অহংকার ও আত্মগরীমাকে মিটিয়ে দেয়ার কতিপয় ঘটনা
মহান বুযুর্গ হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রঃ) এর ঘটনা
হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রঃ) মুরীদানের এক কাফেলা সহকারে এক তরকারী বিক্রেতা বুড়ীর দোকানের সম্মুখ দিয়া যাইতেছিলেন। বুড়ী বলিল, হে জুনাইদ, তোমার দাড়ি উত্তম, না আমার ছাগলের দাড়ি উত্তম ? তিনি নিরুত্তর থাকিলেন। শুধু এতটুকু বলিলেন যে, ইহার জওয়াব পরে কোন সময় দিব। কিন্তু মুরীদগণ ক্রোধে ফাটিয়া পড়িতেছিলেন । তিনি বলিলেন, তোমরা ক্রুদ্ধ হইওনা। কারণ, কি হালতে আমার মউত হইবে সেই খবর তো আমার নাই। যদি ঈমান সহকারে মউত হয় এবং ঈমান লইয়া কবরে যাইতে পারি তবে নিঃসন্দেহে আমার দাড়ি তাহার ছাগলের দাড়ি অপেক্ষা উত্তম। আর যদি আমি ঈমান সহকারে কবরে যাইতে না পারি তবে নিঃসন্দেহে তাহার ছাগলের দাড়ি আমার দাড়ি হইতে উত্তম ।
আল্লাহু আকবার! নিজেকে কতটা মিটাইতে পারিলে এমন সরল ভাষায় উত্তর দেওয়া যায়। আমিত্ব বাকী থাকিলে কস্মিনকালেও কি তাহা সম্ভব হইত? বস্তুতঃ আমিত্বকে পিষিয়া ফেলিয়া দাসানুদাস হইয়া থাকাই হইতেছে বান্দার বান্দাসুলভ চরিত্র ও কর্তব্য। আল্লাহ্পাক আপন দয়ায় আমাদিগকে সেই নেআমত নসীব করিয়া দিন। আমীন ।
অতঃপর হযরত জুনাইদ (রঃ) দোআ করিলেন যে, আয় আল্লাহ্, (আপনার মেহেরবানীতে) যখন ঈমানের সহিত আমার মৃত্যু হইবে এবং কবরস্থানের দিকে আমার লাশ নিয়া যাওয়া হইবে, তখন কিছুক্ষণের জন্য আমাকে হায়াত নসীব করিয়া দিয়েন, যাহাতে আমি ঐ বুড়ীর প্রশ্নের উত্তর দিয়া যাইতে পারি। এবং তিনি মুরীদগণকে ওছিয়ত করিলেন যে, আমার কাফন পরানো লাশ ঐ বুড়ীর দোকানের সামনে দিয়া নিয়া যাইও। ইন্তেকালের পর মুরীদগণ তাহাই করিলেন। হযরত জুনাইদ (রঃ) কাফনের মধ্য হইতে মাথা উঠাইয়া বলিলেন, হে বুড়ী, আমার দাড়ি তোমার ছাগলের দাড়ি হইতে উত্তম ও দামী। কারণ, আমার ‘দয়াময় মাওলা’ আপন দয়ায় আমাকে ঈমানের সহিত মৃত্যু দান করিয়াছেন। (মাআরেফে শামসে তাবরেয ২৩৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।
সাইয়েদ আহমদ কবীর রেফাঈ (রঃ)-এর ঘটনা
সাইয়েদ আহমদ কবীর রেফাঈ (রঃ) নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম-এর অধঃস্তন বংশধর ও মস্ত বড় বুযুর্গ ছিলেন। হায়াতে-রেফাঈ ও আল্-বুইয়ানুল মুশাইয়াদ গ্রন্থদ্বয়ে লিখিয়াছেন : ৫৫৫ হিজরী সনে তিনি হজ্শে ষে মদীনা শরীফে গমন করিলেন। রওযা শরীফের সামনে দাঁড়াইয়া সালাম পেশ করিলেন। রওযা শরীফ হইতে সালামের উত্তর শোনা গেল। অতঃপর তিনি দুইটি ছন্দ আবৃত্তি করিলেন যাহার অর্থ এই যে, হে পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম, আমি যখন দূরে ছিলাম তখন আমার রূহকে পাঠাইয়া দিতাম, সেই রূহ্আ মার পক্ষ হইতে আপনার পাক রওযার মাটি চুম্বন করিয়া যাইত। আজত আমি সশরীরে আপনার সম্মুখে হাযির। পেয়ারা নবীজী ! আপনার হস্ত মোবারক বাড়ান, আমি তাহাতে চুম্বন করিয়া আমার প্রাণের সাধ মিটাইব। সঙ্গে সঙ্গে রওয়া শরীফের ভিতর হইতে পবিত্র হস্ত মোবারক বাহির হইল এবং তিনি তাহাতে চুম্বন করিলেন।
বর্ণিত আছে যে, ঐ সময় মসজিদে নববীতে প্রায় নব্বই হাজার মানুষ সমবেত ছিল, তাহারা এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। তাহাদের মধ্যে একজন ছিলেন মাবূবে-সুবহানী বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জীলানী (রঃ)। এই ঘটনা হযরত থানবী (রঃ) এবং হযরত শায়খুল হাদীস (রঃ) ও স্ব স্ব গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন।
হযরত থানবী (রঃ) বলেন : ইমাম জালালুদ্দীন (রঃ) লিখিয়াছেন যে, (হস্ত চুম্বনের মর্মস্পর্শী আবেদন পেশের পর) রওযা শরীফের মধ্য হইতে অতি নূরানী একখানা হাত বাহির হইল। তাহা ছিল প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম-এর পেয়ারা হাত। হযরত রেফাঈ দৌড়াইয়া গিয়া হস্ত মুবারকে চুম্বন করিলেন এবং বেহুশ হইয়া পড়িয়া গেলেন। ঐদিকে নূরানী হস্ত-মুবারক গায়েব হইয়া গেল, কিন্তু অবস্থা এই দাঁড়াইল যে, সমগ্র মসজিদে নববীতে উহার নূর ছড়াইয়া পড়িল যে, নূরের বন্যায় সমস্ত মসজিদ উজ্জ্বল হইয়া গেল, যেই নূরের সম্মুখে সূর্যের জ্যোতিও তুচ্ছ, হীন ও ম্লান হইয়া গেল।
হুশ ফিরিয়া আসার পর তাঁহার মনে খেয়াল জাগিল যে, এই ঘটনার ফলে লোকদের মধ্যে আমার বড়ত্ব যাহির হইবে যাহা আমাকে ধ্বংস করিয়া দিবে। অতএব,তিনি মসজিদে-নববীর দরজায় যমীনের উপর শুইয়া পড়িলেন এবং সকলকে কসম দিয়া বলিলেন : সকলে আমাকে পদদলিত করিয়া আমার উপর দিয়া পার হইয়া যান। এরূপ করার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, যেন তাঁহার অন্তরে অহংকার বা আত্মগরিমা পয়দা না হইতে পারে। বে-সমঝ সাধারণ লোকজন তাঁহার শরীরের উপর দিয়া পদদলিত করিয়া বাহির হইয়া গেল। আর তিনি ইহাতে বড়ই আনন্দ উপভোগ করিতেছিলেন যে, হে নফ্স্, কিছুক্ষণ আগে কী শান-মান প্রকাশ পাইয়াছিল, আর এখন কিরূপ যিল্লতির স্বাদ আস্বাদন করিতেছ ?
এক ব্যক্তি ঐ জন-সমাবেশের জনৈক বুযুর্গকে বলিল, হুযূর, মনে হয় এই ঘটনা দেখিয়া আপনার খুবই ঈর্ষা হইতেছিল। তিনি বলিলেন, শুধু আমাদের কেন, ঐ সময় আল্লাহ্ ফেরেশতাকুলেরও ঈর্ষা হইতেছিল যে, হায়, (পবিত্র হস্ত চুম্বনের) এই দৌলত যদি আমাদের ভাগ্যে জুটিত।
হযরত রেফাঈ (রঃ) এর আর একটি ঘটনা
হায়াতে-রেফাঈ গ্রন্থে আছে, এই মহান বুযুর্গ একদা রাস্তা দিয়া কোথাও যাইতেছিলেন । জনৈক ইয়াহুদী-আলেম দূর হইতে তাঁহাকে দেখিয়া সাথীদেরকে বলিতে লাগিল, ঐ দেখ, মুসলমানদের মহামান্য এক বুযুর্গ আসিতেছেন। আমি তাঁহাকে একটি প্রশ্ন করিব। যদি তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন, তাহা হইলে আমি সপরিবারে মুসলমান হইয়া যাইব। হযরত রেফাঈ (রঃ) নিকটে আসার পর সে প্রশ্ন করিল, মাননীয় হুযূর, আমার একটি প্রশ্ন : আপনি উত্তম, না ঐ কুকুরটি উত্তম ? হযরত রেফাঈ (রঃ) শান্তভাবে উত্তর দিলেন, হে ইয়াহুদী বন্ধু, শোন, যদি আমি ঈমান সহকারে মরিতে পারি, তবে অবশ্যই আমি এই কুকুর হইতে উত্তম। আর খোদা না করুন, যদি আমি ঈমান হারাইয়া মৃত্যু বরণ করি, তবে নিঃসন্দেহে কুকুরটি আমার চাইতে উত্তম ।
এ উত্তর শুনিয়া ঐ ইয়াহুদী পণ্ডিত কালেমা পড়িয়া মুসলমান হইয়া গেল । তাঁহার পরিবার-পরিজনও ইসলাম কবূল করিল । এই মহামানবগণ নিজেকে নিজে এত বেশী তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করিতেন । তাই, আল্লাহ্পাক তাঁহাদিগকে এত বড় উচ্চ বানাইয়াছেন ৷
হযরত বায়যীদ বোস্তামী (রঃ)-এর ঘটনা
হযরত থানবী (রঃ) বলেন : হযরত বায়ীদ বোস্তামী (রঃ)-এর ইন্তেকালের পর এক ব্যক্তি তাঁহাকে স্বপ্নে দেখিল এবং জিজ্ঞাসা করিল যে, হুযূর, আল্লাহ্পাকের পক্ষ হইতে আপনার সহিত কিরূপ ব্যবহার আসিল? তিনি বলিলেন, আল্লাহ্পাক আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, (হে বায়জীদ!) আমার জন্য কি আনিয়াছ ? আমি তখন চিন্তা করিয়া দেখিলাম যে, আমার অন্যান্য সমস্ত আমলই ত ত্রুটিপূর্ণ,অতএব, এসব আমল ও ইবাদতের নাম উল্লেখ করাই অসমীচীন। অবশ্য, আমি একজন মুসলমান, আমার তওহীদ ত কামেল্। আল্লাহ্ এক, সেই এক আল্লাহকেই আমার আল্লাহ্ এবং তাহাকেই আমার ‘সব কিছু’ জানিয়াছি, আমার এ তওহীদী-বিশ্বাসত পরিপূর্ণ। অতএব, ইহাই পেশ করিয়া দেই। সুতরাং, আমি আরয করিলাম, আয় আল্লাহ্, স্রেফ তওহীদ আনিয়াছি, তওহীদের ঈমান লইয়া হাযির হইয়াছি।
আল্লাহ্পাক বলিলেন :اتَذْكُرُ لَيْلَةَ اللَّبَنِ ؟“ দুধের রাত্রের ঘটনা কি তোমার মনে আছে ?”ইহাতে একটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হইয়াছে। একদা তিনি রাত্রিবেলা দুধ পান করার পর তাঁহার পেটে বেদনা হইতেছিল। তখন তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া গেল যে, দুধ পান করার কারণে পেটে ব্যথা করিতেছে। ঐ কথার উপরই আজ পাকড় হইয়া গিয়াছে যে, দুধকে তুমি ব্যথার উৎস (বা ব্যথাদাতা) বলিয়াছ। হযরত বায়যীদ (রঃ) এই প্রশ্ন শুনিয়া ঘাবড়াইয়া গেলেন। বিনত হইয়া আরয করিলেন,আমার মাওলা! আমার কাছে কিছুই নাই, কিছুই আনি নাই,আমি খালি হাতে আসিয়াছি । আল্লাহ্পাক বলিলেন, এখন তুমি ঠিক পথে আসিয়াছ । যাও, আজ আমি তোমাকে এমন একটি আমলের ওছীলায় ক্ষমা দান করিতেছি যাহা সম্পর্কে তোমার কল্পনাও হয় নাই যে, ইহার দ্বারা তোমার ক্ষমা লাভ হইতে পারে।
তাহা এই যে, একদা রাত্রিবেলা একটি বিড়ালছানা শীতে কাঁপিতেছিল । উহার কষ্ট দেখিয়া উহার প্রতি তোমার দয়া লাগিল। তুমি উহাকে নিয়া তোমার লেপেরমধ্যে শোওয়াইয়া ছিলে। বিড়ালছানাটি দোআ করিয়াছিল যে, আয় আল্লাহ্, যেভাবে ইনি আমাকে আরাম দান করিলেন, তদ্রূপ আপনিও তাহাকে আরাম দান করুন। অদ্য আমি ঐ বিড়ালছানার দোআর ওছীলায় তোমাকে ক্ষমা করিয়া দিতেছি। আমার তরীকত-তাছাওউফ, যিকির- মোরাকাবা, জীবনের সকল সাধনাই এখানে ‘তুচ্ছ’ সাব্যস্ত হইয়াছে। কেবলমাত্র একটি বিড়াল ছানার সুপারিশেই আমাকে ক্ষমা ও নাজাত দান করা হইয়াছে।
ফায়দা : এই ঘটনায় আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় ইহাই যে, আমল ও বন্দেগী ত করিয়াই যাইতে হইবে। মউত পর্যন্ত মাওলার বাতলানো হুকুম ও আমল হইতে আমাদের মুহূর্তকালের জন্যও কোন ছুটি নাই। কারণ, ঈমান ও আমলই নাজাতের শর্ত, কিন্তু নাজাতের জন্য যথেষ্ট নয়। নাজাত একমাত্র দয়াময়ের দয়ার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, যত আমলই করিনা কেন, যিকির, ওযীফা, হজ্, ওমরাহ্, দান-খয়রাত ইত্যাদির পরিমাণ পাহাড় ছাড়াইয়া আসমানও ছুঁইয়া ফেলুক না কেন, তবুও, সর্বদা নিজেকে, নিজের সমস্ত আমলকে তুচ্ছ, অগণ্য, কবূলের অযোগ্য বলিয়া ধারণা রাখিতে হইবে। আমল করিয়া অহংকার অথবা গরিমা করা যাইবে না। আর দ্বীন হইল সবচেয়ে বড় জিনিস। দ্বীন ও দ্বীনী আমলের উপরও যখন গরিমা করা যায় না,তখন দুনিয়া, গাড়ি,বাড়ি, টাকাকড়ি, জোত-জমি, বংশ-ভাষা, বর্ণ, গোত্র প্রভৃতি লইয়া গরিমা করার তো কোন প্রশ্নই আসে না।
বই : অহংকার ও তার প্রতিকার
লিখক : হাকীম আখতার সাহেব (রহ,)