লোকদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হলে পালনীয় সুন্নাত
একজন মুসলিমের সাথে সাক্ষাতে পালনীয় সুন্নাতগুলো হলো নিম্নরূপ :
১। মুসলমানদের উপর সালাম প্রদান করা সুন্নাত
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে: عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رضى اللهُ عَنْهُمَا، أَنَّ رَجُلًا سَأَلَ النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَيُّ الإِسْلَامِ خَيْرُ؟ قَالَ: تُطْعِمُ الطَّعَامَ، وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفُ .
“হযরত ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞেস করেছিলো, ইসলামে কোন কাজ উত্তম? তিনি বললেন, ‘লোকদের খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিতকে সালাম প্রদান করা।
২। সালামে শব্দ বাড়িয়ে বলায় সাওয়াব বেশি
“ওয়ালাইকুমুসসালাম” এর সাথে “ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু বলার মাধ্যমে সালামের উত্তর দিলে ৩০টি নেকী হয়।
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে: عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ، قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ : السَّلَامُ عَلَيْكُمْ ، فَرَدَّ عَلَيْهِ السَّلَامَ ، ثُمَّ جَلَسَ ، فَقَالَ النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : عَشْرُ ثُمَّ جَاءَ آخَرُ فَقَالَ: السَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ ، فَرَدَّ عَلَيْهِ ، فَجَلَسَ ، فَقَالَ: عِشْرُونَ ثُمَّ جَاءَ آخَرُ فَقَالَ: السَّلَامُ عَلَيْكُمْ رَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ ، فَرَدَّ عَلَيْهِ، فَجَلَسَ ، فَقَالَ: ثَلَاثُونَ.
“হযরত ইমরান বিন হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকটে এক ব্যক্তি এলো এবং বললো ‘আস্সালামু আলাইকুম’ এবং লোকটি বসলো, রাসূলুল্লাহ সা. বললেন ‘দশ’ । অতঃপর আরেক ব্যক্তি এলো এবং বললো ‘আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ’ এবং লোকটি বসলো, রাসূলুল্লাহ সা. বললেন ‘বিশ’। অতঃপর আরেক ব্যক্তি এলো এবং বললো ‘আস্সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওবারাকাতুহু’ এবং লোকটি বসলো, রাসূলুল্লাহ সা. বললেন ‘ত্রিশ’ (”আবু দাউদ, হাদীস নং: ৫১৯৫, আত তিরমিযী, হাদীস নং: ২৬৮৯)
বি. দ্রঃ দেখুন! একজন মুসলমান সালাম পূর্ণাঙ্গভাবে না দেয়ার ফলে কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, প্রতি দু’আর জন্য ১০ নেকি, এভাবে সালামে ১০টি পর্যন্ত দু’আ করা যেতে পারে। যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ১০০ নেকি পর্যন্ত অর্জন করতে পারে। সুতরাং সালামের উত্তর দেওয়ার সময় অবশ্যই বাড়িয়ে বলতে হবে। একজন মুসলিম দিনে রাতে বহুবার সালাম উচ্চারণ করে থাকে। মুসলমানরা মসজিদ ও বাড়িতে প্রবেশ এবং বের হওয়ার সময় সালাম দেয়। মনে রাখবেন একজন বিদায় নেয় তখনও পূর্ণ সালাম দেয়া উচিত । রাসূলুল্লাহ সা. এর হাদীস এসেছে: عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِذَا انْتَهَى أَحَدُكُمْ إِلَى الْمَجْلِسِ ، فَلْيُسَلِّمُ فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَقُومَ ، فَلْيُسَلِّم فَلَيْسَتِ الْأُولَى بِأَحَقِّ مِنَ الْآخِرَةِ.
“হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, যখন তোমাদের কেউ কোনো মজলিসে আসে (সাক্ষাতে আসে) তখন সালাম দিবে এবং যখন কেউ বিদায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেবে তখনও সালাম দেবে। (আবু দাউদ, হাদীস নং: ৫২০৮, আত তিরিমিযী, হাদীস নং: ২৭০৬।)
৩। প্রস্রাব-পায়খানা অবস্থায় সালাম দেয়া নিষেধ
এ প্রসঙ্গে হাদীসে এসেছে: عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ رَجُلًا مَرَّ عَلَى النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَبُولُ، فَسَلَّمَ عَلَيْهِ، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِذَا رَأَيْتَنِي عَلَى مِثْلِ هَذِهِ الْحَالَةِ، فَلَا تُسَلِّمْ عَلَيَّ، فَإِنَّكَ إِنْ فَعَلْتَ ذَلِكَ لَمْ أَرُدَّ عَلَيْكَ.
“হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা. এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে প্রস্রাবরত অবস্থায় সালাম দিলে রাসূলুল্লাহ সা. তাকে ডেকে বললেন: যখন তুমি আমাকে এ অবস্থায় দেখবে, তখন আমাকে সালাম করবে না। কারণ, তুমি আমাকে এ অবস্থায় সালাম করলে আমি তোমার সালামের উত্তর দেব না ৷ ” সুনানে ইবনে মাজাহ;, হাদীস নং: ৩৫২।
৪। হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা সুন্নাত
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. এর হাদীস: عَنْ أَبي ذَرٍ، قَالَ: قَالَ لِي النَّبِي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لَا تَحْقِرَنَّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا، وَلَوْ أَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهِ طَلْقٍ.
“হযরত আবু যার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, কোনো সামান্য ভালো ব্যবহার ছোট করে দেখবে না, যদিও তা তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাতের মতো বিষয়ও হয়।মুসলিম, হাদীস নং: ২৬২৬।
৫। ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতে মুসাফাহা করা সুন্নাত
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. এর হাদীস: الْبَرَاءِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ ، فَيَتَصَافَحَانِ إِلَّا غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا.
“হযরত বারা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, দুই জন মুসলিম নেই যারা পরস্পর সাক্ষাৎ করে এবং হাত মুসাফাহা করে,তারা তাদের আলাদা হওয়ার পূর্বেই তাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। আবু দাউদ, হাদীস নং: ৫২১২। আত তিরমিযী ২৭২৭।
(ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতে ও বিদায়ে সালাম দেয়া এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের হক, যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।) ইমাম নববী রহ. বলেন, প্রত্যেকের উচিত প্রতিটি সাক্ষাতেই মুসাফাহা করা। তবে অমুসলিমদের সাথে মুসাফাহা করা জায়েয নয়।
৬। মানুষের সঙ্গে উত্তম কথা বলা সুন্নাত
এ বিষয়ে আল কুর’আনের বাণী: وَقُل لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنسَانِ عَدُوا مُّبِينًا.
“আমার বান্দাদেরকে বলে দিন, তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে । শয়তান তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধায়। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।বনী ইসরাঈল ১৭ঃ ৫৩।
নবী করীম সা. এর হাদীস أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْكَلِمَةُ الطَّيِّبَةُ صَدَقَةٌ.
“হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘কালিমা তাইয়্যিবাহ’ উত্তম কথা একটি সাদকাহ। (আল বুখারী, হাদীস নং: ২৯৮৯, মুসলিম, হাদীস নং: ১০০৯)
কালিমা তাইয়্যিবার মধ্যে রয়েছে আল্লাহর স্মরণ, দু’আ, সালাম, ভালো কর্মাবলীর জন্য অন্যদের প্রশংসা করা, উত্তম ব্যবহার, উত্তম আচরণ, উত্তম কর্ম ও মার্জিত মধুময় ভাষায় কথা ৷ উত্তম কথাবার্তা বলা ব্যক্তির সততা, একনিষ্ঠতা, শান্তিপ্রিয়তা হবার পূর্বশর্ত। উত্তম কথাবার্তা ব্যক্তিকে সৎ ও শান্তির পথে চলতে সাহায্য করে।
মনে রাখবেন আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাদের সাথে দেখা হয়, অর্থাৎ স্বামী, স্ত্রী, সন্তানাদি, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করি, তাহলে এটি হবে এক একটি সাদাকাহ সমতুল্য সাওয়াবের কাজ।
ঐক্যবদ্ধ বা জামা’আতবদ্ধ থাকা
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. এর হাদীস عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ، قَالَ: دَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ المَسْجِدَ وَهُمْ حِلَقٌ فَقَالَ: «مَالِي أَرَاكُمْ عِزِينَ.
“হযরত জাবির ইবনে সামুরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,“রাসূলুল্লাহ সা. মসজিদে প্রবেশ করলেন এ অবস্থায় তারা (সাহাবীরা) বৃত্তাকারে বসা ছিল। তিনি রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, আমার কী হলো যে, আমি তোমাদের পৃথক দেখছি? সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ৪৮২৩।
عَنِ الْأَعْمَشِ بِهَذَا قَالَ: كَأَنَّهُ يُحِبُّ الْجَمَاعَةَ . “হযরত আ‘মাশ থেকে এরূপ বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, “মনে হয় তিনি ঐক্যবদ্ধ থাকাকে পছন্দ করতেন। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ৪৮২৪।
এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা. অন্যত্র বলেন عَنْ أَبي ذَرٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَقَدْ خَلَعَ رِبُقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ.
“হযরত আবু যার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন যে ব্যক্তি জামা’আত থেকে এক বিঘত পর্যন্ত পৃথক হয়ে যায়, সে তো তার ঘাড় থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং: ৪৭৫৮। عَنْ ابْن عَبَّاسٍ رضي اللهُ عَنْهُمَا، عَنِ النَّبِي صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ . قَالَ: «مَنْ رَأَى مِنْ أَمِيرِهِ شَيْئًا يَكْرَهُهُ فَلْيَصْبِرُ عَلَيْهِ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الجَمَاعَةَ شِبْرًا فَمَاتَ إِلَّا مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً .
“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সা. থেকে বর্ণনা করেন: যে ব্যক্তি নেতার মাঝে এমন কিছু (ত্রুটি) দেখে, যা সে অপছন্দ করে, তাহলে সে যেন এ বিষয়ে ধৈর্যধারণ করে। কেননা, যে ব্যক্তি জামা’আত থেকে এক বিঘত পরিমাণ পৃথক হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার মৃত্যু হলো জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু। সহিহ বুখারী, হাদীম নং:৭০৫৪
জামা’তের ব্যাপারে কুর’আনী নির্দেশনা
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا. “আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আল কুরআন,সূরা আলে ইমরান ৩:১০৩
তথ্যসূত্র :
বই: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ১০০০ সুন্নাত
লেখক: শাইখ খালীল আল হোসেনান
অনুবাদক: মাওলানা ডক্টর শাহ্ মুহাম্মাদ আবদুর রাহীম