একাধিক মাযহাবের অনুসরণ মূলত বৈধ
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বিশদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে অত্যন্ত জোরালোভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। এর সারসংক্ষেপ নিম্নে পেশ করছি-
একাধিক মাযহাবের অনুসরণ মূলত বৈধ ছিল। কোন এক বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) বা তার মতাদর্শের কাউকে জিজ্ঞেস করে নেয়া এবং অন্য বিষয়ে অপর কোন মাযহাবের কাউকে জিজ্ঞেস করে আমল করার অবকাশ ছিল। কেননা, সে যুগে জনমনে তাকওয়া ও ধার্মিকতার প্রভাব বেশী ছিল।
পক্ষান্তরে বর্তমানে মানুষের মধ্যে ধর্মদ্রোহিতা ও প্রবৃত্তিপ্রবণতা বেড়েই চলছে। অতীতকালে মানুষ আলিমগণকে স্বাভাবিক কারণে অথবা সতর্কতাহেতু জিজ্ঞেস করতেন। তাই আজও যদি মানুষের মধ্যে অতীতের ন্যায় দীন-ধর্ম ও তাকওয়া প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে বর্তমানেও নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ না করে সুযোগমত একাধিক মাযহাবের শরণাপন্ন হওয়া বৈধ হবে; কিন্তু বাস্তব সত্য এই যে, সেদিনের আশা আর করা যায় না। বরং দিন দিন ধর্মহীনতা, ফিতনা-ফাসাদ, মিথ্যা ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। আর তা আমার কথা নয়;
বরং রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং ইরশাদ করেছেন- “আমার সর্বোত্তম উম্মাত আমার যুগের উম্মাত। অতঃপর শ্রেষ্ঠ তারা যারা তাদের সংশ্লিষ্ট হবে। অতঃপর তারা যারা তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবে। তারপর এমন জনগোষ্ঠির আগমন ঘটবে, যারা খেয়ানত করবে তাদেরকে আমানতদ্বার মনে করা হবেনা। তারা সাক্ষ্য দিবে কিন্তু তাদের থেকে তা তলব করা হবেনা, তারা অঙ্গীকার করবে কিন্তু তা পূর্ণ করবেনা।
এ হাদীসের আলোকে বুঝা গেল যে, দুর্নীতি, ধর্মদ্রোহীতা ও মানুষের মধ্যে কু-প্রবৃত্তি দিন দিন বেড়েই চলবে। তাই বর্তমানে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষের হাতে যদি দীন-ধর্ম ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তারা ধর্মকে খেলনায় পরিণত করবে এবং যখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই নাচাবে।
হযরত থানভী (রহ.)-এর উদাহরণ
হযরত থানভী (রহ.) উদাহরণস্বরূপ বলেন যে, আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের জনৈক ছেলে-মেয়ে পরস্পর বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে তারা জানতে পারে যে, তারা উভয়ই এক মহিলার দুধ পান করেছে। এমতাবস্থায় আমার নিকট ফতওয়া জিজ্ঞেস করার জন্য আসলে আমি বলি যে, তারা দুগ্ধজাত ভাই বোন। বিধায় তাদের মধ্যে বিয়ে বন্ধন অবৈধ।
অতঃপর সে তার স্বার্থনিহিত ফতওয়া উদ্ধারের মানসে আলিম নামধারী ব্যবসায়ীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকে। ব্যবসায়ীরা তাকে হীলা বাহানা শিখিয়ে পুনরায় আমার কাছে প্রেরণ করে। তখন সে এসে আমাকে বলে যে, সে দুধ পান করেছিল ঠিকই কিন্তু সাথে সাথে বমি করে ফেলে দিয়েছিল। এ মর্মে তার কাছে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণও ছিল। আমি বলি যে, এমতাবস্থায়ও বিবাহ বন্ধন হারাম হবে। তখন সে জনৈক আহলে হাদীস থেকে ফতওয়া নিয়ে এসেছে।
ফতওয়ায় একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে: إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تُحَرِّمُ الرَّضْعَةُ وَلَا الرَّضْعَتَانِ أوِ الْمَصَّةُ وَالْمَصَّتَانِ . وَفِي رَوَايَةِ مُسْلِمٍ الْإِمْلَاجَةُ وَالْإِمْلَاحَتَان
“এক দু’ চোষণের দ্বারা বিবাহ বন্ধন অবৈধ হয় না!।” এখন সে খুব আনন্দের সাথে ঐ মেয়েকে নিয়ে ঘর সংসার করে যাচ্ছে। কেননা, এটিও তো আলিমেরই ফতওয়া!। এ মুতাবিক আমল করতে অসুবিধা কি?
কিন্তু কে তাকে জিজ্ঞেস করবে যে, তুমি কয় চুমুক দুধ পান করেছ এবং তুমি কি তা গণনা করেছিলে? বমি করার পর কি দুধের প্রতিক্রিয়া মোটেই তোমার মধ্যে ছিল না? বাস্তবে যদি তোমাদের বিয়ে বন্ধন হারাম হয়েই থাকে তাহলে পুরো জীবনের ব্যভিচারের গুনাহ কার আমলনামায় যাবে? এ বিষয়ে কি হাদীস আরও আছে? তাহলে সকল হাদীসের সামঞ্জস্য ও রহিত অরহিত এবং প্রাধান্যনির্ভর বিষয়সমূহ তোমার ও তোমার ফতওয়াদাতা কথিত হাদীস বিশারদের মালূম আছে?
এ হল বর্তমান মাসআলা সন্ধানী স্বেচ্ছাচারী জনগণ আর স্বঘোষিত ব্যবসায়ী গবেষকদের হাল। আর এটাই হল আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী শ্রেষ্ঠযুগের মধ্যে পার্থক্য। তাদের উদ্দেশ্য হত কুরআন-সুন্নাহর সঠিক তথ্য জানা ও আমল করা। তাই এ জাতির সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও ধর্মীয় বিধি-বিধানের যথাযথ প্রয়োগের একমাত্র জরুরী ব্যবস্থা হল এদিক সেদিক ঘোরাফেরার দ্বার রুদ্ধ করে শুধু এক মাযহাবের উপরই অনুসরণ করা। অন্যথায় প্রবৃত্তি তাড়িত এ জাতিকে মারাত্মক ভয়াবহ পরিণতি ও চরম খাসারত বহন করতে হবে।
তাকলীদের প্রকারভেদ
প্রধানতঃ তাকলীদকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ১. (মুক্ত তাকলীদ) ২. (ব্যক্তি তাকলীদ)।
শরীয়তের পরিভাষায় সকল বিষয়ে নির্দিষ্ট মুজতাহিদের পরিবর্তে বিভিন্ন মুজতাহিদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলার নাম তাকলীদে মুলাক বা মুক্ত তাকলীদ।
পক্ষান্তরে সকল বিষয়ে নির্দিষ্ট মুজতাহিদের সিদ্ধান্ত মতে চলার নাম বা ব্যক্তি তাকলীদ অবশ্য উভয় তাকলীদেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ, নিজস্ব যোগ্যতার অভাবহেতু সুগভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী মুজতাহিদের পরিবেশিত ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের আলোকে কুরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করে যাওয়া। বলাবাহুল্য যে, উপরোক্ত অর্থে তাকলীদের বৈধতা ও অপরিহার্যতা কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য দলীলাদি দ্বারা সুপ্রমাণিত।
তথসূত্র:
তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ
মুফতি হিফজুর রহমান
প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।