ইবাদত

লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকার উপায়

ভূমিকা

লোভ-লালসা মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। এটি মানুষের অন্তরে কৃপণতা, হিংসা, অসততা ও অন্যায় প্রবৃত্তির জন্ম দেয়। একজন মুমিনের জন্য দুনিয়ার প্রতি অতি আসক্তি এবং হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত ক্ষতিকর। কুরআন ও হাদিসে বারবার লোভ-লালসার কুফল সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে এবং তা থেকে বেঁচে থাকার উপায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এই প্রবন্ধে লোভ-লালসার ক্ষতিকর দিক এবং তা থেকে মুক্ত থাকার কার্যকর উপায় কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।

লোভ-লালসার ক্ষতিকর দিক

১. হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে সম্পদ অর্জন করা

২. অন্যের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়া

৩. সত্যের পথে বাধা সৃষ্টি হওয়া

৪. আখেরাতের চিন্তা ভুলে যাওয়া

৫. অসন্তুষ্টি ও মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হওয়া

এগুলো থেকে বাঁচার জন্য কিছু কার্যকর উপায় গ্রহণ করতে হবে।

লোভ-লালসা থেকে বাঁচার উপায়

১. আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল করা

লোভ মানুষের মধ্যে তখনই সৃষ্টি হয়, যখন সে ভাবে যে, সম্পদ ও বৈভবই তার জীবনের সফলতার মূল চাবিকাঠি। কিন্তু একজন মুমিনের বিশ্বাস হওয়া উচিত যে, তার রিজিকের মালিক আল্লাহ, এবং তিনিই তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, সেটাই তার জন্য যথেষ্ট।

আল্লাহ বলেন: وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا ۝ وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ

“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না।”(সূরা আত-তালাক: ২-৩)

প্রকৃত তাকওয়া অবলম্বন করলে লোভ-লালসা মন থেকে দূর হয়ে যায়, কারণ সে জানে যে, তার রিজিকের ব্যবস্থা আল্লাহই করবেন।

২. দুনিয়ার ফিতনার প্রতি সতর্ক থাকা

দুনিয়ার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা মানুষের লোভ-লালসার মূল কারণ। তাই রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে সতর্ক করেছেন।

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: إِنَّ لِكُلِّ أُمَّةٍ فِتْنَةً وَفِتْنَةُ أُمَّتِي الْمَالُ

“প্রত্যেক উম্মতের জন্য একটি বিশেষ ফিতনা রয়েছে, আর আমার উম্মতের ফিতনা হলো সম্পদ। (তিরমিজি: ২৩৩৬)

দুনিয়ার সম্পদ ও মোহ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। তাই দুনিয়ার প্রতি আসক্তি কমানো জরুরি।

৩. অল্পে তুষ্ট থাকার অভ্যাস গঠন করা

অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে পারলে লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। যারা অল্পে তুষ্ট নয়, তারা সর্বদা অধিক সম্পদের পেছনে ছোটে এবং কখনোই সুখী হতে পারে না।

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: لَيْسَ الغِنَى عَنْ كَثْرَةِ الْعَرَضِ، وَلَكِنَّ الغِنَى غِنَى النَّفْسِ

“প্রকৃত ধনী সে নয় যার প্রচুর সম্পদ আছে, বরং প্রকৃত ধনী সে, যার অন্তরে পরিতৃপ্তি আছে।” (সহিহ বুখারি: ৬৪৪৬)

যার মন পরিতৃপ্ত, সে কখনো দুনিয়ার অতিরিক্ত লোভ করবে না।

৪. দান-সদকা করার অভ্যাস গড়ে তোলা

দান-সদকা লোভ-লালসা কমানোর অন্যতম কার্যকর উপায়।

আল্লাহ বলেন: الشَّيْطَانُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَأْمُرُكُم بِالْفَحْشَاءِ وَاللَّهُ يَعِدُكُم مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَفَضْلًا

“শয়তান তোমাদের দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং অসৎ কাজে প্ররোচিত করে, আর আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা ও দানশীলতার প্রতিশ্রুতি দেন।” (সূরা বাকারা: ২৬৮)

যারা দান করতে কৃপণতা করে, তারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে। কিন্তু দান করলে অন্তর প্রশান্ত হয় এবং লোভ কমে যায়।

৫. কবর ও মৃত্যুর কথা স্মরণ করা

মৃত্যুর স্মরণ মানুষকে দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি থেকে বিরত রাখে।

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَادِمِ اللَّذَّاتِ – يَعْنِي الْمَوْتَ

“তোমরা অধিক পরিমাণে লজ্জার আনন্দ বিনষ্টকারী জিনিসের কথা স্মরণ করো, আর তা হলো মৃত্যু।”

(তিরমিজি: ২৩০৭)

যখন মানুষ মৃত্যুর কথা স্মরণ করে, তখন দুনিয়ার লোভ কমে যায় এবং সে আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।

৬. হারাম থেকে বেঁচে থাকা

লোভ-লালসার কারণে মানুষ হারামের দিকে ধাবিত হয়। তাই রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদের হালাল-হারামের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন।

রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেন: إِنَّ الْحَلَالَ بَيِّنٌ وَإِنَّ الْحَرَامَ بَيِّنٌ، وَبَيْنَهُمَا أُمُورٌ مُشْتَبِهَاتٌ لَا يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ

“হালাল স্পষ্ট এবং হারামও স্পষ্ট। তবে এ দুটির মাঝে কিছু সন্দেহজনক বিষয় রয়েছে, যা অনেক মানুষ জানে না।” (সহিহ বুখারি: ৫২)

লোভের কারণে অনেকে হারামের পথে পা বাড়ায়। কিন্তু যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকেও দূরে থাকে, সে নিরাপদ থাকে।

৭. হিসাব দিবসে আল্লাহর কাছে জবাবদিহীতার ভয়

পৃথিবীতে মানুষ যা কিছুই করে, আল্লাহ তায়ালার কাছে এসবের জবাবদিহীতা করতে হবে, এই বিশ্বাস অন্তরে রাখতে হবে। হিসাব দিবসের কথা সবসময় অন্তরে থাকলে মানুষের উচ্চাকাঙ্খা কমে যাবে।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও নিজের জায়গা থেকে সামনে নড়তে দেওয়া হবে না। তা হলো- ১) তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে, ২) যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৩) ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, ৪) এবং তা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৫) সে দ্বীনের (ইসলাম) যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা বা কতটুকু করেছে। (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৬)

৮. দুনিয়ার অসারতা

যেই পৃথিবীতে মানুষ বর্তমানে বসবাস করছে, যেই জীবন নিয়ে উচ্চাকাঙ্খা দেখছে, তা একদিন শেষ হয়ে যাবে। মালাকুল মাউত এসে উপস্থিত হলেই রঙরসে ভরপূর পৃথিবীর সফর শেষ হবে। এই কথা সবসময় মনে রাখতে হবে।

হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন আমাকে বললেন, আমি তোমাকে দুনিয়া ও দুনিয়াস্থিত বস্তুসমূহ দেখাব। আমি আরয করলাম, খুব ভাল কথা। অতঃপর তিনি আমার হাত ধরে মদীনার একটি জঙ্গলে গেলেন। জঙ্গলের এক জায়গায় মৃত মানুষের মাথার খুলি, মল, হাড়গোড় ও ছিন্নবস্ত্র ছিল। তিনি বললেন, হে আবু হুরায়রা, এসব খুলি তেমনি আকাঙ্খা করত, যেমন তুমি কর এবং তেমনি আশা করত, যেমন তুমি কর; কিন্তু আজ এমন হয়ে গেছে যে, এগুলোর উপর চামড়া পর্যন্ত নেই। কিছুদিনের মধ্যেই এগুলো ভস্ম হয়ে যাবে। এই যে মল দেখছ, এগুলো তাদের খাদ্য ছিল। খোদা জানে কোথা থেকে উপার্জন করে খেয়েছিল। আজ এমন হয়ে গেছে যে, তোমার ঘৃণা হয়। আর এই ছিন্নবস্ত্র ছিল তাদের পোশাক। বায়ু একে এদিক থেকে ওদিকে উড়িয়ে ফিরে। আর এই হাড়গুলো তাদের চতুষ্পদ জন্তুর, যেগুলোর পিঠে চড়ে তারা এক শহর থেকে অন্য শহরে যেত। ক্ষণভঙ্গুর দুনিয়ার যখন এই পরিণতি, তখন এটা শিক্ষা গ্রহণেরই স্থান। (এহইয়াউ উলুমিদ্দীন)

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *