ইসলাম

পরিপূর্ণ ঈমান হচ্ছে সাতটি বিষয় পালন ও বাস্তবায়নের নাম :

প্রথম বিষয় : মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও সত্যায়ন করা

মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও সত্যায়নের অর্থ হচ্ছে, ঈমান-ইসলামের অকাট্য বিষয়সমূহে মজবুত স্পষ্ট বিশ্বাস ও দৃঢ়তা থাকতে হবে। এতে কোনো ধরনের সন্দেহ-সংশয়, দ্বিধা, দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতা, অস্পষ্টতা ও অপছন্দতা থাকতে পারবে না।

আকীদার ইমাম আবুল মুঈন নাসাফী মাতুরীদী রাহ. (মৃ. ৫০৮ হি.) লেখেন, ‘সত্যায়ন বা বিশ্বাস হলো, মিথ্যা এবং দ্বিধা-সিদ্ধান্তহীনতার বিপরীত। কেননা, দ্বিধা-সিদ্ধান্তহীনতায় ঝুলে থাকা হয়। আর ঝুলে থাকা ব্যক্তি এবং মিথ্যা প্রতিপন্নকারী সত্যায়নকারী বা বিশ্বাসী নয়। কাজেই যে ব্যক্তি মিথ্যা এবং দ্বিধা-সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মুক্ত থেকে সত্যায়ন করবে, সে বিশ্বাসী (মুমিন) হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

আল্লাহ তাআলা মুমিনের পরিচয় তুলে ধরে ইরশাদ করেন, ‘তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনল, আর সন্দেহ পোষণ করল না এবং জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করল, তারাই সত্যবাদী মুমিন।”(সূরা হুজুরাত, আয়াত :১৫)

এক লম্বা হাদীসে এসেছে, হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আমি আল্লাহর রাসূল হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করছি। আর যে ব্যক্তি এ দুটি বিষয় (লা-ইলাহা…) কোনো ধরনের সন্দেহ-সংশয় ছাড়া গ্রহণ করে মারা যাবে, সে নিশ্চিত জান্নাতে প্রবেশ করবে।(সহিহ মুসলিম,হাদীস নং: ২৭)

পক্ষান্তরে সন্দেহ-সংশয় হচ্ছে মুনাফিকের লক্ষণ। আর মুনাফিক হলো কাফেরেরই এক প্রকার। এ কাফের-মুনাফিক সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের অন্তর সন্দেহে নিপতিত। কাজেই তারা আপনসন্দেহের ভেতর দোদুল্যমান।’

দ্বিতীয় বিষয় : ওই সকল বিষয় বিশ্বাস করতে হবে, যা ইসলামে অকাট্যভাবে প্রমাণিত

মুমিন হওয়ার জন্য দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও সত্যায়ন করতে হবে ওই সকল বিষয়, যা ইসলামে অকাট্যভাবে ও নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত।

আকীদা-বিশেষজ্ঞ আল্লামা আয়ুদুদ্দীন ইজী রাহ. (মৃ. ৭৫৬ হি.) লেখেন, ‘আমাদের ও অধিকাংশ ইমামের মতানুসারে শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান হচ্ছে, সেসব বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিশ্বাস করা, যা তাঁর নিয়ে আসা (তথা তাঁর আনীত) দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হওয়া অকাট্যভাবে ও সুস্পষ্টভাবে জানা গেছে। যে বিষয়গুলো বিস্তারিত জানা গেছে, সেগুলো বিস্তারিতভাবে বিশ্বাস করা আর যে বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে জানা গেছে, তা সংক্ষিপ্তভাবে বিশ্বাস করা। পরিভাষায় এগুলোকে ‘কাতইয়াত’, ‘জরুরিয়াতে দ্বীন’ ও ‘অকাট্য ইজমা’ বলে।

অর্থাৎ যে সকল বিষয় কুরআন বা মুতাওয়াতির হাদীস (অসংখ্য সূত্র, যাতে সন্দেহের অবকাশ থাকে না) দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত অথবা ইসলামের অংশ হওয়াটা প্রসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত কিংবা ইমামগণের ঐকমত্যপূর্ণ, এগুলো সবই বিশ্বাস করতে হবে।

আল্লামা আবুশ শাকুর সালিমী রাহ. (মৃ. ৪৬০ হিজরীর পর) লেখেন, ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর মতে ঈমানের (মুমিন হওয়ার) জন্য শর্ত হলো সেসব বিষয়, যেগুলোর ওপর ঈমান আনা আবশ্যক, যা ছাড়া ঈমান বিশুদ্ধ হয় না এবং যা অস্বীকার করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়। আর তা হচ্ছে, ওই সকল বিষয়, যা নস (অকাট্য ও সুস্পষ্ট) বা মুতাওয়াতির হাদীস (অকাট্যভাবে প্রমাণিত সূত্র) কিংবা উম্মাহর ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত সুতরাং তা গ্রহণ করা এবং বিশ্বাস করা অপরিহার্য।’

তৃতীয় বিষয় : অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়গুলোর নির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত অর্থ-ব্যাখ্যা ও রূপ-পদ্ধতিসহ বিশ্বাস করতে হবে

মুমিন হওয়ার জন্য তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়গুলোর নির্ধারিত ও প্রতিষ্ঠিত অর্থ-ব্যাখ্যা ও রূপ-পদ্ধতিসহ বিশ্বাস করা।

ইসলাম ও শরীয়ত যেমন বেশ কিছু অকাট্য আকীদা-আমল দিয়েছে, তেমনই এগুলোর অর্থ-ব্যাখ্যা ও পালনের রূপ-পদ্ধতি কী হবে, তাও অকাট্যভাবে জানিয়ে দিয়েছে, যা প্রজন্ম পরম্পরায় প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। এমন অকাট্যভাবে প্রতিষ্ঠিতের বিপরীত ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা-পদ্ধতি বা বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা করা কুফরের আলামত।

কাজেই ঈমান-আকীদার বিষয়গুলোকে এর অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত অর্থ-ব্যাখ্যা ও পালনের রূপ-পদ্ধতিসহ বিশ্বাস করতে হবে। এগুলোর প্রতিষ্ঠিত অর্থ-ব্যাখ্যা পাশ কেটে নতুন কোনো মর্ম গ্রহণ করলে অথবা এগুলো পালনের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি বাদ দিয়ে ভিন্ন কোনো পন্থা অবলম্বন করলে মুমিন হওয়া যাবে না বা ঈমান থাকবে না ।

যেমন : কেউ যদি নামাজের প্রতি বিশ্বাস রাখে, কিন্তু কুরআন-হাদীসে এর নির্ধারিত যে অর্থ-ব্যাখ্যা রয়েছে তা গ্রহণ না করে বলে, নামাজ অর্থ মা’রিফাত বা অন্তরে আল্লাহর স্মরণ। অথবা নামাজ আদায়ের অকাট্যভাবে যে রূপ-পদ্ধতি বর্ণিত ও প্রজন্মপরম্পরায় প্রতিষ্ঠিত, তা পালন না করে নতুন কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করে, যেমন : হিজবুত তাওহীদের মিলিটিরিয়ান ট্রেনিংয়ের মতো বিকৃত নামাজ, কিংবা আহলে কুরআন নামধারী হাদীস অস্বীকারকারীদের অভিনব পদ্ধতির নামাজ, অথবা সজল রোশন নামক কুরআনিস্টের মতে চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সালাতের অর্থ হচ্ছে, সর্বাবস্থায় আল্লাহর বিধি-নিষেধ ছায়ার মতো অনুসরণ করা !

চতুর্থ বিষয় : মৌখিকভাবে সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তি প্রদান

ঈমানের চতুর্থ বিষয় হচ্ছে, অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিষয়গুলোর মৌখিকভাবে সাক্ষ্য দেওয়া এবং স্বীকারোক্তি প্রদান করা। হযরত ইবনে উমর রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি। তন্মধ্যে প্রথম হচ্ছে, এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং নিশ্চয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।(সহিহ বুখারী ,হাদীস নং ৮)

কুরআনে কারীমে এসেছে, ‘আল্লাহ স্বয়ং এবং ফেরেশতাগণ ও জ্ঞানীগণও এ বিষয়ের সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, যিনি ইনসাফের সাথে (বিশ্বজগতের) নিয়ম-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্ৰণ করছেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নন। তাঁর ক্ষমতা পরিপূর্ণ এবং হিকমতও পরিপূর্ণ।”(সূরা আলে ইমরান, আয়াত :১৮)

ইমাম আবু হানীফা রাহ. ‘আল-ওসিয়্যাহ’-তে ও ইমাম তাহাবী রাহ. (মৃ. ৩২১ হি.) তাঁর বিখ্যাত ‘আকীদা’ গ্রন্থে লেখেন, ‘ঈমান হলো মৌখিক স্বীকারোক্তি দেওয়া এবং আন্তরিক বিশ্বাস করা।’

