ইসলাম

প্রত্যেক কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ

প্রত্যেক কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ

الحمد لله رب العالمين والعاقبة المتقين والصلاة و السلام على رسوله الكريم وعلى آله وأصحابه أجمعين أما بعد فاعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرحمن الرحيم .فقد قال النبي صلى الله عليه وسلم : كل أمر ذي بال لا يبدأ فيه ببسم الله الرحمن الرحيم فهو أقطع

সম্মানিত সুধী ও প্রিয় ভাইয়েরা আমার

বিগত জুমু’আয়- বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম- সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলাম । হাদীছ শরীফে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যে-কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আল্লাহর নামে শুরু করা হয় না তা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায় । ৮. কানযুল-উম্মাল, হাদীছ নং ২৪৯১

এই উক্তির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে শিক্ষা দিলেন, আমরা যেন প্রতিটি কাজ আল্লাহর নামে শুরু করি “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” এরূপ একটি বাক্য, প্রতিটি কাজ শুরু করার পূর্বে যা পাঠ করতে আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সময়, ওয়াশরুমে প্রবেশকালে, `ওয়াশরুম থেকে বের হওয়াকালে, খাবার খাওয়া শুরু করতে, বাজারে প্রবেশের পূর্বে, মসজিদে প্রবেশের পূর্বে, মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে, কাপড় পরতে শুরু করার পূর্বে, গাড়ী চালানো শুরু করার সময়ে, বাহনে আরোহণের পূর্বকালে, বাহন হতে নামার প্রক্কালে, ঘরে প্রবেশের সময়ে ইত্যাদি সকল কাজের শুরুতে আমাদেরকে বাক্যটি পাঠ করতে বলা হয়েছে।

সকল কাজের পিছনে আল্লাহ তা’আলার রুবূবিয়্যাত বা প্রতিপালন ব্যবস্থা

বিগত জুমু’আয় যেমনটা বলেছিলাম যে, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ পাঠ করার নির্দেশ দিয়ে আমাদের দ্বারা কোন মন্ত্র পাঠ করানো হচ্ছে না। না, এটি কোন মন্ত্র নয়। বরং এর পিছনে রয়েছে এক মহান দর্শন । এই বাক্য পাঠ করানোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এক মহাসত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে । আর সেই মহাসত্যটি হল এই যে, মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যে কাজই করছে তা সম্পন্ন করা আল্লাহর তাওফীক ব্যতীত মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় । বাহ্য দৃষ্টিতে যদিও মনে হয় যে, যে কাজটি আমি করছি তা আমার চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু মানুষ যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করে তাহলে সে উপলব্ধি করতে পারবে যে, তার কাজকর্মে তার চেষ্টা ও পরিশ্রমের দখল নেহায়েতই গৌণ। বরং তার কাজকর্মের পিছনে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর মহা প্রতিপালন-ব্যবস্থাই তার দৃষ্টিতে ধরা পড়বে ।

এক গ্লাস পানিতেও তাঁর মহা প্রতিপালন-ব্যবস্থা কার্যকর

উদাহরণ স্বরূপ দেখুন, আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যখন পানি পান করবে তখন পানি পান করার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ পাঠ করে নাও । বাহ্য দৃষ্টিতে তো মনে হয় যে, পানি পান করা একটি মামুলি বিষয়, খুবই সাধারণ বিষয় । ঘরে পানি সরবরাহের জন্য আমরা পাইপ লাইন স্থাপন করেছি । পানিকে ঠাণ্ডা করার জন্য কূলার ও ফ্রিজও ঘরে মজুদ আছে । ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি বের করলাম, গ্লাসে পানি ভরে তা পান করে নিলাম । বাহ্যত মনে হচ্ছে যে, এই ঠাণ্ডা পানি পান করার ব্যাপারটি আমার চেষ্টা ও পরিশ্রমের ফল, আমার অর্থব্যয়ের ফসল। কিন্তু খুব কম মানুষই আছে, যাদের মস্তিষ্কে এই চিন্তা উদিত হয় যে, যে-এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি আমি এক মুহুর্তে গলার মধ্য দিয়ে পেটে চালান করে দিলাম সেই পানিকে আমাদের গলা পর্যন্ত পৌঁছাতে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর প্রতিপালন-ব্যবস্থার কী বিরাট ও মহাকারখানা কিভাবে কাজ করছে ।

জীবন নির্ভরশীল পানির উপর

দেখুন, পানির উপর মানুষের জীবন নির্ভরশীল। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

وجعلنا من الماء كل شيء حي

‘এবং প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টি করলাম পানি হতে । ৯.সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩০

অতএব শুধু মানুষ নয়, বরং প্রতিটি প্রাণীর সূচনা-উপাদানও হল পানি এবং প্রতিটি প্রাণীর প্রাণের অস্তিত্বও নির্ভরশীল পানির উপর । এই কারণে আল্লাহ তা’আলা এই জগতে পানি সৃষ্টি করেছেন এত পর্যাপ্ত পরিমাণে ে

পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশকে করেছেন স্থলভাগ, আর দুই তৃতীয়াংশকে সাগর মহাসাগরের আকারে করেছেন পানি। আর ঐ দুই তৃতীয়াংশ জলভাগে অসংখ্য প্রাণীকে আবাদ করেছেন। সেখানে অসংখ্য প্রাণী প্রতিদিন জন

নিচ্ছে আর মরছে। সমুদ্রের ঐ পানি যদি লবণাক্ত না হয়ে মিঠা পানি হত তাহলে যে অসংখ্য প্রাণী সেখানে মরছে এবং পচে গলে যাচ্ছে তাতে সমুদ্রের পানি বিনষ্ট হয়ে যেত । আল্লাহ তা’আলা তাঁর অসীম প্রজ্ঞায় ঐ পানিকে বিনষ্ট

হওয়া থেকে রক্ষা করতে তাকে লবণাক্ত বানিয়ে দিয়েছেন ।

পানির অস্তিত্ব যদি সমুদ্রেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে কী হত?

আল্লাহ যদি বলে দিতেন, আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রের আকারে পানি সৃষ্টি করে দিয়েছি এবং সমুদ্রের পানিকে বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে তাকে লবণাক্ত বানিয়ে দিয়েছি। এখন তোমরা জান কিভাবে পানি সংগ্রহ করবে । পানির প্রয়োজন হলে এখন তোমরা সমুদ্রে যাও, সেখান থেকে পাত্র ভরে পানি নিয়ে আস এবং লবণাক্ততা দূর করে তাকে মিঠা পানিতে পরিণত কর ও এবং পান কর । যদি এই ব্যবস্থাই আল্লাহ তা’আলা আমাদের উপর চাপিয়ে ও দিতেন, তাহলে বলুন, মানুষের কি সাধ্য ছিল সমুদ্র থেকে পানি নিয়ে এসে তা পান করার ও ব্যবহার করার? আচ্ছা পানি না হয় নিয়ে আসল, কিন্তু তার লবণাক্ততা দূর করত কিভাবে? তাকে মিঠা পানিতে রূপান্তরিত করত কিভাবে?

পানিকে মিঠাকরণ ও তা সরবরাহের কুদরতী ব্যবস্থা

সৌদি আরবে পানি মিঠা করণের জন্য শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে এক মহা প্ল্যান্ট (Bigplant) স্থাপন করা হয়েছে। শত শত কোটি টাকা এর পিছনে ব্যয় হওয়ার কারণে জায়গায় জায়গায় এই সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এই পানি মিঠা করতে এবং ব্যবহার-উপযোগী করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয়েছে, কাজেই অত্যন্ত সতর্কতা ও সচেতনতার সাথে এই পানি ব্যবহার করুন। যতটুকু না হলেই নয়, ততটুকু ব্যবহার করতে এবং পানির অপচয় রোধ করতে এই জাতীয় বিজ্ঞপ্তি জায়গায় জায়গায় টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর অনুগ্রহে মানুষের খাতিরে সমুদ্রের পানিকে মিঠাকরণের জন্য এই ব্যবস্থা করে রেখেছেন যে, সমুদ্র হতে বাষ্পের আকারে পানি উপরে উঠে যায়। যখন তা বাষ্পের আকারে উপরে ওঠে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমুদ্রের লবণাক্ত ও ক্ষারযুক্ত পানি মিঠা পানিতে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা ঐ বাষ্পকে মেঘের আকার দান করে বিনামূল্যে কার্গো সার্ভিসের ব্যবস্থা করেছেন ।

মেঘ বিনামূল্যে এক কার্গো সার্ভিস প্রদান করে

কিছুদিন পূর্বে নরওয়ে গিয়েছিলাম। সেখানকার লোকেরা বলল, যেহেতু এখানকার পানি খুব ভালো ও স্বাস্থ্যকর সেহেতু অনেক দেশ এখান থেকে পানি আমদানি করে নিয়ে যায়। এই পানি বড় বড় কন্টেইনারে করে জাহাজের মাধ্যমে অন্যান্য দেশে এখান থেকে রফতানি করা হয়। ফলে আমদানিকারক দেশগুলোর এক লিটার পানির পিছনে এক ডলার অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য, মুসলমান কাফের নির্বিশেষে

সকলের জন্য মেঘের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা এই ফ্রী কার্গো সার্ভিসের ব্যবস্থা করেছেন । ফলে সমুদ্র থেকে উত্থিত পানি মিঠা পানিতে রূপান্তরিত হয়ে যে মেঘের আকার ধারণ করে, সেই মেঘ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত মানুষের জন্য মিঠা পানি সরবরাহ করে। আর আল্লাহ তা’আলা এরূপ ব্যবস্থা স্থাপন করেছেন যে, পৃথিবীর কোন প্রান্ত এই কার্গো সার্ভিসের সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থাকে না । মেঘ আসে, গর্জন করে, বিদ্যুৎ চমকায়, অতঃপর পানি বর্ষণ করে চলে যায় ।

পানি সংরক্ষণ করাও মানুষের সাধ্যের বাইরে

মেঘের মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা তো ঘরে ঘরে পানি পৌঁছে দিলেন। কিন্তু এরপর যদি বলা হত যে, আমি তো তোমাদের ঘর পর্যন্ত পানি পৌঁছে দিয়েছি । এখন তোমরা নিজেরা এই পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা কর এবং সারা বছরের জন্য পানি জমা করে রাখ। বলুন, হাউজ বা টাংকি বানিয়ে এই পানি সারা বছরের জন্য হাউজ বা টাংকিতে সংরক্ষণ করে রাখা কি মানুষের জন্য সম্ভবপর ছিল? মানুষের কাছে কি এরূপ কোন সংরক্ষণ ব্যবস্থা আছে যদ্দারা তারা সারা বছর ব্যবহারের জন্য পানি সংরক্ষণ করে রাখতে পারে? আল্লাহ তা’আলা জানতেন যে, এই কমজোর ও অসহায় মানুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এজন্য আল্লাহ তা’আলা বলে দিলেন মেঘ-বৃষ্টির এই পানিকে তোমরা যতটুকু পার সংরক্ষণ করে নাও, যতটুকু পার ব্যবহার কর। অবশিষ্ট সারা বছরের জন্য সংরক্ষণের দায়িত্বও আমিই নিয়ে নিচ্ছি ।

বরফের পাহাড়গুলো মূলত কোল্ড স্টোরেজ

আর তাই মেঘের পানিকে আল্লাহ তা’আলা বৃষ্টিরূপে বর্ষণ করিয়ে তাকে বরফের পাহাড়ে পরিণত করলেন। পাহাড়গুলোকে পানির কোল্ড ষ্টোরেজ বানিয়ে দিলেন। এবং বরফের আকারে পানির বিশাল ভাণ্ডার সংরক্ষণ করলেন । এবং এত উঁচুতে ঐ পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলেন যে, পানি বিনষ্টকারী কোন কিছু যেন সেই পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে। আর তাপমাত্রাও রাখলেন এতটুকু পরিমাণে, যাতে পানি সেখান থেকে গলে না যায় । বরফের এই উঁচু পাহাড়গুলো একদিকে মানুষের জন্য আকর্ষণীয় দৃশ্য সৃষ্টি করছে, অপরদিকে তা মানুষের সারা জীবনের পানির ভাণ্ডার সংরক্ষণ করছে।

