কিয়াসের আলোকে তাকলীদ

الْقِيَاسُ هُوَ الْحَاقُ فَرْعٍ بِأَصْلِ لِمُسَاوَاتِهِ فِى عِلَّةٍ حُكْمِهِ . “কিয়াস হল কোন শাখাগত বিধানকে মূলনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট করা হুকুমের ইল্লতে উভয়টি সম পর্যায়ের হওয়ার দরুণ।”আল ফিকরুস সামী ১/১২৭, মুদ্রণ: মাকতাবাতুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বাইরূত,

কুরআন-হাদীস ও যৌক্তিক বিচারে কিয়াস নিঃসন্দেহে শরীয়তের অন্যতম একটি দলীল। এই কিয়াসের আলোকেও তাকলীদের গুরুত্ব প্রমাণিত। আল্লামা শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ (রহ.) আল ইনসাফ’ গ্রন্থে এবং আল্লামা ইবনে হাজার মক্কী (রহ.) ‘ফাতহুল মুবীন’ গ্রন্থে’ একটি কানুন বর্ণনা করেছেন। লিখেছেন, مُقَدِّمَةُ الْوَاجِبِ وَاحِبٌ. “ওয়াজিবের আনুষাঙ্গিকতা পালন করাও ওয়াজিব।”

এদিকে আল্লামা তীবী (রহ.) মিশকাতের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বিদ’আত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, الْبِدْعَةُ مُنْقَسِمَةٌ عَلَى خَمْسٍ وَاحِبَةٌ كَالْاِشْتِغَالِ بِعِلْمِ النَّحْوِ الَّذِى يُفْهَمُ بِهِ كَلَامُ اللهِ وَكَلَامُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِاَنَّ حِفْظُ الشَّرِيعَةِ وَاجِبٌ وَلَا يَتَأَتَى إِلَّا بِذَلِكَ وَمَالَا يَتِمُّ الْوَاجِبُ إِلَّا بِهِ فَهُوَ وَاحِبٌ كَحِفْظِ غَرِيْبِ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ وَكَتَدْوِيْنِ أَصُولِ الْفِقْهِ وَالكَلَام فِي الْجَرْحِ وَالتَّعْدِيْلِ وَتَمْيِيزِ الصَّحِيحِ مِنَ السَّقِيمِ.

“বিদ’আত পাঁচ প্রকার। তন্মধ্যে এক প্রকার হল বিদ’আতে ওয়াজিবাহ। যেমন আরবী ব্যাকরণ পাঠ করা, যদ্বারা কুরআন ও হাদীস বুঝা সম্ভব হয়। কারণ শরীয়তকে সংরক্ষণ করা ওয়াজিব। আর শরীয়ত সংরক্ষণ এ বিদ’আত ছাড়া সম্ভব নয় । সুতরাং এ বিদ’আতও ওয়াজিব। যেমন কুরআন ও সুন্নায় কম ব্যবহার হয় এমন শব্দাবলী সংরক্ষণ করা। উসুলে ফিকহ্ সংকলন করা ইত্যাদি ইত্যাদি ।”শরহে তীবী আলাল মিশকাত ১/২২৫, ২২৬, মুদ্রণ: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা,বাইরূত, লেবানন ।

এগুলো যদিও বিদ’আত তথাপি এগুলো পালন করা ওয়াজিব। কেননা, যে সকল বিষয়বস্তু ছাড়া ওয়াজিব পূর্ণ হয় না, সেগুলো আদায় করাও ওয়াজিব।

উল্লিখিত নীতিমালার প্রেক্ষিতে মাদারুল হক গ্রন্থকার লিখেছেন, ‘তাকলীদ যেহেতু ওয়াজিবের পূর্ব অনুষঙ্গ, তাই মাযহাবের তাকলীদ করা ওয়াজিব। কেননা, দীন হেফাযত করা ওয়াজিব। আর এ যুগে তাকলীদ করা ছাড়া দীনের পরিপূর্ণ হেফাযত করা সম্ভব নয়।

আল্লামা মুহাক্কিক কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম (রহ.)-এর এক গবেষণায় দেখা যায়, এক লাখ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে মুজতাহিদ আলিমের সংখ্যা বিশ জনের বেশি ছিল না। ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেছেন, যে সমস্ত সাহাবী ফতওয়া প্রদান করেছেন তাদের সংখ্যা ১৩০ এর উর্ধ্বে।

অন্যরা সকলে প্রয়োজন মত তাদের তাকলীদ করতেন। তাদের মধ্যে তাকলীদে শাখসী ও গায়রে শাখসী উভয় প্রকারের প্রচলন ছিল। এ প্রসঙ্গে প্রমাণভিত্তিক আলোচনা সামনে আসবে।

কিয়াস ও যুক্তির দাবীও এই যে, সাধারণ মানুষের কোন না কোন ইমামের অনুসরণ করে চলতে হবে। কারণ কুরআনে কারীম ও হাদীস শরীফের মধ্যে অনেক বিষয় এমন আছে যার মর্ম-বিষয় বিজ্ঞ তাফসীরকার, ফকীহ ও মুহাদ্দিস ব্যতীত কেউ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয় না। যেমন মনে করুন কুরআনে কারীমের অনেক স্থানে আদেশ সূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যদ্বারা আল্লাহ তা’আলা বান্দার প্রতি কোন হুকুম ফরয করে দিয়েছেন।

আবার কোন ক্ষেত্রে এমনও আছে যে, ব্যবহৃত শব্দটি আদেশসূচক বটে কিন্তু তা দ্বারা কোন হুকুম ফরয বা ওয়াজিব করা হয়নি। যথা- أَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُو الزكوة . “নামায কায়েম কর ও যাকাত প্রদান কর।”

এখানে দু’টি শব্দই আদেশ সূচক যদ্বারা নামায ও যাকাত ফরয করা হয়েছে। কিন্তু অন্য স্থানে বলা হয়েছে : . وَإِذَا حَلَلْتُمْ فَاصْطَادُوْا “যখন তোমরা (হজ্বের আমল থেকে) হালাল হয়ে যাও তখন (পশু-পাখি) শিকার করো।”সূরা মায়িদা ২।

এখানে আদেশসূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পশু, পাখি শিকার করা ফরয বা ওয়াজিব করা হয়নি। শুধুমাত্র হালাল করা হয়েছে ও অনুমতি দেয়া হয়েছে । তদ্রুপ পবিত্র কুরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : كُلُوا وَاشْرَبُوْا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ. “তোমরা খানা পিনা করো যতক্ষণ না কালো সূতা অর্থাৎ রজনীর অন্ধকার থেকে সাদা সূতা অর্থাৎ দিনের আলো প্রকাশ পায়।”

অর্থাৎ সুবহে সাদিক ও ফজরের ওয়াক্ত না আসা পর্যন্ত তোমরা খাও ও পান করো। এ আয়াতে আদেশ সূচক শব্দ দ্বারা খাওয়া ও পান করা ওয়াজিব করা হয়নি বরং খাওয়া ও পান করার অনুমতি দেয়া হয়েছে মাত্র।

সাধারণ মানুষ তো দুরের কথা বিশেষ প্রজ্ঞাময় ও বিজ্ঞ আলিম ও মুজতাহিদ ব্যতীত সাধারণ আলিম সমাজও কুরআনে কারীমের সর্ব বিষয়ের উদ্দিষ্ট মর্ম সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম নয়। যদি কিছুটা সক্ষমতা থাকেও তা বিজ্ঞদের রচিত ও সংকলিত গ্রন্থাদির সহায়তায় সংগৃহীত।

কাজেই আয়াতের গভীরে লুকায়িত বিষয়কে হাদীসের সাথে মিল করে শরয়ী বিধান সংকলন করা সাধারণ মানুষের পক্ষে কস্মিন কালেও সম্ভব নয়। সুতরাং একথা বলা বাহুল্য যে মাযহাব অনুকরণ ব্যতীত সাধারণ মানুষের ইসলামী বিধান মোতাবেক আমল করা ও জীবন গড়ার বিকল্প কোন পথ নেই, থাকতে পারেও না।

অতএব যুক্তিযুক্ত কথা হচ্ছে, যে কোন একটি মাযহাব অনুকরণ করা ওয়াজিব। যারা মাযহাব অনুকরণ না করে বরং অবজ্ঞা বশত: মনগড়া পথে চলবে নি:সন্দেহে তাদের ওয়াজিব তরক হয়ে যাবে এবং তারা ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তা’আলা সবাইকে হেফাযত করুন।

তথসূত্র:

তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ

মুফতি হিফজুর রহমান

প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *