মাতা-পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা কবীরা গুনাহ
এ পর্যন্ত যা কিছু আলোচনা করা হয়েছে তা থেকে মা-বাবার মর্যাদা কত উচ্চে এবং তাঁদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব-কর্তব্য কত বড় সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়ার প্রয়াস পেয়েছি। বাবা-মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করা সন্তানের কর্তব্য। বৃদ্ধ বয়সে তাদের সেবা-যত্ন করা, তাঁদের জন্য অর্থ ব্যয় করা সন্তানের দায়িত্ব। তাদের মনে কোনোরূপ কষ্ট না দেয়া, তাঁদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ না করাও ইসলামের নির্দেশ। আজকাল অনেক ছেলেই বড় হয়ে জীবিকার্জনের ব্যবস্থা করে বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অথবা বিয়ে সাদী করে বাবা-মার সাথে খারাপ ব্যবহার করে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই আলাদাভাবে বসবাস করা পসন্দ করে। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে যে মূলনীতি উল্লিখিত হয়েছে তা হচ্ছে এই ঃ فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِعُوا أَرْحَامَكُمْ . أولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ – محمد : ۲۲-۲۳
“ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং রেহেম (রক্ত-সম্পর্ক) ছিন্ন করবে। আল্লাহ এদেরকেই করেন অভিশপ্ত আর করেন বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন।”-(সূরা মুহাম্মদ ঃ ২২-২৩) রেহেম বা রক্ত-সম্পর্ক ছিন্নকারীদেরকে অভিশপ্ত বলে আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন। এরূপ সম্পর্কচ্ছেদকারীগণ “বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন’ হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ‘বধির’ অর্থে সত্যের আওয়াজ কর্ণেন প্রবেশ না করা এবং ‘দৃষ্টি শক্তিহীন’ অর্থে সত্য-দর্শনে অক্ষম বলে তাফসীরকারকরা উল্লেখ করেছেন। রক্ত-সম্পর্ক বলতে মা-বাবা নিসন্দেহে প্রথম।
এছাড়াও ভাই-বোন, দাদা-দাদী, নানা-নানী, মামা, খালা, চাচা- ফুফু ইত্যাদি নিকটাত্মীয় বুঝায়। তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করা, সকল ব্যাপারে তাদের সাথে সহযোগিতা-সমমর্মিতা প্রকাশ করা এবং সম্পর্ক ছিন্ন না করার ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার স্পষ্ট নির্দেশ উপরোক্ত আয়াতে রয়েছে। এর অন্যথা হলে তার যে কী শাস্তি সেটাও এখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ অন্যত্র বলেন :
“যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখতে আল্লাহ আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য আছে লা’নত এবং মন্দ আবাস। -সূরা আর রা’দ : ২৫
এসব আয়াতের পরিপ্রেক্ষিতে যেসব হাদীস এসেছে তা থেকে কয়েকটি নীচে উদ্ধৃত হলো ঃ لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِع – بخاری، مسلم
“রেহেমের সম্পর্ক কর্তনকারী কখনই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” عَنِ الْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ إِنَّ اللهَ حَرَّمَ عُقُوقَ الْأُمَّهَاتِ وَوَادَ الْبَنَاتِ وَمَنْعًا وَهَاتِ وَكَرِهَ لَكُمْ قِيْلَ وَقَالَ وَكَثرَةَ السُّوَالِ وَاضَاعَةَ الْمَالِ –
“হযরত মুগীরাহ রা. থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা মায়ের নাফরমানী করা এবং কন্যা সন্তানের জীবিত কবর দেয়া, হকদারের হক না দেয়া, তোমাদের ওপর হারাম করে দিয়েছেন। আর আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জন্য গল্প-গুজবে লিপ্ত হওয়া, অতিরিক্ত প্রশ্ন করা এবং সম্পদ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন।”-বুখারী عَنْ أَبِي بَكْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ أَلا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ثَلَاثًا قُلْنَا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ : قَالَ الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَكَانَ مُتَّكِلًّا فَجَلَسَ فَقَالَ اَلا وَقَوْلَ النُّورِ وَشَهَادَةَ النُّورِ فَمَازَالَ يُكَبِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا لَيْتَهُ سَكَتَ –
“হযরত আবু বকর রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন : আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় তিনটি গুনাহ সম্পর্কে জানাবো না ? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল ! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শিরক করা। মা-বাপের নাফরমানী করা। এ সময় তিনি হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন, তারপর উঠে বসলেন এবং বললেন শোন মিথ্যা বলা ও মিথ্যা সাক্ষ দেয়া, এভাবে তিনি একাধারে বলে যাচ্ছিলেন যতক্ষণ না আমরা বললাম যে, যদি তিনি চুপ হতেন।”-বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ الله الكَبَائِرُ الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ وَقَتْلُ النَّفْسِ وَاليَمِينُ
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, কবীরা গুনাহগুলো হচ্ছে আল্লাহর সাথে শিরক করা, মাতা-পিতার নাফরমানী করা, (অন্যায়ভাবে) কোনো লোক হত্যা করা এবং মিথ্যা সাক্ষ দেয়া।”-বুখারী فِي كِتَابِ النَّبِيِّ ﷺ الَّذِي كَتَبَهُ إِلَى أَهْلِ الْيَمَنِ وَبَعَثَ بِهِ عَمْرِو بْنِ حَزْمٍ وَإِنَّ أَكْبَرَ الْكَبَائِرِ عِنْدَ اللَّهِ الْإِشْرَالُ بِاللهِ وَقَتْلُ النَّفْسِ الْمُؤْمِنِ بِغَيْرِ الحَقِّ وَالفِرَارُ عَنْ سَبِيلِ اللهِ يَوْمَ الزَّحْفِ وَعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ وَرَمَى المُحْصَنَةِ وَتَعَلَّمُ السَّحْرِ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكُلُ مَالِ الْيَتِيم –
“রাসূলুল্লাহ স. আমর বিন হাযম-এর মারফত ইয়েমেনবাসীদের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল, কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো : আল্লাহর সাথে শরীক করা, অন্যায়-ভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করা, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা থেকে পালানো, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া, সতী নারীকে অপবাদ দেয়া, যাদু বিদ্যা শিক্ষা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের সম্পদ গ্রাস করা । ”—ইবনে হিব্বান, সহীহ عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ ثَلَاثَةٌ لَا يَنْظُرُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ العَقُ لِوَالِدَيْهِ وَمُدْمِنْ خَمْرٍ وَالْمَنَّانُ عَطَاتَهُ وَثَلاثَةُ لَا يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ العَاقُ لِوَالِدَيْهِ وَالدَّيُّوتُ وَالرَّجَلَةُ .
“হযরত ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। রাসূল স. বলেছেন, তিন প্রকার লোকের দিকে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন, রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। ১. মাতা-পিতার অবাধ্য, ২. মদ-খোর ও ৩. দান করে তার খোটাদানকারী। আরো তিন প্রকারের লোক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।(১) মাতা-পিতার অবাধ্য ব্যক্তি (২) দাউয়ুস (যে তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্যদেরকে পর্দায় রাখে না, (৩) পুরুষের বেশধারীণী মহিলা।”-হাসারী, বাজ্জার, হাকিম । عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ العَاصِ أَنْ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ ثَلَاثَةٌ حَرَّمَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى عَلَيْهِمُ الجَنَّةَ مُدْمِنُ خَمْرٍ وَالْعَاق والديوث الَّذِي يَقِرُّ الخُبْثَ فِي أَهْلِه.
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা তিন প্রকার লোকের জন্য জান্নাত হারাম করেছেন, (১) মদ পানকারী, (২) মাতা-পিতার অবাধ্য (৩) দাইয়ুস – যে ব্যক্তি নিজ পরিবারের মধ্যে অশ্লীল কাজকে স্থান দিয়েছেন।” —আহমদ, নাসাঈ, বাজ্জার হাকীম
عَنْ أَبِي أُمَامَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ثَلاثَةٌ لَا يَقْبَلُ الله عَزَّ وَجَلَّ مِنْهُمْ صَرْفًا وَلَا عَدْلاً عَاقٌ وَمَنَّانُ وَمُكَذِّبُ بِقَدَرٍ
“আবু উমামাহ রা. হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা তিন প্রকার লোকের তাওবা কবুল করবেন না এবং তাদের কাছ থেকে কিছু বিনিময় (অর্থাৎ কোনোভাবেই তারা নাজাত পাবে না) গ্রহণ করবেন না । (১) মাতা-পিতার অবাধ্য ব্যক্তি (২) দান করে খোটাদানকারী ও (৩) তাকদীরকে অস্বীকারকারী।” হাদীসটি ইবনে আবু আসেম ‘সুন্নাহ’ নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে আসাকিরও তা বর্ণনা করেছেন। عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ مِنَ الْكَبَائِرِ شَتْمُ الرَّجُلِ وَالِدَيْهِ قَالُوا يَارَسُولَ اللهِ وَهَلْ يَسْتُمُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ ؟ قَالَ نَعَمْ، يَسُبُّ أَبَا الرَّجُلِ فَيَسُبُّ أَبَاهُ وَأَمَّهُ –
“আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো- মাতা- পিতাকে গালি দেয়া। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল ! কীভাবে একজন লোক তার মাতা-পিতাকে গালি দিতে পারে ? রাসূলুল্লাহ স. বললেন, হ্যা, একজন আরেকজনের পিতাকে গালি দেয়, তখন সেও ঐ লোকের পিতাকে গালি দেয় এমনিভাবে একজন অপর জনের মাকে গালি দেয়, তখন সেও ঐ লোকের মাকে গালি দেয়।” -বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী
وَفِي رِوَايَةٍ لِلْبُخَارِي وَمُسْلِرٍ إِنَّ مِنْ اَكْبَرِ الْكَبَائِرِ أَنْ يَلْعَنَ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ، قِيْلَ يَا رَسُولَ اللهِ كَيْفَ يَلْعَنُ الرَّجُلُ وَالِدَيْهِ ؟ قَالَ يَسُبُّ أَبَا الرَّجُل فَيَسبُ آبَاهُ وَيَسبُ أُمَّهُ فَيَسُبُّ أُمَّهُ –
“বুখারী, এবং মুসলিমের রিওয়ায়াতে কবীরা গুনাহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে মাতা-পিতাকে অভিশাপ দেয়া। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল ! কীভাবে মানুষ তার মাতা-পিতাকে অভিশাপ দেয় ? রাসূলুল্লাহ স. বললেন, অন্য লোকের পিতাকে গালি দিলে সে যেন নিজের পিতাকে গালি দেয়। তেমনিভাবে অন্যের মাকে গালি দিলে সে যেন তার মাকে গালি দিলো ।”
عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ إِنَّ الْعَبْدَ لَيَمُوتُ وَالِدَاهُ أَوْ أَحَدُهُمَا وَأَنَّهُ لَهُمَا لَعَاقُ، فَلا يَزَالُ يَدْعُوا لَهُمَا وَيَسْتَغْفِرُ لَهُمَا حَتَّى يَكْتُبَهُ اللَّهُ بَارًا –
“আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, যদি কারো মা- বাবা মারা যায় এবং তাঁদের জীবিত অবস্থায় সে তাঁদের অবাধ্য থেকে থাকে (তারপর মা-বাপের মৃত্যুর পর এ অবাধ্যতা সম্পর্কে তার অনুভূতি সৃষ্টি হয়) তবে সে যেন তাঁদের জন্য সবসময় দোয়া করতে থাকে, তাঁদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। তাহলে আল্লাহ তা’আলা সেই ব্যক্তিকে মা-বাপের হুকুম মান্যকারীরূপে গণ্য করে মা-বাপের অবাধ্যতার শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেবেন।”-বায়হাকী
জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ স.-কে মাতা-পিতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন : مَا حَقُّ الْوَالِدَيْنِ عَلَى وَلَدِهِمَا قَالَ هُمَا جَنَّتُكَ وَنَارَكَ – “হে আল্লাহর রাসূল! মা-বাবার প্রতি সন্তানদের কী হক ? রাসূলুল্লাহ স. বললেন, তাঁরা তোমার জান্নাত, তাঁরা তোমার জাহান্নাম (অর্থাৎ মা- বাবার সন্তুষ্টির কারণে সন্তানের জান্নাত, তাঁদের অসন্তুষ্টির কারণে সন্তানের জাহান্নাম।)”-ইবনে মাজাহ
বই : মাতা-পিতা ও সন্তানের হক
অধ্যাপক মুহাম্মদ মতিউর রহমান