গীবতের ক্ষতি
গীবতের দ্বারা প্রচুর ক্ষতি হয়, পার্থিব জগতেও পরজগতেও। গীবতকারী দুনিয়া-আখেরাত উভয় স্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গীবতের ক্ষতি নিম্নরূপ ঃ
(এক) গীবতকারীর দোয়া কবুল হয় না। যে ব্যক্তি অনবরত গীবতে লিপ্ত থাকে সে খুব কমই অনুতপ্ত হয়। তাই তার দোয়া কবুল হয় না এবং তার প্রতি করুণা বর্ষিত হয় না। লোকেরা ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রঃ)- এর নিকট অভিযোগ করলো যে, তারা দোয়া করছে কিন্তু কবুল হচ্ছে না, এর কারণ কি? তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে আটটি দোষ রয়েছে, ফলে তোমাদের অন্তরের সজীবতা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই তোমাদের দোয়া কবুল হয় না।
(১) তোমরা আল্লাহর মহত্ব স্বীকার করো কিন্তু তাঁর অধিকার আদায় করো না, তাঁর বিধানের আনুগত্য করো না।
(২) তোমরা কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করো কিন্তু তদনুযায়ী কাজ করো না।
(৩) তোমরা মুখে মুখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করো কিন্তু তাঁর হাদীস মোতাবেক জীবনযাপন করো না। অথচ ভালোবাসার দাবি এই যে, কাউকে ভালোবাসলে তার মর্জি অনুযায়ী কাজ করতে হয়
(৪) তোমরা কথায় কথায় বলো যে, তোমরা মৃত্যুর ভয় করো কিন্তু তার প্রস্তুতি স্বরূপ ইবাদত করো না। অথচ কোন ব্যক্তি যে জিনিসকে ভয় করে সে তা থেকে মুক্তি লাভের পথ অন্বেষণ করে।
(৫) মহান আল্লাহ বলেন : إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوا . শয়তান তোমাদের দুশমন, অতএব শয়তানকে শত্রু হিসাবেই গ্রহণ করো’। (সূরা ফাতির : ৬) অথচ তোমরা অহরহ পাপাচারে লিপ্ত হয়ে রয়েছো এবং শয়তানকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নিয়েছো।
(৬) তোমরা মুখে বলছো যে, তোমরা দোযখের ভয় করো কিন্তু নিজেরাই নিজেদের দোযখে নিক্ষেপ করছো।
(৭) তোমরা বেহেশতে যাওয়ার আকাঙ্খা জাহির করছো অথচ বেহেশতে যাওয়ার পাথেয় সংগ্রহ করছো না।
(৮) তোমরা অপরের দোষ চর্চা (গীবত) করছো অথচ নিজেদের দোষের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছো না। এসব কারণে তোমাদের অন্তর মরে গেছে। তাই তোমাদের প্রতি আল্লাহর রহমাত নাযিল হচ্ছে না এবং তোমাদের দোয়া কবুল হচ্ছে না।
(দুই) গীবতের কারণে আমলনামা থেকে সৎ কাজের পরিমাণ কমে যায়। আবু উমামা আল-বাহিলী (রাঃ) বলেন, কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি তার আমলনামায় এমন কিছু নেক আমল দেখতে পাবে যা সে কখনও করেনি। সে বলবে, হে প্রভু! এসব নেক কাজ তো আমি করিনি, তা কিভাবে আমার আমলনামায় যুক্ত হলো? মহান আল্লাহ বলবেন, যেসব লোক তোমার গীবত করেছে তাদের আমলনামা থেকে তাদের নেক কাজ বিয়োগ করে তা তোমার আমলনামায় লিখে দেওয়া হয়েছে (তামবীহুল গাফেলীন, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব)।
একই সাহাবী থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন কোন ব্যক্তি তার আমলনামায় তার কোন কোন নেক আমল লিপিবদ্ধ না দেখে জিজ্ঞেস করবে, হে আল্লাহ! আমি তো পার্থিব জীবনে এই এই নেক কাজ করেছি অথচ তা আমার আমল নামায় দেখতে পাচ্ছি না! মহান আল্লাহ বলবেন, তুমি অমুক অমুক লোকের গীবত করেছো। তাই তোমার আমলনামা থেকে তা বিয়োগ করে তুমি যার গীবত করেছো তার আমলনামায় যোগ করে দিয়েছি (তারগীব তারহীব)।
হাসান বসরী (রঃ) জানতে পারলেন যে, এক ব্যক্তি তাঁর গীবত করছে। তিনি তার জন্য কিছু উপহার সামগ্রী পাঠালেন এবং বললেন, তুমি আমার গীবত করে তোমার নেক আমল আমাকে দিয়ে দিয়েছো। তাই তোমার জন্য এই উপহার সামগ্রী পাঠালাম (নুযহাতুল মাজালিস)।
একদা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণ কে জিজ্ঞেস করলেন ঃ দেউলিয়া কে তা কি তোমরা জানো? সাহাবীগণ বললেন, যার কোন অর্থ সম্পদ নাই। তিনি (সঃ) বললেন : না অর্থ-সম্পদহীন ব্যক্তি দেউলিয়া নয়। বরং কিয়ামতের দিন দেখা যাবে কোন ব্যক্তি এমন অবস্থায় উপস্থিত হয়েছে যে, সে প্রচুর নামায-রোযা করেছে, যাকাত দিয়েছে কিন্তু সে কারো জায়গা-জমি, অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারো গীবত করেছে, কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অত্যাচার করেছে বা হত্যা করেছে। সেদিন আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক ব্যক্তির প্রাপ্য পূর্ণরূপে পরিশোধ করে দিবেন। অতএব উপরোক্ত বদ কাজের দরুন সেই লোকের আমলনামা থেকে তার নেক আমল কেটে নেয়া হবে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে যে, তার আমলনামায় কোন নেক আমল আর বাকি নাই ৷ প্ৰকৃতপক্ষে এই ব্যক্তিই হলো দেউলিয়া (বাগাবীর মাআলিমুত তানযীল গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত)।
(তিন) গীবতের কারণে বদকাজের পরিমাণ বেড়ে যায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “সাবধান! তোমরা গীবত থেকে দূরে থাকো। কারণ গীবতের মধ্যে তিনটি বিপদ রয়েছে। গীবতকারীর দোয়া কবুল করা হয় না, তার সৎকাজসমূহও কবুল করা হয় না এবং তার আমলনামায় তার পাপ বর্ধিত হতে থাকে” (খিযানাতুর রিওয়ায়াত)।
(চার) গীবতকারীর সৎ কাজ কবুল হয় না। যেমন উপরের হাদীস থেকে আমরা জানতে পেরেছি এবং এই সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন ঃ مَا النَّارُ فِي الْيَبِس بأَسْرَعَ مِنَ الْغَيْبَةِ فِي حَسَنَاتِ الْعَبْدِ “বান্দার নেক আমল গীবতের দ্বারা যত দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় আগুনও তত দ্রুত শুকনা বস্তু ধ্বংস করতে পারে না” (ইহয়া উলূমিদ্দীন)। অর্থাৎ শুকনো কাঠে আগুন লাগলে তা কত দ্রুত জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায় তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। কিন্তু গীবত তার চেয়েও দ্রুত গতিতে নেক আমল ধ্বংস করে দেয়। অনন্তর গীবতকারী কিয়ামতের দিন কঠিন হিসাবের সম্মুখীন হবে, অপমানিত ও লজ্জিত হবে, নিজের দেহের গোশত চিবিয়ে খাবে, নখের আঁচড়ে নিজের দেহ ক্ষতবিক্ষত করবে, দোযখে যাবে সর্বাগ্রে কিন্তু জান্নাতে যাবে সর্বশেষে। তাছাড়া গীবতের আরও বহু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। যেমন গীবতকারী আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, তার শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, শয়তান তার প্রতি প্ৰসন্ন হয়,সে আল্লাহ্ অসন্তোষের শিকার হয় ইত্যাদি।
(পাঁচ) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গীবতকারীকে পুনরায় রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দুই রোযাদার ব্যক্তি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যোহর ও আসরের নামায পড়লো। আসরের নামাযের পর তিনি তাদের বললেন : তোমরা উভয়ে উযু করে যোহর ও আসরের নামায পুনরায় পড়ে নাও এবং রোযারও কাযা করো। তারা বললো, হে আল্লাহর রাসূল! কেন আমাদের জন্য এই হুকুম? তিনি বলেন : তোমরা রোযা অবস্থায় গীবত করেছ (বায়হাকীর শুআবুল ঈমান থেকে মিশকাতুল মাসাবীহ, বাবুল গীবাত)।
এক দিন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আজ যেন কেউ আমার নির্দেশ দেয়ার পূর্বে ইফতার না করে। সন্ধ্যা হলে প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁর অনুমতি নিয়ে ইফতার করতে থাকে। এক ব্যক্তি এসে বললো, হে আল্লাহর নবী! দুই যুবতী নারী আমার ঘরে রোযাদার। তারা আপনার নিকট আসতে লজ্জাবোধ করছে এবং ইফতার করার অনুমতি চাচ্ছে। এ কথা শুনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন। লোকটি পরপর তিনবার তার কথার পুনরাবৃত্তি করলো। তৃতীয়বারের পর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : তাদের রোযা হয়নি। কারণ যে বক্তি দিনভর মানুষের গোশত খায় (গীবত করে বেড়ায়) তার রোযা কিভাবে হতে পারে। তাদের দুইজনকে এখানে এসে বমি করতে বলো। তারা তাঁর দরবারে উপস্থিত হলে তিনি (সাঃ) তাদের একটি পাত্রে বমি করতে বলেন। তারা পুঁজ মিশ্রিত রক্তবমি করলো। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ এই দুই নারী সারা দিন এক জায়গায় বসে মানুষের গোশত খেয়েছে (ইহয়া উলূমিদ্দীন)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : এমন চারটি জিনিস আছে যার দ্বারা উযু নষ্ট হয়ে যায়, নেক আমল নষ্ট হয়ে যায় এবং রোযাও বাতিল হয়ে যায়। তা হলো ঃ গীবত, চোগল খোরি, মিথ্যাচার এবং বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টিপাত। এই চারটি জিনিস পাপাচারের শিকড়কে সজীব করে, যেভাবে পানি গাছের শিকড়কে সজীব করে (তামবীহুল গাফিলীন)।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন : এমন পাঁচটি জিনিস আছে যার দ্বারা রোযা নষ্ট হয়ে যায়। সেগুলো হলো : মিথ্যাচার, চোগলখোরি, গীবত, মিথ্যা শপথ এবং কোন নারীর প্রতি কামভাব নিয়ে তাকানো (ইয়া উলুমুদ্দীন,রোযা অধ্যায়)।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন : مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الرُّوْرِ وَالْعَمَلِ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يُدَعَ طَعَامَهُ “যে ব্যক্তি (রোযা থেকেও) মিথ্যাচার ত্যাগ করতে পারলো না তার পানাহার ত্যাগ করায় (রোযা রাখায়) আল্লাহর কিছু যায় আসে না” (তিরমিযী)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তার রোযার কোন মূল্য ও মর্যাদা দেন না। মোল্লা আলী আল-কারী (রঃ) মিরকাত গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কাওলায-যূর’ অর্থ বাতিল কথা, তা মিথ্যাই হোক অথবা গীবত অথবা চোগলখোরি, যা মানুষের পরিহার করা কর্তব্য। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন : كم مِّنْ صَائِمِ لَيْسَ لَهُ مِنْ صَوْمِهِ إِلا الْجُوعَ وَالْعَطَش “কত রোযাদার আছে যারা রোযার দ্বারা ক্ষুধা ও পিপাসা ছাড়া আর কিছুই পায় না” (ইয়া উলূমিদ্দীন, সাওম অধ্যায়)।
সূত্রঃ বই- গীবত
লিখক :মাওলানা আবদুল হাই লাখনাভী (রহঃ)