জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে পরিত্রাণের উপায়
জাহান্নামে প্রবেশের মূল কারণ হল, আল্লাহ তা’আলার সাথে কুফরী করা। অতএব, জাহান্নাম হতে মুক্তিলাভের প্রধান উপায় হল, ঈমানের ছয়টি আরকানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং সৎকর্ম করা ।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, الَّذِيْنَ يَقُولُونَ رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ –
‘যারা বলে, হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই আমরা ঈমান আনলাম। অতএব আমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন’ (সূরা আলে-ইমরান ৩/১৬)।
তিনি অন্যত্র বলেন, رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ رَبَّنَا إِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ – رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيْمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ – رَبَّنَا وَآتِنَا مَا وَعَدْتَنَا عَلَى رُسُلِكَ وَلَا تُحْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمَيْعَادَ
হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করনি। তুমি পবিত্র মহান । সুতরাং তুমি আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর। হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই তুমি যাকে আগুনে প্রবেশ করাবে, অবশ্যই তাকে তুমি অপমান করবে। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের রব! নিশ্চয়ই আমরা শুনেছিলাম একজন আহ্বানকারীকে, যে ঈমানের দিকে আহবান করে যে, তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আন। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব! আমাদের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করুন এবং বিদূরিত করুন আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি, আর আমাদেরকে মৃত্যু দিন নেককারদের সাথে। হে আমাদের রব! আর আপনি আমাদেরকে তা প্রদান করুন যার ওয়াদা আপনি আমাদেরকে দিয়েছেন আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে। আর কিয়ামতের দিনে আপনি আমাদেরকে অপমান করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না’ (সূরা আলে-ইমরান ৩/১৯১-১৯৪)।
অত্র আয়াত সমূহ থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা’আলার প্রতি ঈমান আনায়ন করাই জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভের প্রধান মাধ্যম যা ব্যতীত কোন নেক আমল আল্লাহ তা’আলার নিকট গ্রহণ হবে না। অতএব প্রথমেই আল্লাহ তা’আলার প্রতি ঈমান আনতে হবে তারপর একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দেখিয়ে দেওয়া পদ্ধতিতে ইবাদত করতে হবে। তাহলেই কেবল আল্লাহ তা’আলার নিকট ইবাদত কবুল হবে এবং তা জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করে জান্নাত লাভের অসীলা হবে ।
এছাড়াও যে সব আমলের মাধ্যমে মানুষ জাহান্নামের শাস্তি হতে মুক্তিলাভ করবে তার মধ্যে যেমন-
১- আল্লাহর প্রকৃত প্রেমিক :
যারা আল্লাহ তা’আলার প্রতিটি আদেশ যথাযথ ভাবে পালন করেন এবং প্রতিটি নিষেধ নিঃশর্তে বর্জন করেন এবং তাঁর সাথে শিরক করেন না। তারাই আল্লাহ তা’আলার প্রকৃত প্রেমিক, যাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে মুক্তিদান করবেন।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لا يُلْقِي الله حَبِيْبَهُ فِي النَّارِ –
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রেমিককে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন না। ছহীহুল জামে— আছ-ছাগীর হা/৭০৯৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪০৭।
২- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রকৃত প্রেমিক :
যারা দুনিয়ার সব কিছু হতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বেশী ভালবাসেন। সার্বিক জীবন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শে পরিচালিত করেন। প্রতিটি ইবাদাত তাঁর সুন্নাত অনুযায়ী পালন করেন। ভাল কাজের দোহায় দিয়ে রাসূল (ছাঃ) এর সুন্নাতকে উপেক্ষা করেন না এবং তার উপর মিথ্যারোপ করেন না। তারাই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রকৃত প্রেমিক, যারা জাহান্নামের আযাব থেকে পরিত্রাণ পাবে।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَلِي قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لا تَكْذِبُوْا عَلَيَّ، فَإِنَّهُ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ فَلْيَلج النَّار –
আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা আমার উপর মিথ্যারোপ করো না। কারণ আমার উপর যে মিথ্যারোপ করবে সে জাহান্নামে যাবে । বুখারী হা/১০৬, ‘নাবী (ছাঃ)-এর উপর মিথ্যারোপ করার পাপ’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ১/৬৯ পৃঃ।
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ إِنَّهُ لَيَمْنَعُنِي أَنْ أُحَدِّثَكُمْ حَدِيثًا كَثِيرًا أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَال مَنْ تَعَمَّدَ عَلَيَّ كَذِبًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ –
আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এ কথাটি তোমাদের নিকট বহু হাদীছ বর্ণনা করতে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় যে, নবী (ছাঃ) বলেছেন, যে ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যারোপ করে সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়।বুখারী হা/১০৮, ‘নাবী (ছাঃ)-এর উপর মিথ্যারোপ করার পাপ’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ১/৬৯ পৃঃ; মুসলিম হা/২।
৩- আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী :
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘আর যে তার রবের সামনে দাঁড়াবার ভয় করে, তার জন্য থাকবে দু’টি জান্নাত’ (সূরা রহমান ৫৫/৪৬)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكَى مِنْ حَشْيَةِ اللهِ حَتَّى يَعُودَ اللَّبَنُ فِي الضَّرْعِ
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীর জাহান্নামে প্রবেশ করা তেমনি অসম্ভব, যেমন- দুধ ওলানে প্রবেশ করা অসম্ভব । তিরমিযী হা/১৬৩৩; নাসাঈ হা/৩১০৮; মিশকাত হা/৩৮২৮; আলবানী, সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে— আছ-ছাগীর হা/৭৭৭৮।
৪- ইসলামের আরকান সমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন :
(ক) ছালাত আদায় করা।
হাদীছে এসেছে, عَنْ بُرَيْدَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْعَهْدُ الَّذِي بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمُ الصَّلاَةُ، فَمَنْ تَرَكَهَا فَقَدْ كَفَرَ –
বুরাইদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমাদের ও তাদের (মুনাফিকদের) মধ্যে যে অঙ্গীকার রয়েছে তা হল, ছালাত । সুতরাং যে ছালাত ত্যাগ করল সে কাফির হয়ে গেল।তিরমিযী হা/২৬২১; নাসাঈ হা/৪৬৩; ইবনু মাজাহ হা/১০৭৯; মিশকাত হা/৫৭৪, ‘ছালাতের ফযীলত ও মাহাত্মা’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/১৬২ পৃঃ; আলবানী, সনদ ছহীহ, ছহীহ তারগীব হা/৫৬৪।
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ الْعَبْدِ وَبَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلاَةُ
জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেছেন, বান্দার ও কুফরীর মধ্যে পার্থক্য হল ছালাত ত্যাগ করা। মুসলিম হা/৮২; মিশকাত হা/৫৬৯, ‘ছালাতের ফযীলত ও মাহাত্মা’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ২/১৬০ পৃঃ।
তবে এই কাফিরগণ কালেমায়ে শাহাদাত’কে অস্বীকারকারী কাফিরগণের ন্যায় চিরস্থায়ী জাহান্নামী নয়। বরং কালেমার বরকতে ও নবী (ছাঃ)-এর শাফা’আতের ফলে শেষ পর্যায়ে তারা এক সময় জান্নাতে ফিরে আসবে।
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنْ رَسُوْلَ الله صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُولُ الصَّلَوَاتُ الْحَمْسُ وَالْجُمُعَةُ إِلَى الْجُمُعَةِ وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنَّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ –
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত, এক জুম’আ হতে পরবর্তী জুম’আ এবং এক রামাযান হতে পরবর্তী রামাযানের মধ্যকার যাবতীয় (ছাগীরা) গুনাহের কাফফারা স্বরূপ, যদি সে কাবীরা গোনাহসমূহ হতে বিরত থাকে (যা তওবা ব্যতীত মাফ হয় না)’। মুসলিম হা/৬৩৪; মিশকাত হা/৬২৪, ‘ছালাতের ফযীলত ও মাহাত্মা’ অধ্যায় ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অন্যত্র বলেন لَنْ يَلِجَ النَّارَ أَحَدٌ صَلَّى قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا يَعْنِي الْفَجْرَ وَالْعَصْرَ –
‘যে ব্যক্তি সূর্য উদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পূর্বে ছালাত আদায় করবে অর্থাৎ ফজর ও আছরের ছালাত আদায় করবে সে ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না’ ৷ মুসলিম হা/২৩৩; মিশকাত হা/৫৬৪, ‘ছালাতের ফযীলত ও মাহাত্মা’ অধ্যায়।
অতএব জাহান্নামের শাস্তি হতে পরিত্রাণের অন্যতম মাধ্যম হল নিয়োমিত ছালাত আদায় করা ।
(খ) যাকাত আদায় করা :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِنَّ فِي الْجَنَّةِ لَغُرْفَةً، قَدْ يُرَى ظَاهِرُهَا مِنْ بَاطِنِهَا، وَبَاطِنُهَا مِنْ ظَاهِرِهَا، أَعَدَّهَا الله لِمَنْ أَطْعَمَ الطَّعَامَ، وَأَلاَنَ الْكَلاَمَ، وَتَابَعَ الصَّيَامَ، وَصَلَّى بِاللَّيْلِ وَالنَّاسُ نِيَام –
‘জান্নাতের মধ্যে এমন সব (মসৃণ) ঘর রয়েছে যার বাইরের জিনিস সমূহ ভিতর হ’তে এবং ভিতরের জিনিস সমূহ বাহির হ’তে দেখা যায়। সে সকল ঘরসমূহ আল্লাহ তা’আলা সেই ব্যক্তির জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন যে ব্যক্তি (মানুষের সাথে) নম্রতার সাথে কথা বলে, ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে (যাকাত আদায় করে), পর পর ছিয়াম পালন করে এবং রাতে ছালাত আদায় করে অথচ মানুষ তখন ঘুমিয়ে থাকে’৷ মুসনাদে আহমাদ হা/১৩৫১; মিশকাত হা/১২৩২; আলবানী, সনদ ছহীহ।
(গ) রামাযান মাসে ছিয়াম পালন করা :
হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الصِّيَامُ
আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ছিয়াম ঢাল স্বরূপ। বুখারী হা/১৮৯৪, ‘ছওমের ফযীলত’ অধ্যায়, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ২/২৯৪ পৃঃ; মুসলিম হা/১১৫১ ৷ অর্থাৎ ছিয়াম জাহান্নামের আগুন প্রতিহত করার ঢাল ।
অন্য হাদীছে এসেছে,
عَنْ عُثْمَانَ بْنِ أَبِي الْعَاصِ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الصَّوْمُ جُنَّةٌ مِنْ عَذَابِ اللهِ، كَجُنَّةِ أَحَدِكُمْ مِنَ الْقِتَالِ
উছমান ইবনু আবিল আছ (রাঃ) রাসূল (ছাঃ) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, ছওম আল্লাহ্র আযাব হতে পরিত্রাণের ঢাল, তোমাদের মধ্যে কারো যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢালের ন্যায়। মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৯৩৯; আলবানী, সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে’ হা/৩৮৬৬।
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِي سَعِيدٍ رَضِيَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَنْ صَامَ يَوْمًا فِي سَبِيْلِ اللَّهِ بَعْدَ اللهُ وَجْهَهُ عَنِ النَّارِ سَبْعِيْنَ خَرِيْفًا –
আবু সা’ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহ্র রাস্তায় এক দিন ছিয়াম পালন করে, আল্লাহ তার মুখমণ্ডলকে জাহান্নামের আগুন হতে সত্তর বছরের রাস্তা দূরে সরিয়ে নেন। বুখারী হা/২৮৪০, ‘আল্লাহর পথে থাকা অবস্থায় ছিয়াম পালনের ফযীলত’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (তাওহীদ পাবলিকেশন্স) ৩/১৫০ পৃঃ; মুসলিম হা/১১৫৩; মিশকাত হা/২০৫৩ ।
অতএব ছিয়াম জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের অন্যতম উপায় ।
৫- আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা :
হাদীছে এসেছে, أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لَا يَجْتَمِعُ كَافِرُ وَقَاتِلُهُ فِي النَّارِ أَبَدًا
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, কাফির এবং তাদেরকে হত্যাকারী (মুসলিম) কখনই এক সঙ্গে জাহান্নামে অবস্থান করবে না ৷ মুসলিম হা/১৮৯১; মিশকাত হা/৩৭৯৫।
হাদীছে আরো বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ جَبْرٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا اغْبَرَّتْ قَدَمَا عَبْدِ فِي سَبِيْلِ اللَّهِ فَتَمَسَّهُ النَّارُ –
আল্লাহর পথে যে বান্দার দু’পা ধূলায় মলিন হয়, তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে এমন হয় না । ১২৫
৬- বেশী বেশী দান-ছাদাক্বাহ করা :
অধিক পরিমাণে দান-ছাদাকা করা আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের অন্যতম মাধ্যম । আল্লাহ তা’আলা বলেন, إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوْهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ –
‘তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর তবে তা উৎকৃষ্ট। আর যদি গোপনে দান কর এবং দরিদ্রদেরকে প্রদান কর তবে তোমাদের জন্য তা কল্যাণকর। আর এর দ্বারা তিনি তোমাদের পাপ সমূহ মোচন করে দেন। বস্তুতঃ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আল্লাহ যথাযথভাবে খবর রাখেন’ (সূরা বাকারাহ ২/২৭১)।
তিনি অন্যত্র বলেন, لا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحِ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللَّهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا
‘তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন মঙ্গল নিহিত থাকে না। তবে যে ব্যক্তি ছাদাকা করে, সৎকর্ম করে, মানুষের মাঝে পরষ্পরে সত্য মীমাংসা করে এবং যে আল্লাহ্র সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে এরূপ করে সে ব্যতীত । আমি তাকে এর জন্য মহা পুরষ্কারে ভূষিত করব’ (সূরা নিসা ৪/১১৪)।
হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللَّهُ تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلا ظِلُّهُ إِمَامٌ عَدْلٌ، وَشَابٌ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللَّهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِي الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلَانِ تَحَابًا فِي اللَّهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِب وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَحْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ حَاليًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ –
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে নিজ ছায়া তলে আশ্রয় দিবেন। (১) ন্যায়-নিষ্ঠাবান নেতা (২) আল্লাহর ইবাদতে গড়ে উঠা যুবক (৩) ঐ ব্যক্তি যার অন্তর সব সময় মসজিদের সাথে ঝুলন্ত থাকে (তার মন সর্বদা মসজিদে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে) (৪) এমন দু’ব্যক্তি যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টিচিত্তে একে অপরকে ভালবাসে, তার উপরেই একত্রিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয় (৫) এমন ব্যক্তি যাকে কোন সুন্দরী, মর্যাদাবতী সম্ভ্রান্তা নারী (ব্যভিচার) এর জন্য আহবান করলে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি (৬) যে ব্যক্তি এমনভাবে গোপনে দান করে যে, তার ডান হাত যা দান করে তার বাম হাত তা জানতে পারে না (গোপনে দান করে) এবং (৭) যে ব্যক্তি নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু নির্গত হয় । বুখারী হা/১৪২৩; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ كُلُّ امْرِئٍ فِي ظِلٍّ صَدَقَتِهِ حَتَّى يُفْصَلَ بَيْنَ النَّاسِ –
উক্ববা ইবনু আমের (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, (কিয়ামতের দিন) মানুষের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক মানুষ নিজ নিজ ছাদাক্বা (দানের) ছায়াতলে অবস্থান করবে। মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৩৭১; সিলসিলা ছহীহা হা/৩৪৮৪ ।
৭- আল্লাহর নিকটে সর্বদা জাহান্নামের আযাব হতে আশ্রয় প্রার্থনা করা :
আল্লাহর নিকট সর্বদা জাহান্নামের কঠিন আযাব হতে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য নিম্নে বর্ণিত দো’আ সমূহ পাঠ করতে হবে।
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ: রাব্বানা আ-তিনা ফিদ্ দুনইয়া হাসানাতাওঁ ওয়া ফিল আ-খিরাতি হাসানাতাওঁ ওয়া কিনা ‘আযা-বান্না-র।
অর্থ: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান কর এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান কর এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর’ (বাক্বারাহ ২০১)।
رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْلَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ: রাব্বানা ইন্নানা আ-মান্না ফাগফিরলানা যুনুবানা ওয়া কিনা ‘আযা-বান্না-র।
অর্থ: ‘হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই আমরা ঈমান এনেছি, কাজেই আমাদের গোনাহ সমূহ ক্ষমা করে দাও। আর আমাদের জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর’ (আলে ইমরান ১৬)।
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ – رَبَّنَا إِنَّكَ مَنْ تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ، وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ – رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِى لِلْإِيْمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْلَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ
উচ্চারণ: রাব্বানা মা খালাক্বতা হা-যা বা-ত্বিলান, সুবহা-নাকা ফাক্কিনা ‘আযা-বান্না-র। রাব্বানা ইন্নাকা মান তুদখিলিন্না-রা ফাক্বাদ্ আখঝাইতাহু, ওয়া মা- লিয্যা-লিমীনা মিন্ আনছা-র। রাব্বানা ইন্নানা সামি‘না মুনা-দিআই ইউনা- দী লিল ঈমা-নি আন আ-মিনু বিরাব্বিকুম ফা আ-মান্না, রাব্বানা ফাগফিরলানা যুনুবানা ওয়া কাফির ‘আন্না-সাইয়েআ-তিনা ওয়া তাওয়াফ্ফ্ফানা মা’আল আবরা-র ।
অর্থ: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। পবিত্ৰতা তোমারই জন্য। আমাদেরকে তুমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচাও। হে প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি যাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর তাকে অপমানিত কর। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান আনার জন্য একজন আহ্বানকারীকে আহ্বান করতে শুনে ঈমান এনেছি। হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদের সকল গোনাহ মাফ করে দাও। আমাদের সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে দাও। আর নেক লোকদের সাথে আমাদের মৃত্যু দাও’ (আলে ইমরান ১৯১-৯৩)।
اَللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوْذُبِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوْذُبِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسيحَ الدَّجَّالِ وَأَعُوْذُبِكَ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَفِتْنَةِ الْمَمَاتِ، اَللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُبِكَ مِنَ الْمَأْثَمِ وَالْمَغْرَم
উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন ‘আযা-বিল ক্বাবরি ওয়া আ’উযুবিকা মিন ফিতনাতিল মাসীহিদ্দাজ্জা-লি ওয়া আ’উযুবিকা মিন ফিতনাতিল মাহইয়া ওয়া ফিতনাতিল মামা-তি, আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ‘উযুবিকা মিনাল মা’ছামি ওয়া মাগরাম ।
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি কবরের আযাব থেকে, দাজ্জালের ফিতনা থেকে এবং জীবন-মৃত্যুর ফিতনা থেকে। হে আল্লাহ! গোনাহ ও ঋণগ্রস্ততা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাই’। বুখারী হা/৮৩২; মুসলিম হা/৫৮৯; মিশকাত হা/৯৩৯ ।
اَللَّهُمَّ إِنِّى اَعُوْذُبِكَ مِنَ الْجُبْنِ وَأَعُوذُبِكَ مِنَ الْبَحْلِ وَأَعُوْذُبِكَ مِنْ أَرْذَلِ الْعُمُرِ وَأَعُوْذُبِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا وَعَذَابِ الْقَبْرِ –
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল জুবনি ওয়া আ’ঊযুবিকা মিনাল বুখলি ওয়া আ’উযুবিকা মিন আরযালিল ‘উমুরি ওয়া আ’উযুবিকা মিন ফিতনাতিদ্দুনইয়া ওয়া ‘আযা-বিল ক্বাবর।
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই কাপুরুষতা হ’তে, আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই কৃপণতা হ’তে, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই দুনিয়ার ফেতনা ও কবরের শাস্তি হ’তে’। বুখারী হা/৬৩৭৪; মিশকাত হা/৯৬৪ ।
-٦- اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْجَنَّةَ وَأَعُوْذُ بِكَ مِنَ النَّارِ –
উচ্চারণ : ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল জান্নাতা ওয়া আ’উযু বিকা মিনান্না-র’।
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে জান্নাত প্রার্থনা করছি এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চাচ্ছি।
رَبِّ قِنِي عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ –
উচ্চারণ : ‘রব্বি ক্বিনী আযা-বাকা ইয়াওমা তাব‘আছু ইবা-দাকা’ ।
অর্থ : হে আমার প্রতিপালক! তোমার আযাব হতে আমাকে বাঁচাও! যেদিন তোমার বান্দাদের তুমি পুনরুত্থান ঘটাবে।
اللَّهُمَّ أَجِرْنِي مِنَ النَّارِ –
উচ্চারণ : ‘আল্লা-হুম্মা আজিরনী মিনান্না-র’।
অর্থ : ‘হে আল্লাহ তুমি আমাকে জাহান্নাম থেকে পানাহ দান কর’ ।
তথ্যসূত্র:
জাহান্নামের ভয়াভহ আযাব
শরীফুল ইসলাম বিন জয়নাল আবেদীন