নদীর মাধ্যমে পানি সরবরাহ

এরপর যদি মানুষকে বলা হত যে, আমি তোমাদের জন্য বরফের পাহাড় আকারে পানির ভাণ্ডার সংরক্ষণ করে দিয়েছি, এখন যার প্রয়োজন সে পাহাড় থেকে পানি নিয়ে আসুক এবং প্রয়োজন মোতাবেক ব্যবহার করুক, তাহলে বলুন, মানুষের জন্য কি সম্ভব ছিল ঐ বরফের পাহাড় থেকে বরফ গলিয়ে পানি নিয়ে আসা? এটাও মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এজন্য আল্লাহ তা’আলা বললেন, যাও, এই দায়িত্বও আমিই নিয়ে নিচ্ছি। তাই আল্লাহ তা’আলা সূর্যকে নির্দেশ দিলেন, তুমি তোমার তাপ দিয়ে ঐ বরফ গলিয়ে দাও। অতঃপর ঐ বরফ-গলা পানি প্রবাহের জন্য নদীর আকারে রাস্তাও আল্লাহ তা’আলা বানিয়ে দিলেন। ফলে ঐ বরফ পানিতে রূপান্তরিত হয়ে পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসে এবং নদীর মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে সারা দুনিয়ায় সরবরাহ হয়ে থাকে। এছাড়া আল্লাহ তা’আলা মাটির অভ্যন্তরে মাটির ফাঁকে ফাঁকে এমনভাবে পানির প্রবাহ বিস্তৃত করে দিয়েছেন, যেমন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানির প্রবাহ বিস্তৃত করে দেওয়া হয়। এখন পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা সেখানে মাটি খনন কর এবং পানি বের করে আন।

পানি পেতে মানুষের কাজ কতটুকু

অতএব এখন মানুষের কাজ শুধু এতটুকু যে, যে পানি আল্লাহ তা’আলা সমুদ্র থেকে উঠিয়ে মেঘ নামক কার্গো সার্ভিসের মাধ্যমে পাহাড়ের উপর বর্ষণ করিয়েছেন, অতঃপর পাহাড় থেকে গলিয়ে পৃথিবীর মাটির ভাঁজে ভাঁজে প্রতিটি কোনায় কোনায় পৌঁছে দিয়েছেন, তা সামান্য একটু পরিশ্রমের মাধ্যমে ঘরে নিয়ে আসা। কাজেই যে পানি তুমি গলা দিয়ে পেটের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছ, যদি চিন্তা করে দেখ তা হলে দেখবে যে, এই সামান্য পানির পিছনে সৃষ্টিজগতের বহু শক্তি ব্যয় হয়েছে। তারপরই এই পানি তোমার মুখ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছে । কাজেই নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে, পানি পান করার সময় আল্লাহ তা’আলার নাম উচ্চারণ করে পানি পান কর এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ কর। এই নির্দেশের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে এই মহাসত্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে যে, তোমাদের মুখ পর্যন্ত পানি পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টি তোমাদের বাহুবলের কারিশমা নয়; বরং তা আল্লাহ তা’আলার কুদরতী ব্যবস্থা । তাঁরই তৈরীকৃত ব্যবস্থার বদৌলতে তোমরা ঐ পানি দ্বারা উপকৃত হচ্ছ, ঐ পানি পান করতে পারছ ।

শরীরের প্রতিটি সেল ও কোষের জন্য পানির প্রয়োজন

অতঃপর চিন্তা করুন, আমরা গ্লাসে পানি ঢেলে নিলাম, এরপর তা পান করে পেটের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিলাম । এরপর এই পানি কোথায় যাচ্ছে, শরীরের কোন্ কোন্ অংশকে উপকৃত করছে তা আমরা জানি না। বেচারা মানুষ এ সম্পর্কে কোন খবরই রাখে না, কিছুই তার জানা নেই। সে শুধু এতটুকু জানে যে, তার পিপাসা লেগেছিল, পানি পান করে সেই পিপাসাটুকু সে নিবারণ করেছে। সে জানে না, কেন তার ঐ পিপাসা লেগেছিল, আর পানি পান করার পর ঐ পানির পরিণাম কী হল, কিভাবে পানি দ্বারা তার পিপাসা নিবারণ হল । সে কিছুই জানে না। আরে, তোমার পিপাসা লাগার কারণ ছিল এই যে, তোমার শরীরের প্রতিটি অংশের প্রতিটি কোষের প্রয়োজন ছিল পানির। শুধু মুখ ও গলার প্রয়োজন ছিল না, বরং তোমার শরীরের প্রতিটি অংশের প্রয়োজন ছিল পানির। শরীরে যদি পানি না থাকে, শরীর যদি পানিশূন্য হয়ে পড়ে তাহলে মানুষের মৃত্যু ঘটে যায়। কারও যদি সামান্য পাতলা পায়খানা হয়, তাহলে তার শরীরে পানির পরিমাণ কমে যায়, ফলে তার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চলাফেরাও তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে ।




সম্পদ দাবী করবে ততটুকু সম্পদই আমি তাকে দিয়ে দেব। এমনকি এর বিনিময়ে সে যদি আমার পুরো রাজত্ব দাবী করে তবে আমি আমার পুরো রাজত্বই তাকে দিয়ে দেব। হযরত বাহলূল বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন,

আসলে আমি এই প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে এই সত্যটি উপস্থাপন করতে চাচ্ছিলাম যে, আপনার রাজত্বের মূল্য এক গ্লাস পানি পান ও তা পেশাব আকারে বাইরে নিয়ে আসার সমানও নয়। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা এই সবকিছু আপনাকে বিনামূল্যে দান করেছেন । বিনামূল্যে পানি পাচ্ছেন, পান করছেন অতঃপর তা বিনামূল্যে বের হয়ে আসছে। বর্জ্য পানি বের করার জন্য কোন ব্যয় করতে হচ্ছে না, কোন চিন্তা করতে হচ্ছে না ।

বিসমিল্লাহ বলার মাধ্যমে দাসত্বের স্বীকারোক্তি

সারকথা হল, আল্লাহ তা’আলা পানি সংশ্লিষ্ট এই ব্যবস্থাপনা প্রতিটি মানুষকে দান করেছেন বিনামূল্যে । মানুষকে এর জন্য না কোন পয়সা খরচ করতে হয়, না পরিশ্রম। অতএব পানি পান করার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহির

রাহমানির রাহীম’ বলার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তার দ্বারা মূলত এই সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে যে, এই সবকিছু আল্লাহ তা’আলার নেযামে রুবূবিয়্যাত তথা তাঁর প্রতিপালন-ব্যবস্থার কারিশমা । আর এর দ্বারা এই স্বীকারোক্তিও করা হচ্ছে যে, হে আল্লাহ, এই পানি পান করতে আমি সক্ষম ছিলাম না । যদি আপনার তৈরী করা রুবূবিয়্যাত ও প্রতিপালনের এই কারখানা না থাকত তাহলে কিভাবে আমাদের নিকট এই পানি পৌঁছত। শুধু আপনার অনুগ্রহে, আপনার ফযল ও করমে আমাদের পর্যন্ত পানি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। এটা যেহেতু শুধুই আপনার অনুগ্রহ তাই হে আল্লাহ্, আমরা আপনারই নিকট এই দরখাস্ত ও প্রার্থনা করছি যে, যে পানি

আমরা পান করছি তা যেন ভিতরে প্রবেশের পরে আমাদের জন্য কল্যাণকর হয় এবং কোন ক্ষতির কারণ না হয়। কারণ এই পানিতে যদি রোগ-জীবাণু থাকে, এই পানি যদি খারাপ পানি হয় তাহলে তা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তদ্রূপ দেহের অভ্যন্তরে পানি পরিশোধনের যে প্রক্রিয়া রয়েছে। তাতে যদি বিশৃংখলা দেখা দেয়, উদাহরণত কিডনী যদি অকার্যকর হয়। তাহলে এই পানি ভিতরে তো যাবে ঠিকই কিন্তু পানি পরিশোধন ও বর্জ্য পানি বাইরে বের করণের যে ব্যবস্থাপনা তা অকার্যকর হয়ে যাবে। আমরা পানি পান করতে এই দুআ করছি যে, এই পানির পরিণামও যেন শুভ তাই ও কল্যাণকর হয়।

মহামূল্যবান কিডনী

করাচিতে একজন কিডনী স্পেশালিষ্ট আছেন । আমার বড় ভাই একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি তো একজনের কিডনী অপরজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু বিজ্ঞান তো অনেক উন্নতি লাভ করেছে, সে ক্ষেত্রে কৃত্রিম কিডনী তৈরী করা হচ্ছে না কেন যাতে অপরের নিকট থেকে কিডনী গ্রহণের প্রয়োজনই না থাকে? উত্তরে তিনি একটু হেসে বললেন, প্রথমত বিজ্ঞান যতই উৎকর্ষ লাভ করুক কৃত্রিম কিডনী বানানো সম্ভব নয় । কারণ আল্লাহ তা’আলা কিডনীতে এরূপ ছাঁকনী সৃষ্টি করেছেন যা খুবই সূক্ষ্ম । এইরূপ সূক্ষ্ম ছাঁকনী তৈরী করার মত যন্ত্র এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি । এরূপ যন্ত্র যদি কখনও আবিষ্কৃত হয়ও তাহলে একটি কৃত্রিম কিডনী বানাতে কোটি টাকা খরচ হয়ে যাবে। তারপর কোটি টাকা খরচ করে যদি তা বানানো সম্ভবও হয় তবুও তা কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। কারণ কিডনীর অভ্যন্তরে এরূপ একটি জিনিস আছে, যা তৈরী করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। আল্লাহ তা’আলা কিডনীর অভ্যন্তরে এরূপ এক মস্তিষ্ক সৃষ্টি করেছেন, যা কিডনীর কার্যক্রমকে পরিচালিত করে । ঐ মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই ব্যক্তির শরীরে কতটুকু পানি রাখা প্রয়োজন, কতটুকু বাইরে বের করে দেওয়া প্রয়োজন । প্রত্যেক ব্যক্তির কিডনী ঐ ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত অবস্থা, তার দেহের স্থুলতা ও ক্ষীণতা এবং ওজনগত অবস্থা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয় যে, কতটুকু পানি তার শরীরের ভিতরে রাখতে হবে, কতটুকু বাইরে বের করে দিতে হবে । কিডনীর এই সিদ্ধান্ত শতভাগ সঠিক হয় । ফলে ব্যক্তির শরীরে সে ততটুকু পানিই রেখে দেয়, যতটুকু রাখা প্রয়োজন । আর প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি পেশাব আকারে বাইরে বের করে দেয়। অতএব আমরা শত-শত কোটি টাকা খরচ করে রাবারের কৃত্রিম কিডনী তৈরী করে নিলেও আমরা কিডনীর ঐ মস্তিষ্ক (Brain) তৈরী করতে পারব না, যা আল্লাহ তা’আলা প্রতিটি মানুষের কিডনীর মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছেন । কুরআন কারীম বার বার এই দিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বলা হয়েছে-

وفي انفسكم أفلا تبصرون

অর্থাৎ তোমরা নিজেদের দেহ নিয়ে চিন্তা কর যে, তোমাদের দেহের অভ্যন্তরে আমার অপার কুদরতের ও পরম প্রজ্ঞার কী রকম কারখানা কার্যরত রয়েছে। ১০. সূরা যারিয়াত, আয়াত ২১

মাঝে মাঝেই এই নিয়ে চিন্তা কর । এই যে কিডনীর কথা বলছিলাম, এই কিডনী কতদিন কাজ করবে, কখন সে তার কাজ বন্ধ করে দেবে তা-ও আল্লাহ তা’আলার কুদরতের অধীন। অতএব বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম আমাদেরকে এই বার্তা দেয় যে, তোমরা একদিকে যেমন এটা স্মরণ করবে। যে, এই পানি তোমাদের নিকট কিভাবে পৌছুল, অপরদিকে এটাও প্রার্থনা করবে যে, এই পানি যেন তোমাদের দেহে প্রবেশের পর কোন ক্ষতিসাধন না করে বরং তা যেন স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর ও বরকতময় হয় । বিসমিল্লাহ পাঠ করা একদিকে যেমন আল্লাহ তা’আলার অপার কুদরত ও পরম প্রজ্ঞার স্বীকারোক্তি, অপরদিকে তেমনই তা এই দুআ ও দরখাস্ত যে, হে আল্লাহ, এই পানি পান তো করছি কিন্তু হে আল্লাহ, এই পানি ভিতরে যেয়ে যেন কোন ক্ষতির কারণ না হয়, বরং তা যেন সুস্বাস্থ্য, কল্যাণ ও সফলতার কারণ হয়। পানি পান করার পূর্বে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করার এটাই হচ্ছে দর্শনগত দিক । সুতরাং পানি পান করাকালে এই দর্শনকে সামনে রাখ অতঃপর লক্ষ কর যে, পানি পান করার মধ্যে কী তৃপ্তি ও আনন্দ অনুভূত হয়, কী রকম বরকত লাভ হয় । আর এভাবে পানি পান করাকে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের জন্য ইবাদতে পরিণত করে দেবেন এবং পানি পান করার জন্যও আজর ও সওয়াব দান করবেন ।

মহব্বত আল্লাহভীতি অর্জনের মাধ্যম

আর পানি পানকালে যখন এই দর্শনকে সামনে রাখবে তখন কি এর ফলে আল্লাহ তা’আলার মহব্বত অন্তরে সৃষ্টি হবে না? যখন তুমি ঐরূপ চিন্তা নিয়ে পানি পান করবে তখন তা আল্লাহ তা’আলার প্রতি তোমার ভালোবাসা ও মুহাব্বাতকে বৃদ্ধি করবে, আল্লাহ তা’আলার মহিমা তোমার অন্তরে বৃদ্ধি করবে। আর এর ফলে তোমাদের অন্তরে সৃষ্টি হবে খাশিয়্যাত আল্লাহভীতি, যা তোমাদেরকে গুনাহকর্ম থেকেও বিরত রাখবে । কাফের ও মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য একজন কাফের নাস্তিকও পানি পান করে। কিন্তু সে শুধুই পানি পান করে। সে না নিজের খালিককে স্মরণ করে, না মালিককে। আর একজন মুমিনও পানি পান করে। কিন্তু সে পূর্বোক্ত চিন্তা ও ধ্যান সহকারে পান করে। পানি নামক নেয়ামত আল্লাহ তা’আলা কাফের ও মুমিন উভয়কেই দান  করেছেন । কিন্তু যে ব্যক্তি অকৃতজ্ঞ তার পানি পানের ধরন ও যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞ তার পানি পানের ধরন এক রকম হতে পারে না। উভয়ের পানি পানের ধরনে কিছু পার্থক্য তো থাকা উচিত। সেই পার্থক্যটা হল, মুমিনের উচিত পানি পানকালে আল্লাহ তা’আলার শুকরিয়া আদায় করা, আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক প্রদত্ত নেয়ামতের অনুভূতি অন্তরে জাগরুক করা, তাঁর নেয়ামত লাভের স্বীকারোক্তি করা এবং বরকতের জন্য দুআ করা । আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে এইসব দিকগুলো বোঝার এবং তদনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন- আমীন ।

واخر دعوانا ان الحمد لله رب العالمين

সূত্র : ইসলাহী খুতুবাত, ১৩খণ্ড, ৮৫-১০০পৃ.

বায়তুল-মুকারম জামে— মসজিদ, জুমু’আর নামাযের পূর্বে

এই ব্লগটি পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

খুশি
0
আরও উন্নত হতে পারে
0

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *