কুরআন সত্য তার প্রমাণ
কুরআন যে সত্য, তার আরও অনেক প্রমাণ রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি প্রমাণ হলঃ
১. একজন উম্মী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও নবী (সাঃ)-এর মুখ থেকে কুরআনের ন্যায় এরূপ মহা জ্ঞান ভান্ডারের গ্রন্থ প্রকাশ পাওয়া এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসব জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছেন।
২. কুরআন মানব রচিত হলে কুরআনের অনুরূপ আর একটি রচনা পেশ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হত। কিন্তু কুরআনের অনুরূপ রচনা পেশ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন চ্যালেঞ্জও পেশ করেছেন। ইরশাদ করেছেনঃ আমি আমার এই বান্দার উপরে যে কিতাব নাযিল করেছি, এ ব্যাপারে তোমাদের যদি সামান্যতম সন্দেহ থাকে (যে, এটা তাঁর রচনা করা কি না,) তাহলে এই কুরআনের (বড় কোন সূরা নয়, ছোট্ট) সূরার মত একটা সূরা রচনা করে দেখাও। তোমরা (একারা নয়) তোমাদের সব সহযোগীদের ডাক ( ডেকে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এরকম একটা সূরা রচনা করে দেখাও )
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেছেনঃ তবুও তোমরা এর সমকক্ষ রচনা পেশ করতে পারবে না। (সূরাঃ ২-বাকারাঃ ২৩) বাস্তবেও কোন দিন কেউ কুরআনের সমকক্ষ রচনা পেশ করতে পারেনি।
এখানে চিন্তা করার বিষয় হল- ইসলামের মিশনকে ব্যর্থ করার জন্য কাফের শক্তিরা লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি ডলার পাউণ্ড ব্যয় করে। শত রকম ষড়যন্ত্র করে। অথচ কুরআনের মোকাবিলা করার জন্য সামান্য একটা সূরা রচনা করে তা পেশ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।
৩. কুরআন অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মনের কথা বলে দিয়েছে, যা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটাও কুরআনের সত্য হওয়ার প্রমাণ। একটা ঘটনা -আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই একজন মুনাফিক ছিল। সে ধোকা দিয়ে, প্রতারণা করে মুসলমানদেরকে ওহুদ যুদ্ধ থেকে সরাতে চেয়েছিল। যাতে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা হ্রাস পায় এবং মুসলমানরা পরাজিত হয়ে যায়। তার ষড়যন্ত্রে পড়ে মুসলমানদের দুটো গোত্র -বনূ হারেছা এবং বনূ সালামার লোকেরা সংশয়ে পড়ে গিয়েছিল যে, তারা যুদ্ধে থাকবে, না চলে যাবে।
এ প্রসঙ্গে আয়াত নাযিল হয়ে গেলঃ তোমাদের মধ্যে দুটো দল যুদ্ধ থেকে সরে যাবে কি না – এই চিন্তা-ভাবনায় লিপ্ত হয়েছিল, তবে আল্লাহ্ তাদেরকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহ তাদের অভিভাবক। (সূরাঃ ৩-আলু ইমরানঃ ১২২) আয়াত নাযিল হওয়ার পর উক্ত দুই গোত্রের লোকেরা স্বীকার করল যে, তারা এরূপ চিন্তা-ভাবনা করেছিল।
৪. কুরআন সত্য হওয়ার আর একটা প্রমাণ হলঃ কুরআনে অনেক বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, যা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।একটা ঘটনা-একবার রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে খৃষ্টানদের একটা প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিল। ঐ মজলিসে কিছু ইয়াহদীও উপস্থিত হল। ইয়াহুদী খৃষ্টানদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হল। ঝগড়ার এক পর্যায়ে ইয়াহুদী-গণ দাবী করল একমাত্র আমরাই হকপন্থী, আর কোন দল হকপন্থী নয়। আমাদের জন্যই জান্নাত নিশ্চিত, আর কারও জন্য নয়। খৃষ্টানরাও দাবী করল একমাত্র আমরাই হকপন্থী অন্য কেউ নয়, জান্নাত একমাত্র আমাদের জন্যই নিশ্চিত আর কারও জন্য নয়। উপরন্তু ইয়াহুদীরা দাবী করত যে, আমরা হলাম আল্লাহর প্রিয়পাত্র, অতএব আমাদের জন্য জান্নাত সুনিশ্চিত।
এরূপ দাবী করনেওয়ালা ইয়াহুদীদেরকে বলা হয়েছিল: হে মুহাম্মাদ! তুমি এদেরকে বলে দাওঃ যদি তোমরা আল্লাহর প্রিয়পাত্রই হয়ে থাকবে, মরলেই জান্নাত নিশ্চিত একথা যদি সত্য হয়, এটা যদি মনের কথা হয়, তাহলে মৃত্যু কামনা করে দেখাও। (সূরাঃ ৬২-জুমুআঃ ৬)
আল্লাহ্ তা’আলা সাথে সাথে এটাও বলে দিয়েছেন যে, কখনোই ওরা এ সাহস করবে না, ওরা মৃত্যু কামনা করবে না। (সূরাঃ ৬২- জুমুআঃ ৭) এ আয়াত তাদের পড়ে শোনানো হল, কিন্তু তাদের কেউ মৃত্যু কামনা করতে সাহস পেল না। কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যই প্রমাণিত হল।
আর একটা ঘটনা-নবী (সাঃ) – এর হিজরতের পাঁচ ছয় বছর পূর্বের ঘটনা। তখনকার দুই পরাশক্তি -রূম আর পারস্য সম্রাটের মধ্যে যুদ্ধ লাগল। যুদ্ধে পারস্য সম্রাট বিজয়ী হয়ে গেল ৷ রোমকরা পরাজিত হল। মক্কার মুশরিকরা ছিল পারস্যের সমর্থক। কারণ পারস্য বাসীরাও মক্কাবাসীদের মত কোন আসমানী কিতাবে বিশ্বাস করত না। তাদেরও কেউ কেউ মক্কাবাসীদের মত মূর্তি পূজা করত, কেউ আগুন পূজা করত। তাই মক্কার মুশরিকরা পারস্যের লোকদেরকে নিজেদের পক্ষশক্তি মনে করত। আর মুসলমানরা তুলনামূলক ভাবে রোমকদেরকে পছন্দ করত। কারণ রোমকরা ছিল খৃষ্টান। তারা আসমানী কিতাবে বিশ্বাস করত। এদিক থেকে তারা মুসলমানদের কাছাকাছি ছিল। পারস্যের বিজয়ে মক্কার মুশরিকরা খুব খুশি হল এই ভেবে যে, আমাদের পক্ষশক্তির বিজয় শুরু হল। তারা মুসলমানদেরকে বললঃ হে মুসলমানরা, পারস্যবাসীরা যেমন রোমকদেরকে পরাজিত করেছে, ভবিষ্যতে আমরাও তোমাদেরকে ওরকম পরাজিত করব। মুসলামানরা কিছুটা মনক্ষুন্ন হল।
আয়াত নাযিল হয়ে গেলঃ অর্থাৎ, রোমকরা পরাজিত হয়েছে। আগামী তিন বছর থেকে নয় বছরের ভিতরে আবার রোমকরা বিজয়ী হবে। সেদিন মুসলমানরা আনন্দিত হবে। (সূরা : ৬২-রূম : ১-৪) আয়াত শুনে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) দৌড় দিয়ে মুশরিক নেতৃবৃন্দের কাছে চলে গেলেন। বললেনঃ তোমাদের খুশি হওয়ার কিছু নেই, কিছুদিন পরেই তোমাদের লোকেরা অর্থাৎ, পারস্যবাসীরা পরাজিত হবে, রোমকরা বিজয়ী হবে।
কাফেরদের নেতা উবাই ইবনে খাল্ফ বললঃ না, এটা কখনো হবে না, তাহলে বাজি ধর। বাজি ধরা হল। ঘটনা বেশ দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত একশত উট বাজি ধরা হল। কথা হল – যদি আগামী নয় বছরের ভিতরে রোমকরা বিজয়ী না হয়, তাহলে আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) একশত উট দিবেন উবাই ইবনে খাল্ফকে, আর বিজয়ী হলে উবাই ইবনে খালফ আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) কে একশত উট দিবে। এর সাত বছরের মাথায় যখন বদর যুদ্ধ হয়, তখন একদিকে বদর যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হল, অপর দিকে রোম পারস্যের মধ্যকার যুদ্ধে রোকমরা বিজয়ী হল। এভাবে কুর-আনের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য-প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে কুরআনের সত্যতা প্রমাণিত হল।
৫. কুরআন শরীফে পূর্ববর্তী উম্মত, সেকালের শরী‘আত ও তাদের ইতিহাস এমন পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সে যুগের ইয়াহুদী খৃষ্টানদের বিজ্ঞ ব্যক্তিগণও ততটা অবগত ছিল না। অথচ রাসূল (সাঃ)-এর কোন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না।
৬. কুরআনকে বারংবার পাঠ করলেও মনে কোন বিরক্তি আসে না। বরং যতই তিলাওয়াত করা হয়, ততই তাতে আগ্রহ বাড়তে থাকে। অথচ দুনিয়ার কোন আকর্ষণীয় থেকে আকর্ষণীয় পুস্তকের বেলায়ও দেখা যায় দুচার বার পাঠ করার পর আর তা পাঠ করতে মন চায় না।
৭. কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ তা’আলা নিজে নিয়েছেন। কিয়ামত পর্যন্ত এর মধ্যে কেউ বিন্দু বিসর্গ পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে না। লক্ষ লক্ষ হাফেযে কুরআন সৃষ্টি হওয়া ও থাকার ফলে এই কিতাবে কোনরূপ পরিবর্তনের সম্ভাবনাও কেউ কল্পনা করতে পারে না।
৮. কুরআনে জ্ঞানের যে মহাভান্ডার পূঞ্জিভূত করা হয়েছে, তা অন্য কোন কিতাবে আজ পর্যন্ত করা হয়নি এবং ভবিষ্যতেও তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
৯. কুরআন পাঠের ফলে মুসলমান অমুসলমান নির্বিশেষে সকলের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
১০. রাসূল (সাঃ)- এর সত্য নবী প্রমাণিত হওয়া কুরআনেরও সত্য কিতাব হওয়ার প্রমাণ।
তথ্য সূত্রঃ
কিতাবঃ ইসলামী আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ
লেখকঃ মাওলানা মুহাম্মাদ হেমায়েত উদ্দিন শায়খুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া, তাঁতিবাজার, ঢাকা – ১১০০। মুহাদ্দিছ, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, ৩৩২, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা ১২৩৬