পঞ্চম বিষয় : আনুগত্য অবধারিত বা পালনীয় হিসেবে মেনে নেওয়া

মুমিন হওয়ার জন্য শুধু ইসলাম ও নবীর সত্যতা সম্পর্কে জানা এবং তা সঠিক ব্যাখ্যাসহ আন্তরিকভাবে বিশ্বাস পোষণ ও মৌখিক স্বীকৃতি প্রদান করলে হবে না; বরং এগুলোর সাথে ইসলামের বিধানাবলির প্রতি আনুগত্য করা নিজের ওপর অবধারিত এবং পালনীয় হিসেবে মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিতে হবে। যাকে ‘ইলতিযামুত তা’আহ’ বা ‘ইলতিযামুল ইনকিয়াদ’ বলা হয়। এটা ঈমানের জন্য আবশ্যকীয় বিষয়।

ষষ্ঠ বিষয় : ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক অন্য সকল ধর্ম-কর্ম, মতবাদ ও আদর্শ থেকে বিমুখতা ও সম্পর্কহীনতা আবশ্যকীয়

ঈমান শুধু গ্রহণের নাম নয়, সাথে বর্জনও করতে হয়। হক ও সত্যকে গ্রহণ এবং বাতিল ও মিথ্যাকে বর্জনের নাম ঈমান। কারণ, কোনো কিছু গ্রহণ ও মেনে নিতে হলে তার বিপরীত বিষয় বর্জন ও অস্বীকার করতে হয়। অন্যথায় তা হবে স্ববিরোধিতা, যা কোনো সুস্থ বিবেক গ্রহণ করতে পারে না।

সুতরাং ঈমানদার হতে হলে তাওহীদ-ঈমান গ্রহণের পাশাপাশি যাবতীয় শিরক-কুফর থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা অপরিহার্য এবং ইসলাম-বিরোধী সকল ধর্ম-কর্ম, মতবাদ ও আদর্শ থেকে বিমুখতা ও সম্পর্কহীনতা প্রদর্শন করা এবং এগুলো অবিশ্বাস ও অস্বীকার করা আবশ্যকীয়।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে সত্য পথ ভ্রান্ত পথ হতে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। এরপর যে ব্যক্তি তাগূতকে (তথা ইসলামের বিপরীত অন্য সব ধর্ম, মতবাদ ও আদর্শকে) অস্বীকার করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, সে নিশ্চিত এক মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরল, যা ভেঙে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।”(সূরা বাকারা, আয়াত :২৫৬)

ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. (মৃ. ১৮১ হি.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, করে না, তাহলে সে মুনাফিক। কেননা, ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য কুফর থেকে সম্পর্কহীন হওয়া আবশ্যক। দলীল হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি তাগূতকে (কুফর) অস্বীকার করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, সে নিশ্চিত এক মজবুত হাতল আঁকড়ে ধরল।

সপ্তম বিষয় : শরীয়তের করণীয়-বর্জনীয় মতে আমল করা

মুমিন হওয়ার জন্য উল্লিখিত অপরিহার্য শর্ত ও বিষয়গুলো করার পর শরীয়তের করণীয়-বর্জনীয় মতে আমল করা। এর নামই হচ্ছে, পরিপূর্ণ ঈমান ও প্রকৃত ইসলাম।

সুতরাং মুমিন হতে হলে প্রথম ছয়টি বিষয় আবশ্যকীয়, আর সাত নম্বরটি হলো পরিপূর্ণ মুমিন হওয়ার জন্য। আর পরিপূর্ণ মুমিনকে প্রকৃত মুসলিম বলা হয়। কেননা, ইসলাম শব্দের অর্থ হচ্ছে, আত্মসমর্পণ করা এবং অনুগত ও তাবেদার হওয়া। আল্লাহপ্রদত্ত এ ধর্মকে ‘ইসলাম’ নামে অভিহিত করার কারণ হলো, এ ধর্মের অনুসারী ব্যক্তি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার কাছে সমর্পণ করে ও তাঁর যাবতীয় আদেশ শিরোধার্য করে। তাই এর অনুসারীকে মুসলিম তথা আত্মসমর্পণকারী বলে। কাজেই ঈমানের স্থান অন্তর, আর ইসলামের স্থান অন্তরসহ সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।

তথ্য সূত্রঃ

কিতাবঃ ঈমান – আকিদা ১

লেখকঃ মাওলানা সাঈদ আহমদ উস্তাদঃ দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *