এমনভাবে করতে পারে, যাতে আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণভাবে ইখলাছ ও ইবাদত বজায় থাকে, তাহ’লে আল্লাহ তা‘আলা তার বিনিময়ে ঐ বান্দার কবীরা গোনাহ পর্যন্ত মাফ করে দিতে পারেন। যেমন আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

يُصَاحُ بِرَجُلٍ مِنْ أُمَّتِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رُءُوْسِ الْخَلاَئِقِ فَيُنْشَرُ لَهُ تِسْعَةٌ وَتِسْعُوْنَ سِجِلاًّ كُلُّ سِجِلٍّ مَدَّ الْبَصَرِ ثُمَّ يَقُوْلُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ هَلْ تُنْكِرُ مِنْ هَذَا شَيْئًا فَيَقُوْلُ لاَ يَا رَبِّ فَيَقُولُ أَظَلَمَتْكَ كَتَبَتِى الْحَافِظُوْنَ ثُمَّ يَقُوْلُ أَلَكَ عُذْرٌ أَلَكَ حَسَنَةٌ فَيُهَابُ الرَّجُلُ فَيَقُولُ : لاَ. فَيَقُولُ : بَلَى إِنَّ لَكَ عِنْدَنَا حَسَنَاتٍ وَإِنَّهُ لاَ ظُلْمَ عَلَيْكَ الْيَوْمَ فَتُخْرَجُ لَهُ بِطَاقَةٌ فِيهَا أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ قَالَ فَيَقُولُ يَا رَبِّ مَا هَذِهِ الْبِطَاقَةُ مَعَ هَذِهِ السِّجِلاَّتِ، فَيَقُولُ : إِنَّكَ لاَ تُظْلَمُ. فَتُوضَعُ السِّجِلاَّتُ فِى كِفَّةٍ وَالْبِطَاقَةُ فِى كِفَّةٍ فَطَاشَتِ السِّجِلاَّتُ-

‘ক্বিয়ামতের দিন আমার উম্মতের একজনকে সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডাকা হবে। তারপর তার সামনে ৯৯টি ভলিউম খুলে ধরা হবে। প্রতিটি ভলিউমের দৈর্ঘ্য একজন মানুষের দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলবেন, তুমি কি এর কোনটা অস্বীকার করতে চাও? সে বলবে, না হে আমার রব! তিনি বলবেন, সংরক্ষণকারীরা কি এ লিখনে তোমার প্রতি কোন যুলুম করেছে? অতঃপর তিনি বলবেন, তোমার কি কোন ওযর আছে? তোমার কি কোন নেকী আছে? তখন লোকটি ভীত হয়ে বলবে, না (কোন নেকী নেই)। এ সময় আল্লাহ বলবেন, আমাদের কাছে তোমার কিছু নেকী আছে। আজ তোমার উপর কোন যুলুম করা হবে না। তারপর তার জন্য একটা চিরকুট বের করা হবে; তাতে লেখা থাকবে কালেমা শাহাদত- আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু। এ দেখে সে বলবে, এতগুলো ভলিউমের মুকাবেলায় এই চিরকুটের কতটুকু মূল্য আছে? তখন আল্লাহ বলবেন, তোমার প্রতি যুলুম করা হবে না। অতঃপর এ চিরকুট এক পাল্লায় রাখা হবে এবং ভলিউমগুলো অন্য পাল্লায় রাখা হবে। তখন ভলিউমের পাল্লা হাল্কা হয়ে যাবে।তিরমিযী হা/২৬৩৯; ইবনু মাজাহ হা/৪৩০০; হাকেম হা/১৯৩৭।

যে ইখলাছের সাথে সত্য মনে কালেমা লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ পড়বে তার অবস্থা এই চিরকুটওয়ালার মত হবে। নচেৎ জাহান্নামী কবীরা গুনাহগার মাত্রই তো কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করে। কিন্তু তাদের উচ্চারিত কালেমা তাদের পাপের পাল্লা থেকে ভারী হবে না, যেমন ভারী হবে এই চিরকুটওয়ালার পাল্লা।

অন্য হাদীছে এসেছে,أَنَّ امْرَأَةً بَغِيًّا رَأَتْ كَلْبًا فِىْ يَوْمٍ حَارٍّ يُطِيْفُ بِبِئْرٍ قَدْ أَدْلَعَ لِسَانَهُ مِنَ الْعَطَشِ فَنَزَعَتْ لَهُ بِمُوقِهَا فَغُفِرَ لَهَا ‘জনৈক পতিতা মহিলা এক গরমের দিনে একটি কুকুরকে একটা কূপের পাশে চক্কর দিতে দেখল। পিপাসায় তার জিহবা বেরিয়ে পড়েছিল। তখন সে তার মোযা খুলে কুকুরটিকে পানি পান করায়। এজন্যে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়’।মুসলিম হা/২২৪৫।

এই মহিলা তার অন্তরে অবস্থিত নির্ভেজাল ঈমানের তাকীদে কুকুরটিকে পানি পান করিয়েছিল। ফলে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়। নচেৎ যখনই কোন পতিতা কুকুরকে পানি পান করাবে আর অমনি ক্ষমা পেয়ে যাবে, তা কখনই হবে না।ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৬/২১৮-২২১।

আমল বাস্তবায়ন করতে না পারলেও শুধু ইখলাছের খাতিরে ছওয়াব লাভ :

ইখলাছ দ্বারা মানুষ যে আমল করতে ইচ্ছুক তা সম্পাদনে অক্ষম হ’লেও তার ছওয়াব ঠিকই পেয়ে যায়। এমনকি বিছানায় মরেও সে শহীদ ও মুজাহিদদের সমমর্যাদায় পৌঁছে যায়। নবী করীম (ছাঃ) যাদেরকে অর্থাভাবে তার সঙ্গে জিহাদে নিতে পারেননি তাদের প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَلاَ عَلَى الَّذِيْنَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلاَّ يَجِدُوْا مَا يُنْفِقُوْنَ- ‘আর ঐসব লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার নিকট এজন্য আসে যে, তুমি তাদের (জিহাদে যাবার) জন্য বাহনের ব্যবস্থা করবে। অথচ তুমি বলেছ যে, আমার নিকটে এমন কোন বাহন নেই যার উপর তোমাদের সওয়ার করাব। তখন তারা এমন অবস্থায় ফিরে যায় যে, তাদের চক্ষুসমূহ হ’তে অশ্রু প্রবাহিত হ’তে থাকে এই দুঃখে যে, তারা এমন কিছু পাচ্ছে না যা তারা ব্যয় করবে’ (তওবা ৯/৯২)

আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ أَقْوَامًا بِالْمَدِينَةِ خَلْفَنَا، مَا سَلَكْنَا شِعْبًا وَلاَ وَادِيًا إِلاَّ وَهُمْ مَعَنَا فِيْهِ، حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ- ‘মদীনাতে আমাদের পিছে এমন কিছু লোক রয়েছে যে, আমরা যেই গিরিপথ কিংবা উপত্যকাই অতিক্রম করি না কেন, সেখানে তারা আমাদের সাথে থাকে; ওযরবশতঃ তারা আটকা পড়ে গেছে’।বুখারী হা/২৮৩৯।

অন্য বর্ণনায় এসেছে,إِلاَّ شَرِكُوْكُمْ فِى الأَجْرِ ‘তারা (প্রতিটি ক্ষেত্রে) ছওয়াবে তোমাদের সাথে শরীক থাকে’।মুসলিম হা/১৯১১।

আনাস বিন মালেক কর্তৃক নবী করীম (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,مَنْ سَأَلَ اللهَ الشَّهَادَةَ بِصِدْقٍ بَلَّغَهُ اللهُ مَنَازِلَ الشُّهَدَاءِ وَإِنْ مَاتَ عَلَى فِرَاشِهِ- ‘যে ব্যক্তি খাঁটি মনে শাহাদত লাভের দো‘আ করবে, আল্লাহ তাকে শহীদদের স্তরে পৌঁছে দিবেন, যদিও সে বিছানায় শুয়ে মারা যায়’।মুসলিম হা/১৯০৯; মিশকাত হা/৩৮০৮।

এমনিভাবে নিয়ত গুণে একজন গরীব লোকও দানশীল ধনী লোকের সমতুল্য ছওয়াব লাভ করতে পারে। আবু কাবশা আল-আনমারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَثَلُ هَذِهِ الأُمَّةِ كَمَثَلِ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ : رَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالاً وَعِلْمًا فَهُوَ يَعْمَلُ بِعِلْمِهِ فِىْ مَالِهِ يُنْفِقُهُ فِىْ حَقِّهِ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ عِلْمًا وَلَمْ يُؤْتِهِ مَالاً فَهُوَ يَقُوْلُ : لَوْ كَانَ لِىْ مِثْلُ هَذَا عَمِلْتُ فِيْهِ مِثْلَ الَّذِىْ يَعْمَلُ. قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَهُمَا فِى الأَجْرِ سَوَاءٌ…، ‘এই উম্মতের উদাহরণ চারজন লোকের ন্যায়। একজন যাকে আল্লাহ অর্থ-বিত্ত ও বিদ্যা প্রদান করেছেন। সে তার অর্থ ব্যয় করে এবং অর্থের হক যথাযথ পরিশোধ করে। আরেকজনকে আল্লাহ শুধু বিদ্যা দিয়েছেন, অর্থ-সম্পদ দেননি। সে বলে, আমার যদি এ লোকের মত সম্পদ থাকত, তাহ’লে আমিও তার মত আমল করতাম। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ছওয়াব লাভে এরা দু’জনই সমান।ইবনু মাজাহ হা/৪২২৮; আহমাদ হা/১৮০৫৩; ছহীহ আত-তারগীব হা/১৬।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যা আলোচনার দাবী রাখে। কোন লোক হয়তো কোন আমল করতে আসলে অক্ষম নয়, কিন্তু সে মনে মনে ঐ আমল করার ইচ্ছা করে আর ভাবে, তার এই ইচ্ছার জন্য সে ছওয়াব পাবে এবং সেই ইচ্ছাকে সে নেক নিয়ত মনে করে। কিন্তু আসলে তা তার কুপ্রবৃত্তির অলীক আশা ও শয়তানী প্রবঞ্চনা মাত্র।

আমরা অনেককে দেখতে পাই, হয়তো সে বাড়িতে বসে কিংবা শুয়ে আছে, মসজিদে ছালাতে যাচ্ছে না, কিন্তু মনে মনে বলছে, আমি ছালাতে যেতে ভালবাসি। আর ভাবছে, আমার এই বলাতেই আমি মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে ছালাতের ছওয়াব পাব। এ ধরনের লোক আমাদের বর্ণিত ছওয়াব অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং হাদীছের আওতায়ও তারা পড়ে না। সুতরাং এ সম্বন্ধে হুঁশিয়ার থাকতে হবে।

ইখলাছের বদৌলতে মুবাহ ও অভ্যাস জাতীয় কাজও ইবাদতে রূপান্তরিত হয়, যার মাধ্যমে উচ্চমর্যাদা অর্জিত হয়:

عَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِىْ وَقَّاصٍ أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : إِنَّكَ لَنْ تُنْفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغِى بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ عَلَيْهَا، حَتَّى مَا تَجْعَلُ فِىْ فِىْ امْرَأَتِكَ-

সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে তুমি যে কোন প্রকার ব্যয়ই কর না কেন, সেজন্য তুমি ছওয়াব পাবে। এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে যে খাদ্যের গ্রাস তুলে দিয়ে থাক সেজন্যও’।বুখারী হা/৪৫; মুসলিম হা/১৬২৮; মিশকাত হা/৩০৭১।

কল্যাণ লাভের এ এক মহৎ উপায়। যখনই কোন মুসলিম এ পথে প্রবেশ করবে তখনই সে মহা কল্যাণ ও অঢেল ছওয়াব লাভ করবে। আমরা যদি আমাদের নিত্যকার অভ্যাসে ও মুবাহমূলক কাজে আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়ত করি তাহ’লে অবশ্যই আমরা মহা পুরস্কার ও প্রচুর ছওয়াব লাভ করব।

যুবাইদ আল-ইয়ামী (রহঃ) বলেছেন, প্রতিটি কথায় ও কাজে আমার আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার নিয়ত থাকা আমি খুব পসন্দ করি, এমনকি খাদ্য-পানীয় গ্রহণের ক্ষেত্রেও।আল-ইখলাছ ওয়ান নিয়্যাত, পৃঃ ৬২।

প্রিয় পাঠক! আপনি বাস্তব থেকে গৃহীত এই দৃষ্টান্তগুলো গ্রহণ করুন, আপনার প্রাত্যহিক জীবনে এগুলো কাজে আসতে পারে।

১. অনেকে খোশবু ব্যবহার করতে পসন্দ করে। সে যদি মসজিদে যাওয়ার আগে খোশবু মাখার সময় আল্লাহর ঘরের সম্মান করা এবং মানুষ ও ফেরেশতাদের তার মুখ ও দেহের গন্ধ দ্বারা কষ্ট দেওয়া থেকে হেফাযত করার নিয়ত করে তাহ’লে অবশ্যই ছওয়াব পাবে।

২. আমরা সবাই খাদ্য ও পানীয়ের মুখাপেক্ষী। কিন্তু যে খাদ্য-পানীয় গ্রহণ দ্বারা আল্লাহর ইবাদতে শক্তি অর্জনের নিয়ত করবে সে ছওয়াব পাবে।

৩. অধিকাংশ মানুষের বিবাহ করা প্রয়োজন। জৈবিক চাহিদা মিটাতে সাধারণত তারা বিবাহ করে। কিন্তু যদি বিবাহ দ্বারা তারা স্বামী-স্ত্রীর চারিত্রিক পবিত্রতা এবং এমন সন্তান কামনা করে যারা তাদের অবর্তমানে আল্লাহর ইবাদত করবে তাহ’লে সেজন্য তারা ছওয়াবের অধিকারী হবে।

৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়ায় ভাল নিয়তের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। একজন মেডিকেল ছাত্র তার অধ্যয়নে ভবিষ্যতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা দানের নিয়ত করতে পারে। অনুরূপভাবে প্রকৌশল ও অন্যান্য শাখার শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই তাদের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমদের সেবার নিয়ত করতে পারে।

এরূপ আরো অনেক বিষয় রয়েছে। আমাদের মধ্যে তো এমন কেউ নেই যার জীবন-জীবিকার জন্য কোন শ্রম দিতে হয় না বা পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করতে হয় না। আবার ঘুমানোর প্রয়োজন নেই এমনও কেউ নেই। তাহ’লে হে পাঠক! এসব মুবাহ কাজে খাঁটি নিয়ত আর ছওয়াবের প্রত্যাশা হ’তে পারে বিচার দিবসে আপনার মুক্তির অসীলা।

শয়তান থেকে আত্মরক্ষা :

শয়তান যখন আল্লাহর বান্দাদের বিপথগামী করার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে অঙ্গীকার করেছিল তখন সে আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের তা থেকে বাদ রেখেছিল। সে বলেছিল, إِلاَّ عِبَادَكَ مِنْهُمُ الْمُخْلَصِيْنَ ‘তবে তাদের মধ্য থেকে তোমার নির্বাচিত বান্দারা ব্যতীত’ (হিজর ১৫/৪০)

তাহ’লে দেখা যাচ্ছে, যে ইখলাছের দুর্গে আশ্রয় নেয় শয়তান তাকে বিপথগামী করার সুযোগ পায় না। মা‘রূফ কারখী (রহঃ) নিজের মনকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, হে মন! তুই ইখলাছ অবলম্বন কর বা খাঁটি হয়ে যা, তাহ’লে তুই মুক্তি পাবি।গাযালী, ইইয়াউ উলূমিদ্দীন ৩/৪৬৫।

কুমন্ত্রণা ও লৌকিকতা থেকে নিরাপদ থাকা :

আবু সুলাইমান আদ-দারানী (রহঃ) বলেছেন, বান্দা যখন ইখলাছের সাথে কাজ করে তখন কুমন্ত্রণা ও লৌকিকতা থেকে সে বহুলাংশে নিরাপদ থাকে।মাদারিজুস সালিকীন ২/৯২।

ফিৎনা-ফাসাদ হ’তে মুক্তি :

ইখলাছ বা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি নিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষ ফিৎনা থেকে মুক্তি পায়। প্রবৃত্তির লালসার শিকার হওয়া থেকে সে আত্মরক্ষা করতে পারে, পাপাচারী দুর্নীতিবাজদের খপ্পর থেকে তার রেহাই মেলে। ইখলাছের ফলেই আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (আঃ)-কে মিশরীয় মন্ত্রীর স্ত্রীর কুপ্রস্তাব থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে তাঁকে পাপাচার ও অন্যায়ের পাঁকে পড়তে হয়নি। আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلاَ أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ- ‘উক্ত মহিলা তার বিষয়ে কুচিন্তা করেছিল এবং সেও তার প্রতি কল্পনা করত যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করত। এভাবেই এটা একারণে যাতে আমরা তার থেকে যাবতীয় মন্দ ও অশ্লীল বিষয় সমূহ সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে ছিল আমাদের মনোনীত বান্দাগণের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউসুফ ১২/২৪)

দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি, জীবিকা বৃদ্ধি :

মুখলেছ ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা যেমন দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেন, তেমনি জীবিকাতে প্রাচুর্য দান করেন। এ বিষয়ে আনাস বিন মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ كَانَتِ الآخِرَةُ هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ غِنَاهُ فِىْ قَلْبِهِ وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِىَ رَاغِمَةٌ وَمَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ جَعَلَ اللهُ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَمْلَهَ وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ مَا قُدِّرَ لَهُ- ‘যার জীবনের লক্ষ্য হবে আখিরাত আল্লাহ তার অন্তরকে ধনী করে দিবেন। তার সব সুযোগ-সুবিধা একত্রিত করে দিবেন এবং দুনিয়া (ধন-সম্পদ) তার পায়ে লুটিয়ে পড়বে। আর যার জীবনের লক্ষ্য হবে দুনিয়া আল্লাহ তা‘আলা দারিদ্র্যকে তার নিত্যসঙ্গী করে দিবেন। তার গোছানো বিষয় ছিন্নভিন্ন করে দিবেন এবং তার জন্য যতটুকু বরাদ্দ তার বাইরে সে দুনিয়ার কিছুই পাবে না’।তিরমিযী হা/২৪৬৫; দারেমী হা/২২৯; ছহীহাহ হা/৯৪৯।

বিপদ থেকে উদ্ধার :

ইহজীবনে মানুষ নানা বিপদাপদের সম্মুখীন হয়। ইখলাছপূর্ণ জীবন-যাপন করলে আল্লাহ সেসব বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করেন। বিপদগ্রস্ত এমন তিনজন মানুষের কথা হাদীছে এসেছে যারা ইখলাছ বা সততার গুনে বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন।

ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি পথে হাঁটছিল। এমন সময় বৃষ্টি শুরু হ’লে তারা একটি পাহাড়ী গুহায় আশ্রয় নিল। এ সময় একটি পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ করে দিল। তখন তারা পরস্পরে বলাবলি করল, তোমাদের জীবনের সর্বোত্তম আমলের অসীলা দিয়ে আল্লাহর নিকট দো‘আ কর। তখন তাদের একজন বলল, ইয়া আল্লাহ, আমার দু’জন অতি বৃদ্ধ মাতা-পিতা ছিলেন। আমি পশু চরাতে বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতাম। তারপর বাড়ী ফিরে দুধ দোহন করতাম। সেই দুধ নিয়ে আমার মাতা-পিতাকে দিতাম তারা তা পান করতেন। পরে শিশুদের এবং আমার স্ত্রী-পরিজনদের পান করতে দিতাম। এক রাতে আমি আটকা পড়ে গেলাম। যখন বাড়ি এলাম তখন মাতা-পিতা দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি তাদের জাগাতে অপসন্দ করলাম। এদিকে ছোট ছেলে-মেয়েরা আমার পায়ের কাছে ক্ষুধায় কাতরাচ্ছিল। কিন্তু ভোর পর্যন্ত মাতা-পিতা ঘুমিয়েই রইলেন, আর আমিও তাদের অপেক্ষায় জেগে রইলাম। হে আল্লাহ! তোমার যদি মনে হয়, আমি একাজ তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য করেছি তাহ’লে তুমি আমাদের জন্য গুহাটা এতটুকু ফাঁকা করে দাও যাতে আমরা আকাশ দেখতে পারি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, অতঃপর তাদের জন্য গুহার এক তৃতীয়াংশ ফাঁকা করে দেওয়া হ’ল।

এবার দ্বিতীয়জন বলল, হে আল্লাহ! তোমার জানা আছে- আমি আমার এক চাচাতো বোনকে ততোধিক ভালবাসতাম যতটা একজন পুরুষ কোন নারীকে ভালবাসে। সে আমাকে বলেছিল, একশ’ দীনার না দেওয়া পর্যন্ত তার মনোস্কামনা পূরণ হবে না। আমি চেষ্টা করে ঐ পরিমাণ অর্থ জমা করলাম। অতঃপর আমি যখন তার সঙ্গে মিলিত হ’তে গেলাম এবং তার দু’পায়ের মাঝে বসলাম তখন সে আমাকে বলল, আল্লাহকে ভয় কর এবং অবৈধভাবে মোহর ছিন্ন কর না। আমি তখন তাকে ছেড়ে উঠে পড়লাম। (হে আল্লাহ) এখন যদি তোমার মনে হয়, আমি ঐ কাজ তোমাকে সন্তুষ্ট করার জন্য করেছি তাহ’লে আমাদের জন্য গুহার মুখটা আরেকটু ফাঁকা করে দাও। এবার গুহার মুখটা দুই-তৃতীয়াংশ ফাঁকা হয়ে গেল।

পরিশেষে তৃতীয়জন বলল, হে আল্লাহ, তোমার জানা আছে, আমি এক ফারাক (ওযন বিশেষ) ভুট্টার বিনিময়ে একজন মজুর নিয়োগ করেছিলাম। আমি তাকে ভুট্টা দিতে গেলে সে তা নিতে অস্বীকার করে। আমি সেই এক ফারাক ভুট্টা জমিতে বপন করি। তাতে যে ফসল হয় তা দিয়ে এক পাল গরু কিনি এবং একজন রাখাল নিয়োগ করি। অনেককাল পরে লোকটা এসে বলল, ওহে আল্লাহর বান্দা! আমার পাওনা আমাকে দাও। আমি বললাম, ঐ যে গরুর পাল ও তাদের রাখালকে দেখছ, ওখানে যাও। ওগুলো সবই তোমার। সে বলল, তুমি কি আমার সাথে তামাশা করছ? আমি বললাম, আমি তোমার সঙ্গে তামাশা করছি না। আসলে ওগুলো তোমারই। হে আল্লাহ! তুমি যদি মনে কর, আমি একাজ তোমার সন্তোষ অর্জনের মানসে করেছি তাহ’লে আমাদের মুক্ত করে দাও। অতঃপর আল্লাহ তাদের মুক্ত করে দিলেন’।বুখারী হা/২১০২; মুসলিম হা/২৭৪৩।

নিষ্ঠাবান ও মানুষের মাঝে সংঘটিত বিষয়ে আল্লাহই যথেষ্ট :

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, হক যদি কোন ব্যক্তির নিজের বিরুদ্ধেও যায় আর সে খালেছ বা খাঁটি নিয়তে ঐ হকের পক্ষে থাকে, তাহ’লে তার ও অন্যান্য মানুষের মাঝে যত যা কিছু হবে তাতে আল্লাহ তা‘আলা তার সহায় থাকবেন’।বায়হাকী, সুনানুল কুবরা ১০/২৫০।

ইখলাছওয়ালা প্রজ্ঞার অলঙ্কারে ভূষিত :

ইমাম মাকহূল (রহঃ) ছিলেন একজন খ্যাতিমান হাদীছবেত্তা। তিনি বলেছেন, কোন বান্দা যদি কখনো একাধারে চল্লিশ দিন যাবৎ ইখলাছের সাথে আমল করে তাহ’লে তার অন্তর থেকে মুখ পর্যন্ত প্রজ্ঞার ঝর্ণাধারা উৎসারিত হবে।মাদারিজুস সালিকীন ২/৯২।

ইখলাছের বদৌলতে বান্দা ভুল করলেও ছওয়াব পায় :

একজন গবেষক মুজতাহিদ, দ্বীনের আলিম, ফক্বীহ কিংবা ন্যায়বিচারক যখন তার গবেষণা বা ইজতিহাদে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের নিয়ত করে এবং সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হ’তে যথাসাধ্য চেষ্টা করে, তখন যদি সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে নাও পারে তবুও সে ছওয়াব লাভ করবে।

ইখলাছেই যাবতীয় কল্যাণ :

ইমাম দাঊদ আত-তাঈ (রহঃ) বলেছেন, আমি দেখেছি, সদিচ্ছা বা ভাল নিয়তই কেবল সকল কল্যাণকে জড়ো করতে পারে। নিয়ত মোতাবেক কাজ করতে না পারলেও শুধু নিয়ত গুণেই কল্যাণ তোমার হাতে ধরা দিবে।আল ইখলাছ ওয়ান নিয়্যাত ৬৪; জামিউল উলূম ওয়াল হিবাম-১৩।

মুখলিছ বান্দাদের জন্য যখন এতসব ফায়েদা তখন আমাদের উচিত হল মুখলিছ হওয়া।

ইখলাছ না থাকার ক্ষতি :

ইখলাছের যেমন অনেক উপকারিতা ও ফল আছে- যা একজন মুসলিম ইখলাছের বদৌলতে অর্জন করে থাকে, তেমনি ইখলাছহীনতার অনেক কুফলও রয়েছে। ইখলাছহীন লোককে তা ভোগ করতে হবে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল :

জান্নাতে প্রবেশ না করা :

ইখলাছহীন আমল করলে মানুষ জান্নাতে যাওয়ার সুযোগ পাবে না; যদিও ঐ আমল ইখলাছসহ করলে জান্নাতে যাওয়া যেত। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيْبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، يَعْنِىْ رِيْحَهَا- ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য ব্যতীত যদি কেউ শুধু পার্থিব স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে বিদ্যা শিখে, তাহ’লে সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না’।[1]

ক্বিয়ামত দিবসে জাহান্নামে প্রবেশ :

আমল যত দামীই হোক না কেন- তা ইখলাছ শূন্য হ’লে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘ক্বিয়ামতের দিন যার বিরুদ্ধে বিচারের প্রথম রায় ঘোষিত হবে সে একজন শহীদ। তাকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে যত নে‘মত দিয়েছিলেন তা তাকে স্মরণ করানো হবে। সে তা স্বীকার করবে। তখন তিনি বলবেন, এসব নে‘মত পেয়ে তুমি কী করেছিলে? সে বলবে, তোমার পথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গিয়েছিলাম। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ (كَذَبْتَ)। তুমি বরং (জনগণের মাঝে) বীরপুরুষ আখ্যায়িত হবে সেজন্য যুদ্ধ করেছিলে। তোমাকে তা বলাও হয়ে গেছে। তারপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে অধোমুখী করে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।

অপর ব্যক্তি (যার বিরুদ্ধে প্রথম রায় ঘোষিত হবে) সে ইলম অর্জন করেছিল ও অন্যদের শিক্ষা দিয়েছিল এবং কুরআন পড়েছিল। তাকে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে যত নে‘মত দিয়েছিলেন তা অবহিত করবেন। সে তা স্বীকার করবে। তখন তিনি বলবেন, এসব নে‘মত পেয়ে তুমি কী করেছিলে? সে বলবে, আমি ইলম অর্জন করেছিলাম, অন্যদের তা শিখিয়েছিলাম এবং তোমার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন তেলাওয়াত করেছিলাম। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি বরং (জনগণের মাঝে) আলেম বা বিদ্বান বলে আখ্যায়িত হবে সেজন্য বিদ্যা শিখেছিলে এবং ক্বারী বলে পরিচিত হবে সেজন্য কুরআন তেলাওয়াত করেছিলে। তোমাকে তো সেসব বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। তারপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে অধোমুখী করে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অতঃপর আরেক ব্যক্তি (যার বিরুদ্ধে প্রথম রায় ঘোষিত হবে) সে যাকে আল্লাহ প্রাচুর্য দিয়েছিলেন এবং তাকে হরেক রকমের ধন-সম্পদ দিয়েছিলেন। তাকে হাযির করা হবে। আল্লাহ তাকে যত নে‘মত দিয়েছিলেন তা তাকে অবহিত করবেন। সে তা স্বীকার করবে। তখন তিনি বলবেন, এসব নে‘মত পেয়ে তুমি কী করেছিলে? সে বলবে, আপনার জন্য এমন কোন পথে অর্থ ব্যয় আমি বাদ দেইনি যেখানে অর্থ ব্যয় আপনি পসন্দ করতেন। তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি বরং একজন দাতা হিসাবে পরিচিত হওয়ার জন্য অর্থ ব্যয় করেছিলে। আর তোমাকে তা বলাও হয়েছে। তারপর তার সম্পর্কে আদেশ দেওয়া হবে। তখন তাকে অধোমুখী করে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

এ হাদীছ এতটাই ভারী ও গুরুত্ববহ যে আবু হুরায়রা (রাঃ) যখনই হাদীছটি বর্ণনা করতে যেতেন তখনই ভয়ে বেহুঁশ হয়ে যেতেন। এ সম্পর্কে বর্ণনাকারী শুফাই আল-আছবাহী বলেছেন যে, একদিন তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় গমন করেন। সেখানে হঠাৎই তিনি দেখতে পেলেন একজন লোকের পাশে বহু লোক জমায়েত হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? তারা বলল, ইনি আবু হুরায়রা (রাঃ)। আমি তাঁর কাছাকাছি যেতে যেতে একেবারে তাঁর সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি তখন লোকদের হাদীছ শুনাচ্ছিলেন। তিনি যখন হাদীছ বলা বন্ধ করে একাকী হ’লেন তখন আমি তাঁকে বললাম, আমি আপনাকে হকের পর হকের শপথ দিয়ে বলছি, আপনি আমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাবেন যা আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে (নিজ কানে) শুনেছেন, বুঝছেন এবং জেনে রেখেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, আমি তা করব। আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটা হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছিলেন, আমি তা বুঝেছি এবং মনে রেখেছি। একথা বলে আবু হুরায়রা (রাঃ) বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। একটু পরেই হুঁশ ফিরে পেয়ে তিনি বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমাকে শুনিয়েছিলেন। তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। এই বলে আবু হুরায়রা (রাঃ) আবার বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে তাঁর মুখমন্ডল মুছলেন এবং বললেন, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমাকে শুনিয়েছিলেন, তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। এই বলে আবু হুরায়রা (রাঃ) পুনরায় বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে তার মুখমন্ডল মুছলেন এবং বললেন, আমি করব, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমাকে শুনিয়েছিলেন। তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। এবার আবু হুরায়রা (রাঃ) পুনরায় বেহুঁশ হয়ে পড়লেন। তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে তার মুখমন্ডল মুছলেন এবং বললেন, আমি করব, আমি অবশ্যই তোমাকে এমন একটি হাদীছ শুনাব, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এই ঘরের মধ্যে আমাকে শুনিয়েছিলেন। তিনি আর আমি ছাড়া আমাদের সাথে অন্য কেউ ছিল না। এবার আবু হুরায়রা (রাঃ) কঠিনভাবে বেহুঁশ হয়ে গেলেন এবং মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে তাঁকে আমার শরীরের সাথে লাগিয়ে রাখলাম। তারপর হুঁশ ফিরে পেয়ে বললেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন, এভাবে তিনি পূর্বের হাদীছের ন্যায় বর্ণনা করে শুনান। আর তার শেষে রয়েছে ثُمَّ ضَرَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى رُكْبَتِى فَقَالَ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ أُولَئِكَ الثَّلاَثَةُ أَوَّلُ خَلْقِ اللهِ تُسَعَّرُ بِهِمُ النَّارُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার হাঁটুতে মেরে বললেন, হে আবু হুরায়রা! এই তিনজনই আল্লাহর সৃষ্টির প্রথম, যাদের দ্বারা ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামের আগুন উত্তপ্ত করা হবে’।

দেখুন! জাহান্নামের আগুনের তাপ প্রথমে কোন খুনী, ব্যভিচারী, চোর, মদ্যপ ইত্যাদি ধরনের লোক দ্বারা বৃদ্ধি করা হবে না, বরং কুরআন পাঠক, দাতা, জ্ঞানী ও মুজাহিদ শ্রেণীর লোকদের দ্বারা তা করা হবে। আর এসবই হবে তাদের রিয়া বা লোক দেখানো কাজের কারণে।

কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللهُ النَّارَ- ‘যে ব্যক্তি এ উদ্দেশ্যে ইলম অর্জন করে যে, তা দ্বারা আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে কিংবা নির্বোধদের সঙ্গে বিতর্ক করবে অথবা মানুষের ঝোঁক তার দিকে ফিরিয়ে আনবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে দাখিল করবেন’।

আমল কবুল না হওয়া :

আমল যদি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর জন্য না করা হয় তাহ’লে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন যে, قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ مَنْ عَمِلَ عَمَلاً أَشْرَكَ فِيهِ مَعِى غَيْرِى تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ- ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমি শিরককারীদের শিরক থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত। কাজেই যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যাতে সে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, আমি তাকেও বর্জন করি এবং তার শিরককেও বর্জন করি’।

عَنْ أَبِى أُمَامَةَ الْبَاهِلِىِّ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ أَرَأَيْتَ رَجُلاً غَزَا يَلْتَمِسُ الأَجْرَ وَالذِّكْرَ مَا لَهُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ شَىْءَ لَهُ. فَأَعَادَهَا ثَلاَثَ مَرَّاتٍ يَقُولُ لَهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ شَىْءَ لَهُ. ثُمَّ قَالَ : إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا وَابْتُغِىَ بِهِ وَجْهُهُ-

আবু উমামা আল-বাহিলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, আপনি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কী মনে করেন যে ছওয়াব ও খ্যাতি উভয়টি লাভের নিয়তে যুদ্ধ করে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তার জন্য কিছুই মিলবে না। সে কথাটি তিনবার পুনরাবৃত্তি করল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, তার জন্য কিছুই মিলবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ঐ আমল কবুল করেন না, যা তাঁর জন্য খালেছভাবে করা না হয় এবং তা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে না হয়’।

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلاً قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ رَجُلٌ يُرِيدُ الْجِهَادَ فِى سَبِيلِ اللهِ وَهُوَ يَبْتَغِى عَرَضًا مِنْ عَرَضِ الدُّنْيَا فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ أَجْرَ لَهُ. فَأَعْظَمَ ذَلِكَ النَّاسُ وَقَالُوا لِلرَّجُلِ عُدْ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَعَلَّكَ لَمْ تُفَهِّمْهُ. فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ رَجُلٌ يُرِيدُ الْجِهَادَ فِى سَبِيلِ اللهِ وَهُوَ يَبْتَغِى عَرَضًا مِنْ عَرَضِ الدُّنْيَا. فَقَالَ لاَ أَجْرَ لَهُ. فَقَالُوا لِلرَّجُلِ عُدْ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ لَهُ الثَّالِثَةَ فَقَالَ لَهُ لاَ أَجْرَ لَهُ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! একজন লোক জাগতিক ধন-সম্পদ অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করতে চায়। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তার জন্য কোন ছওয়াব নেই। লোকেরা কথাটিকে ভারী মনে করে তাকে বলল, তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে ফিরে গিয়ে কথাটি পুনরায় তুলে ধরো- হয়ত তুমি তাঁকে বুঝাতে পারোনি। ফলে সে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! একজন লোক জাগতিক ধন-সম্পদ অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করতে চায়। তিনি বললেন, তার কোন ছওয়াব মিলবে না। তারা লোকটিকে বললেন, তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে আবার বল। সে তৃতীয়বার তাঁকে বলল। তিনি বললেন, তাঁর কোন ছওয়াব মিলবে না’।

আমলের ছওয়াব ও পারিতোষিক বিনষ্ট হওয়া :

আল্লাহ বলেন,وَقَدِمْنَا إِلَى مَا عَمِلُوْا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَاءً مَنْثُوْرًا- ‘আর আমরা সেদিন তাদের কৃতকর্মসমূহের দিকে মনোনিবেশ করব। অতঃপর সেগুলিকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করব’ (ফুরক্বান ২৫/২৩)

হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা লোক দেখানো আমলকারীদের (বিচার দিবসে) বলবেন,اذْهَبُوْا إِلَى الَّذِيْنَ كُنْتُمْ تُرَاءُوْنَ بِأَعْمَالِكُمْ فِى الدُّنْيَا فَانْظُرُوْا هَلْ تَجِدُوْنَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً- ‘যাদের দেখিয়ে দেখিয়ে তোমরা দুনিয়াতে আমল করতে তাদের কাছে যাও এবং দেখো, তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কি-না’।

ইখলাছের সাথে পূর্বসূরীদের সম্পর্ক :

আমাদের পূর্বসূরীগণ ইখলাছ সম্পর্কিত কিছু আয়াত পাঠ কিংবা কিছু হাদীছ প্রচারকেই যথেষ্ট মনে করতেন না। বরং ইখলাছের সাথে তাদের সম্পর্ক এতটাই গভীর ও নিবেদিত ছিল যে, অন্যদের মধ্যে তা দেখা যায় না। তাদের জীবনটাই ছিল ইখলাছে ভরা এক একটা প্রদীপ-যারা অনুসরণীয় ও বরণীয়। কারণ তারা ইখলাছের মর্ম ও গুরুত্ব ভালোমত অনুধাবন করেছিলেন। ফুযাইল বিন ইয়ায (রহঃ) বলেন, إِنَّمَا يُرِيْدُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ مِنْكَ نِيَّتَكَ وَإِرَادَتَكَ ‘আল্লাহ তো তোমার কাছে তোমার নিয়ত ও উদ্দেশ্য দেখতে চান’।

ইখলাছকে বরণ করতে গিয়ে পূর্বসূরীগণ যে কী চূড়ান্ত কষ্ট ভোগ করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তারা লোকদের সে কথা জানিয়েছেনও।

সাহল বিনু আব্দুল্লাহ আত-তাস্তারীকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, أَيُّ شَيْءٍ أَشَدُّ عَلَى النَّفْسِ؟ فَقَالَ: الْإِخْلَاصُ؛ لِأَنَّهُ لَيْسَ لَهَا فِيْهِ نَصِيْبٌ ‘নফসের উপর কোন জিনিসটা সবচেয়ে ভারী? তিনি বললেন, ইখলাছ। কেননা এতে নফসের কোনই অংশ নেই’।

ইউসুফ বিন আসবাত্ব (রহঃ) বলেন,تَخْلِيصُ النِّيَّةِ مِنْ فَسَادِهَا أَشَدُّ عَلَى الْعَامِلِينَ مِنْ طُولِ الِاجْتِهَادِ- ‘ভেজাল নিয়তকে নির্ভেজাল করার প্রয়াস একজন আমলকারীর জন্য দীর্ঘকাল ধরে ইজতিহাদ বা গবেষণা করা থেকেও কঠিন’।

প্রিয় পাঠক! আমাদের পূর্বসূরীরা ইখলাছ নিয়ে কেমনটি ভাবতেন সে সম্পর্কে আপনার সামনে কিছু নমুনা তুলে ধরা হ’ল। হয়ত আপনি এ থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবেন এবং তাদের পথ অনুসরণ করবেন।

নিজেকে মুখলিছ মনে না করা :

পূর্বসূরীরা যখন জেনেছেন যে, মানুষ তার জীবনে যত পরিস্থিতির মুখোমুখী হয় তন্মধ্যে ইখলাছ অত্যন্ত গুরুতর, আর তা অর্জনে একজন মুসলমানকে প্রকৃত জিহাদই চালিয়ে যেতে হয় তখন তারা নিজেদের জীবনে ইখলাছকে অস্বীকার করেছেন। তারা যে নিষ্ঠাবান মুখলিছ মানুষ, নিজেদের বেলায় তা সাব্যস্ত করেননি। প্রখ্যাত হাদীছ বর্ণনাকারী হিশাম আদ-দাস্ত্তওয়াই (রহঃ) বলেন,وَاللهِ مَا أَسْتَطِيْعُ أَنْ أَقُوْلَ إِنِّيْ ذَهَبتُ يَوْماً قَطُّ أَطْلُبُ الحَدِيْثَ، أُرِيْدُ بِهِ وَجْهَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ- ‘আল্লাহর কসম একদিনের জন্যও যে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হাদীছের তালাশে গিয়েছি তা বলতে পারি না’।

এই হিশাম আদ-দাস্ত্তওয়াই- যিনি হাদীছ তালাশে নিজেকে অভিযুক্ত করছেন তাকে কি আপনারা চেনেন? ইনি সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে শু‘বা ইবনুল হাজ্জাজ (রহঃ) বলেছেন, مَا أقول إنّ أحدًا يطلب الحديث يريد بِهِ وجه الله تعالى إلا هشام الدستوائي ‘হিশাম আদ-দাস্ত্তওয়াই ছাড়া আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন বলে আমি বলতে পারি না’।

তাঁর সম্পর্কে শায়খ ইবনু ফাইয়ায (রহঃ) বলেছেন, بَكَى هِشَامٌ الدَّسْتُوَائِيُّ حَتَّى فَسَدَتْ عَيْنُهُ، ‘হিশাম কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ নষ্ট করে ফেলেছিলেন। হিশাম তাঁর নিজের সম্পর্কে বলতেন, যখন থেকে আমি (চোখের) আলো হারিয়েছি তখন থেকে আমি কবরের অন্ধকার স্মরণ করি। তিনি আরো বলতেন, عَجِبْتُ لِلْعَالِمِ كَيْفَ يَضْحَكُ؟ ‘একজন আলেম কিভাবে হাসতে পারে তা ভেবে আমি অবাক হই’।

সুফিয়ান (রহঃ) বলেন, আমার নিয়ত নিয়ে আমি যত মুশকিলে পড়েছি আর কোন কিছু নিয়ে আমি তত মুশকিলে পড়িনি। কারণ আমার নিয়ত বারবার পাল্টে যায়।

ইউসুফ ইবনুল হুসাইন বলেন,أَعَزُّ شَيْءٍ فِي الدُّنْيَا، الإِخْلاَصُ. وَكَمْ أَجْتَهِدُ فِيْ إِسْقَاطِ الرِّيَاءِ عَنْ قَلْبِي. فَكَأَنَّهُ يَنْبُتُ عَلَى لَوْنٍ آخَرَ- ‘দুনিয়াতে ইখলাছের থেকে কঠিন কিছুই নেই। কতবার যে আমি আমার মন থেকে রিয়া বা লৌকিকতা মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু ভিন্নভাবে তা আবার জন্ম নেয়’।

মুতার্রিফ ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) তাঁর দো‘আয় বলতেন,اللهُمَّ إِنِّي أَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا تُبْتُ إِلَيْكَ مِنْهُ ثُمَّ عُدْتُ إِلَيْهِ، وَأَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا جَعَلْتُهُ لَكَ عَلَى نَفْسِيْ ثُمَّ لَمْ أُوَفِّ بِهِ، وَأَسْتَغْفِرُكَ مِمَّا زَعَمْتُ أَنِّيْ أَرَدْتُ بِهِ وَجْهَكَ فَخَالَطَ قَلْبِيْ فَيْهِ مَا قَدْ عَلِمْتَ- ‘হে আল্লাহ! যে গুনাহ থেকে আমি তোমার নিকটে তওবা করেছি অতঃপর পুনরায় তা করেছি সে গুনাহ থেকে আমি তোমার নিকটে ক্ষমা ভিক্ষা চাচ্ছি। আমি তোমার জন্য আমার নিজের উপর যে কাজ নির্ধারণ করে নিয়েছিলাম, কিন্তু তা পূরণ করতে পারিনি তা থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং যে কাজ আমার ধারণা ছিল যে, আমি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করছি কিন্তু আমার মনের ইচ্ছা তাতে মিশে গিয়ে তা অন্য রকম করে দিয়েছিল আমি তা থেকে তোমার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’।

এরা ছিলেন জাতির অনুসরণীয় নেতৃবর্গ। অথচ দেখুন এরাই নিজেরা নিজেদেরকে কীভাবে দোষারোপ করেছেন।

সংগোপনে আমল :

আমাদের পূর্বসূরী মনীষীগণ গোপনে আমল করতে যে কতটা সচেষ্ট ছিলেন সে সম্পর্কে ইমাম হাসান বছরী (রহঃ) বলেন, একজন লোক (দীর্ঘদিন ধরে) কুরআনের অনুলিপি করছে অথচ তার প্রতিবেশী সে সম্পর্কে কিছুই জানে না। একজন ফিক্বহ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করে চলেছে কিন্তু লোকেরা তা মোটেও টের পায়নি। কারো বাড়ি মেহমানে ভরা-সে বাড়িতে দীর্ঘ সময় ধরে ছালাত আদায় করছে অথচ মেহমানরা তা টের পাচ্ছে না। আমি এমন বহু লোক পেয়েছি যারা পৃথিবীর বুকে গোপন করা সম্ভব এমন আমল কোন দিন প্রকাশ্যে করেননি।

মুসলমানরা আল্লাহর দরবারে দো‘আ করতে খুবই সচেষ্ট থাকতেন। কিন্তু তাদের সে দো‘আর কোন শব্দ কানে আসত না- তা ছিল কেবলই তাদের এবং তাদের রবের মাঝে নিঃশব্দ আওয়ায। কারণ আল্লাহ বলেছেন,ادْعُوْا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ডাকো বিনীতভাবে ও চুপে চুপে’ (আ‘রাফ ৭/৫৫)

স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের থেকে আমল লুকানো :

হাসসান বিন আবী সিনানের স্ত্রী নিজ স্বামী সম্পর্কে বলেছেন, ‘সে বাড়ি এসে আমার সঙ্গে আমার বিছানায় প্রবেশ করত, তারপর মা যেমন দুধের শিশুকে রেখে সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে যায় (অথচ শিশু টের পায় না), ঠিক তেমনি করে সে আমাকে বুঝতে না দিয়ে বিছানা থেকে উঠে যায়। যখন তার মনে হয় আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তখন আস্তে করে বিছানা থেকে বেরিয়ে যায় এবং ছালাতে দাঁড়িয়ে যায়। একদিন আমি তাকে বললাম, হে আব্দুল্লাহর পিতা! তোমার নফসকে আর কত শাস্তি দিবে? তোমার জীবনের উপর দয়া করো। সে বলল, আহ! চুপ করো। অচিরেই হয়ত আমি এমন ঘুম ঘুমাব যে কোন কালে আর উঠব না’।

এমনিভাবে দাঊদ ইবনু আবু হিন্দ চল্লিশ বছর ছিয়াম পালন করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পরিবার তা জানত না। তিনি তাঁর সকালের খাবার তাদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় দান করে দিতেন। আবার সন্ধ্যায় ফিরে এসে তাদের সাথে ইফতার করতেন।

জিহাদের মাঝে গোপনীয়তা অবলম্বন :

জিহাদে লোক দেখানো কাজ এবং ইখলাছ শূন্যতার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। যারাই জিহাদে অস্ত্র ধরুক এবং মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করুক তারা প্রত্যেকেই যে মুখলিছ হবে এমন কোন কথা নেই। ইতিপূর্বে কিছু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যাতে জিহাদে ইখলাছ ও নিয়তের গুরুত্ব জোরালোভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের নেককার পূর্বসূরীগণ জিহাদে ইখলাছ বজায় রাখতে আত্মপরিচয় গোপন রাখার ব্যবস্থা নিতেন, যাতে তাদের চেনা না যায়। প্রিয় পাঠক! আপনি নিচের ঘটনা দু’টি থেকে তা বুঝতে পারবেন।

প্রথম ঘটনা : আবাদা ইবনু সুলায়মান (রহঃ) বলেন, আমরা রোম দেশে একটি অভিযানে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারকের সাথে ছিলাম। আমরা শত্রুর মুখোমুখি হ’লাম। যখন দু’দল পরস্পরের সামনাসামনি হ’ল তখন শত্রুপক্ষের এক লোক এসে মল্লযুদ্ধের আহবান জানাল। ফলে মুসলমানদের মধ্য হ’তে একজন বেরিয়ে এসে তাকে আক্রমণ করল এবং বল্লমের আঘাতে তাকে ধরাশায়ী করল। পুনরায় তাদের একজন বেরিয়ে এসে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। এবারও সেই লোকটি তার দিকে এগিয়ে গেল এবং তাকে হত্যা করল। এবার এল তৃতীয়জন। এবারও সে তাকে আক্রমণ করল এবং বর্শার আঘাতে হত্যা করল। তখন এই বীরযোদ্ধাকে চেনার জন্য লোকদের ভিড় জমে গেল। দেখা গেল লোকটি চোখ বাদে তার সারা মুখ ঢেকে রেখেছে। আবাদা বলেন, আমিও তাকে দেখার জন্য ভিড়কারীদের মধ্যে ছিলাম। আমি তার জামার আস্তিন ধরে টান দিলাম তখন দেখলাম তিনি আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক। এ সময় যে তাঁর মুখের আবরণ খুলে দিয়েছিল তাকে ভৎর্সনা করে তিনি বললেন, ওহে আবু আমর! তুমি আমাদের এমন অপদস্থ করতে পারলে?

দ্বিতীয় ঘটনা (সুড়ঙ্গওয়ালা বাহিনী) :

একবার মুসলিম বাহিনী শত্রুপক্ষের একটি দুর্গ অবরোধ করে। কিন্তু শত্রুপক্ষের তীরবৃষ্টিতে তাদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। তখন মুসলমানদের একজন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে দুর্গের মধ্যে প্রবেশের জন্য সুবিধামত একটি সুড়ঙ্গ খনন করে। সে সুড়ঙ্গ পথে দুর্গে ঢুকে পড়ে এবং দ্বাররক্ষীদের সঙ্গে লড়াই করে দুর্গের ফটক খুলে দিতে সমর্থ হয়। তখন মুসলিম বাহিনী  দুর্গে প্রবেশ করে তা দখল করে নেয়। কিন্তু কে যে এই সুড়ঙ্গওয়ালা তা জানা গেল না। তখন মুসলিম সেনাপতি মাসলামা ইবনু আব্দুল মালিক (খলীফা আব্দুল মালিক ইবনু মারওয়ানের ছেলে) তাকে পুরস্কৃত করার জন্য খোঁজ করলেন। কিন্তু তাকে না পাওয়ায় তিনি সৈন্যদের মাঝে আল্লাহর কসম দিয়ে বললেন, সুড়ঙ্গওয়ালা যেই হোক সে যেন আমার কাছে আসে। রাতের বেলায় একজন আগন্তুক সেনাপতির কাছে গেলেন এবং তাকে একটি শর্ত কবুলের আবেদন জানালেন। শর্তটি এই যে, তিনি যখন সুড়ঙ্গওয়ালার পরিচয় জানতে পারবেন তখন কোন দিন যেন তার অনুসন্ধান না করেন। সেনাপতি অঙ্গীকার করলেন। এবার তিনি সুড়ঙ্গওয়ালার পরিচয় তাঁকে জানালেন। এরপর থেকে মাসলামা দো‘আ করতেন,اللَّهُمَّ احْشُرْنِيْ مَعَ صَاحِبِ النَّفَقِ ‘হে আল্লাহ! আখিরাতে তুমি ঐ সুড়ঙ্গওয়ালার সাথে আমার হাশর করো’।[21]

একজন মরুচারী ছাহাবী ও যুদ্ধলব্ধ গণীমত :

শাদ্দাদ ইবনুল হাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক মরুবাসী বেদুঈন নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট এসে  ঈমান আনল এবং তাঁর অনুসরণ করতে লাগল। কিছুকাল পর সে নবী করীম (ছাঃ)-কে বলল, আমি আপনার কাছে হিজরত করে আসতে চাই। ফলে নবী করীম (ছাঃ) তাঁর একজন ছাহাবীকে তার সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দিলেন। ইতিমধ্যে  একটি যুদ্ধে নবী করীম (ছাঃ) কিছু বন্দীকে গণীমত হিসাবে পেলেন। তিনি বন্দীদেরকে ভাগ করে দিলেন। ঐ বেদুঈন ছাহাবীকেও এক ভাগ দিলেন। তার ভাগটা তিনি তার সাথীদের হাতে দিলেন। লোকটি পশুপাল চরাত। পশুপাল চরিয়ে ফিরে এলে তারা গণীমতের সম্পদ (বন্দী) তাকে দিল। সে বলল, এসব কী? তারা বলল, তোমার গণীমতের ভাগ, নবী করীম (ছাঃ) তোমাকে দিয়েছেন। সে তা নিয়ে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, এসব কী? তিনি বললেন, আমি তোমাকে ভাগ হিসাবে দিয়েছি। সে বলল, আমি তো এগুলোর জন্য আপনার অনুসরণ করছি না। সে তার কণ্ঠনালীর দিকে ইশারা করে বলল, আমি বরং এজন্য আপনার অনুসরণ করছি যে, আমার এখানটায় তীরবিদ্ধ হয়ে আমি মারা যাব, তারপর জান্নাতে প্রবেশ করব। তিনি বললেন, যদি তুমি আল্লাহকে সত্য বলে থাক তাহ’লে তিনি তোমাকে সত্যে পরিণত করবেন। এভাবে অল্প কিছুদিন গেল। তারপর মুসলিম বাহিনী একটি যুদ্ধে লিপ্ত হ’ল। যুদ্ধে ঐ মরুচারী বেদুঈন ছাহাবী (রাঃ) নিহত হন। তাকে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসা হ’ল। সে যে জায়গায় ইশারা করেছিল ঠিক সেখানটাতেই তীর লেগেছিল। নবী করীম (ছাঃ) দেখে বললেন, এই কি সেই? তারা বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, সে আল্লাহকে সত্য বলেছিল, তাই আল্লাহ তাকে সত্যে পরিণত করেছেন। তারপর নবী করীম (ছাঃ) নিজের জামা দিয়ে তাকে কাফন দেন এবং তার জানাযার ছালাতে ইমামতি করেন। তার ছালাতে যেটুকু তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন তন্মধ্যে এ দো‘আ ছিল-

اللَّهُمَّ هَذَا عَبْدُكَ خَرَجَ مُهَاجِرًا فِىْ سَبِيْلِكَ فَقُتِلَ شَهِيْدًا أَنَا شَهِيْدٌ عَلَى ذَلِكَ-

‘হে আল্লাহ! এ তোমার বান্দা। মুহাজির হয়ে এসে তোমার রাস্তায় বের হয়েছিল। অতঃপর শহীদ হিসাবে সে নিহত হয়েছে। আমি এ ঘটনার সাক্ষী’।

সাজ-গোজ ও সৌন্দর্য চর্চার ভয় :

সাধক আলী ইবনু বাক্কার বছরী (রহঃ) বলেন, অমুকের সাথে সাক্ষাতের তুলনায় আমি শয়তানের সাথে সাক্ষাৎকে বেশি পসন্দ করি। আমার ভয় হয় যে, আমি তার জন্য সাজ-গোজ করে যাব, ফলে আমি আল্লাহর রহমতের দৃষ্টি থেকে ছিটকে পড়ব।সালাফে ছালেহীন তো এভাবে সৌন্দর্য চর্চা করতেও ভয় পেতেন।

বিদ্যা-বুদ্ধি প্রকাশ না করা :

ইবনু ফারিস আবুল হাসান আল-কাত্ত্বান (রহঃ) সম্পর্কে বলেন যে, তিনি বলেছেন, ‘আমার দৃষ্টিশক্তি রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ধারণা যে, আমি সফরের অবস্থায় বেশী বেশী কথা বলি, যার শাস্তি হিসাবে এমনটা ঘটেছে’। তার ধারণা, তার বিদ্যা মানুষের সামনে তুলে ধরার কারণে তার এ অসুখ হয়েছে।

যাহাবী (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! তিনি সঠিক কথাই বলেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছা ও বিশুদ্ধ নিয়ত থাকা সত্ত্বেবও তাঁরা কথা-বার্তা ও জ্ঞান-গরিমা প্রকাশে ভয় পেতেন। কিন্তু আজকের (যাহাবীর যুগের) অবস্থা দেখুন! বিদ্যার স্বল্পতা ও নিয়তের খারাবী সত্ত্বেও লোকেরা বেশী বেশী কথা বলে। আল্লাহ তো তাদের অপদস্থ করবেনই। সেই সঙ্গে তাদের মূর্খতা, কুপ্রবৃত্তি ও জ্ঞাত বিদ্যার মাঝে দোদুল্যমানতা যাহির করে দিবেন।

কান্না লুকানো :

হাম্মাদ ইবনু যায়েদ (রহঃ) বলেন, আইয়ূব হাদীছ বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়শই ব্যথিত হয়ে পড়তেন। তার দু’চোখে অশ্রু দেখা দিত আর কান্না ঠেলে বের হয়ে আসতে চাইত। কিন্তু তিনি সর্দি ঝাড়তেন আর বলতেন, কী কঠিন সর্দিরে।  কান্না গোপন করতে গিয়ে তিনি সর্দির কথা প্রকাশ করতেন।

হাসান বাছরী (রহঃ) বলেন, দেখা গেল, ব্যক্তি বিশেষ কোন মজলিসে বসেছে, তারপর তার কান্না চলে এল। পরে সে চেষ্টা করে তা রোধ করল। আর যদি রোধ করতে না পারে তাহ’লে উঠে চলে গেল।

মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াসি‘ বলেন, এক ব্যক্তি বিশ বছর যাবৎ কান্নাকাটি করত অথচ তার সাথে থেকেও তার স্ত্রী বিষয়টা জানত না।

তিনি আরো বলেছেন, আমি এমন লোকের দেখা পেয়েছি যে একই বালিশে মাথা রেখে স্বামী-স্ত্রী শুয়ে আছে, স্বামীর চোখের পানিতে তার গন্ডদেশের নিচের বালিশ ভিজে গেছে অথচ স্ত্রী তার খবরই পায়নি। আবার অনেক লোক জামা‘আতের কাতারে দাঁড়িয়ে চোখের পানিতে গাল ভিজিয়ে ফেলছে অথচ তার পাশে দাঁড়ানো লোকটি তা অনুভবই করতে পারেনি।

ইমাম আল-মাওয়ার্দী ও তাঁর রচনাবলী :

গ্রন্থ প্রণয়নে ইখলাছ অবলম্বনের ক্ষেত্রে ইমাম আল-মাওয়ার্দীর ঘটনা বড়ই অদ্ভূত। তিনি তাফসীর, ফিক্বহ প্রভৃতি বিষয়ে অনেক বই লিখেছিলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় কোনটিই জনসম্মুখে প্রকাশ করেননি। বইগুলো তিনি রচনা শেষে এমন স্থানে লুকিয়ে রেখেছিলেন, যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ জানত না। মৃত্যু ঘনিয়ে এলে তিনি তাঁর একজন বিশ্বস্ত লোককে বলেন, ‘অমুক জায়গায় রক্ষিত সকল বই আমার রচিত। আমি খাঁটি নিয়তে বইগুলো রচনা করেছি কি-না সে বিষয়ে সন্দেহ থাকায় বইগুলো প্রকাশ করিনি। এক্ষণে যখন আমার মৃত্যু সন্নিকটবর্তী হবে এবং আমি মুমূর্ষু দশায় পতিত হব তখন তুমি তোমার হাত আমার হাতে রেখো। যদি আমি তোমার হাতটা মুঠি পাকিয়ে ধরতে পারি এবং তাতে চাপ দিতে পারি তাহ’লে তুমি বুঝবে যে, আমার কোন কিছুই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়নি। তুমি তখন বইগুলো নিয়ে রাতের অাঁধারে দজলা নদীতে ফেলে দিয়ো। আর যদি আমার হাত প্রসারিত করি কিন্তু তোমার হাত আমি যদি মুঠিবদ্ধ করতে না পারি তাহ’লে তুমি বুঝবে যে, সেগুলো আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে এবং আল্লাহর দরবারে আমার যে চাওয়া-পাওয়া ছিল তা পূর্ণ হয়েছে। ঐ ব্যক্তি বলেন, অতঃপর তার মৃত্যু যখন আসন্ন হ’ল তখন আমি আমার হাত তার হাতে রাখলাম। তিনি হাত প্রসারিত করে আমার হাত মুঠিবদ্ধ করতে গেলেন, কিন্তু পারলেন না। তখন আমি বুঝলাম এটা তার বইগুলোর কবুল হওয়ার আলামত। তারপর আমি তার বইগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করলাম।

আলী ইবনুল হুসাইন (রহঃ) ও রাতের দান :

যায়নুল আবিদীন আলী ইবনুল হুসাইন (রহঃ) রাতের অাঁধারে আটা পিঠে করে গরীব-মিসকীনদের তালাশ করে ফিরতেন। তিনি বলতেন, রাতের অাঁধারের দান প্রভুর রাগ স্তিমিত করে। মদীনা শহরে এমন অনেক লোক ছিল, যাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা কোথা থেকে হ’ত তারা তা জানত না। আলী ইবনুল হুসাইন মারা গেলে ঐ লোকগুলোর রাতের পাওয়া খাদ্য-খানা বন্ধ হয়ে গেল, তখন তারা বুঝতে পারল কোথা থেকে এগুলো আসত। তিনি এভাবে একশ’ পরিবারের ব্যয় বহন করতেন। মারা যাওয়ার পর লোকেরা আলী ইবনুল হুসাইন (রহঃ)-এর পিঠে কড়া পড়ার চিহ্ন দেখতে পায়। রাতে রুটির আটা বহন করতে করতে তাঁর পিঠে কড়া পড়ে গিয়েছিল।[30] এসব ঘটনার নায়কেরা যদিও তা গোপন রাখার চেষ্টা করতেন তবুও আল্লাহ তা‘আলা তা প্রকাশ করে দিয়েছেন। যাতে তারা নেতা হিসাবে বরিত হ’তে পারেন। আল্লাহ বলেছেন, وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا ‘আমাদেরকে আল্লাহভীরুদের জন্য আদর্শ বানাও’ (ফুরক্বান ৭৪)। অন্যত্র এসেছে وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا  ‘আর আমরা তাদেরকে নেতা করেছিলাম। যারা আমাদের নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে পথ প্রদর্শন করত’ (আম্বিয়া ৭৩)

ইখলাছের নিদর্শনাবলী

ইখলাছের কিছু আলামত রয়েছে। একজন মুখলিছ মানুষের মধ্যে তা ফুটে ওঠে। যেমন- খ্যাতি প্রত্যাশী না হওয়া, প্রশংসা-গুণ-কীর্তন লাভের আকাঙ্ক্ষী না হওয়া, দ্বীনের জন্য পাগলপারা হয়ে আমল করা, কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, ছওয়াবের নিয়তে কাজ করা, ধৈর্য-সহিষ্ণুতা অবলম্বন করা, অভিযোগ না করা, আমল গোপন করতে আগ্রহী থাকা, গোপনে আমল করতে অভ্যস্ত হওয়া, প্রকাশ্যে কৃত আমলের তুলনায় গোপনে আমলের সংখ্যা বেশী হওয়া।

এসবই ইখলাছের আলামত। তবে হে মুসলিম ভাই আমার! তুমি সতর্ক থেকো। কেননা ইখলাছের মধ্যেও ইখলাছ আছে কি-না তা খুব খেয়াল রাখতে হবে। ইখলাছও ইখলাছের মুখাপেক্ষী। আমরা আল্লাহর নিকট দো‘আ করি তিনি যেন আমাদের ও আপনাদের সকলকে মুখলিছ মানুষ বানান এবং আমাদের মন ও আমলকে লৌকিকতা ও মুনাফিকী থেকে পবিত্র রাখেন-আমীন!

ইখলাছ সংক্রান্ত কিছু মাসআলা

কখন আমল প্রকাশ্যে করা শরী‘আতসম্মত?

ইখলাছ সম্পর্কে আমাদের পূর্বসূরীদের অবস্থা কেমন ছিল আর কিভাবে তারা তাদের আমল গোপন করার চেষ্টা করতেন তা আমরা আলোচনা করেছি। আমরা এটাও আলোচনা করেছি যে, আমল গোপনে করা ইখলাছের অন্যতম নিদর্শন। তা সত্ত্বেও কখনো কখনো লোকচক্ষুর সামনে আমল করা শরী‘আতসম্মত। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তা গোপনে করা থেকে প্রকাশ্যে করা উত্তম।

ইবনু কুদামা (রহঃ) ‘নেকীর কাজ প্রকাশ্যে করার নিয়তের অনুমতি’ অনুচ্ছেদে বলেছেন, ‘প্রকাশ্যে আমল করলে তা অনুসরণ করার সুযোগ মেলে। মানুষ সৎকাজে অনুপ্রাণিত হ’তে পারে। কিছু আমল তো এমন আছে যে, ইচ্ছা করলেও তা গোপনে করা যায় না। যেমন হজ্জ ও জিহাদ। সেগুলো তো প্রকাশ্যেই করতে হয়। তবে প্রকাশ্যে আমলকারীর নিজের মন নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট থাকতে হবে। যাতে লোকরঞ্জন লাভের সুপ্ত বাসনা মনে আদৌ জাগ্রত হ’তে না পারে। বরং উক্ত প্রকাশ্য আমল দ্বারা সে রাসূলের অনুসরণের নিয়ত করবে’।

তিনি আরো বলেছেন, দুর্বলমনা লোকদের প্রকাশ্য আমল দ্বারা নিজেকে ধোঁকায় ফেলা মোটেও উচিত নয়। যারা দুর্বলমনা অথচ আমল যাহির করে তাদের উদাহরণ ঐ লোকের ন্যায়, যে দুর্বল সাঁতারু কোনরকম সাঁতরাতে পারে।

একদল লোককে ডুবে মরতে দেখে তার মনে দয়ার উদ্রেক হ’ল। সে তাদের পানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন ডুবন্ত লোকেরা তাকে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু সে ভালমত সাঁতরাতে না পারায় তারা সবাই ডুবে মারা গেল’।[1]

মাসআলাটি বিশদভাবে বুঝার জন্য আমরা আরো কিছু কথা বলছি। আমল প্রকাশ্যে ও গোপনে করার বেশ কিছু অবস্থা রয়েছে। অবস্থা বুঝে আমলকারীকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

১ম অবস্থা : সুন্নাহ অনুসারে আমলটি গোপনে করার কথা। এক্ষেত্রে গোপনে আমল করতে হবে। যেমন তাহাজ্জুদ ছালাত আদায় ও বিনয়-নম্রতা বজায় রাখা।

২য় অবস্থা : সুন্নাহ অনুসারে আমলটি প্রকাশ্যে করার কথা। এক্ষেত্রে প্রকাশ্যে আমল করতে হবে। যেমন জুম‘আ, জামা‘আতে নিয়মিত হাযির থাকা, সত্য কথা জোরে-শোরে বলা ইত্যাদি।

৩য় অবস্থা : আমলটা প্রকাশ্যেও করা যায় আবার গোপনেও করা যায়। সেক্ষেত্রে প্রকাশ্যে করলে যার মনে রিয়া বা লোক দেখানোর ভাব জাগরিত হবে তার জন্য আমলটি গোপনে করা সুন্নাত হবে। আর যে মনে করবে তার আমল প্রকাশ পেলে অন্য লোকেরা তার অনুসরণ-অনুকরণ করবে তার জন্য আমল প্রকাশ্যে করা সুন্নাত হবে। যেমন নফল দান।

এরূপ দানকালে কারো যদি মনে হয় লোকে দেখলে তার মনে প্রদর্শনেচ্ছা জাগবে তার জন্য গোপনে দান করা আবশ্যক। আর যদি তার মনে হয় দান করা দেখে অন্যেরা তার দানের অনুকরণ-অনুসরণ করবে এবং লোক দেখানো ভাবের ক্ষেত্রে সে তার মনের সাথে সংগ্রাম করতে পারবে, তাহ’লে তার জন্য প্রকাশ্যে দান করা সুন্নাত। অনুরূপভাবে কোন আলেম মসজিদে জনসমক্ষে নফল ছালাত আদায় করে যাতে নফল ছালাত কী এবং তার রাক‘আত সংখ্যা কত লোকে তা জানতে পারে। এ জাতীয় আরো অনেক বিষয় আছে যা অবস্থা ও নিয়ত ভেদে প্রকাশ্যে করা যায়।

কিছু পূর্বসূরী সম্পর্কে জানা যায় যে, তারা তাদের কিছু মর্যাদাপূর্ণ আমল প্রকাশ্যে করতেন যাতে লোকেরা তাদের অনুকরণ-অনুসরণ করে। যেমন জনৈক পূর্বসূরী মৃত্যুকালে তার পরিবারের সদস্যদের বলেছিলেন, তোমরা আমার জন্য

কেঁদো না। কেননা ইসলাম গ্রহণ করা অবধি আমি কোন পাপ কাজ করিনি। আবুবকর ইবনু ‘আইয়াশ তার ছেলেকে বলেছিলেন,يابنى إياك أن تعصي الله تعالى في هذه الغرفة، فإني ختمت فيها اثني عشر ألف ختمة- ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! এই কামরায় তুমি আল্লাহর নাফরমানী থেকে বিরত থাকবে। কেননা আমি এখানে বার হাযার বার কুরআন খতম করেছি’।[2]

এখানে একটি বিষয়ে সতর্ক না করলেই নয়। বিষয়টি এই যে, যে ব্যক্তি সর্বপ্রকার আমল সকল মানুষের দৃষ্টির আড়ালে করার আহবান জানায় সে একজন কুৎসিত বদমাশ লোক। ইসলামকে মিটিয়ে দেওয়াই তার অভিলাষ। মুনাফিকরা যখন কাউকে বড় অঙ্কের দান করতে দেখত তখন বলত এ রিয়াকার লোক দেখাতে দান করছে। আবার যখন দেখত কেউ অল্প কিছু দান করছে তখন বলত, আল্লাহর এই সামান্য দানের কোনই প্রয়োজন নেই। যাতে সমাজে কোন নেক আমল না থাকে এবং নেক্কারদের দেখাদেখি অন্যেরা তা না করে সেই লক্ষ্যে এসব কথা তারা বলাবলি করত।

এ কারণে যখন কোন ভাল মানুষ তার কোন নেক কাজ প্রকাশ্যে করে আর সেজন্য মুনাফিকরা তাকে মনোকষ্ট দেয়, তখন সে যেন ধৈর্য ধারণ করে এবং তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে। ভবিষ্যতে ইনশাআল্লাহ সে মহাকল্যাণ লাভ করবে।

রিয়া বা প্রদর্শনেচ্ছার ভয়ে আমল পরিহার :

ফুযাইল বিন আইয়ায (রহঃ) বলেছেন, تَرْكُ الْعَمَلِ مِنْ أَجْلِ النَّاسِ رِيَاءٌ، وَالْعَمَلُ مِنْ أَجْلِ النَّاسِ شِرْكٌ وَالْإِخْلَاصُ أَنْ يُعَافِيَكَ اللهُ عَنْهُمَا ‘মানুষের কথা ভেবে আমল ত্যাগ করা রিয়া বা লৌকিকতা এবং মানুষের কথা ভেবে আমল করা শিরক।  আর ইখলাছ হ’ল এতদুভয় থেকে তোমার আল্লাহর ক্ষমা লাভ’।[3] ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, যে কোন ইবাদত করতে সংকল্পবদ্ধ হওয়ার পর তা মানুষের নযরে পড়ার ভয়ে পরিত্যাগ করে সে একজন রিয়াকার বা লৌকিকতাকারী।

উল্লেখিত নির্দেশনা কেবল তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে গোপনে-প্রকাশ্যে সব রকম আমল ত্যাগ করে বসে থাকে। কিন্তু যে গোপনে আমল করার জন্য জনসমক্ষে আমল পরিহার করে তার কোন দোষ নেই। লৌকিকতার উক্ত বিধানের মাঝে কিছু জাহিল-মূর্খও পড়ে, যারা লৌকিকতা থেকে বাঁচার নাম করে দাড়ি ছাঁটে ও মুন্ডন করে। তারা বলে, দাড়িওয়ালা তার দাড়ি দ্বারা নিজেকে ঈমানদার ও ভাল মানুষ হিসাবে যাহির করে। যা সুস্পষ্ট রিয়া বা লৌকিকতা। এ লৌকিকতা থেকে বাঁচার জন্যই আমরা দাড়ি ছাঁটি বা মুন্ডন করি। কিন্তু এই লোকগুলো নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণিত দাড়ি ছেড়ে দেওয়া ও মুন্ডন না করা সংক্রান্ত বহু সংখ্যক সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হাদীছের কি জবাব দেবে? আমরা আল্লাহর নিকট দ্বীনের সঠিক বুঝ লাভের প্রার্থনা জানাই।

রিয়া ও আমলের মধ্যে একাধিক নিয়তের পার্থক্য :

রিয়া/লৌকিকতা : আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে খুশি করার নিয়তে কোন শারঈ আমল করা হ’লে তাকে রিয়া বা লৌকিকতা বলে।

আমলের মধ্যে একাধিক উদ্দেশ্য বা অংশীদার বানানো :

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়াও অন্য কিছু লাভের নিয়তে শারঈ কোন আমল করা হ’লে তাকে আমলের মধ্যে একাধিক উদ্দেশ্য বা অংশীদার বানানো বলে। উল্লেখিত দু’টি বিষয়ের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, শারঈ আমলের বেশ কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে। যথা:

প্রথম শ্রেণী : ব্যক্তি শুধুই আল্লাহর জন্য আমল করবে, অন্য কোন কিছুর প্রতি ভ্রুক্ষেপমাত্র করবে না। এ প্রকার আমল সবার ঊর্ধ্বে এবং সর্বোত্তম।

দ্বিতীয় শ্রেণী : ব্যক্তি আল্লাহর জন্য আমল করবে এবং সে সঙ্গে বৈধ আছে এমন কিছু অর্জনের নিয়ত করবে। যেমন ছিয়াম রাখবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, আর সে সাথে নিয়ত করবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য। হজ্জের সফর করবে আল্লাহকে রাযী-খুশী করার জন্য। সে সঙ্গে নিয়ত করবে ব্যবসায়ের জন্য। জিহাদ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। সে সঙ্গে নিয়ত করবে পরিবার-পরিজনকে খাওয়াতে-পরাতে গণীমত লাভের জন্য।

পায়ে হেঁটে মসজিদে যাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য, সে সাথে নিয়ত করবে হাঁটার ব্যায়ামের জন্য। এতে আমল অবশ্য বাতিল হবে না, তবে ছওয়াব কমে যাবে। বান্দার উচিত, তার আমলে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া অন্য কিছুর নিয়ত না করা।

তৃতীয় শ্রেণী : ব্যক্তি আল্লাহর জন্য আমল করবে, তবে সেই সঙ্গে এমন কিছু আশা করবে যা আশা করা বৈধ নয়। যেমন

মানুষের প্রশংসা লাভের আশা করা, ছালাত আদায় করে তার বিপরীতে অর্থ লাভের আকাঙ্ক্ষা করা। এটির আবার বেশ

কয়েকটি অবস্থা রয়েছে। যেমন-

এক. আমল শুরুর আগেই তার মধ্যে প্রশংসা কিংবা অর্থ লাভের আকাঙ্ক্ষা জাগবে। আর সেটাই তার আমলের মূল কারণ হবে। এক্ষেত্রে পুরো আমল বরবাদ হয়ে যাবে। যেমন মানুষ দেখুক এমন নিয়তে নফল ছালাত শুরু করা।

দুই. আমল শুরুর পরে উক্ত কামনা মনে জেগে উঠছে। তারপর সে তা দূর করতে চেষ্টা করছে। যেমন সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে ছালাত শুরু করেছিল। পরে দেখল যে, একজন তার দিকে তাকাচ্ছে। তার এ দৃশ্য ভাল লাগল এবং সে তাদের প্রশংসা ও সুখ্যাতি পাবার জন্য লালায়িত হয়ে উঠল। তারপর সে এই কামনা-বাসনা মন থেকে দূর করার জন্য চেষ্টা করতে করতে ছালাত শেষ করল। এক্ষেত্রে তার আমল ছহীহ হবে এবং সে তার প্রচেষ্টার জন্য ছওয়াব পাবে। তিন. আমল চলাকালে তার মাঝে উক্ত অসদুদ্দেশ্যের উদয় হ’ল কিন্তু সে তা প্রতিরোধের চেষ্টা করল না। এক্ষেত্রে তার আমল বাতিল গণ্য হবে।

৪র্থ শ্রেণী : ব্যক্তি তার আমল দ্বারা জায়েয কিছু নিয়ত করবে কিন্তু শারঈ প্রতিদানের জন্য আকাঙ্ক্ষী হবে না। যেমন- শুধু জোশ দেখানোর জন্য ছিয়াম রাখা। স্রেফ গণীমতের জন্য জিহাদ করা, শুধু সম্পদ বৃদ্ধির আশায় যাকাত দেওয়া। এতে তার আমল বাতিল গণ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا ‘যে ব্যক্তি দুনিয়া কামনা করে, আমরা সেখানে যাকে যা ইচ্ছা করি দিয়ে দেই। পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত করি। সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায়’ (বনী ইসরাঈল ১৭/১৮)

৫ম শ্রেণী : ব্যক্তি তার আমল দ্বারা এমন কিছু চাইবে যা চাওয়া শারঈভাবে মোটেও জায়েয নয়। সে সঙ্গে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দিকে মোটেও নযর দেবে না। যেমন শুধুই লোক দেখানোর জন্য ছালাত আদায় করা। এ শ্রেণীর লোকদের আমল বাতিল তো বটেই তদুপরি তারা গুনাহগার হবে।

রিয়া বা লৌকিকতা থেকে বাঁচতে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ :

রিয়া বা লৌকিকতা থেকে বাঁচার জন্য কোন কোন মুসলমান মিথ্যার আশ্রয় নেওয়াকে বৈধ মনে করে। এটা তাদের দাবীও বটে। এটি জঘন্য ভুল এবং কদর্য আমল। কেননা মিথ্যা কখনও মুসলিমের চরিত্রে পড়ে না। যেমন কোন একজন নিজে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে মসজিদ কিংবা মাদরাসা বানাচ্ছে। কিন্তু তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলছে, অমুক লোকে এটা বানাচ্ছে। তার কথা তো আসলে মিথ্যা। অনুরূপভাবে কথা ঘুরিয়ে বলাও এ পর্যায়ভুক্ত। যেমন সে বলল, মসজিদটা আমি বানিয়েছি জনৈক মুসলিমের অর্থে। জনৈক মুসলিম বলতে সে কিন্তু নিজেকে বুঝাচ্ছে।

কিছু কিছু জিনিস মনে হয় রিয়া বা লৌকিকতা, কিন্তু আসলেতা নয় :

  • কেউ না চাইতেই মানুষ তার ভালো কাজের প্রশংসা করে। এটা বরং মুমিনের জন্য আগাম সুসংবাদ।
  • দাবী-দাওয়া ছাড়াই খ্যাতি অর্জন। যেমন কোন আলিম কিংবা দ্বীন শিক্ষার্থী লোকদের দ্বীন-ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে থাকেন। তাদের কাছে যা দুর্বোধ্য ও জটিল তার সমাধান তারা প্রদান করেন। এভাবে জনগণের মাঝে কখনো কখনো তাদের নাম ছড়িয়ে পড়ে। লৌকিকতা থেকে দূরে থাকার নামে তাদের এহেন কাজ থেকে বিরত থাকা মোটেও সমীচীন হবে না। বরং তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাবেন এবং নিয়ত ঠিক রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
  • কেউ কেউ কখনো কোন উদ্যমী ইবাদতকারীকে দেখে তার মতো ইবাদতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এটা কোন লৌকিকতা বা রিয়া নয়। সে তার ইবাদতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত করলে অবশ্যই ছওয়াব পাবে।
  • পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জুতা সুন্দর ও পরিপাটি করে পরা, সুগন্ধি ব্যবহার করা ইত্যাদি। এর কোনটাই রিয়া বা লৌকিকতা নয়।
  • পাপ গোপন রাখা এবং সে সম্পর্কে কাউকে কিছু না বলা রিয়া নয়। বরং শারঈভাবে আমরা নিজেদের ও অন্যদের দোষ গোপন রাখতে আদিষ্ট। কিছু লোকের ধারণা অপরাধ প্রকাশ করা যরূরী, যাতে করে সে মুখলিছ বা খাঁটি মানুষবলে গণ্য হবে। এটি একটি ভুল ধারণা এবং ইবলীসের ধোঁকা। কেননা পাপের কথা বলে বেড়ানো মুমিনদের মাঝে অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত।

উপসংহার :

আমার প্রিয় মুসলিম ভাই! বর্তমান মুসলিম উম্মাহ যে সংকট ও সমস্যার মাঝে কালাতিপাত করছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের ইখলাছের বড়ই প্রয়োজন। অনেক বড় বড় ইসলামী প্রচার ও কল্যাণমূলক সংস্থা প্রতিষ্ঠা লাভের পর আজ ইখলাছের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে। কোন কোন দায়িত্বশীল ইখলাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে রিয়া বা লৌকিকতা, খ্যাতি ও দুনিয়ার স্বার্থকে লক্ষ্যভূত করেছে। ফলে তারা এমন এমন কাজ করেছে যদ্দরুণ সংস্থাগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।

ব্যক্তির নিজের আমলেও ইখলাছ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু আফসোস! যে নিয়তের হাকীকত বা তাৎপর্য জানে না সে কিভাবে নিয়ত ছহীহ-শুদ্ধ করবে? যে ইখলাছের হাকীকত বা পরিচয় জানে না সে কিভাবে ইখলাছ ছহীহ-শুদ্ধ করবে?

হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ইখলাছ দাও এবং আমাদের অন্তরে তা বদ্ধমূল করো। আল্লাহ তা‘আলার ছালাত ও সালাম বর্ষিত হৌক আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ), তাঁর পরিবার-পরিজন এবং তাঁর ছাহাবীদের উপর।

তথ্যসূত্র :

https://at-tahreek.com/article_details/1286

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *