ইসলাম

তাকলীদের বিভিন্ন স্তর

আলোচনার এ পর্যায়ে এসে তাকলীদের বিভিন্ন স্তর এর তারতম্য ও শ্রেণী বিভাগ নিয়ে আলোচনা করব।

উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক স্তররের হুকুম ভিন্ন ভিন্ন। মূলত: এ সবের পার্থক্য না বুঝার কারণেই গাইরে মুকাল্লীদীন বা তথাকথিত আহলে হাদী,স (?) ভাইয়েরা বিভিন্ন উদ্ভট প্রশ্নের অবতারণা করে থাকেন।

কাজেই ‘তাকলীদের’ স্তর বুঝা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

তাকলীদের মোট চারটি স্তর

১। সাধারণ মানুষের তাকলীদ ২। প্রজ্ঞাবান বিদগ্ধ আলিমের তাকলীদ ৩। মুজতাহিদ ফিল মাযহাবের তাকলীদ ৪। মুজতাহিদে মুতলাক এর তাকলীদ প্রথমে আমরা ‘সাধারণ মানুষ’ এর তাকলীদ শীর্ষক বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ভাবে আলোচনা করছি।

প্রথম স্তর : সাধারণ মানুষের ডাকলীদ

তাকলীদের সর্বপ্রথম স্তর হল ‘সর্ব সাধারণের’ তাকলীদ। এখানে ‘সাধারণ মানুষ’ বলতে আমরা নিম্নের তিন ধরণের মানুষকে বোঝাতে চাচ্ছি।

প্রথমত: ঐ সব মানুষ যারা আরবী ভাষা ও ইসলামী ভ সম্মন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ; চাই তারা অন্যান্য বিষয়ে যতই বিজ্ঞ ও পারদর্শী হোননা কেন।

দ্বিতীয়ত: ঐ সকল লোক যারা আরবী ভাষা জানেন এবং আরবী কিতাবও বুঝেন কিন্তু তার তাফসীর, হাদীস, ফিক্হ ইসলামী আইনশাস্ত্র বা সংশ্লিষ্ট দীনী বিষয়গুলো নিয়মতান্ত্রিক ভাবে কোন উস্তাদের নিকট পাঠ করেননি।

তৃতীয়ত: ঐ সকল লোক যারা প্রচলিত ইসলামী জ্ঞান শিখে শিখে ফারিগ তো হয়েছেন বটে কিন্তু তাফসীর, হাদীস, ফিক্হ বা এর নীতিমূলক বিষয়ে ভাল যোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারেননি বা তেমন পান্ডিত্য লাভ হয়নি।

উল্লিখিত লোকদেরকে তাকলীদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কাতারে ধরা হচ্ছে। এ জন্যে এদের সকলের হুকুম এক ও অভিন্ন। আর তা হচ্ছে এই যে, এ জাতীয় সাধারণ মানুষের নির্ভেজাল তাকলীদ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কেননা তাদের মধ্যে এ যোগ্যতাই নেই যে, তারা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সরাসরি মাসআলা আহরণ করবেন। এ কারণে তাদের জন্য কোন মুজতাহিদের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ বা তাকলীদের বিকল্প নেই।

তাই তো বিশ্বখ্যাত মুহাদ্দিস খতীবে বাগদাদী (রহ.) লিখছেন- أَمَّا مَنْ يَسُوعُ لَهُ التَّقْلِيدُ فَهُوَ الْعَامِيُّ الَّذِي لَا يَعْرِفُ طرق الاحكام . وَلانَّهُ لَيْسَ مِنْ الشَّرْعِيَّةِ فَيَجُوزُ لَهُ أنْ يُقَلَّدَ عَالِمًا وَيَعْمَلَ بِقَوْلِهِ . أهْلِ الْإِجْتِهَادِ فَكَانَ فَرْضُهُ التَّقْلِيدُ كَتَقْلِيدِ الْأَعْمَى فِي الْقِبْلَةِ فَإِنَّهُ لَمَّا لَمْ يَكُنْ مَعَهُ آلَةُ الْإِجْتِهَادِ فِي الْقِبْلَةِ كَانَ عَلَيْهِ تَقليدُ البَصِيرِ فِيهَا.

“ঐ সকল সাধারণ মানুষ যারা শরীয়তের হুকুম-আহকাম বা বিধি-বিধান সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না এ ধরনের ব্যক্তির জন্য কোন মুজতাহিদের তাকলীদ করা ও তার আমল অনুযায়ী আমল করা অপরিহার্য। যেহেতু এ ব্যক্তি ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখে না সেহেতু তার উপর ফরয তাকলীদ করা । যেমন অন্ধ ব্যক্তি কিবলা নির্ধারণে যোগ্যতার অভাবে চক্ষু বিশিষ্ট মানুষের অনুসরণ করে থাকে”।আল ফাকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ লিল খতীব আল বাগদাদী ৬৮, সৌদী সংস্করণ :

দ্বিতীয় স্তর ঃ বিদগ্ধ আলিমের তাকলীদ

‘বিদগ্ধ আলিম’ বলতে আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন আলিম যিনি যদিও ‘ইজতিহাদ’ করার যোগ্যতা লাভ করেননি কিন্তু তিনি ইসলামী জ্ঞান নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্ভরযোগ্য আলিমদের নিকট হতে তাঁদেরই তত্ত্বাবধানে দীর্ঘ সময় নিয়ে শিখেছেন। তাফসীর, উসূলে তাফসীর, হাদীস, উসূলে হাদীস,ফিক্হ, উসূলে ফিকহ ইত্যাদি বিষয়গুলো তাঁর নখদর্পণে অবস্থিত। এর সাথে সাথে তিনি যে কোন মাসআলায় গবেষণার ক্ষেত্রেও মহান পূর্বসূরীদের ইজতিহাদ পদ্ধতি ও তাঁদের মূল্যবান বক্তব্যের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও তথ্য সম্পর্কে পূর্ণ সজাগ ও সচেতন ।

যুগশ্রেষ্ঠ আলিম হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) এ ধরনের আলিমকে মুতাবাহহির ফিল মাযহাব বা মাযহাব বিশেষজ্ঞ আলিম হিসেবে অভিহিত করে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে- ..فصل في المُتَبَحْرِ فِي الْمَذْهَبِ ، وَهُوَ الْحَافِظُ لِكُتُبِ مَذْهَبِهِ. مِنْ شَرْطِهِ أَنْ يَكُونَ صَحِيحَ الْفَهْمِ عَارِفاً بِالْعَرَبِيَّةِ وَأَسَالِيبِ الْكَلَامِ وَمَرَاتِبِ التَّرْجِيْحِ مُتَفَطَنَا لِمَعَانِي كَلَامِهِمْ لَا يَخْفَى عَلَيْهِ غَالِبًا تَفْسِيدُ مَا يَكُونُ مُطْلَقاً فِى الظَّاهِرِ وَالْمُرَادُ مِنْهُ الْمُقَيَّدُ وَإِطْلَاقُ مَا يَكُونُ مُقَيَّداً فِي الظَّاهِرِ وَالْمُرَادُ مِنْهُ الْمُطْلَقُ .

“মুতাবাহির ফিল মাযহাব বা মাযহাব বিশেষজ্ঞ বিদগ্ধ আলিম তাকেই বলা হবে যিনি (প্রামাণ্য) গ্রন্থ সমূহের ব্যাপারে উপস্থাপনের অধিকারী। তার জন্য আবশ্যকীয় শর্ত হল, তাকে সহীহ সমঝওয়ালা হতে হবে। হতে হবে আরবী ভাষায় দক্ষ। সেই সাথে কথার রং ও ঢং সম্পর্কে থাকতে হবে স্বচ্ছ ধারণা। (মুজতাহিদদের বিভিন্ন বক্তব্যের মাঝে মতাবিরোধের ক্ষেত্রে) কোন একটি মতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য তাঁকে অবশ্যই সে বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে। এবং তাঁদের কথা বুঝতে হবে। আর ক্ষেত্র বিশেষে বাহ্যত ফুকাহায়ে কিরামের কোন বক্তব্য শর্তমুক্ত হলেও বাস্তবে তা শর্তযুক্ত হয়ে থাকে। আবার অনেক সময় এর ঠিক বিপরীত অবস্থাও হয়ে থাকে। এ বিষয়েও সে আলিমকে পূর্ণ সচেতন থাকতে হবে।”

এ ব্যক্তি যদিও ইজতিহাদের মর্যাদায় পৌঁছেননি কিন্তু তারপরও তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যোগ্যতার সুবাদে সাধারণ মানুষের তাকলীদের সাথে তাঁর তাকলীদের কিছু পার্থক্য হয়ে থাকে। অতএব, যদি তিনি কোন বিশেষ মাসআলায় অনুভব করেন যে, তিনি যে ইমামের মুকাল্লিদ সে ইমামের বক্তব্যটি সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক, আর সেই সাথে এর বিপরীতে কোন শক্তিশালী প্রমাণও নেই। সে ক্ষেত্রে তিনি নিজ ইমামের বক্তব্য পরিত্যাগ করতে পারবেন কি পারবেন না? আলিমদের এক জামা’আতের মন্তব্য হচ্ছে এই যে, যেহেতু তিনি এখনো ইজতিহাদের যোগ্যতা লাভে সক্ষম হননি সেহেতু তিনি নিজ ইমামের বক্তব্য বর্জন করতে পারবেন না।

এর বিপরীতে অন্য একদল অধিকাংশ আলিমের মত হচ্ছে, সহীহ হাদীসের কারণে তিনি নিজ ইমামের বক্তব্য গ্রহণ না করলেও পারবেন।

কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত

অবশ্য এর জন্যও কয়েকটি শর্ত রয়েছে। যার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা ১। বিদগ্ধ ও প্রজ্ঞাবান আলিম হিসেবে অবশ্যই তাকে মনোনীত হতে হবে

২। উক্ত হাদীসের বিপরীতে অন্য কোন আয়াত বা হাদীস নেই এ ব্যাপারেও তাকে সুনিশ্চিত হতে হবে।

৩। ঐ নির্দিষ্ট হাদীসের মর্ম সম্পূর্ণ পরিস্কার ও স্বচ্ছ হতে হবে এবং অন্য কোন সন্তোষজনক অর্থ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকতে হবে।

৪। এর সাথে সাথে আরেকটি অপরিহার্য শর্ত এই যে, এ হাদীসের আলোকে যে বক্তব্য গ্রহণ করা হবে সেটা ইমাম চতুষ্টয়ের ঐকমত্যের বিপরীত হলে চলবেনা । ১

উল্লিখিত সকল শর্ত সাপেক্ষে একজন দূরদর্শী বিজ্ঞ ও সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী আলিমের জন্য নিজ ইমামের মত গ্রহণ না করার অবকাশ আছে।

পক্ষান্তরে যদি এ শর্তগুলোর একটি শর্তও কম হয়, তাহলে তার জন্য নিজ ইমামের মতামত ত্যাগ করা জায়িয হবে না।

তৃতীয় স্তর : মুজতাহিদ ফিল মাযহাবের তাকলীদ

তাকলীদের তৃতীয় স্তর হচ্ছে মুজতাহিদ ফিল মাযহাবের তাকলীদ। ‘মুজতাহিদ ফিল মাযহাব’ ঐসব ব্যক্তিকে বলা হয় যারা মূলনীতির ক্ষেত্রে ‘মুজতাহিদে মুতলাক’ বা পূর্ণাঙ্গ মুজতাহিদের অনুসরণ করত: সে আলোকে আনুষাঙ্গিক মাসায়িল কুরআন, হাদীস ও সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.)-এর বাণী থেকে আহরণ করতে সক্ষম।

কথাটিকে আরো সহজ করে এভাবে বলা যেতে পারে যে, যে বা যারা খুঁটিনাটি মাসায়িলের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র মত থাকা সত্ত্বেও মূলনীতির প্রেক্ষাপটে ‘মুজতাহিদে মুতলাক’ এর তাকলীদ করেন তিনি বা তারাই হলেন ‘মুজতাহিদ ফিল মাযহাব’।

উদাহরণ স্বরূপ: ইমাম আবূ ইউসুফ’ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) ফিকহে হানাফীর ক্ষেত্রে। ফিকহে মালিকীতে সাহনূন ও আবূ আবদিল্লাহ আবদুর রহমান ইবনুল কাসিম (রহ.)। ফিকহে হাম্বলীতে ইবরাহীম ইবনে ইসহাক ইবনে ইবরাহীম আল হারবী ও আবূ বকর আল আসরাম (রহ:)। ফিকহে শাফেঈতে আবূ ইবরাহীম ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া আল মুযানী ও আবূ আলী হাসান ইবনে মুহাম্মাদ আয যা‘আফরানী প্রমুখ।

হিজরী ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ আলিম, বিশ্বখ্যাত ফকীহ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রহ.) নিজ যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘শরহে উকূদে রসমিল মুফতী’ গ্রন্থে মুজতাহিদ ফিল মাযহাবের সংঙ্গা প্রসঙ্গে লিখেছেন : “ফকীহদের দ্বিতীয় স্তর হল মুজতাহিদীন ফিল মাযহাবের স্তর। যেমন ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) ও ইমাম আবু হানীফা (রহ.) -এর অন্যান্য সকল শিষ্য। যাঁরা উল্লিখিত দালায়িল তথা কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস হতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আহকাম আহরণে পারদর্শী। যে পন্থা তাঁদের (সম্মানিত) উস্তাদ তাঁদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। এ সব মনীষী যদিও খুঁটিনাটি মাসায়িলের ক্ষেত্রে নিজ উস্তাদ ইমামে আ’যম আবূ হানীফা (রহ.)-এর সাথে মতভেদ করেছেন কিন্তু উসূল বা মূলনীতির ক্ষেত্রে তাঁরা বরাবরই ইমাম আবূ হানীফার (রহ.)-এর তাকলীদ করেছেন।

চতুর্থ স্তর : মুজতাহিদে মুতলাকের তাকলীদ

তাকলীদের চতুর্থ ও সর্বশেষ স্তর হচ্ছে মুজতাহিদে মুতলাকের তাকলীদ। মুজতাহিদে মুতলাক বা পূর্ণাঙ্গ মুজতাহিদ বলা হয় ঐ মহান ব্যক্তিকে যার মধ্যে ইজতিহাদের সকল শর্ত পাওয়া যায় এবং তিনি নিজ ইলম ও বুদ্ধি দ্বারা ইজতিহাদের মূলনীতিগুলো কুরআন ও হাদীস থেকে সরাসরি আহরণে সক্ষম। যেমন ইমামে আ’যম হযরত আবূ হানীফা (রহ.) ইমাম শাফেয়ী (রহ.) ইমাম মালিক (রহ.) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ.) প্রমুখ। তাঁরা যদিও উসূলী ও ফুরূয়ী তথা মূলনীতিমূলক ও শাখা-প্রশাখাগত সকল বিষয়েই মুজতাহিদ, তথাপি তাঁদেরকেও এক পর্যায়ে তাকলীদ করতেই হয়।

আর সেটা এভাবে যে, যে সব ক্ষেত্রে কুরআনে কারীম বা হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থহীন কোন বক্তব্য পাওয়া না যায় সে) ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের বিচার বুদ্ধি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত প্রদানের পরিবর্তে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) লক্ষ্য করেন যে, এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম (রাযি.) বা তাবেয়ীগণ (রহ.)-এর কোন বক্তব্য বা কার্যপ্রমাণ পাওয়া যায় কিনা; যদি পাওয়া যায় তাহলে সে ক্ষেত্রে তাঁরা সাহাবা অথবা তাবেয়ীদের তাকলীদ করেন।

তথসূত্র:

তাকলীদ ও মাযহাব প্রসঙ্গ

মুফতি হিফজুর রহমান

প্রধান মুফতি,জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া,সাতমসজিদ,মুহাম্মদপুর,ঢাকা।

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *