ইসলাম

ইসলামে মাযহাবের গুরুত্ব

প্রত্যেক ধর্মের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক বিষয় হচ্ছে সে ধর্মকে পরিপূর্ণ জানা। আর ধর্মকে পরিপূর্ণ জানতে হলে উক্ত ধর্মের মূল গ্রন্থের উপর গভীর জ্ঞান লাভ করতে হবে। ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন কোরআন-হাদীসের উপর গভীরভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণা করা । আর সবার পক্ষে এটা সম্ভব নয় যে, সে ধর্মের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সকল বিষয়কে গভীরভাবে উপলব্ধি করবে। তবে প্রত্যেকের জন্য জরুরি হলো, ইসলামের সকল বিধি-বিধান মেনে জীবনকে পরিচালনা করা। একদিকে যেমন কোরআন-সুন্নাহর সকল বিষয়ের নিগূঢ় রহস্য সবার উপলব্ধি সম্ভব নয়, অন্যদিকে ইসলামের সকল বিধি-বিধান মেনে চলা সকলের জন্য জরুরি। এখন প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি সকল বিধান উপলব্ধির যোগ্যতা রাখে না, সে কীভাবে ইসলামের সকল বিধান পালন করবে। এখানেই মাযহাবের গুরুত্ব প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে। আর এটা তো মহান আল্লাহর চিরন্তন বিধান ও অমোঘ নীতি যে, সকল মানুষ এক স্তরের হবে না। কেউ অধিক সমঝদার। আর কেউ তার তুলনায় কম। সুতরাং যারা সকল বিষয়ের সমঝ রাখে না তারা অধিক সমঝদার ও জ্ঞানী ব্যক্তি থেকে বিধান জেনে নেবে । আর এটাই মাযহাব।

এখানে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার- কিছু বিধি-বিধান এমন রয়েছে, যে ব্যাপারে কোনো ইমামের মাঝে মতপার্থক্য নেই। যেগুলো ‘মুজমা আলাইহি’ তথা সকলের নিকট এক ও অভিন্ন । যেমন- পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে সর্বমোট সতের রাকাত নামায ফরয হওয়া, প্রতি রাকাতে একটি রুকু ও দুইটি সিজদা করা, তাকবীরে তাহরীমার মাধ্যমে নামায শুরু করা এবং সালামের মাধ্যমে শেষ করা ইত্যাদি । ইবাদত থেকে মীরাছ পর্যন্ত শত শত নয়; হাজার হাজার এমন মাসআলা আছে, যা ‘মুজমা আলাইহি’ অর্থাৎ এসব মাসআলায় মুজতাহিদ ইমামগণসহ গোটা উম্মাহর ইজমা রয়েছে । আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে এসব বিষয়ের ভিন্ন বিধান পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে কিছু মাসায়েলের ক্ষেত্রে ইমামগণের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে। আর এ মতভিন্নতার সূচনা হয়েছে খায়রুল কুরুন থেকে । যেসব মাসায়েলের মধ্যে মতভিন্নতা পাওয়া যায়। তার অধিকাংশেই সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনের যুগ থেকেই মতভিন্নতা চলে আসছে কিংবা বিষয়টিই এমন যাতে সুস্পষ্ট বক্তব্যপূর্ণ কোনো আয়াত বা সহীহ হাদীস নেই, এমনকি এ বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা অথবা কোনো আছারও পাওয়া যায় না। মুজতাহিদ ইমামগণ শর’ঈ কিয়াসের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে এসব বিষয়ের পূর্ণ সমাধান বের করেছেন। এ ধরণের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাসায়েলের সমাধান একজন সাধারণ মানুষ কীভাবে করবে? এ জন্যই তো মাযহাব বা মুজতাহিদ ইমামদের ফাতওয়ার অনুসরণ করতে হয় ।

এবার দেখুন এ সকল বিষয়ে কোরআন, হাদীস ও সাহাবাযুগের পথ নির্দেশনা। পর্যায়ক্রমে আমরা এখানে তা তোলে ধরছি- আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

يَأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَ أَحْسَنُ تَأْوِيلًا )

অর্থ: ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং তোমাদের মধ্য হতে ‘উলূল আমরের অনুসরণ করো । অনন্তর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে মতোবিরোধ করো তাহলে তা (নিরসনের জন্য) পেশ করো আল্লাহ ও রাসূলের সমীপে । যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনে থাকো । এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং পরিণামের দিক থেকে মঙ্গলজনক।’ (সূরা নিসা, ৪:৫৯)

এ আয়াত প্রসঙ্গে ইমাম আবু বকর জাসসাস রহ. (মৃ: ৩৭০ হি.) বলেন,

يدل على أن أولي الأمر هم الفقهاء ; لأنه أمر سائر الناس بطاعتهم

অর্থাৎ ‘এটি (এ আয়াত) প্রমাণ করে যে, উলূল আমর হলেন ফকীহ ইমামগণ। কেননা সকল মানুষকে (এ আয়াতের দ্বারা) তাদের আনুগত্য করার প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ (আহকামুল কোরআন, ৭/২৩১)

অন্যত্র আল্লাহ তা’আলা বলেন, فَسْتَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

অর্থ: ‘যদি তোমরা না জেনে থাকো তাহলে আহলে ইলমদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।’ (সূরা নাহাল (১৬), আয়াত: ৪৩; সূরা আম্বিয়া (২২), আয়াত: ৭)

আলোচ্য আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, অনভিজ্ঞ ও অপরিপক্ক ব্যক্তিদেরকে অভিজ্ঞ ও পরিপক্ক ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হয়ে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে। সঠিক ইসলামের দিকনির্দেশনা জেনে সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করতে হবে। আর এটাই তো মাযহাবের অনুসরণ।

অন্যদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, اقْتَدُوا بِاللَّذَيْنِ مِنْ بَعْدِي أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ অর্থ: ‘তোমরা আমার পরবর্তীতে আবু বকর ও ওমরকে অনুসরণ করে চলবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ২৩২৪৫; সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ৩৬৬২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস: ৩২৬০৫)

এখানে ‘ইকতেদা’ শব্দটি দ্বারা ধর্মবিষয়ে বিজ্ঞদের অনুসরণ করার প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে । যেমন দ্বীন ও শরীয়তের বিষয়ে নবীগণের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কোরআন ইরশাদ করে, أوليكَ الَّذِيْنَ هَدَى اللَّهُ فَبِهَدْهُمُ اقْتَيه অর্থ: ‘ওরাই সে সকল লোক (নবী-রাসূলগণ) আল্লাহ যাদেরকে হেদায়াত দান করেছেন ।

সুতরাং আপনি তাদের হেদায়াতের অনুসরণ করুন, ইকতেদা করুন।’ (সূরা আন’আম (৬), আয়াত:৯০) সুতরাং দ্বীনী বিষয়ে অনুসরণ-অনুকরণই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে মাযহাবের অনুসরণ। কেননা, মাযহাবের অনুসরণের অর্থ তো হচ্ছে নিষ্ঠার সাথে দ্বীনী বিষয়ে বিজ্ঞজনের শরণাপন্ন হওয়া। আর মাযহাবের ইমামগণ তো হচ্ছেন দ্বীনের ক্ষেত্রে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়কে ইজতিহাদ করে সঠিক পন্থাকে উম্মাহর সামনে উপস্থাপনকারী। যারা প্রকৃতপক্ষে ওয়ারেসে রাসূল, তারাই দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি, অতিরঞ্জন, মিথ্যাচার ও মূর্খতাকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে দাফন করার নিমিত্তে জীবনকে বিলীন করেছেন।

হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,

يَحمل هذا العلمَ مِن كُل خَلَفٍ عدوله ينفون عنه تحريف الغالين ، وانتحال المبطلين ، وتأويل الجاهلين

অর্থ: ‘পূর্বসূরীদের কাছ থেকে এ ইলমকে নিখুঁতভাবে বহন করবে এমন উত্তরসূরীগণ যারা নিষ্ঠাবান, ইনসাফগার। তারা এ ইলম থেকে অতিরঞ্জনকারীদের অতিরঞ্জন, বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার ও মূর্খ-অজ্ঞদের ভুল ব্যাখ্যাকে প্রতিহত করবে এবং দ্বীনকে হেফাজত করবে।’ (মুশকিলুল আছার, হাদীস: ৩২৬৯)

শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে মূর্খ-জাহিলরা নানাবিধ ভুল ব্যাখ্যা করে থাকে, সে সকল ভুল ব্যাখ্যাদান কারীদের থেকে দ্বীনকে হেফাজত করার জন্য প্রয়োজন একদল নিষ্ঠাবান ইনসাফগার। আর প্রতিটি যুগে তারাই বাতিলপন্থীদের কবল থেকে দ্বীনকে হেফাজত করবে। কোরআন-সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা মানুষকে শেখাবে। মুজতাহিদ ইমামগণ সেই নিষ্ঠাবান আলিমদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তাদের ইজতিহাদকৃত মাসআলা মান্য করাই হচ্ছে মাযহাব মানা। মাযহাব ভিন্ন কিছু নয়।

আরেক হাদীসে খলীফাগণের সুন্নত অনুসরণ করার প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ المهدِيِّينَ فَتَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِدِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

আমার (ইন্তেকালের) পর তোমাদের মধ্য হতে যারা বেঁচে থাকবে তারা বহু ইখতিলাফ দেখতে পাবে । তখন তোমরা অনুসরণ করবে আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাত এবং সেগুলোকে আকড়ে ধরবে সর্বশক্তি দিয়ে । আর সকল নব আবিস্কৃত ও নবউদ্ভাবিত বিষয় থেকে দূরে থাকবে। কেননা, সকল নবউদ্ভাবিত বিষয় বিদ’আত। আর সকল বিদ’আত গোমরাহী।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ১৭১৪৫)

সুতরাং যখন ফুরূ’ঈ মাসায়েলের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দেখা দিবে তখন জরুরি হলো, কোনো একজন বিজ্ঞ আলেমে দ্বীনের ইত্তেবা করা । বর্ণিত হাদীসে এ ইশারা দেয়া হয়েছে যে, মতপার্থক্য হলে হেদায়াতপ্রাপ্ত জামাত খলীফাগণের রীতি-নীতি অনুকরণ করবে । খলীফাগণের পর তাদের অনুসৃত পথে যারা চলেছেন তাদের পথে চলবে। মুজতাহিদ ইমামগণ প্রকৃতপক্ষে রাসূলের খলীফাগণের পূর্ণ অনুসারী ছিলেন।

সাহাবায়ে কেরামের মাঝে এ মাযহাব বা মাসায়েলের ক্ষেত্রে যোগ্যব্যক্তির ইত্তেবার বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে। হযরত ওমর ফারূক রাযি. জাবিয়া নামক স্থানে ভাষণ দেয়ার সময় বলেন, منْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْقُرْآنِ فَلْيَأْتِ أَبَيَّ بْنَ كَعْبٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْقَرَائِضِ فَلْبَاتِ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفِقْهِ فَلْيَأْتِ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْمَالِ فَلْيَأْتِنِي فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى جَعَلَنِي لَهُ خَازِنًا وَقَاسِمًا অর্থাৎ ‘যে চায় কোরআন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে, সে যেন উবাই বিন কা’ব রাযি. এর নিকট গমন করে । আর যে চায় ইলমে ফারায়ে সম্পর্কে জানতে, সে যেন যায়দ বিন ছাবেত রাযি. এর নিকট উপস্থিত হয়। আর যে চায় ফিকহ সম্পর্কে অবগত হতে, সে যেন মু’আয বিন জাবালের নিকট হাজির হয় । আর যে ধন-সম্পদ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে ইচ্ছুক সে যেন আমার কাছে আসে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা আমাকে এর তত্ত্বাবধায়ক ও বণ্টনকারী বানিয়েছেন । (সুনানে রাইহাকী, হাদীস: ১২৫৫১)

সাহাবাযুগেও ফিকহের মাযহাব ছিলো। সাহাবাগণ একে অপরের মাযহাবের অনুসরণ করতেন । হযরত মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব দামাত বারকাতুহুম লিখেন, ‘সাহাবায়ে কেরামের যুগে ফিকহের মাযহাব সম্পর্কে ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রহ. বলেন-

ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. (১৬১ হি.-২৩৪ হি.) ইমাম বুখারী রহ.-এর বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামের সেসব ফকীহের কথা আলোচনা করেছেন, যাদের শাগরিদগণ তাঁদের মত ও সিদ্ধান্তগুলো সংরক্ষণ করেছেন, তা প্রচার প্রসার করেছেন এবং যাদের মাযহাব ও তরীকার উপর আমল ও ফাতওয়া জারী ছিল । আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. এই প্রসঙ্গে বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এমন ব্যক্তি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. (মৃত্যু : ৩২ হিজরী), যাইদ ইবনে ছাবিত রাযি. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ১১ ও মৃত্যু : ৪৫ হিজরী) ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ৩ ও মৃত্যু : ৬৮ হিজরী) ।

তাঁর আরবী বাক্যটি নিম্নরূপ- ولم يكن في أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم من له صُحَيْبَةٌ، يذهبون مذهبه، ويفتون بفتواه ويسلكون طريقته، إلا ثلاثة عبد الله بن مسعود وزيد بن ثابت وعبد الله بن عباس رضي الله عنهم، فإن لكل منهم أصحابا يقومون بقوله ويفتون الناس.

এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. তাঁদের প্রত্যেকের মাযহাবের অনুসারী ও তাঁদের মাযহাব মোতাবেক ফাতওয়াদানকারী ফকীহ তাবেয়ীগণের নাম উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর কিরাত অনুযায়ী মানুষকে কুরআন শেখাতেন, তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানুষকে ফাতওয়া দিতেন এবং যারা তাঁর মাযহাব অনুসরণ করতেন তারা হলেন নিম্নোক্ত ছয়জন মনীষী : আলকামাহ (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আসওয়াদ (মৃত্যু : ৭৫ হিজরী), হিজরী)মাসরূক (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আবীদাহ (মৃত্যু : ৭২ হিজরী), আমর ইবনে শারাহবীল (মৃত্যু : ৬৩হিজরী ) ও হারিস ইবনে কাইস (মৃত্যু : ৩৬ হিজরী)।

ইবনুল মাদীনী রহ. বলেছেন, ইবরাহীম নাখায়ী রহ. (৪৬-৯৬ হিজরী) এই ছয়জনের নাম উে করেছেন।

ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর উপরোক্ত বিবরণের সংশ্লিষ্ট আরবী পাঠ নিম্নরূপ- الذين يقرؤن الناس بقراءته ويفتونهم بقوله ويذهبون مذهبه …. এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. লিখেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি.-এর (ফকীহ) শাগরিদদের সম্পর্কে এবং তাঁদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবরাহীম নাখায়ী (৪৬- ৯৬ হিজরী) ও আমের ইবনে শারাহীল শাবী (১৯-১০৩ হিজরী)। তবে শাবী মাসরূক রহ.-এর মাযহাব অনুসরণ করতেন ।

আরবী পাঠ নিম্নরূপ- وكان أعلم أهل الكوفة بأصحاب عبد الله ومذهبهم إبراهيم والشعبي إلا أن الشعبي كان يذهب مذهب مسروق. এরপর লিখেছেন- وكان أصحاب زيد بن ثابت الذين يذهبون مذهبه في الفقه ويقومون بقوله هؤلاء الاثنى عشر …..

অর্থাৎ যাইদ ইবনে ছাবিত রাযি.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসারে মগ্ন ছিলেন তাঁরা বারো জন ।

তাদের নাম উল্লেখ করার পর ইবনুল মাদীনী রাহ. লিখেন, এই বারো মনীষী ও তাদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবনে শিহাব যুহরী (৫৮-১২৪ হিজরী), ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আনসারী (মৃত্যু : ১৪৩ হিজরী), আবুয যিনাদ (৬৫-১৩১ হিজরী), আবু বকর ইবনে হাযম (মৃত্যু ১২০ হিজরী)।

এদের পরে ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহ. (৯৩-১৭৯ হিজরী) ।

এরপর ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন- وكما أن أصحاب ابن عباس ستة الذين يقومون بقوله ويفتون به ويذهبون مذهبه

তদ্রূপ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.-এর যে শাগরিদগণ তার মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচারে মগ্ন ছিলেন, সে অনুযায়ী ফাতওয়া দিতেন এবং তার অনুসরণ করতেন, তাঁরা ছয়জন ।

এরপর তিনি তাঁদের নাম উল্লেখ করেন। ইমাম ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর পূর্ণ আলোচনা তাঁর ‘কিতাবুল ইলালে’ (পৃষ্ঠা : ১০৭-১৩৫, প্রকাশ : দারুবনিল জাওযী রিয়ায, ১৪৩০ হিজরী।) বিদ্যমান আছে এবং ইমাম বাইহাকী রাহ.-এর ‘আলমাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা’তেও (পৃষ্ঠা: ১৬৪-১৬৫) সনদসহ উল্লিখিত হয়েছে । আমি উক্তিটি উভয় কিতাব সামনে রেখেই উদ্ধৃত করছি। এই কথাগুলো আলোচ্য বিষয়ে এতই স্পষ্ট যে, এখানে আর কোনো টীকা-টিপ্পনীর প্রয়োজন নেই ।’ (উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা, ৪৬-৪৮)

সাহাবাযুগ থেকেই মাযহাবের অনুসরণ ও অনুকরণ চলে আসছে। সাহাবাদের মধ্যে কেউ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. এর মাযহাব গ্রহণ করেছেন । আবার কেউ হযরত ইবনে ওমরের কেউ ইবনে আব্বাসের, কেউ যায়দ বিন ছাবেতের। এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তা হলো একাধিক মুজতাহিদ থাকা সত্ত্বেও একজনকে মানা আবশ্যক কেন? তাছাড়া মাযহাব চারটি কেন? অথচ মুজতাহিদ ইমাম অনেক!

যদি মুক্তভাবে মাযহাব মানার অনুমতি দেয়া হয় তাহলে অবশ্যই প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ বড় বড় পাপকর্মে জড়িয়ে পড়বে। তখন দ্বীন ও শরীয়ত ছেলাখেলার বস্তুতে পরিণত হবে। মানুষ জেনেশোনে পাপকর্মে লিপ্ত হবে । এক মাযহাবের দোহাই দিয়ে এক সময় এক আমল করবে। আবার তার বিপরীত আমল করবে অন্য মাযহাবের দোহাই দিয়ে। নিজের সুবিধা ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করবে । সুতরাং তাকওয়া ও ইখলাস এবং পরকালের চিন্তা-চেতনার স্থানে শিকড় গেড়ে বসবে শয়তানী, মুনাফেকী ও স্বার্থান্ধতা। আর প্রবৃত্তির ঘৃণ্য চাহিদা পূরণে শরীয়তকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেও মানুষ তখন দ্বিধাবোধ করবে না। কোনো সন্দেহ নেই যে, তখন মানুষ সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে জড়িয়ে পড়বে প্রবৃত্তির গোলামীতে। আর তা তার জন্য বয়ে আনবে দ্বীন ও দুনিয়ার হালাকাত ও ধ্বংস। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. (মৃ: ৭২৮ হি.) বিয়ের মাসআলার ক্ষেত্রে লিখেন, فيكونون في وقت يقلدون من يفسده وفي وقت يقلدون من يصححه بحسب الغرض والهوى ومثل هذا لا يجوز باتفاق الأمة…… لأن ذلك يفتح باب التلاعب بالدين وفتح للذريعة إلى أن يكون التحليل والتحريم بحسب الأهواء

‘তারা আপন স্বার্থ ও প্রবৃত্তির অনুকূল হলে সেই ইমামের মাযহাবকে অনুসরণ করে যিনি স্বার্থের মোতাবেক বিয়ে ভঙ্গ হওয়ার ফাতওয়া প্রদান করেন । আবার স্বার্থ ও প্রবৃত্তির প্রতিকূল হলে এমন ইমামের মাযহাবকে অনুকরণ করে যিনি বিয়ে বিশুদ্ধ হওয়ার ফাতওয়া প্রদান করেন । প্রবৃত্তির এমন লাগামহীন গোলামী উম্মাহর ঐক্যমতে নাজায়েয। (একটু আগে বেড়ে তার কারণ বলেন)…… কারণ হচ্ছে, তখন দ্বীন ও শরীয়ত ছেলেখেলার পুতুলে পরিণত হবে । প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের জন্য হালাল ও হারামের দ্বার উন্মোচিত হবে। (মাজমূউল ফাতাওয়া ৩২/১০০-১০১)

আল্লামা শাতেবী রহ. (মৃ: ৭৯০ হি.) এদিকে ইঙ্গিত করে বলেন, فلو فتح لهم هذا الباب لانحلت عرى المذهب অর্থাৎ ‘যদি তাদের (এ উম্মাহর) জন্য একাধিক মাযহাব অনুসরণের দ্বার উন্মুক্ত করা হতো তাহলে মাযহাবের দ্বীনী-বন্ধন ও ধর্মীয়-সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো ।’ (আল-মুওয়াফাকাত, ৪/১৪৭)

নির্দিষ্ট ব্যক্তির মাযহাব অনুসরণ করা অপরিহার্য। সেই অপরিহার্যতা সম্পর্কে শাইখুল ইসলাম ইমাম নববী রহ. (মৃ: ৬৭৬ হি.) লিখেন, ووجهه أنه لو جاز اتباع أي مذهب شاء لا فضى إلى أن يلتقط رخص المذاهب متبعا هواه ويتخير بين التحليل والتحريم والوجوب والجواز وذلك يؤدى إلى انحلال ربقة التكليف بخلاف العصر الأول فانه لم تكن المذاهب الوافية بأحكام الحوادث مهذبة . فعلى هذا يلزمه أن يجتهد في اختيار مذهب يقلده على التعيين

অর্থাৎ ‘শুধুমাত্র ব্যক্তির মাযহাব অপরিহার্য হওয়া কারণ এই যে, মাযহাব অনুসারীকে যদি অনুমতি দেয়া হয়, তুমি যেকোনো একটি মাযহাবকে গ্রহণ করতে পারবে, তাহলে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ সকল মাযহাবের অনুকূল বিষয়গুলোই নিজের জন্য বেছে নেবে । ফলে হারাম-হালাল ও বৈধাবৈধ নির্ধারণের এখতিয়ার এসে যাবে তার হাতে। প্রথম যুগে অবশ্য ব্যক্তিতাকলীদ সম্ভব ছিলো না । কেননা, তখন ফিকহ বিষয়ক মাযহাবগুলো সুবিন্যস্ত ও পূর্ণাঙ্গ ছিলো না । সুতরাং যেকোনো একটি মাযহাব বেছে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে তা অনুসরণ করাই এখন অপরিহার্য। (আলমাজমু শরহুল মুহায্যাব, ১/৫৫)

আল্লামা নববী রহ. -এর কথা খোলাসা হলো, সাহাবাযুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত যত ফকীহ মুজতাহিদ বিগত হয়েছেন তাদের প্রত্যেকের ফাতওয়াসমূহে কিছু না কিছু সহজ ও সুবিধাজনক বিষয় রয়েছে। তাছাড়া কোনো মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃত সকল মাসআলাই কিন্তু উম্মাহর সম্মিলিত মতে গ্রহণযোগ্য নয়। দু’একটি মাসআলা তো এমন আছে, যা উম্মাহর সম্মিলিত মতামতের পরিপন্থী। এমতাবস্থায় যদি মুক্তভাবে একাধিক মাযহাব গ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়। তাহলে স্বার্থান্ধ সুবিধাবাদীরা প্রত্যেক মাযহাব থেকে নিজেদের স্বার্থ ও প্রবৃত্তির অনুকূলের মতটিকেই গ্রহণ করবে। ফলে ইমাম নববী যে আশংকা করেছেন তাই প্রতিফলিত হবে যে, হারাম-হালালের বিষয়টি হয়ে যাবে মানুষের স্বার্থ ও মর্জিনির্ভর।আর এটা শরীয়তের মাকদাসের পরিপন্থী। তদুপরি মুক্ত-মাযহাবকে গ্রহণ করে যদি ব্যক্তি-মাযহাবকে বর্জন করা হয় তাহলে প্রতিটি মুহূর্তে আমরা যাদের ‘ধর্মপ্রাণ’ মনে করি তাদের পদস্খলনের সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে । কেননা, নফস ও প্রবৃত্তির কুমন্ত্রণা এবং শয়তানের প্ররোচনা এতই সূক্ষ্ম ও ভয়ঙ্কর যে, মানুষের অবচেতন মনও তার নাগালের বাইরে নয়।

এ ক্ষেত্রে আল্লামা আবদুর রউফ মুনাবী রহ. (মৃ: ১০৩১ হি.) অত্যন্ত সারগর্ভ আলোচনা করেছেন । মুহাক্কিক ইবনে হুমাম রহ. (মৃ:৮৬১ হি.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন, والغالب أن مثل هذه الالتزامات لكف الناس عن تتبع الرخص

অর্থাৎ ‘সুযোগসন্ধানী মানুষের সহজিয়া মনোবৃত্তিকে প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যেই এ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।’ (ফায়জুল কাদীর, ২/১২)

এবার আমরা দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দেবো। বহু মুজতাহিদ ইমাম থাকা সত্ত্বেও কেন চার মাযহাবের ইমামদের কোনো একজনকেই সুনির্দিষ্টভাবে মানতে হবে?

এ কথা তো সুস্পষ্ট যে, চার ইমাম ছাড়াও মুজতাহিদ আরো অনেক ইমাম ছিলেন। যেমন, ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহ, ইমাম আওযায়ী রহ, ইমাম লাইস বিন সাদ রহ. ইমাম বুখারী ও ইবনে প্রমুখ মুজতাহিদ ইমামগণ। তারা ফুরূ’ঈ মাসায়েলের ক্ষেত্রে ইখতিলাফ করেছেন।তথাপিও তাদের মাযহাব কেন অবশিষ্ট নেই ?

অতি সংক্ষিপ্তভাবে বিষয়টি উল্লেখ করবো। প্রথমে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মাযহাব (ইমামের অনুসরণ) পরবর্তীদের মাঝে বিস্তার লাভ করার জন্য স্বতসিদ্ধ শর্ত হচ্ছে, সেই ইমামের ইজতিহাদকৃত মাসায়েল সুবিন্যস্ত গ্রন্থবদ্ধ ও সংরক্ষিত থাকা এবং উক্ত ইমামের ছাত্র কর্তৃত সেই ইজতিহাদকৃত মাসায়েল পরবর্তীদের নিকট পৌঁছা। আর এ বিষয় চার ইমাম ছাড়া অন্য কোনো ইমামদের ক্ষেত্রে হয়নি। তাই পৃথিবীতে চার মাযহাবের অনুসরণের উপর ওলামায়ে কেরামের ইজমা প্রমাণিত হয়েছে।

এ কথাটিকে আল্লামা আবদুর রউফ মুনাবী রহ. (মৃ: ১০৩১ হি.) এভাবে বর্ণনা করেছেন,

لأن المذاهب الأربعة انتشرت وتحررت حتى ظهر تقييد مطلقها وتخصيص عامها بخلاف غيرهم لانقراض اتباعهم

অর্থাৎ কেননা, বর্তমানে চার মাযহাবই সুবিন্যস্ত ও গ্রন্থবদ্ধ। ফলে ইসলামী জগতের জন্য চার মাযহাবের কোনো একটিকেই ইত্তেবা করা জরুরি, অন্যদের মাযহাবের অস্তিত্ব জগতের কোথাও না পাওয়া কারণে ।’ (ফায়জুল কাদীর, ২/৯)

ইবনে তাইমিয়া রহ. এ ব্যাপারে খুব সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, وليس في الكتاب والسنة فرق في الائمة المجتهدين بين شخص وشخص ؛ فمالك والليث بن سعد والاوزاعى والثوري هؤلاء أئمة في زمانهم ، وتقليد كل منهم كتقليد الآخر لا يقول مسلم : إنه يجوز تقليد هذا دون هذا ، ولكن من منع من تقليد أحد هؤلاء في زماننا ، فإنما يمنعه لأحد شيئين : أحدهما : اعتقاده أنه لم يبق من يعرف مذاهبهم وتقليد الميت فيه نزاع مشهور، فمن منعه قال: هؤلاء موتى ، ومن سوغه قال : لابد أن يكون في الإحياء من يعرف قول الميت. و الثاني : أن يقول الإجماع اليوم قد انعقد على خلاف هذا القول

অর্থাৎ ‘এতে কোনো দ্বিমত নেই যে, কোরআন-সুন্নাহের বিচারে ইমাম মালেক, লাইছ বিন সা’দ, আওযায়ী ও সুফিয়ান সাওরী প্রমুখ মুজতাহিদগণ নিজ নিজ যুগের ইমাম ছিলেন। সুতরাং তাকলীদ বা মাযহাবের অনুসরণের ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে এদের মাঝে কোনো পার্থক্য করার অধিকার কোনো মুসলমানের নেই। অবশ্য বর্তমানে দু’টি অনিবার্য কারণে কতিপয় মুজতাহিদের তাকলীদের ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে।

প্রথমত : তাদের মাযহাবের প্রতিনিধিত্ব করার মত কোনো আলিম বিদ্যমান নেই। আর মৃত ব্যক্তির অনুসরণ ও তাকলীদের বৈধতা বিষয়ে জোরালো মতভেদ রয়েছে। মৃত হওয়ার কারণে কেউ এটিকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলেছেন। আর কেউ বলেছেন, মৃত মুজতাহিদ আলিমের মাযহাবের প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্য আলিম জীবত থাকতে হবে। (আর চার মাযহাবের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্বকারী আলিম অবশিষ্ট রয়েছে। সুতরাং চার মাযহাবই এ শর্তের মাপকাঠিতে পূর্ণ উত্তীর্ণ হতে পারে। অন্য কোনো মাযহাবের অনুসরণ করা বৈধ হবে না।)

দ্বিতীয়ত : বর্তমানে বিলুপ্তির শিকার মাযহাবগুলোর বিপক্ষে (মাযহাব চতুষ্টয়ের উপর) উম্মাহর জমা সম্পন্ন হয়েছে । (তাই মুসলিম উম্মাহর ইজমা উপেক্ষা করে মাযহাব চতুষ্টয়ের বিপরীতে কোনো মাযহাব রচনা করা আদৌ বৈধ হবে না।) (মাজমুউল ফাতাওয়া ২০/৫৮৩)

অন্যদিকে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. (মৃ: ১১৭৬ হি.) তার অমর গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ তে লিখেন,

هذه المذاهب الأربعة المدونة المحررة قد اجتمعت الأئمة عليها

অর্থ: ‘সুবিন্যস্ত গ্রন্থবদ্ধ এ চার মাযহাবের উপর সকল ইমামগণের ‘ইজমা’ তথা ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ, ১/১২৩)

হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. (মৃ: ১১৭৬ হি.) ‘ইকদুল জীদ’ নামক কিতাবে এ সম্পর্কে স্বতন্ত্র একটি পরিচ্ছেদ এনেছেন এই শিরোনামে باب تأكيد الأخذ بهذه المذاهب الأربعة التشديد في تركها والخروج عنها

(চার মাযহাবের অপরিহার্যতা এবং তা লঙ্ঘন করার কঠিন পরিণতি প্রসঙ্গ) এতে শাহ সাহেব লিখেছেন,

اعلم أن في الأخذ بهذه المذاهب الأربعة مصلحة عظيمة و في الإعراض عنها كلها مفسدة كبيرة ونحن نبين ذلك بوجوه

অর্থ: ‘চার মাযহাবের অনুসরণ ও ইত্তেবাতে যেমন বিরাট কল্যাণ রয়েছে, তেমনি তা বর্জন ও লঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে সমূহ ক্ষতি ও অকল্যাণ। আমরা এখানে তার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করবো।’ (ইকদুল জীদ, পৃ:১৩)

এরপর শাহ সাহেব বিস্তারিত আলোচনা করেন । আমরা এখানে তার সারসংক্ষেপ পেশ করছি ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিরোধানের পর থেকে মুসলিম উম্মাহ দ্বীনী বিষয়ের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে অনুসরণের পথ অবলম্বন করে আসছে। তাবেয়ীগণ সাহাবীগণের, তাবে তাবেয়ীগণ তাবেয়ীগণের, এভাবে পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীগণের ইত্তেবা ও তাকলীদ করার সমষ্টিগত সুন্নাত নবীযুগ থেকে চলে আসছে। আর এটি কল্যাণের প্রমাণ বহন করে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,’তোমরা বড় দল ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অনুসারী হও।’ বলাবাহুল্য যে, অন্যান্য মাযহাবের বিলুপ্তির কারণে এখন চার মাযহাবের অনুসরণই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অনুসরণ এবং তা লঙ্ঘনের অর্থ হলো গরিষ্ঠ অংশের বিরুদ্ধাচরণ।

এ ছাড়া যে কোনো মুজতাহিদের সিদ্ধান্ত মোতাবিক ফাতওয়া প্রদানের অনুমতি দেয়া হলে ওলামায়ে সূ তথা ধর্মব্যবসায়ী আলিমরা নিজেদের ফাতওয়াকে কোনো না কোনো মুজতাহিদের নামে চালিয়ে দেয়ার মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যাবে। পক্ষান্তরে চার মাযহাবের বেলায় সে আশংকা নেই। কেননা এখানে বিশেষজ্ঞ আলিমগণের স্বতন্ত্র জামাত গবেষণা ও বিশ্লেষণের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছেন। সুতরাং তাদের সতর্ক দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে ইমাম চতুষ্টয়ের কোনো সিদ্ধান্তের ভুল অর্থ করা সম্ভব নয়।

সুতরাং চার মাযহাবের কোনো একটার অনুসরণ করাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পথ ও পন্থা । ভিন্ন কোনো ফিরকা তৈরী করা হবে ইজমা’র ভিত্তিতে গোমরাহী । ইজমা বা সাবিলুল মুমিনীন থেকে বিচ্যুত হওয়া গোমরাহী ।

আল্লাহ বলেন, وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ

অর্থ: “আর যে মুমিনগণের বিপরীত পথের অনুসরণ করে আমি তাকে ঐদিকে ফিরিয়ে দেবো যেদিকে ফিরে যেতে সে মনস্থ করেছে। আর আমি তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করবো।’ (সূরা নিসা (৪), আয়াত: ১১৫)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَمَاتَ إِلَّا مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةٌ অর্থ: ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের জামা’আতের মাঝে ন্যূনতম ফাটল সৃষ্টি করে সে তো ধর্মহীন জাহেলী অবস্থায় মরবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৭০৫৪, সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৮৪৯)

অতএব চার মাযহাবের কোনো একটির অনুসরণকে ত্যাগ করলে ইজমা বা উম্মাহর অনুসৃত পথ ও পন্থার বিরুদ্ধাচরণ করা হবে । আর উম্মাহর ইজমার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া কি হাদীস অনুসরণ?! মুসলমানদের অনুসৃত পথকে অস্বীকারকারী কীভাবে আহলে হাদীস (!) হবেন। আহলে হাদীসের ইমামগণের তো অবশ্যই ফিকহের ক্ষেত্রে একজন অনুসৃত ইমাম ছিলেন। কারো যদি না থাকে তাহলে তাকে আমরা প্রকৃত আহলে হাদীস বা হাদীস বিশারদ বলতে পারি না ।এ বিষয়ে একটি উক্তি পেশ করছি।

ইবনে ওয়াহাব রহ. বলেন, كل صاحب حديث ليس له إمام في الفقه فهو ضال، ولو لا أن الله انقذنا بمالك والليث لضللنا

অর্থ: ‘কোনো হাদীসের ধারকের যদি ফিকহের ক্ষেত্রে কোনো ইমাম না থাকে তাহলে সে পথহারা হবে । আল্লাহ তা’আলা যদি ইমাম মালিক ও লাইসের দ্বারা আমাকে মুক্ত না করতেন তাহলে আমি পথ হারিয়ে ফেলতাম । (কিতাবুল জামি, ইবনে আবি যায়েদ আলকাইরাওয়ানী, পৃষ্ঠা: ১১৭)

ইবনে ওয়াহব রাহ.-এর এই কথাগুলোর আরো হাওয়ালা জানার জন্য এবং বিষয়টির গুরুত্ব বোঝার জন্য দেখা যেতে পারে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামাহর কিতাব اثر الحديث الشريف في اختلاف الائمه

তথসূত্র:

মাযহাব ছেড়ে বেদ্বীনির পথেে

আল্লামা মুহাম্মদ যাহিদ আল কাউসারী

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *